জ্বলদর্চি

তুর্কী নাচন-৭ /মলয় সরকার

পর্ব-৭  (পূর্ব প্রকাশিতের পর)

তুর্কী নাচন
মলয় সরকার

কুসাদাসি পর্ব

ইজমিরের  আদনান মেন্ডেরেস এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়েই দেখি ড্রাইভার দাঁড়িয়ে আছে আমাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য। গন্তব্য প্রায় ৭০ কিমি দূরে কুসাদাসি। ড্রাইভার ভদ্রলোক বেশ গল্প করেন আর আমুদে, যদিও ওনার ইংরাজী জ্ঞান খুব সামান্য, ফলে কথাবার্তা চালাতে খুব অসুবিধা হচ্ছিল।রাস্তায় আসতে আসতে দেখছিলাম, অসংখ্য জলপাই বা অলিভের ক্ষেত, পাহাড়ের পর পাহাড় জুড়ে শুধু অলিভ। ওখানকার অলিভ বলতে কিন্তু আমরা এখানে যে জলপাই বুঝি সে রকম নয়। ওখানকার অলিভ কিন্তু অনেক বড়, শাঁসালো।গাছ ভর্তি অলিভের ছড়াছড়ি। ওরা সকালে ব্রেকফাস্ট থেকে জলপাই খাওয়া আরম্ভ করে এবং অনেক কিছুতেই এবং অনেক ভাবেই জলপাই খায়। থাকতে থাকতে আমরাও জলপাইএর ভক্ত হয়ে গিয়েছিলাম।এছাড়া প্রচুর পরিমাণে ডুমুর (Fig, এটি শুনতে ডুমুর হলেও, আমাদের দেশের মত ব্রাত্য নয়। বরং এটি বেশ বড় মিষ্টি ফল। এটি দিয়ে জ্যাম- জেলীও হয়),চেরী, নানা ধরণের লেবু, ইত্যাদি নানা ফলের চাষ দেখলাম রাস্তায়। মিলিয়ে নিলাম ছেলেবেলায় পড়া ভূগোল জ্ঞানের সঙ্গে, যে, ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে বিভিন্ন ধরণের ফলের চাষ হয়।এত  ফলের চাষের জমি কোথাও দেখি নি।লেবু, বিশেষ করে ম্যাণ্ডারিন ধরণের, খুব হয়ে আছে।

একটু পরেই রাস্তার পাশে দেখলাম সমুদ্র, চলেছে আমাদের পাশে পাশে। ড্রাইভার সাহেব বলেন, এটি ইজিয়ান সমুদ্র, যা ভূমধ্যসাগরের একটা অংশ।কিছুক্ষণ পরে সমুদ্রের মাঝে দেখি অনেক ছোট বড় দ্বীপ দেখা যাচ্ছে। জানলাম ওটাই গ্রীস দেশ এবং তার অন্তর্গত ছোট ছোট দ্বীপ। মনে পড়ল গ্রীসের সাথে আমাদের ভারতবর্ষের সম্পর্কের কথা। মহাবীর আলেক্সান্ডার, মেগাস্থিনিসের কথা। এই এত দূর থেকে অত অল্প বয়সে, কেবল মাত্র ঘোড়ায় চড়ে কত দূর ভারতবর্ষে এসে পৌঁছেছিলেন, ভাবতেই অবাক লাগে।শুধু তাই নয় ভারতের সংস্কৃতিকেই অনেক বদলে দিয়েছিলেন তাঁর ঐ স্বল্প দিনের ভারত বাসের কারণে।


 যাই হোক আমরা প্রায় দেড় ঘণ্টা পরে এসে পৌঁছালাম এক অদ্ভূত সুন্দর হোটেলে, যার অর্ধেকটা ঝুলে রয়েছে পিছন দিকের সমুদ্রের উপর।পাঁচতারা হোটেল। ঘরে ঢুকে দেখি, পিছন দিকের দেওয়ালটা পুরো কাঁচের। সেখানে একটা ব্যালকনিও আছে। আর ঘরের ভিতর থেকেই পর্দা সরিয়ে দেখা যায় আমরা সমুদ্রের নীল জলের উপরেই রয়েছি আর সামনে বিস্তৃত নীল সমুদ্র। ইজিয়ান সাগর, এটি ভূমধ্যসাগরেরই একটা অংশ।কোন স্রোত বা বিশাল ঢেউ নেই, বরং অনেক স্থির, বেশ মনভোলানো ফিরোজা নীলের মত।
                                      

ঘরে ঢুকে বুলু বলল, চল বাইরে ঘুরে আসি।এখানে কি ঘরে বসার জন্য এসেছি না কি? ভাল কথা। লাঞ্চ সেরে আমরা বেরোলাম সামনের ফুটপাথে হাঁটতে।দেখি পরিচ্ছন্ন রাস্তা ঘাট। রাস্তার পাশে কোথাও সর্বসাধারণের জন্য খোলা জিম রয়েছে পার্কের মধ্যে। অনেকে জিম করছে।বিশাল বিশাল বাড়ী ও হোটেল রয়েছে। আর পাশে রয়েছে সমুদ্র। তবে এখানে বালিয়ারী বা বেলাভূমি নেই।একটু পাথুরে জায়গা।সারা দুপুর রাস্তায় ঘুরে কাটিয়ে বেলা পড়তে একটা চা-কফির দোকানে ঢুকলাম, খেতে, তার চারদিকটা খোলা। দু’ গ্লাশ এপল টি র অর্ডার দিয়ে সঙ্গে একটু স্ন্যাক্স নিয়ে বসলাম। ঠিক তখনই চোখ গেল পশ্চিম আকাশের দিকে। ঘন কালো মেঘের সঙ্গে টকটকে লাল পড়ন্ত সূর্যের যে কি শোভা সমুদ্রের উপরে, মনে হল, এমন সূর্যাস্ত বোধ হয় কোন দিনও দেখিনি। আর সমুদ্রও এখানে যেন অদ্ভূত ধরণের নীল বা ফিরোজা রঙের।


হোটেলে ফিরতেই রিসেপশন থেকে আমাদের একটি চিরকুট দিয়ে গেল, তাতে লেখা,কাল সকাল সাতটায় তৈরী থাকতে হবে, আমাদের যাত্রা হবে শুরু।


পরদিন ভোরে তৈরী হয়ে আমরা হোটেলের গেটে অপেক্ষা করছি, এল সেই আগের মতই একটি ছোট বাস। রাস্তায় দৃশ্যাবলি যেন গিলে খাচ্ছি।


অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা গিয়ে হাজির হলাম শহরের মধ্যেই একটি বহু প্রাচীন মসজিদে, যার বেশ কিছুটা অংশ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। এটির নাম ইসা বে মসজিদ (Isa bey Mosque)। এর ভিতরে ভগ্নাবশেষগুলো অনেকই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।এটি যেন অন্য যে সমস্ত মসজিদ দেখেছি তার থেকে ঢং, স্থাপত্য বেশ কিছুটা আলাদা। কতকটা অটোমান বাইজান্টাইন স্থাপত্যের মত। ঢোকার মুখেই একটি মূর্তি তৈরী করা রয়েছে।কার বুঝলাম না।ভিতরে চত্বরে বেশ কয়েকটি পুরানো দিনের বেশ উঁচু উঁচু থাম দায়িত্বহীন ভাবেই দাঁড়িয়ে রয়েছে।বোধ হয় দুটো তিনটে হাত পড়েছে এর গঠনে। এটি সম্ভবতঃ ১৩৭৪-৭৫ সালে তৈরী হয়েছিল। 
                                                    

ভিতরের উচ্চতা অনেক।একধারে রয়েছে মৌলবীর বসার জায়গা সিঁড়ি দিয়ে উঠে বসার মত একটা বেশ উঁচু জায়গা।এ ছাড়া মসজিদের ভিতর প্রায় ফাঁকা, অনেক প্রশস্ত।
এখান থেকে বেরিয়ে শহরের মাঝখান দিয়ে চললাম।রাস্তায় প্রায় প্রত্যেক বাড়ির মাথাতেই দেখলাম সোলার প্যানেল ও জলের ট্যাঙ্ক। অর্থাৎ, এখানে সূর্যের আলোকে যে বেশ কাজে লাগানো হয় বুঝলাম।


 ক্রমশঃ শহর ছাড়িয়ে এসে পড়লাম একটু গ্রামীন এলাকায়। এখানে আমাদের গাইড মেয়েটি আমাদের বলল, নামুন, আমার পিছনে পিছনে আসুন।সামনেই দেখতে পাচ্ছি ছড়িয়ে থাকা ধ্বংসাবশেষের টুকরো ।
আমরা এসে পড়েছি প্রাচীন এশিয়া মাইনরের গ্রীক ধ্বংসপ্রাপ্ত শহর এফেসাস ( Ephesus)এ।বর্তমান তুরস্কের এই সমস্ত অঞ্চল সেই সময় গ্রীসের অধীনেই ছিল। এখানে যা কিছু দেখা যাচ্ছে, সেগুলি সেই প্রাচীন বর্ধিষ্ণু শহরেরই ধ্বংসাবশেষ। এটি সম্ভবতঃ খ্রীঃ পূঃ দশম শতাব্দীতে তৈরী হয়েছিল। শেষে.১২৯ খ্রীঃ পূঃতে এটি রোমানদের অধিকারে আসে।আশেপাশে এক জনহীন পাহাড়ি এলাকায় মাটি খুঁড়ে বেশ কিছুটা নীচে পাওয়া এই শহরের ব্যাপ্তি তো কম লাগছে না।আস্ত একটা বিশাল শহর তার সমস্ত কিছু নিয়ে ঘুমিয়ে রয়েছে।এই জায়গাটি প্রাচীন এশিয়া মাইনর বা বর্তমান পশ্চিম তুরস্কের সেলচুক গ্রামের কাছে। মাটির বেশ কিছুটা নীচেই চাপা পড়ে ছিল এই সভ্যতা। আজ থেকে দু আড়াই হাজার বছর আগেও যে মানুষ অনেক উন্নত ছিল এগুলিই তার প্রমাণ।সমুদ্র বন্দরের কাছে এই জায়গা যে সেই সময় ব্যবসা বাণিজ্যের দিক থেকে যথেষ্ট এগিয়ে ছিল এবং এক বিশাল  অঞ্চলে এদের প্রভুত্ব ছিল  ইতিহাস তার সাক্ষী। যেখান দিয়ে এই অভিশপ্ত শহরে ঢুকলাম , একটু এগিয়েই দেখি একপাশে জমা করা রয়েছে প্রচুর পোড়া মাটির জলের পাইপের স্তুপ। খুঁড়ে যেমন যেমন পাওয়া গেছে রাখা আছে। তবে এই খনন কার্য যারা করেছিল, কত দক্ষতায় তারা করেছিল, দেখলে আশ্চর্য হতে হয়, যে কত জিনিষকে নিটোল বাঁচিয়ে  রাখা হয়েছে। বেশির ভাগটাই পাথরের তৈরী। বড়, ছোট সমান , অসমান নানা মাপের পাথর দিয়ে তৈরী। কি করে যে অত ভারী ভারী পাথর এরা এনে কারুকার্য করে গেঁথে ছিল,ভাবলে আশ্চর্য লাগে। সারা এলাকা জুড়ে এরকম ভারী পাথরের স্থাপত্য দেখে মাথা ঘুরে যায়। সমস্ত পাথরই শ্বেত পাথরের মত, তবে তাতে একটু হাল্কা লালচে ভাব আছে। এর সঙ্গে অবশ্য প্রয়োজন অনুসারে পাতলা টেরাকোটাতে ব্যবহৃত ধরণের বিভিন্ন আকৃতির ইঁট ও ব্যবহার হয়েছে। তবে শহরটা বেশির ভাগই আমাদের কোলকাতার মতন, কোথাও মাটি বেশি নেই, সবটাই ইঁট বা পাথর দিয়ে বাঁধানো। একমাত্র বাজার বা বিশেষ কারণে যেখানে মাটির জমি প্রয়োজন সেখান বাদ দিয়ে। আর একটা কথা, এখানে সমস্ত ঘর বাড়ী , দোকান পাট, মন্দির সব কিন্তু একেবারে গায়ে লাগালাগি করে আছে। কোন সৌধের সাথে কিছুই কিন্তু ফাঁক ছাড়ের কোন ব্যাপার নেই। 
                                     

প্রথমে দেখলাম একটা মুক্ত মঞ্চ।সেটি আজও প্রায় সম্পূর্ণই অবিকৃত । দর্শকগ্যালারী, নাটকের কুশীলবদের ঢোকা বেরোনোর জায়গা, মঞ্চ, ইত্যাদি সমস্তই নিটোল আছে। এটি বর্তমানের ইন্ডোর স্টেডিয়ামের মত মুক্ত মঞ্চ। একদিক বাদ দিয়ে বাকী তিনদিকে দর্শকদের বসার জায়গা। এরকম মঞ্চ আমি অন্য অনেক জায়গায় আগে ও পরে দেখেছি।


ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছি। রাস্তা একটু ঢালু। এই রাস্তা কিন্তু সেই সময়েরই। বেশ চওড়া , বাঁধানো। রাস্তার দুপাশে দোকান বা ঘরের সারি , কোথাও সিঁড়ি উঠে গেছে।সারি সারি গোল গোল পাথরের থাম, কেউ আজও গোটা আছে, কেউ ভগ্ন দশায়।কিছু ঘরের ঢোকার দরজার বা জানালার ধনুকাকৃতি পাথরের খিলান, দাঁড়িয়ে আছে।থামগুলোর গায়ে অনেক গুলোতেই কারুকাজ করা আছে।আর গোল পাথরের ভারী ভারী বড় টুকরো গুলো নিটোল জোড় দেওয়া আছে, সম্ভতঃ চুণ জাতীয় কিছু দিয়ে। এটাও আমি বহু ঐতিহাসিক স্থানে দেখেছি।অসমান পাথর গেঁথে কি সুন্দর সমান নিটোল কারুকাজ করেছে, দেখলে আশ্চর্য লাগে।পাথরের দরজা কোথাও দাঁড়িয়ে আছে অর্ধ বৃত্তাকার খিলান নিয়ে , যার নীচে কোন কিছুই নেই। কেবল তৈরীর কায়দার উপর তা হাজার হাজার বছর দাঁড়িয়ে আছে, ভেঙ্গে পড়ে নি।


এখানে চলতে চলতে দাঁড়িয়ে পড়ে হঠাৎ মনে হল চলে গেছি সেই প্রাচীন গ্রীকদের যুগে , যখন গমগম করত এই শহর, নানা রকম মানুষের ভীড়ে কর্মব্যস্ত শহর, কত কান্না, হাসি আনন্দের হুল্লোড় । ক্রুরতা, শঠতা , হিংসার জীবনযাত্রা।শিশুদের কলকাকলী, গৃহিণীদের গৃহকর্মে জমজমাট ছিল , আজ সব স্তব্ধ। কোথায় চলে গেছে সেই সব পাত্রপাত্রী, আজ শুধু স্মৃতি আগলে পড়ে আছে এই পাষাণ হর্ম্য।

রাস্তা ,বাজার , খেলার মাঠ সমস্তটাই ছিল জ্যামিতিক আকারে চতুষ্কোণ এবং কোন  বাঁকাচোরা গলি ঘুঁজি রাস্তা ছিল না।রাস্তা বরাবর নির্দিষ্ট দূরত্ব অন্তর একই রকমের থাম ; হয়ত দোকান পাট ছিল । তার পাশে চওড়া ফুটপাথ।তবে , দ্বিতল ছিল হয়ত কিছু, থাম গুলো কিন্তু যথেষ্ট উঁচু ছিল।অনেক জায়গায় পাশাপাশি দুটি থামের মাথায় জোড়া দেওয়া লম্বা  পাথরের টুকরো আজও আছে।অনেক পাথরের গায়েই কারুকার্য করা আছে। গাইড ভদ্রমহিলা দেখালেন এক জায়গায় পাথরের গায়ে , আজ সারা পৃথিবীর ডাক্তাররা চিকিৎসা সংক্রান্ত কিছু বোঝানোর জন্য যে, দুটি প্যাঁচানো সাপের ছবি ব্যবহার করেন, তা খোদিত রয়েছে। উনি বললেন, এটা থেকেই আজকের চিকিৎসা শাস্ত্র এটি গ্রহণ করেছে।এই জায়গাটি ছিল এখানকার হাসপাতাল। দেওয়ালে আরও কিছু চিকিৎসা সম্বন্ধীয় খোদাইএর ছবি দেখছিলাম।সে যুগেও চিকিৎসা যে উন্নত ছিল তার প্রমাণ তো পেয়েইছি অনেক জায়গায়।


এরপর এক আশ্চর্য জিনিস দেখলাম, সেটা জানতে গেলে দেখতে হবে পরের পর্ব—-

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments