জ্বলদর্চি

ভারতীয় সংগীতের ক্রমবিকাশ-৮/দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

ভারতীয় সংগীতের ক্রমবিকাশ
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

পর্ব – ৮

বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাঈজীদের বিভিন্ন প্রকার নৃত্যগীতের অনুষ্ঠান হতো। যেমন, গজারা জাতীয় অনুষ্ঠানে দুজন বাঈজী দাঁড়িয়ে দ্বৈত সঙ্গীত পরিবেশন করতেন, ঝুমুর নামক অনুষ্ঠানে চার-পাঁচজন বাঈজী একত্রে নৃত্য ও গীত পরিবেশনা করতেন আবার দঙ্গল অনুষ্ঠানে কবিগানের তরজার মত দুজন বাঈজীর মধ্যে সাঙ্গীতিক বিতর্ক বা বাকযুদ্ধ হত। এইসব অনুষ্ঠানগুলি বিশেষ বিশেষ সময়ে সারা দিনরাত্রি ব্যাপী হত। হোলির সময়ে হত 'বারোয়া মঙ্গল' উৎসব, বর্ষাকালে হত 'কাজরী' উৎসব। এইভাবে প্রতিটি উৎসবের সঙ্গে সঙ্গীত ও নৃত্যের এইরূপ ঘনিষ্ঠতা থেকে প্রতীয়মান যে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও নৃত্য প্রকৃতি থেকে আহরিত। ঋতু পরিবর্তন, দিনের বিভিন্ন সময় এবং মানুষের জীবনের আনন্দ ও যন্ত্রণা থেকে অনুপ্রাণিত। এইসব অনুষ্ঠানে সংগীত ও নৃত্যের এই মেলবন্ধন যেন শরীরী আকর্ষণের এক নতুন সজ্ঞা তৈরী করল। ধনী ব্যক্তি ও বাবু শ্রেণীর পাশাপাশি পাশ্চাত্যবাসীদের এইসব অনুষ্ঠান গুলির প্রতি আকর্ষণের কারণ হিসেবে বিলাসিতা, রোমান্স এবং যৌনতার আমেজ নিয়ে ব্রিটিশ ভারতের এক অবসরপ্রাপ্ত সেনাধ্যক্ষ জি, ম্যাকমান, যিনি এই ধরনের একটি অনুষ্ঠানে বাঈজীদের কোঠায় উপস্থিত থেকে চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করে তার 'দি আন্ডারওয়ার্লড অফ ইন্ডিয়া' গ্রন্থে লিখেছেন "বিরাট বড় একটি আধো অন্ধকার কক্ষ থেকে তবলার মৃদু চাপড় ভেসে আসত,কোঠার অভ্যন্তরের কোন কক্ষে ভেলভেটের গদির থেকেও নরম গদির উপরে উপবিষ্ট অতিথিদের সামনে উজ্জ্বল লাল ও সবুজ রঙের জুতো পরা নর্তকীদের নৃত্যরত পা গুলি মেঝেতে আলোড়ন তুলত, তাদের পেটের কাছের উন্মুক্ত অংশে নরম জলপাইয়ের মত ত্বকের নীচে প্রায় প্রতিটি পেশীর সঞ্চালনা প্রত্যক্ষ করা যেত, পরনের সূক্ষ্ম মসলিনের ভিতরে শরীরী অঙ্গ বিভঙ্গ, পায়ের গোড়ালি এবং শরীরের উপরিভাগ কখনো আলতোভাবে আবার কখনো এলোমেলোভাবে নরম গদির উপরে বাবুদের গড়গড়ার দিকে এগিয়ে যাওয়া এক দুর্লভ অভিজ্ঞতা"।                           

  লক্ষ্ণৌ ও আউধের নবাবদের রাজত্ব যখন অস্তমিত হয়ে আসছিল সেই সময়ে বারাণসীতে এই নৃত্যগীতের শিল্প ব্যাপকভাবে প্রসারিত হয়েছিল বিভিন্ন ধনী, অভিজাত ব্যাক্তি ও 'রইস আদমী'দের পৃষ্ঠপোষকতায়। এরা যে শুধু শিল্পের প্রতি উদারতা দেখানোর কারণে বিখ্যাত ছিল তা নয়, তাদের অগাধ ধন-সম্পত্তি জনসমক্ষে প্রকাশ করার উদ্ভট সব চিন্তা ভাবনা ছিল। শোনা যায় তারা নাকি তাদের বাড়ির বারান্দায় থলি ভর্তি আশরফি বা সোনার মোহর ছড়িয়ে রাখত যেন গ্রীষ্মকালে বারান্দাতে পাঁপড় শুকনো হতে দেওয়া হয়েছে। এইরকম ভাবে তারা তাদের ধন সম্পত্তির নির্লজ্জ প্রকাশ করতো।     

  অযোধ্যার নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ কলকাতাতে আসার পরে ঠুমরি গানের ক্ষেত্রে বাংলার প্রভাব পড়তে শুরু করে। সেইসময় কলকাতাতে রামনিধি গুপ্তর ঠুমরি ও 'টপ্পা' গান খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। রামনিধি গুপ্তর লেখা 'নিধুবাবুর টপ্পা' সেই সময়ে খুব প্রচলিত ছিল।                            

  খুব সম্ভবত অষ্টাদশ শতকের শেষভাগে ঠুমরি একটি স্বতন্ত্র সংগীতরীতি হিসেবে বিখ্যাত হতে শুরু করে। এটি একদিকে যেমন খেয়াল গানের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল অন্যদিকে ঠুমরিও খেয়াল গানকে প্রভাবিত করেছিল। লোকগানে প্রচলিত কাহারবার পরিবর্তে ষোল মাত্রার তিনতাল চালু হলো, যা একটি বৃত্তের মত পাক খেয়ে 'সমে' পড়ত। খেয়াল গানকে দুটি ভাগে ভাগ করে গায়করা গাইতেন। একটি অপেক্ষাকৃত ধীরে লয়ে সৃষ্ট যাকে বড় খেয়াল বলা হতো, অন্যটি তুলনায় সংক্ষিপ্ত ও দ্রুতলয়ের যাকে ছোট খেয়াল বলা হতো। মনে করা হয় এই ছোট খেয়াল, ঠুমরি বিশেষতঃ বন্দিশ ঠুমরি থেকে সৃষ্ট।                             

  নবাব ওয়াজেদ আলী শাহের আমল ছিল ঠুমরি গান ও কত্থক নৃত্য বিকাশের স্বর্ণযুগ। নবাব নিজে নাচ শিখেছিলেন বিনদাদিন মহারাজের বাবা ও কাকার কাছ থেকে যাঁরা তাঁর দরবারের স্থায়ী নৃত্যশিল্পী ছিলেন। নবাব নিজে অনেক নৃত্য নাট্য প্রযোজনা করেছিলেন এবং ঠুমরি গান রচনা করতেন। তাঁর একটি বিখ্যাত রচনা এখানে উল্লেখ করছি। যেমন, 'বাবুল মোরা নইহার ছুটো হি জায়ে, চার কহর মিল দুলিয়াঁ মাঙ্গাও, আপনা বিগানা ছুটো জায়ে'। অর্থাৎ হায় বাবা, আমি আমার বাড়ির সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে দিলাম, চার বেহারা আমার পালকি করে আমার প্রিয়তমের বাড়ি নিয়ে যাচ্ছে। নবাব সেইসময়ের ঠুমরি গানের রাজা সাদিক আলি খানের মতো বহু সংগীত ব্যক্তিত্বের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। বন্দিশ ঠুমরির মার্জনার কৃতিত্ব এই সাদিক আলি খানের, যাঁর শিষ্যদের মধ্যে অনেক বিখ্যাত গায়ক ও ঠুমরি গানের স্রষ্টা ছিলেন। সাদিক আলি খানের সুযোগ্য শিক্ষায় তাঁর যে সমস্ত শিষ্যরা সংগীত জগতকে আলোকিত করেছিলেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন বিনদাদিন মহারাজ, কাদর পিয়া (আসল নাম ভাজির মির্জাবালা কাদর), ভাইরা গণপত রাও। বিখ্যাত কণ্ঠসঙ্গীত শিল্পী যেমন লখনৌয়ের খুরশিদ আলি খান, মহারাষ্ট্রের খেয়াল গায়ক রামকৃষ্ণ বুয়া ওয়েজ, সাহে শাওয়ান ঘরানার ইনায়েত হুসেন খান, লখনৌয়ের বিখ্যাত বাঈজি হায়দার জান এবং নাজমা। এ ছাড়াও বহু পুরুষ সঙ্গীতজ্ঞ যাঁরা ঠুমরি গানের ক্ষেত্রে বিখ্যাত গায়ক ও সৃষ্টি কর্তা যেমন লালন পিয়া, মথুরার 'সরস পিয়া' কালে খান, রামপুরের 'নজর পিয়া' নজর আলি, বেরিলি ও রামপুরের সনদ পিয়া,  মাধো পিয়া, চাঁদ পিয়া এবং অন্যান্যেরা।          
                                                                                                 ক্রমশঃ

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments