জ্বলদর্চি

কবিতা অ্যাভিনিউ-৬/ বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়

কবিতা  অ্যাভিনিউ

বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়

পর্ব -৬  



"বাউলের মতো আমি ভিতরে জ্বালাব বাতি 

এই অলীক ঘুরিয়ে মেরেছে বহুদিন। বহুদিন এই জন্যে নির্বাপিত

থেকেছি আঁধার

ঐ টিমটিমে  নিজস্ব বাতির জন্য এত লোভ !

এই এক অভিমান, মায়া!

তবু ভাগ্য ঈশ্বর আমাকে ফিরিয়েছে ঠিক পথে –

রোদ্দুরে , কাদায় , জলাধারে,

মোষের  মতন পাঁকে , সাপের মতন পদ্মবনে, সন্ন্যাসী- বাঁদর – অভিমানে ।

ভাগ্যিস জ্বলে নি আলো তাই এই বিশালতা ছুঁতে পারি।

নীলের গহন অভ্যন্তরে ফুটে উঠে সুদূর মন্দির।" ( মহিস্ন স্তোত্র )

কবি মণীন্দ্র গুপ্ত প্রকৃত অর্থেই একজন পরিব্রাজক। নীলের গহন অভ্যন্তরে ডুব দিয়ে তুলে আনেন নিজস্ব বাতিঘর যা অন্তরের সমস্ত রুদ্ধতা দূর করে।  বাইরের  আলোর সহায়তা ছাড়াই তিনি রোদ্দুরে জলে ও কাদায় স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়াতে পারেন। স্পর্শ করতে পারেন প্রতিটি জৈব এবং অজৈব উপাদানের মনোজগতের স্তর। তাদের  ভেতর চারিয়ে দিতে পারেন  হৃদয়ের সঞ্জীবনী মন্ত্র। ওই টিমটিমে  নিজস্ব বাতির জন্য তাই এত লোভ তাঁর । পৃথিবীর বিক্ষুদ্ধ তরঙ্গ,সামগ্রিক প্রতিকুল অবস্থানের বিন্দুমাত্র পরোয়া না করে জীবনমিতির এক আশ্চর্য পরিক্রমণে মধ্যবিত্ত বৈভবগুলিকে পাশ কাটিয়ে আঁকড়ে ধরেন জল মাটি আর নৈসর্গিক বস্তুসমূহের পরিচর্চাকে। এভাবেই তাঁর জীবন মন্থন। এভাবেই তাঁর কবিতা যাপন।

"শীতের দিন। আশি বছরের পুরনো ফুসফুস

যেন উমা কর্মকারের তালি দেওয়া হাপর -

নিঃশ্বাস নিই  আর ঘুরুর ঘুরুর শব্দ হয়

দুটো ঘুঘু এসে পোড়ো ভিটেয় বসেছে যেন।

নিকোটিনে ঘাস চোরকাঁটা  পিঙ্গল-

তাদের উপর রোদ্দুর রোদ্দুর আর ভাঙা উনুনের ছায়া। "( ঘুঘু)

 শীত ,তালি দেওয়া হাপর , ভাঙা উনুনের ছায়া , পোড়ো ভিটে এই শব্দগুলি জীবন্ত হয়ে গেছে কবি মণীন্দ্র গুপ্তের যথার্থ প্রয়োগে । আশি বছরের পুরনো ফুসুফুস বোঝানোর জন্য তিনি যেভাবে শব্দের ভেতর স্থাপন করেছেন প্রাণের স্পন্দন তা খুব বেশি লক্ষ্য করা যায় নি।মনে হচ্ছে এই শব্দগুলো যেন নিজেরাই পায়ে হেঁটে হেঁটে এসে তার কবিতার গায়ের উপর বসেছে এবং কবিতাটিকে সজীব করে তুলেছে।

"জনহীন গোল চাতালের পিছে

পাহাড়ের মতো  শূন্য উঁচুতে উঠেছে ,

শূন্য সামনে নেমেছে খাদ হয়ে ।

নেশার বুদবুদ – বিড়বিড় ভাষায় লহরী শোনা যায় –

উদ্ভট শ্লোকের

ভাঙা সুর…



নিকটে গাছের গম্ভীর ভাঙা দালানের ঘরে ঘন ছায়া-

একজন রাহী ঐখানে ফিরে এল সন্ধ্যাবেলা  রাত্রে

এক মুশকিল আসান

তার আধখানা মুখে আলো ফেলে।

গোল চাতালের নীচে দূর খাদে, দুইজন চোর

হিমরাত্রে আগুনের কুঞ্জ জ্বালিয়েছে।" ( গল্পগুলো)

উদ্ভট শ্লোকের ভাঙা সুর থেকে আগুনের কুঞ্জ জ্বালানো খুব সহজ কথা নয়। শূন্য খাদের প্রান্তরে দাঁড়িয়ে জীবনের অকলুষ সমগ্রতাকে নির্মাণ করবার দক্ষতা না থাকলে জীবন জ্যামিতির এই সংযোগ স্পর্শ করা যায় না। সমস্ত বিশুদ্ধতাকে তুবড়ে তার নির্যাস টেনে এনে অনির্দেশ দিগন্তের ঠিকানা খুঁজেছেন তিনি। এই তাঁর পরিব্রাজক সত্তা। শূন্যের উন্মুক্তির ভেতর প্রাণের রহস্য আর ছেতরে যাওয়া অনাস্বাদিত চলাচলের পাশে নিজের পা মিলিয়ে দিতে পারার যে সাহজিক অভিযাত্রা সেই জীবনশিক্ষাই তাঁকে করে তুলেছে কাশফুলের বন্ধু, করে তুলেছে  শরৎমেঘের আত্মীয়।

তবু নিঃসঙ্গ নই-

কুকারের মধ্যে মাংস টগবগায় ।একা খাওয়া বড়ো আনন্দের

খাদ্য আমি দুজনেই মুখোমুখি । প্লেট থেকে কথা বলছে

সাদা ভাত বহু মমতার, বৌলে মাংস

বন্য উপকথা , যেন বনের কিনারে

একটি হাড়ি ও আকাশ , তিন দিকে মহাশূন্য – হাড়ি থেকে

মহাজাগতিক মেঘে বিশ্বসংসারের গল্প ওঠে –


কখনও নিঃসঙ্গ নই নিজেই নিজের সঙ্গে থাকি। (রাত্রিতরঙ্গ) 

আনুষ্ঠানিক কোলাহল থেকে তিনি দূরে থেকেছেন সবসময়।তবু তিনি নিঃসঙ্গ নন, তাঁর চারপাশে  রয়েছে ভালোবাসার শেকড় বাকড় ।  কাব্য ব্যবসায়ী হতে চান নি বলেই  প্রচারের আলোর বিপরীতে  ছোট কাগজের মধ্যেই লিপিবদ্ধ করেছেন তাঁর আশ্রয়। শব্দের সাধনা, প্রাণের সাধনা জীবন ও অন্তর্জগতের সাধনা তাঁকে উদ্দীপিত করেছে অনুভবী পৃথিবীর দিকে।যেখানে রূপ- রস গন্ধ তাঁর অনুচিন্তায় এক অদ্ভুত স্বাক্ষর রেখে যায়।প্রবাহিত জল জীবনের মানচিত্র এঁকে দেয়। পাললিক স্থিতিশীলতা মুছে যা আবার নতুন করে তৈরি করে  বোধের বৈভব। সীমানা পেরিয়ে কাঁটাতার পেরিয়ে দেশভাগের যন্ত্রনা পেরিয়ে এলেও তিনি জেনেছেন মনের ভেতর  রহস্যের, প্রেমের আর আসঞ্জনের যে  শিল্পভূমি  রয়ে যায় তার নামই স্বদেশ। যেখানে শরতের মেঘ ঘুরে বেড়ায় ,সাদা  ভাতের মধ্যে রয়ে যায় মমত্বের স্পর্শ । একটা হাড়ি , আকাশ আর তার  পরিসীমানায় রচিত হয় মহাশূন্য।এখানেই এক মহাজাগতিক মেঘের জন্ম হয়। অন্তর্গত জগতের সমুহ গল্প রাত্রির তরঙ্গ হয়ে মুখোমুখি বসে, গল্প করে। একে কি নিসঙ্গতা বলব আমরা? না কি বলব নিজের অন্তরের অনুভবময় জগতের বস্তুবিশ্বকে একাকার করে দেওয়ার মিলিয়ে দেওয়ার সার্বভোম তপস্যা।কবিতাই হয়ে ওঠে এই তপস্যার বীজমন্ত্র।এই প্রসঙ্গে কবি ও গদ্যকার কমল চক্রবর্তীর  একটি লোভনীয় উদ্ধৃতি ব্যবহা্রের আকাঙ্ক্ষা থেকে নিজেকে অব্যহতি দিতে পারলাম না কিছুতেই- ‘ মানুষ যখন থামে, কবিতা তখন শুরু করে জারিজুরি। খুব ক্লান্ত মানুষ বারো ঘণ্টা আঠারো ঘণ্টা এক নাগাড়ে খাটলে হঠাৎ তার কবিতা পায়। কবিতা মন্ত্র দেয়। দেয় জীবনী শক্তি।কবিতা পরের দিনের তাকত। আবার সূর্য ওঠার ব্যবস্থা।রাতের জোনাকি , আঁধারের ঝিমঝিম, রক্তে জ্যোৎস্না।ঐ যা ছুঁতে পারি না, বুঝতে পারি না, দেখতে পাই না  তবু আছে মনে হয়। এমনকি একটা সিঁধেল  ওই যে গা ছমছম বুনো পথে ,ঐ আলোহীন পৃথিবীর চোরাপথে  সাপ ব্যাঙ জোক ডিঙিয়ে  , কাঁটা কাঁকড়া এড়িয়ে সে তো কবি।পেটকাপড়ে লুকানো তার সিঁধকাঠি  না ঝর্নাকলম, মাটিতে স্বাক্ষর রাখতে চলেছে। এই পথচলা তার ভালো লাগে । কবির এই আঁধার ভুবন অপূর্ব। কবিকে ডেকে বলি –চোরা ওই পথে আমাকে নিবি?  কবি কথা শোনে না, ঝোপেঝাড়ে সুড়ুত কোথায় হারিয়ে যায়। পৃথিবী আরও রহস্যময় সুন্দর হয়…’ কবি মনীন্দ্র গুপ্তের চলাচল কিন্তু সাপ ব্যাঙ পোকা মাকড় এড়িয়ে নয় বস্তুত সমস্ত প্রাণ অপ্রাণ জগতের সারাংশ নিয়ে এক রহস্যপথের উপর অতি ধীর তাঁর চলাচল।এমনকী সম্পর্কের গভীর তলদেশ খনন করেও তুলে এনেছেন মনের তুমুল বিক্রিয়া।

যত কাছাকাছি থাকছে ,তত তারা চিনতে পারছে না

একে অপরকে। দুজনাই লোক ভাল, তবু ভাবে

এ বুঝি সরাবে ওর সোনা।

অথচ কদিন আগে দুজনাই ভেবেছিলঃ যে –কোনো দরকারে

নিজের সূর্যাস্ত দিয়ে অপরকে ভোর কিনে দেবে (দম্পতি)

এই রহস্যভেদী অন্তর্দৃষ্টিই তাঁর নিরীক্ষণকে তীব্র এবং তীক্ষ্ণ করেছে। জীবনের প্রতি আমূল  ভালোবাসা না থাকলে, জীবনের প্রতিটি আয়োজনকে নিবিড় পর্যবেক্ষণ দিয়ে না জানলে চারপাশের টুকরো টুকরো বিক্ষিপ্ত ছবি, চেনা পট, কাদামাখা মুখচিত্র ,লোককথা, বহমান ইতিহাস, মিথ এবং আপাত তুচ্ছ বিষয়সমূহের ভেতর কীভাবে প্রাণের সঞ্জীবনী মন্ত্র উচ্চারণ করা যায় না। কী সেই রহস্য মনীন্দ্র গুপ্তের কবিতা পড়তে পড়তে পাঠক সন্ধান করেন তা বারবার। কেন , কেন তিনি বলেন’ কখনও নিঃসঙ্গ নই, নিজেই নিজের সঙ্গে থাকি।’ বরিশালে ১৯২৬ সালে জন্মেছিলেন যে মানুষটি, গ্রাম আর প্রকৃতিজীবনের এক অপূর্ব সহবাস তিনি দেখেছেন দিনের পর দিন।কথা বলেছেন প্রতিটি অণু পরমাণুর সাথে।দেখেছেন  দেশভাগের আগুন, সেই আগুনে প্রতিদিন দগ্ধ ক্ষতবিক্ষত হতে হতে কীর্তনখোলা থেকে গঙ্গাপাড়ে উঠে আসতে হয়েছে তাঁকে।ফেলে আসা ঝিঁঝিঁপোকা, জলফড়িং,জারুল গাছের সাথে একাত্ম হয়ে থাকত তাঁর আত্মিক অনুভূতি।যা তিনি অর্জন করেছেন এক বিচ্ছেদের ভেতর থেকে, ভালোবাসা সম্পৃক্ত এক মগ্নতার ভেতর থেকে। এই গভীর সংবেদনশীলতাই তাঁকে নিসর্গ ও বস্তুজগতের সুখ দুঃখের অংশীদার করেছে। প্রকৃত অর্থেই তিনি হয়ে উঠেছেন  শরৎমেঘ ও কাশফুলের বন্ধু।  ( চলবে) 

 
জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


 

Post a Comment

0 Comments