জ্বলদর্চি

তুর্কী নাচন /পর্ব-৫ /মলয় সরকার

তুর্কী নাচন 

পর্ব-৫  (পূর্ব প্রকাশিতের পর)

মলয় সরকার


কাপাদোসিয়া পর্ব-৫ (ডাভ কোট)

আমরা যত এগোতে লাগলাম, তত বেশি করে এই ধরণের পাহাড়ের গায়ে খোপ খোপ ঘরের দেখা পাচ্ছিলাম, এক কথায় সমস্ত পাহাড় জুড়েই এই পায়রার খোপের মত খোপ। আমি রুইয়া কে জিজ্ঞাসা করলাম , এগুলোতে মানুষ থাকত না পায়রা? ও বলল, সেটা দেখাতেই এনেছি। এই পাহাড় গুলোতে মানুষ তো থাকতই, তার সাথে উপরে যত খোপ দেখছেন, সেগুলো তে পায়রা থাকত। এগুলো নাকি ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে ওরা এইভাবে পায়রার বিষ্ঠার ব্যবহার করত।ওরা সেই খোপে (Dovecotes) পায়রার জন্য খাবার রাখত। বললাম, কেন? ও বলল, এখানে তো গরু নেই, কাজেই সাধারণ গোবর সারও নেই।অন্য কোন প্রাণীর বিষ্ঠা সারও নেই। কাজেই ওরা প্রচুর পায়রা পুষত। সেই পায়রার মল সারা বছর জমিয়ে তাই দিয়ে চাষ বাস করত।আমি তো শুনে হতবাক। এ রকম যে হতে পারে জানা ছিল না।পায়রার কত মল হবে, যে, তাই দিয়ে সার হবে এবং তাতে চাষ হবে, ভাবতেই আশ্চর্য লাগছিল।কিন্তু, ও জানাল, এটাই সত্যি।আমরা যা দেখলাম, সেটা নাকি অল্প কিছু অংশ। আরও আছে এ সমস্ত এবং তা ইউনেস্কো হেরিটেজ রূপে খ্যাতি লাভ করেছে।
 
হবে হয়ত। পৃথিবীর কত আশ্চর্যই তো জানা ছিল না । যত দেখছি, আশ্চর্য হচ্ছি।



এর পর এসে পৌঁছালাম একটা ছোট চা দোকানে।সে বলল, এখানে একটু বসে এখানকার বিখ্যাত আপেল চা খেয়ে দেখুন।একেবারেই ছোট। রাস্তার পাশের চা দোকান, দু একটা চেয়ার রয়েছে, তাতেই আতিথ্য করে বসতে দিল। সবার আর বসার সুযোগ হল না। তবে  নতুন জিনিস জানার সুযোগ হল, খেলাম আপেল চা।আপেলের চা হয় জানতাম না।(তখনও আমাদের দেশে এত বেশি অন্যান্য চায়ের চল ছিল না) ওরা বলল, এরকম বেদানার চা এবং আরও নানা ফলের চা হয়। পরিবেশন হল সুন্দর এক কাঁচের গ্লাসে। মনটা আপেলের চায়ের স্বাদে গন্ধে ভরে গেল।ইচ্ছা রইল এই চা নিয়ে যাবার।তার থেকেও ভাল কাঁচের গ্লাশটার আকৃতি।(পরে এগুলো নিজেদের জন্য জোগাড় করা হয়েছিল ইস্তানবুলের গ্রাণ্ড বাজারে।)
                                                           

রুইয়া এগোল, আমরা দেখতে দেখতে যাচ্ছি, ওই রকম বাড়ী , কোনটি আবার বেশ উঁচুতে,। বললাম , ওরা উঠত কিভাবে? ও বলল, দেখুন, ছোট ছোট সিঁড়ি মত কাটা আছে। কিন্তু তা দিয়ে আমাদের মত মানুষ উঠতে প[রবে না, অন্ততঃ আমি তো নয়ই।তারা বোধ হয় হনুমানের মত এই ভাবে উঠতেই দক্ষ ছিল। এই ভাবেই তারা নিচে ওঠানামা, নিচে এসে চাষ বাস, খাবার জল উপরে নিয়ে যাওয়া, এসব তো নিশ্চয়ই করত। আমি রুইয়ার কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করছিলাম। না, কেউ অন্য কিছু ভাববেন না, আসলে ও কি বলতে বলতে যাচ্ছে সেগুলো না শুনলে তো বাদ পড়ে যাব, তাই শোনার চেষ্টা করছিলাম।


 হঠাৎ পিছন ফিরে দেখি বুলু নেই । সে কি, বিদেশ বিভুঁইয়ে এসে শেষে বৌ হারাব না কি! সব মাথায় উঠে গেল, বৌ খুঁজতে লাগলাম।দেশে ফিরে ছেলেমেয়েকে কি জবাব দেব, ভাবতেই বুকটা শুকিয়ে গেল। সব ছেড়ে পিছন দিকে ছুটলাম। হঠাৎ চোখে পড়ল, আমার অর্ধাঙ্গিনী দু হাতে দুটি গোলগাল মার্জারকে কোলে নিয়ে আদর করছেন আর আমাকে দেখে উল্লসিত হয়ে ,আমাকে তার আদরের বস্তু দুটি দেখিয়ে ছবি তুলে দেওয়ার জন্য আবদার করতে লাগলেন। কি করি, হাসব না কাঁদব!
                                                          

এরকমই একটা পাহাড় কাটা ঘর রয়েছে এক জায়গায়। এটি কিন্তু বেশ বড় ধরণের, কিন্তু মাটি থেকে বেশ উঁচুতে। যারা তরুণ তারা লাফিয়ে উঠে পড়ল, দেখার জন্য। তাতে দরজা বেশ বড়, অন্যান্যদের মত নয়। আমি দু একবার ওঠার চেষ্টা করে ক্ষান্তি দিলাম। বুড়ো বয়সে বিদেশে এসে হাত পা ভাঙ্গার ইচ্ছা হল না। তাদের মুখেই শুনে নিলাম, ভিতরে বিশেষ কিছু নেই। ফাঁকাই, তবে মেঝেটা সমতল ও কিছুটা প্রশস্ত।
                                                       

এর পর আমরা একই জিনিষ দেখতে দেখতে এগোলাম। বেলাও হয়ে গেল। আমরা গিয়ে পৌঁছালাম এক বিশাল বড় হোটেলে। এখানে সব বুফে সিস্টেম। যে যা খুশী খেতে পারে। আমরা তো ঘুরে ঘুরে নানা রকমের  সালাড  নিলাম। রুটি নিলাম। চেনা লাগছে যেগুলো বা যেগুলোর সম্বন্ধে কিছু লেখা আছে সেগুলো নিচ্ছি। এর পর আমি আর বুলু দুজনে অন্য কিছু টেস্ট করার জন্য উঠলাম।দেখি ধোঁকার ডালনার মত কি রয়েছে আর একটা কিসের যেন সব্জীর না ডালের মত একটা জিনিস । নিলাম দুজনে , খেয়ে দেখি কেমন। কি মনে হল, একজন হোটেল বয় কে জিজ্ঞাসা করলাম, এতে কি আছে। ও বলল, প্রধানতঃ এগুলো গরুর মাংস দিয়েই তৈরী। ব্যস। খাওয়া মাথায় উঠে গেল। প্লেট ছেড়ে উঠে দুজনেই হাত ধুয়ে নিলাম।( বলছি না, গোমাংস অখাদ্য। তবে আমরা খাই নি তো তাই-)

বাইরে বেরিয়ে দেখি আমাদের গাড়ী তৈরী। রুইয়া এল হাসতে হাসতে। সত্যি, হাসলে ওর লালচে ফর্সা গালে সুন্দর টোল পড়ে। ভীষণ ভাল লাগে।এসেই জিজ্ঞাসা করল, কি কেমন খেলেন সবাই? ভাল ছিল তো? সবাই বলল একবাক্যে, হ্যাঁ। এটা মানতেই হবে এত বড় , এত পরিচ্ছন্ন, এত সুন্দর ব্যবস্থা ও ব্যবহার হোটেলের, আমি খুব কমই দেখেছি।অঢেল খাবার বিভিন্ন ধরণের ও বিভিন্ন দেশের এবং সেগুলি সুস্বাদুও। কাজেই অস্বীকার করার উপায় নেই, খাবার সত্যি ভাল ছিল।


দুপুর রোদের মধ্যে ধূ ধূ ফাঁকা মাঠের মধ্যে দিয়ে চলছে গাড়ী। ঘুম এসে যাচ্ছে। হঠাৎ রুইয়া বলল, এমন এক জায়গায় আপনাদের নিয়ে যাচ্ছি, জানি না , আর কোথাও এ জিনিস দেখতে পাবেন কি না। তবে এখনই বলছি না, সেটা কি।


গাড়ী থামল। জায়গার নাম কায়মাকলি। গেলাম রুইয়ার পিছনে পিছনে। ঢোকার মুখে টিকিটের ব্যবস্থা। ও-ই টিকিট কাটল।


এটি আসলে মাটির নীচে একটি শহর।আমি তো ভাবতেই পারি নি, যে আমার জীবদ্দশায় এরকম একটি জিনিস দেখতে পাব। ঢোকার মুখে রুইয়া বলল, এরকম জিনিস আশা করি আপনারা আর কোথাও দেখতে পাবেন না।এটি একটি মাটির নীচের শহর, যা তৈরী হয়েছিল সম্ভবতঃ সপ্তম- অষ্টম খ্রীষ্টপূর্বাব্দে। শুনেই চমকে গেলাম। তাও নাকি শহরটা মাটির নীচে আটতলা পর্যন্ত আছে, যদিও আপাততঃ পর্যটকদের জন্য চারতলা পর্যন্ত খোলা। এর নীচে নাকি অন্ততঃ পাঁচ হাজার লোক থাকতে পারত। এছাড়াও খাবার দাবার  ,নানা শস্য মজুত করার জায়গাও ছিল।ও বলল, বাকীটা পরে বলব, এখন চলুন।ঘাবড়ে গেলাম সব শুনে।এখন আমাদের মেট্রো রেল বা লণ্ডনের টিউব রেল তাহলে কিই বা এমন আশ্চর্য জিনিস দেখাচ্ছে আমাদের। সেই সুপ্রাচীন যুগে, অর্থাৎ প্রায় আড়াই হাজার বছরেরও আগে , গৌতম বুদ্ধের সময়ে যদি মানুষ এত উন্নত ছিল, প্রযুক্তিগত ভাবে বা চিন্তা এবং বুদ্ধিতে, তাহলে কি সত্যিই বিজ্ঞানের অগ্রগতি হয়েছে না পশ্চাদ্গতি হয়েছে ,সেটাই ভাবার। 


ঢোকার মুখেই, গুহার ভিতরে সিঁড়ি দিয়ে নামার আগে, বেশ খানিকটা জায়গা রয়েছে দেখলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, এটা কেন? রুইয়া বলল, এটা ওদের গরু ঘোড়া রাখার জন্য আস্তাবল ধরণের ছিল। এই রকম পাতালপুরীর যেখানে যেখানে প্রবেশদ্বার আছে, সেখানে অনেক জায়গাতেই এরকম জায়গা করে আছে।
ও বলল, এই পাথর গুলো অপেক্ষাকৃত নরম আগ্নেয় পাথর । কিন্তু তারা কি কৌশলে কেটেছিল বা প্রযুক্তির কত উন্নত স্তরে ছিল বলতে পারব না। গুহা বা পাহাড় কাটা স্থাপত্য আমাদের দেশেও আছে, অজন্তা ইলোরা বা মহাবলীপুরম এরকম অনেক জায়গায়। তবে মাটির নীচে শহরের খবর সত্যি আমার খুব বেশি জানা নেই। আর সুড়ঙ্গ খোঁড়ার ব্যাপারে মহাভারতের যুগে বারণাবত পর্বে সুড়ঙ্গ খোঁড়ার উল্লেখ পাই, কিন্তু এরকম ঘটনা জানা নেই।শুনেছি ইরাকে প্রয়াত প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম নাকি মাটির তলায় এরকম সড়ঙ্গ শহর বানিয়েছিলেন, দেখার সৌভাগ্য এখনও হয় নি।পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় (কোথাও কোথাও দেখেছি, রাজারা রাজপ্রাসাদের ভিতর এরকম সুড়ঙ্গ বানাতেন অনেক সময়, হঠাৎ শত্রু আক্রমণ হলে পালিয়ে বাঁচার জন্য।) মহাভারতে আমরা অবশ্য দেখেছি শেষের দিকে দ্বৈপায়ন হ্রদের নীচে দুর্যোধন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে গিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। অর্থাৎ হ্রদের নীচে থাকার বন্দোবস্ত তখনও ছিল। 

এগোলাম নামার সিঁড়ির দিকে।  

ক্রমশঃ-

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments