জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা-১১/প্রীতম সেনগুপ্ত

পর্ব ১১

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

প্রীতম সেনগুপ্ত


স্বামী ব্রহ্মানন্দজী ১৪ মে, ১৮৯৮, বেলুড় মঠ থেকে একটি পত্র লিখছেন যা এই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে খুবই প্রাসঙ্গিক ও তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি পত্রে লিখছেন--“... আজকাল কলকাতায় প্লেগের বড় panic(আতঙ্ক) হইয়াছে। অনেক লোক শহর পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গিয়াছে এবং যাইতেছে। প্রধান প্রধান ডাক্তারেরা বলিতেছেন যে প্লেগ নয়। এখনো ঠিক জানা যাইতেছে না। স্বামীজী আমাদের প্রতি আদেশ করিয়াছেন যে যদ্যপি কলকাতায় যথার্থই প্লেগ হয়, তাহা হইলে Hospital(হাসপাতাল) এবং segregation jouse (আলাদা বাড়ি) করিয়া ভদ্র ও দরিদ্রগণকে সেবাশুশ্রূষা করিতে হইবে। কলকাতায় স্থান দেখা যাইতেছে।” বর্তমান সময়ের সঙ্গে খুবই সাযুজ্যপূর্ণ এক পরিস্থিতি বর্ণিত হয়েছে পত্রটিতে। আবার ১৮ জুন, ১৮৯৮, বেলুড় মঠ থেকে অপর একটি পত্রে এই প্লেগের প্রসঙ্গেই লিখছেন--“...কলকাতায় প্লেগের আন্দোলন খুব চলিতেছে। শুনিতেছি, ২/৪ জনের মৃত্যু নিত্য হইতেছে। কেহ বলে, একটু সন্দেহ হইলেই হাসপাতালে যাইতেছে। যাহা হউক, শ্রীশ্রীজগদম্বার কৃপায় না হইলেই মঙ্গল; নচেৎ বাঙলাদেশ ছারখারে যাইবে। চাকর ইত্যাদির জন্য লোকের এত কষ্ট হইয়াছে যে, বলা যায় না।”

       স্বামী বিবেকানন্দ পরিকল্পিত রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের ইংরেজি মুখপত্র ‘ প্রবুদ্ধ ভারত’-এর জন্মলগ্নের কিছু উল্লেখ তাৎপর্যপূর্ণভাবে পাওয়া যাচ্ছে স্বামী ব্রহ্মানন্দজী লিখিত ৬ জুলাই, ১৮৯৮-এর পত্রে। বেলুড় মঠ থেকে লেখা। তিনি লিখছেন--“...আলমোড়া হইতে ‘প্রবুদ্ধ ভারত’ বাহির হইবে। ১ আগস্ট হইতে নিয়মিতভাবে বাহির হইবে। বার্ষিক মূল্য দেড় টাকা। মধ্যে মধ্যে স্বামীজীর প্রবন্ধ তাহাতে থাকিবে। তুমি তাহার একটি গ্রাহক হইবে এবং পড়িবে। তাহাতে সুন্দর সুন্দর প্রবন্ধ থাকিবে।” স্বামীজীর কার্যধারার প্রতি তাঁর ছিল অপরিসীম শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস। প্রসঙ্গক্রমে বলেছেন--“তোদের সাধন ভজনের সুবিধা হবে বলে স্বামীজী প্রাণপাত করে এত ব্যবস্থা করেছেন! আহা! তোদের সুবিধা করবার জন্য over-exertion (অতিরিক্ত পরিশ্রম) করে তাঁর life(আয়ু) এত কমে গেল। কি ভালবাসা তাঁর ছিল! তোরা নিমকহারাম হসনি। বাংলার উপর তাঁর খুব আশা ভরসা ছিল। Young Bengal(বাংলার যুবক) তোরা। তাঁর mission(কার্যের ভাব) তোদের trust(ন্যস্ত) করে দিয়ে গেছেন-- তোরা বি‌শ্বাসঘাতক হসনি।” (ধর্মপ্রসঙ্গে স্বামী ব্রহ্মানন্দ)

      ১৮৮৬ সালে শ্রীরামকৃষ্ণের দেহত্যাগের পর রাখাল বাস্তবিকই ব্যাকুল হলেন। জীবনদেবতার প্রয়াণ তাঁকে অস্থির করে তুলল। অদ্ভুত শূন্যতা! ১৮৮৮ সালের নভেম্বর মাসে শ্রীশ্রীমা'র সঙ্গে পুরীধামে গেলেন। সেখানে কয়েকমাস থাকার পর পুনরায় বরানগর মঠে প্রত্যাবর্তন। কিন্তু তাঁর মন নির্জন নর্মদাতীরে তপস্যার জন্য ব্যাকুল। ১৮৮৯ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি আবার বেরিয়ে গেলেন। কঠোর তপস্যায় কাটতে থাকল তরুণ সন্ন্যাসী স্বামী ব্রহ্মানন্দের জীবন। নিরন্তর জপ ধ্যান, মাধুকরী, আকাশবৃত্তি অবলম্বনে বইতে থাকল তাঁর তাপস জীবন। বৃন্দাবন, হরিদ্বার কিংবা জ্বালামুখী প্রভৃতি জায়গায় তপস্যায় কয়েক বছর কাটল। এই সময় আবু পাহাড়ে হঠাৎই মহারাজের সঙ্গে স্বামীজীর দেখা হয়ে যায়। এই সাক্ষাতের অব্যবহিত পরেই ১৮৯৩ সালে স্বামীজী সর্বধর্মসমন্বয়ের বার্তা নিয়ে শিকাগো ধর্মমহাসভায় যোগদান করতে চলে যান। মহারাজ পুনরায় তপস্যায় ডুবে গেলেন। ১৮৯০ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ৺বৃন্দাবনধাম থেকে মহারাজের লেখা একটি পত্রে তাঁর পরিব্রাজকরূপের কিছু পরিচয় পাই। তিনি লিখছেন--“...আমাদের কাশীধাম হইতে একটি সঙ্গী জোটে, তাহার সহিত নর্মদা যাই। নর্মদায় স্নানাদি করিয়া তাহার পর ওঙ্কারনাথ দর্শন করিয়া সেখানে কিছুদিন থাকা যায়। ওঙ্কারনাথ স্থানটি অতি উত্তম-- নর্মদার ধারে, অনেক সাধু এবং বাবাজী আছেন, থাকিবার খুব সুবিধা। আমরা একটি মঠে ছিলাম। চতুর্দিকে খুব পাহাড় এবং নির্জন স্থান, অতি চমৎকার দৃশ্যসকল আছে। কিছুদিন বেশি তথায় থাকিবার ইচ্ছা ছিল কিন্তু প্রারব্ধ কোথা হইতে কোথায় লইয়া যায়। তাহার পর সেখান হইতে গোদাবরীর ধারে দণ্ডকারণ্যে পঞ্চবটীর বন দর্শন করি। তথায় ২/৩ দিবস থাকি।...তথা হইতে বোম্বাই যাই। বোম্বাই শহরে আমরা ৭/৮ দিন ছিলাম, কোনরূপ অসুবিধা আমরা বোধ করি নাই।...বোম্বাই হইতে একটি শেঠ আমাদিগকে দ্বারকা যাইবার জন্য জাহাজের টিকিট দেয়। জাহাজে ৪৭ ঘন্টা প্রায় থাকিতে হয়; পরে দ্বারকাধামে পৌঁছাই। দ্বারকাধীশের মন্দির প্রায় সমুদ্রের সন্নিকট এবং মন্দির কম বড় নয়। সেখান হইতে ১৪ মাইল ভেটপুরী নামক স্থানে যাই। সেখানে খুব জাঁকজমক-আচারে মন্দিরের সেবাকার্য করিয়া থাকে। তথায় দর্শন করিয়া পুনরায় দ্বারকা আসিয়া জাহাজে চড়িয়া সুদামাপুরী নামক স্থানে আসি। তথা হইতে জুনাগড় নামক স্থানে যাই। সেখান হইতে গির্ণারের পাহাড় ৭ মাইল, তথায় ২/১ দিন থাকিয়া গির্ণারের পাহাড়ে যাই। গির্ণারের পাহাড় অত্যন্ত উচ্চ, খাড়া চড়াই ১০ মাইল। আমাদের উঠিতে অত্যন্ত কষ্ট হইয়াছিল, ৩/৪ দিবস গায়ের ব্যথা ছিল।”

     ভারতের সাধক ভারত ভূখণ্ড পরিভ্রমণ না করে পূর্ণ সার্থকতা অর্জন করতে পারেন না। এই আধ্যত্মিক ভূমির প্রতি কণার পবিত্র স্পর্শে সাধক পূত হন, এটাই বিশেষত্ব! সাধনার অনুকূল আবহযুক্ত স্থান এই ভারতভূমিতে অপ্রতুল নয়। যুগে যুগে ঈশ্বরপ্রেমী সাধকেরা সেইসব স্থানে গিয়েছেন এবং তপস্যায় মগ্ন হয়েছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ মানসপুত্র স্বামী ব্রহ্মানন্দজীও এর ব্যতিক্রম নন। বস্তুতপক্ষে স্বামী বিবেকানন্দসহ শ্রীরামকৃষ্ণের  সন্ন্যাসী সন্তানদের অনেকেই তাঁর জীবনাবসানের পর এই পথের পথিক হন। তীর্থস্থানগুলির ক্ষেত্রমাহাত্ম্য বিষয়ে ব্রহ্মানন্দজীর নানা অনুভূতির কথা জানা যায়। এই বিষয়ে বৃন্দাবনে তাঁর নিজের তপস্যার স্থান কুসুম সরোবর ও শ্রীমতী রাধারাণীর পৈতৃক আবাস বর্ষাণার কথা বিশেষভাবে বলতেন। অন্যান্য স্থানে দশ বৎসরে সাধনার যা ফল লাভ করা যায়, বৃন্দাবনে তা দুই বৎসরে হয়। বর্ষাণায় যেন বর্ষে দেয়, তাঁকে এমন কথা বলতে শোনা গিয়েছে। তিনি বলতেন বৃন্দাবনে মহানিশায়, কাশীতে ব্রাহ্মমুহূর্তে ও পুরীতে অপরাহ্ণকালে আধ্যাত্মিক ভাবের প্রবাহ বইতে থাকে। এইসব স্থানে এই সময়গুলি জপধ্যানের অনুকূল সময়। একবার তিনি বলেছিলেন,“...ভদ্রকে আছি, ক্ষণ ঠিক ধরতে পারছি না। রাত্রি ২ টার সময় উঠতেই ধ্যান বেশ জমে গেল, বুঝলাম ওখানকার ক্ষণ ২ টা রাত্রি। বেলুড় মঠে ভোর ৪টা, ভুবনেশ্বরেও তাই।” (ব্রহ্মানন্দ লীলাকথা) তিরুপতিতে বেশ অভিনব ঘটনা ঘটে। সেখানে তাঁর সঙ্গে ছিলেন স্বামী শর্বানন্দ, স্বামী শান্তানন্দ প্রমুখ। সেখানে তিনদিন থাকার কথা ছিল কিন্তু ইচ্ছা করেই সাতদিন অবস্থান করেন। সেটা ছিল ১৯১৭ সালের মার্চ মাস। প্রথমদিন দর্শনেই তিনি বলে ওঠেন,“শর্বানন্দ, এ যে দেবীমূর্তি দেখচি।” এরপর অনুসন্ধানপূর্বক জানা গেল, এই বিগ্রহ আদিতে দেবীমূর্তি ছিলেন, ‘বালা’ শব্দটিও স্ত্রীদেবতাবাচক। প্রতি শুক্রবার সকালে এই বিগ্রহের অভিষেক বা মহাস্নান হয়। মোহন্তের ব্যবস্থাপনায় এই স্নানকালে মহারাজ দিগম্বরী মূর্তি দর্শন করেছিলেন। কালো পাথরে নির্মিত সাত আট ফুট উঁচু দণ্ডায়মান মূর্তি। পায়ে ‘বিছা’ পরিহিতা। তৃতীয় নয়নটি ঘষে তোলা সত্ত্বেও দৃশ্যমান। এই নয়ন আবৃত রাখা হয় রামানুজী তিলকে!

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments