জ্বলদর্চি

জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি- ৫ /সূর্যকান্ত মাহাতো

জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি- ৫

সূর্যকান্ত মাহাতো

রামগড় ও লালগড় রাজবংশের ইতিহাস

যদি বলি জায়গাটার নাম "শাঁকাকুলিয়া" তাহলে পাশের গ্রামের লোকও জায়গাটা জানে  কী না সন্দেহ আছে। হয় তো বলবে, এটা আবার কোন জায়গা! কিন্তু যদি বলি 'লালগড়' তাহলে পাশের গ্রাম কেন, গোটা বঙ্গভূমি নামটা শুনেই একটু নড়ে চড়ে বসে বলে দিতে পারবে এর নাড়ি নক্ষত্র। তার কারণ কয়েক বছর আগে ঘটে যাওয়া লালগড়ের এক উত্তাল ইতিহাস। লালগড়েরই পাশের গ্রামের এক আদিবাসী বৃদ্ধা মহিলার উপর পুলিশি অত্যাচারের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল এখানকার মানুষ। ছাই চাপা আগুনে এটাই প্রথম ফুঁ দেওয়ার ঘটনা। প্রতিবাদে এখানে গড়ে ওঠেছিল "পুলিশি সন্ত্রাস বিরোধী জনসাধারণের কমিটি"। এবং তাদের লাগাতার আন্দোলনে একটা দীর্ঘ সময় তো পুলিশ এই লালগড়ে প্রবেশ করতেই পারেনি। বরং পুলিশই ওই সময় নাস্তানাবুদ হয়ে উঠেছিল। একটা সময় মাওবাদীদের মুক্তাঞ্চল হয়ে উঠেছিল এই লালগড়। আবার এই লালগড়ের বুকে 'নেতাইয়ে', এই তো কয়েক বছর আগেই অসহায় নিষ্পাপ নারী পুরুষের উপর চলেছিল হার্মাদ বাহিনীর নৃশংস তান্ডবলীলা। বন্দুকের সেই হামলা চলেছিল জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের ধাঁচেই, উপস্থিত অসহায় মানুষের জমায়েতে। রক্তে 'লাল' হয়ে উঠেছিল এই 'গড়'। তাই লালগড় নামটি সেই দিক থেকেও বেশ তাৎপর্যময়। রাজাদের শাসন-শোষণ, ব্রিটিশদের অত্যাচার, পুলিশের অত্যাচার, মাওবাদী আক্রমণ এবং হার্মাদের গুলিবর্ষণ, সবকিছুই চাক্ষুষ করেছে লালগড়ের মাটি ও মানুষ। আপামর জনসাধারণ তবুও ভয়ে পিছিয়ে আসেননি। বরং এখানকার মানুষজন বড় সাহস দেখিয়েছেন এবং প্রতিরোধ গড়ে তুলে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এই সাহস ও বীরত্বের নমূনা কেবল আজকের নয়, অতীত কাল থেকেই ছিল লালগড়ে। রামগড় ও লালগড়ের তৎকালীন দুই রাজা তো সেই কবেই এমন সাহস ও বীরত্ব দেখিয়ে গেছেন। তাদের সাহসে ও বীরত্বে সন্তুষ্ট হয়ে নবাব আলীবর্দী খাঁ তাদেরকে "সিংহ সাহস রায়" ও "সাহস রায়" নামে বিশেষ উপাধিতে ভূষিতও করেন।
লাল রক্তে ভেজা এই গড়ের মাটিতে তাই একদা রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কুলুকুলু করে বয়ে চলা কংসাবতী নদীর তীরেই গড়ে উঠেছিল সেই রাজবংশ ও রাজাদের প্রাসাদোপম রাজপ্রাসাদ। এখনও স্বমহিমায় বিরাজমান সেই বৃহৎ অট্টালিকা। যদিও সেই প্রাসাদের সম্মুখভাগ ও বাড়ির বেশ কিছু কিছু অংশ এখন ভগ্ন প্রবন হয়ে ক্রমশ বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। তাসের ঘরের মতো যে কোনওদিন হয় তো ভেঙে পড়তে পারে সংরক্ষণের অভাবে। তবুও প্রাচীন রাজ আভিজাত্য ও গর্ব এখনও বহন করে চলেছে প্রাসাদের প্রতিটি ইঁট, কাঠ, বালি দেওয়াল সহ সমগ্র রাজবাড়িটি।

বেশ কিছুদিন আগেই জঙ্গলে মোড়া লালগড়ের রাতের ঘুম উড়ে গিয়েছিল। কী কারনে? হঠাৎ কোন সুদূর হতে এক নরশার্দূল বা বাঘের  অনুপ্রবেশ ঘটেছিল লালগড়ের জঙ্গলে। আতঙ্কে লালগড় বাসীরা তখন ভাবছিল, অনেক রকমের বিপদ ও হামলা তো দেখলাম, এ আবার কোন ধরনের আপদ রে বাবা!
 তাই বলে কী দক্ষিনরায় ব্যাঘ্র মহাশয় লালগড়ে আসবেন না! তাও আবার হয় না কী! কারণ লালগড়ের রাজবংশের সঙ্গে তারও পূর্বপুরুষের যে একটা অতীতে গভীর সম্পর্ক ছিল। সে কাহিনী কী আর সহজে ভোলা যায়! লালগড়ের রাজারা "সাহস রায়" উপাধিটি কী আর এমনি এমনি লাভ করেছিলেন? রাজা তো তার এক পূর্বপুরুষকে মেরে ফেলেছিলেন বলেই না সেই উপাধিটিটুকু লাভ করেছেন!

তো সেই সাহসী রাজা উদয় চন্দ্রের রাজবংশের ইতিহাসে একবার চোখ ফেরানো যাক। রাজা উদয় চন্দ্র রাও ও গুণচন্দ্র রাও ছিলেন দু-ভাই। তারা জাতিতে ছিলেন ব্রহ্মভট্ট। তাদের পূর্বপুরুষ ছিলেন মধ্যপ্রদেশের কাটোয়া(এটোয়া) জেলার বাসিন্দা। তারা তীর্থস্থান ভ্রমণ করে ফেরার সময় এখানে বসবাস শুরু করেছিলেন। বিনয় ঘোষ এ প্রসঙ্গে একটা খুব দামি কথা বলেছেন, রাজাদের শ্রীক্ষেত্রে পুণ্যলোভাতুর হয়ে এদিকে আসা এবং ঘটনাচক্রে রাজ্যলোভাতুর হয়ে রাজ-তখ্তে বসা। স্থানীয় সব রাজবংশগুলোর সেই একই ইতিহাস(পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি, দ্বিতীয় খণ্ড)। যাই হোক এই ভট্টদের জাতীয় ব্যবসা বলতে ছিল সংবাদ বহন করা আর দূতের কাজ করা। বেলী সাহেব তার "স্মারক পুস্তক"(Memoranda of Midnapur) গ্রন্থে বলেছেন---

এইরূপ কিংবদন্তি আছে যে, তৎকালীন মেদিনীপুর রাজবংশের কোন এক রাজার রাজপুত্রের জন্ম হয়েছিল। এবং সদ্যোজাত রাজপুত্রের জন্ম সংবাদ বিদেশে অবস্থিত রাজাকে প্রথম জানিয়েছিলেন গুণচন্দ্র এবং উদয় চন্দ্র এই দুই ভাই। আর এমন শুভসংবাদ পেয়েই রাজা অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়ে উদয় চন্দ্রকে 'লালগড়' এবং গুণচন্দ্রকে 'রামগড়' রাজ্য দু'টি দান করেন।

একবার নবাব আলীবর্দী খাঁ রামগড় ও লালগড়ের জঙ্গলে নাকি শিবির বসিয়েছিলেন। সে সময় একটি বাঘের ওই জঙ্গলে খুব উপদ্রব শুরু হয়েছিল। নবাবের সেনারা বাঘটিকে কোনওভাবেই বধ করতে পারছিলেন না। তখন দুভাই উদয় চন্দ্র ও গুণচন্দ্র অনেক খোঁজাখুঁজি করে বাঘটিকে হত্যা করেছিলেন। নবাব তখন এই দুই ভাইয়ের সাহস ও বীরত্ব দেখে দু'জনকেই একটি করে রাজ উপাধি দান করেন। বড় ভাই গুণচন্দ্রকে "সিংহ সাহস রায়" এবং ছোট ভাই উদয় চন্দ্রকে "সাহস রায়" নামে উপাধি দান করেন।

এই 'লালগড়' নামটি নিয়েও একাধিক মতামত রয়েছে। কেউ কেউ বলেন যে, দু ভাই রাম সিং আর লাল সিং এটোয়া থেকে এখানে এসেছিলেন। সেই লাল সিংয়ের নাম থেকেই জায়গাটার নাম হয় লালগড়। আবার কেউ কেউ বলেন, দু ভাই রামচন্দ্র রাও ও লক্ষ্মণ চন্দ্র রাও এর মধ্যে লক্ষ্মণ চন্দ্র লালগড়ের পরবর্তী রাজা হন। তাঁর নামানুসারেই লালগড় নামকরণ হয়েছেন। তবে নামকরণের সবটাই লোকশ্রুতি।সেরকম ভাবে কোনও লিখিত তথ্য প্রমান কিছু নেই।

 ব্রিটিশ রাজত্বের শুরুর দিকে রামগড় ও লালগড়ের জমিদাররা যখন ইংরেজদের বশ্যতাকে অস্বীকার করে বিদ্রোহ শুরু করেছিলেন তখন রামগড় ও লালগড়ের রাজারাও সেই বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেছিলেন। যদিও পরে ইংরেজদের কাছে পরাজিত হয়ে তাঁরা ইংরেজদের বশ্যতা স্বীকার করতে একরকম বাধ্য হয়েছিলেন। এবং ইংরেজদের অতিরিক্ত রাজস্ব দানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছিলেন। শুধু তাই নয় ইংরেজরা রামগড় রাজ্যের নন্দলাল সিংহ সাহস রায় এবং লালগড়ের রসিক নারায়ণ সাহস রায়ের সঙ্গে রাজ শাসনের নতুন এক শর্তে চুক্তিবদ্ধও হন।

লালগড়ের রাজা উদয় চন্দ্র ছিলেন নিঃসন্তান। তাই দাদা গুণচন্দ্রের ছোট ছেলে লক্ষণ চন্দ্রকে পরবর্তী রাজা ঘোষণা করেছিলেন। তারপরে রাজা রসিক নারায়ণের পৌত্র ছিলেন গঙ্গানারায়ণ সিংহ সাহস রায়। আবার গঙ্গানারায়ণের পিতা অকালে মারা যান, তখন গঙ্গানারায়ণ ছিলেন অপ্রাপ্তবয়স্ক। তাই লালগড়ের জমিদারি বহুদিন ধরে, গঙ্গানারায়ণের সাবালকত্ব না হওয়া পর্যন্ত কোর্ট অব ওয়ার্ডস এর তত্ত্বাবধানে ছিল। এই গঙ্গানারায়ণ ইংরেজি ও বাংলা দুই ভাষাই বেশ সাবলীল ভাবে শিখেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সতীশ নারায়ন রাজকার্যের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তিনি মারা যাওয়ার পর শেষে যোগেন্দ্রনারায়ণ রায় লালগড়ের উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন। তিনি প্রজা কল্যাণের জন্য নানান গঠনমূলক কাজ এবং প্রচুর অর্থ-সম্পত্তি দান করেছিলেন। যেমন রামকৃষ্ণ মিশনের জন্য জমি দান করেন এবং রামকৃষ্ণ বিদ্যামন্দির স্থাপন করেন। রাজভবনের নিচে সেই বিদ্যালয় এখনও চলে। শুধু তাই নয় মেদিনীপুর বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভাপতিও নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেই কারণে তিনি প্রভূত খ্যাতি ও  সুনাম অর্জন করেছিলেন।

রাজ ভবনের অদূরেই আছে রাজাদের কুলদেবতা 'রাধামোহন জিউ'-র মন্দির। লোকশ্রুতি যে, কোনও এক সাধু এই কুলদেবতা রাধামোহন জিউ কে রাজবাড়িতে রেখে যান। তারপর রাজাকে স্বপ্নাদেশে ঠাকুর জানান যে তিনি দেবতা রাধামোহন জিউ। তাকে প্রতিষ্ঠিত করে পূজা করতে হবে। এমনকি তাকে শুধু একাকী নয়, তাঁর শ্রীমতি-কেউ তার পাশে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। তিনি আছেন বালি দুমদুমির জঙ্গলে এক গাছের তলায়। মাত্র আড়াই কোদাল মাটি কোপালেই তাঁর শ্রীমতি-কে পাওয়া যাবে। সেই মতো রাজা বালি দুমদুমির জঙ্গলে সেই গাছের তলায় কোদাল দিয়ে মাটি কোপায়। কিন্তু আড়াই বারের জায়গায় তিন কোদাল মাটি কোপানো হয়ে যায়। ফলে শ্রীমতি-র কপালে একটি ক্ষত তৈরি হয়। সেই ক্ষতের দাগ এখনও শ্রীমতি-র কপালে রয়ে গেছে। আজও এই কুলদেবতার মন্দিরে দেব দেবী দর্শনে গেলে শ্রীমতির কপালে সেই দাগ দেখা যায়। 

মন্দিরের পাশেই আছে একটি 'হাওয়ামহল' বা 'হাওয়াখানা'। প্রতি বছর গ্রীষ্মের সময় শ্রী শ্রী রাধামোহন জিউ ও তাঁর শ্রীমতি এই মহলের ওপরে এসে শীতল হাওয়া খান। তাই ওপরে বালিশ ও বিছানায় কিছুক্ষন বিশ্রামের জন্য এই দেব দেবীকে শুইয়ে রাখা হয়। বেশ কারুকার্যময় এই হাওয়াখানা।

রাজবাড়ির অদূরেই আছে রাজাদের দুর্গা মন্দির। লালগড় রাজাদের দুর্গাপূজা আবার কিছুটা ব্যতিক্রমী। এই দেবী দুর্গার পূজা হয় কার্তিক আর গনেশকে ছাড়াই।  পূজিত হন কেবল মা দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী আর মহিষাসুর। এখনও কেউ যদি এই রাজবাড়ির দুর্গা মন্দিরে যান তাহলে কার্তিক গনেশ ছাড়াই বাকি দেবতাদের দেখতে পাবেন।

লালগড় রাজভবনটি নির্মাণ করেছিলেন স্বর্গীয় রাজা স্বরূপ নারায়ণ সাহস রায়। পরবর্তীকালে রাজবাড়ির সংস্কার করা হয়েছিল। এই সংস্কার করেছিলেন রাজা যোগেন্দ্রনারায়ণ সাহস রায়। এখনও লালগড় রাজভবনের উপরে বেশ বড় করে লেখা আছে--"রাজা যোগেন্দ্রনারায়ণ ভবন।" 

রাজবাড়ির পাশেই আছে কাছারি ঘর। এখানে বসে রাজা খাজনা আদায় করতেন। শুধু তাই নয়, এই কাছারি ঘরে বসেই রাজা দরিদ্র প্রজাদের অন্ন ও বস্ত্র বিতরণও করতেন।

রামগড় রাজবংশ: লালগড়ের অদূরেই উত্তর দিকে অবস্থিত রামগড় রাজবংশ। রাজা গুণচন্দ্র ছিলেন এ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা রাজা। এখানকার জঙ্গলে নবাব আলীবর্দী খাঁ-র শিবির চলাকালীন ভাই উদয় চন্দ্রের সঙ্গে বাঘ মেরে ছিলেন বলে তিনি "সিংহ সাহস রায়" উপাধি লাভ করেছিলেন। আবার স্থানীয় মানুষেরা বলেন, রামচন্দ্র রাও লক্ষণ চন্দ্র রাও নামে দু'ভাই মাহাতো ও আদিবাসী সেনাদের নিয়ে বর্গীদের তাড়িয়ে যে সাহস ও বীরত্বের পরিচয় দিয়েছেন তাতেই নাকি এই উপাধি লাভ। রাজা রামচন্দ্রের নামেই জায়গাটির নাম হয় রামগড়।"গড়" শব্দের আভিধানিক অর্থ হল "দুর্গ" বা "কেল্লা"। অর্থাৎ রামের দুর্গ বা গড় থেকেই রামগড় নামকরণ হয়েছে। এখনও সে দুর্গ স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে রাজ ঐতিহ্য বুকে নিয়ে। রাজবাড়ীর মূল ফটকের স্তম্ভে একটি সিংহের মূর্তি রাজার সেই সাহসী কাহিনী আজও বহন করে চলেছে। 

রাজভবনের পিছনে আছে একটি রাজদিঘী বা রাজাদের জলাশয়।আর ভবনের সম্মুখ ভাগের স্তম্ভে বিরাজ করছে গরুড়দেবের মূর্তি। পাশেই জঙ্গলাকীর্ণ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাজপরিবারের দুর্গা মন্দির।কেবল একা নয়, একইভাবে জঙ্গল আর ঝোপ ঝাড়ে ঢাকা পড়ে আছে আদি গোপীনাথ জিউ মন্দিরও। গোপীনাথ জিউ হলেন এই রাজবংশের কুলদেবতা।

রাজা গুণচন্দ্রও পরবর্তী কালে ইংরেজদের বৈশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছিলেন। তার মৃত্যুর পর জ্যৈষ্ঠ পুত্র হিসাবে রামচন্দ্র রামগড়ের রাজ্য লাভ করেছিলেন। আর ভাই লক্ষণ চন্দ্র পেয়েছিলেন লালগড়ের রাজত্ব। পরে ইংরেজ ক্ষমতাবলে নন্দলাল সিংহ সাহসের সঙ্গে যৌথভাবে রাজ্যের অধিকার লাভ করেন। তার পরে রাজ্য লাভ করেন রাজা শ্রী বাহাদুর সিংহ সাহস রায়(১২৩০-১২৭৮ রাজত্বের সময়কাল)। রাজভবনের বিখ্যাত শ্বেতশুভ্র কালাচাঁদের মন্দিরটি ১২৬৩ বঙ্গাব্দের ২৯শে বৈশাখ তিনিই নির্মাণ করেন। বাহাদুর সিংহ সাহস রায়ের পর রাজা হন বনওয়ারিলাল। পরবর্তী কালে বনওয়ারিলালের পুত্র নগেন্দ্রনাথ সিংহ সাহস রায় রামগড়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজা হয়ে উঠেছিলেন। তিনি নাকি দেখতে যেমন সুপুরুষ ছিলেন, তেমনি বিচক্ষণও ছিলেন। বিশেষ করে শিক্ষায় তার অবদান ছিল অসীম। রামগড়ে শিক্ষা বিস্তারের তিনি অন্যতম রূপকার ছিলেন। বর্তমান উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় "মোক্ষদা সুন্দরী হাই ইস্কুল" নির্মাণে তার জমি দান থেকে শুরু করে একাধিক ভূমিকা ছিল।

নগেন্দ্র সিংহ সাহস রায়ের পর রাজা হন বীরেন্দ্র কিশোর সিংহ সাহস রায়। বীরেন্দ্র কিশোর যখন মারা যান তখন পুত্র রঞ্জিত কিশোর নাবালক। তাই রাজ্যের ভার কোর্ট অফ ওয়ার্ড এর হাতে চলে যায়। রাধারমণ রায় তখন রাজকার্য দেখাশোনা করতেন। তারপর লায়েক হয়ে উঠে রামগড়ের শেষ রাজা হয়ে উঠেছিলেন  রাজা রঞ্জিত কিশোর সিংহ সাহস রায়।  রামগড়ের উন্নতি সাধনে তার প্রভূত অবদান আছে। তাঁর প্রবল সাহিত্য প্রীতির পরিচয় সকলকে মুগ্ধ করেছিল। তিনি "মাধুকরী" নামে একটি সাহিত্য পত্রিকাও প্রকাশ করতেন। এখনও যদি কারও কাছে এই পত্রিকা থেকে থাকে,তাহলে রাজবাড়ির অনেক ইতিহাস তা থেকে জানা যাবে।

রামগড় রাজবাড়িতে দুটো বড় বড় রাজমহল মুখোমুখি আজও দাঁড়িয়ে আছে। একটি পুরনো মহল আরেকটি নতুনমহল। নতুন করে ও পরবর্তীকালে রাজা শ্রী বাহাদুর সিংহ সাহস রায় এই মহলটি নির্মাণ করেছে বলেই এটি নতুন রাজমহল। শেষ রাজা রঞ্জিত কিশোর পরবর্তী কালে এই মহলের সংস্কারও করেন। তখন তার মা কৈবল্যদেবীর নামে ভবনটির নামে 'কৈবল্যভবন' নাম রাখেন। এই দুই রাজ মহলের মাঝখানে অবস্থান করছে একটি শ্বেতশুভ্র উঁচু মন্দির। এটি কালাচাঁদের মন্দির নামে প্রসিদ্ধ। রাজা বাহাদুর সিংহ সাহস রায় এর নির্মাণ করেন। এই মন্দিরের পাশেই আছে শেষ রাজা রঞ্জিত কিশোর সিংহ সাহস রায়ের সমাধি। পরবর্তীকালে এই মন্দিরে একবার বড় ধরনের ডাকাতি হয়েছিল। মন্দিরের রুপার দরজা সহ অনেক কিছুই চুরি হয়ে গেছিল। তাই মন্দিরের আসল বিগ্রহটি(গোপীনাথ জিউ) মেদিনীপুরে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। এখন যে বিগ্রহটি রয়েছে সেটা পরে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। কৃষ্ণের আরেক নাম কালাচাঁদ। তাই মনে করা হয় রাজা বৈষ্ণব ধর্মের প্রবল অনুরাগীও ছিলেন। রাজবাড়ির পাশেই প্রতিবছর চৈত্র মাসে অনুষ্ঠিত হয় "নবকুঞ্জ" মেলা। এলাকার সর্বশ্রেষ্ঠ হরিনাম মেলা হিসাবে প্রসিদ্ধ। নয়টি পৃথক পৃথক হরিমন্দির বা আটচালা আছে। সেখানেই নয়দিন ধরে চলে হরিনাম সংকীর্তন। এই মেলা ও অনুষ্ঠানে রামগড়ের রাজাদের দারুণ অবদান ছিল।

শেষ রাজা রঞ্জিত কিশোর সিংহ সাহস রায় ছিলেন চিত্ত বিনোদন প্রিয় মানুষ। তাই রামগড়ে একটি সিনেমা হল খুলে দিয়েছিলেন। তবে তার সবথেকে বড় অবদান শিক্ষাক্ষেত্রে। মাতা কৈবল্য রাণীর স্মৃতিরক্ষার উদ্দেশ্যে মেদিনীপুরে স্থাপন করেছিলেন "কে.ডি. কলেজ অফ কমার্স"। যেখান থেকে এখন প্রতি বছর সেরা সেরা ছাত্র ছাত্রী ডিগ্রী লাভ করছেন ও নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমান করে চলেছেন। এটাই বা কম কিসের! রামগড়ের রাজ অবদান ছাড়া সেটা কী আর সম্ভব হত?

শেষ রাজা রঞ্জিত কিশোর সিংহ সাহস রায় মাত্র এক বছরের মতো রাজ্য শাসন করেছিলেন। কিন্তু তার আচরণ কখনওই নাকি রাজা সুলভ ছিল না। বরং অনেক বেশি ছিল সন্ন্যাসী সুলভ। সারা দিন রাত্রি গীতা ও ধর্মগ্রন্থ নিয়েই সময় কাটাতেন। তাই তিনি ছিলেন 'রাজর্ষি'। অর্থাৎ রাজা হয়ে তিনি ঋষির মতোই জীবন অতিবাহিত করেছিলেন। রামগড়ে অনেক বার তিনি ধর্মসভারও আয়োজন করেছিলেন। তাঁর একমাত্র কন্যা ছিলেন দুলালী সিংহ সাহস রায়। তার সঙ্গে মেদিনীপুর নিবাসী সনৎ রায়ের সঙ্গে বিয়ে হয়। রাজা রঞ্জিত কিশোর শেষ বয়সে মেদিনীপুর রাজা বাজারে মেয়ের সঙ্গেই থাকতেন। বর্তমানে পিতা কন্যা দুজনের কেউ আর আজ বেঁচে নেই।

রামগড় রাজবংশের ক্রমানুযায়ী রাজারা হলেন----
১) গুণচন্দ্র রাও(পরে সিংহ সাহস রায়)
২) রামচন্দ্র রাও (সিংহ সাহস রায়)
৩) গোরাচাঁদ সিংহ সাহস রায়
৪) দীনবন্ধু সিংহ সাহস রায়
৫) রাজা গোপীনাথ সিংহ সাহস রায়
৬) রাজা দলেল চাঁদ সিংহ সাহস রায়
৭) রাজা নন্দলাল সিংহ সাহস রায়
৮) রাজা বাহাদুর সিংহ সাহস রায়
৯) রাজা চন্দ্রমোহন সিংহ সাহস রায়
১০) রাজা বনওয়ারী সিংহ সাহস রায়
১১) রাজা নগেন্দ্রনাথ সিংহ সাহস রায়
১২) রাজা বীরেন্দ্র কিশোর সিংহ সাহস রায়
১৩) রাজা রঞ্জিত কিশোর সিংহ সাহস রায়

বাবার মতো মেয়ে দুলালী রায়ও শিক্ষানুরাগী ছিলেন। তাই বর্তমানে রামগড়ে যে সরকারি পলিটেকনিক ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজটি স্থাপিত হয়েছে, তার জন্য সমস্ত জমিই কলেজকে দান করেছেন। এমনকী বর্তমানে রাজবাড়িটিও কলেজের সীমানার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত আছে। এখন রাজবাড়ি দর্শন করতে হলে কলেজ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিতে হয়। কলেজের নামটিও রাখা হয়েছে শেষ রাজা রঞ্জিত কিশোরের নামেই "রাজা রঞ্জিত কিশোর গভর্নমেন্ট পলিটেকনিক"(R.R.K.G.P.)। তবে রাজভবনটি এখন ঝাড়গ্রাম পূর্ত দপ্তরের অধীনে আছে।
           
তথ্যসূত্র: ১)পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি ২য় খণ্ড- বিনয় ঘোষ
২) মেদিনীপুরের ইতিহাস- যোগেশচন্দ্র বসু
৩) ঝাড়গ্রাম ইতিহাস ও সংস্কৃতি- মধুপ দে

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments