জ্বলদর্চি

একটি কসমিক লাভ-স্টোরি : 'নমস্কার, বিশ্বে শান্তি হোক'/পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞানী ।। পর্ব ― ৫৩


একটি কসমিক লাভ-স্টোরি : 'নমস্কার, বিশ্বে শান্তি হোক'

পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

(১)
ক্লাইম্যাক্স-এক্স

বেহায়া! হতচ্ছাড়ি! পোড়ার মুখী! চরিত্রহীনা! কুলটা! কী নামে ডাকব তোকে? লাজ-লজ্জার মাথা খেয়ে কেন গেলি রেকর্ড রুমে? এতটুকু লজ্জা-শরমের বালাই থাকতে নেই! পুরো বিশ্বের কাছে নিজের সতীত্ব বিকিয়ে এলি? কী আস্পর্ধা!

চুম্বন করলি গোপনে, ঠিক আছে। তা বলে, সে-চুম্বনের রেকর্ড তৈরি করে গোটা পাড়া (পড়ুন, মহাবিশ্ব) বিলিয়ে আসা! এ কেমন বেহায়াপনা; শুনি! এতে কার না মাথা গরম হবে, বল দেখি! এত বড় ধাংড়ি মেয়ে হয়েছিস। এতকাল তোকে লোকচক্ষুর আড়ালে সযত্নে লালনপালন করে বড় করেছি। এখন সোমত্থ হয়েছিস। ভালো সম্বন্ধ দেখে দু'দিন পরে বে-থা'র কথাবার্তা পাড়া হবে। তার আগেই একটা উটকো ঝামেলা পাকিয়ে ফেল্লি! ভালো করেই জানিস― পাড়ায় (পড়ুন, পৃথিবীতে) একটা সম্মান আছে আমাদের। সকলে খুব সম্ভ্রম করে চলে তোর বাবাকে, আমাকে। কই, কেউ একটা কটু কথা বলবার সাহস পেয়েছে এতকাল? অথচ আজ যা করলি, সমাজে লোকের কাছে মুখ দেখাব কী করে! ঘটে কি তোর গোবর ভরা আছে? জ্ঞান গম্যি কবে হবে কে জানে!

হা ভগবান! কী সব্বনাস হলো গো আমার। তুমি সব জান্তা, করুণাময়ী। অন্তরভেদী। দীনের উদ্ধার কর্তা। রক্ষা কর, হে প্রভু। রক্ষা কর। এ যাত্রায় বিপদ থেকে উদ্ধার করো। সকল শঙ্কা বিনাস করো।

(২)
সাউন্ড অব আর্থ

ভালোবাসার চুম্বনের আওয়াজ কেমন হবে? খাঁটি প্রেমের চুম্বনের শব্দ কি আলাদা? চুম্বন কি শুধু যৌন চাহিদা আংশিক পূরণের একটা অবস্থা মাত্র? না-কি, চুম্বনেরও রকম ভেদ আছে? কালচার ও প্রতিযোগিতা-তর্কবিতর্কের উপর যার যাবতীয় সত্তা লুকিয়ে থাকে! পৃথিবী জুড়ে যত রকমের ভালোবাসা আছে; তাদের সবার আওয়াজ কি অভিন্ন?

সদ্যোজাত শিশুসন্তানের প্রতি একজন মায়ের প্রথম বাক্য কিংবা প্রথম অভিব্যক্তি কেমন হয়? প্রসব যন্ত্রণার সীমাহীন কষ্টের পরেও নবজাতকের প্রতি সেই মায়ের স্নেহভরা চাহুনির আড়ালে কী প্রতিক্রিয়া কাজ করে? নবজাতকের প্রথম কান্নার সুরে কতটা ভিজে যায় মায়ের নরম মন, কষ্ট?
      
পৃথিবী কাঁপানোর শব্দ আর বাড়ি-ঘর-গাছপালা ঝন ঝন করে কেঁপে ওঠার শব্দ কি একই? পৃথিবীতে মেঘ গুড়গুড় বজ্রপাতের শব্দে চমকে উঠবে কি ওরা? বৃষ্টির রিমঝিম, বাতাসের সোঁ সোঁ, বন্য কুকুরের গরগর বা ঘেউ ঘেউ, নিস্তব্ধ হাঁটার শব্দ, পাতা ঝরার টুপটাপ, ঘোড়া ও ঘোড়ার গাড়ির টগবগের জোর কতটুকু? জাহাজ, বাস, অটো কিংবা ট্র্যাক্টরের বিকট আওয়াজে সে হয়ত বিরক্ত হবে। অথবা, শিম্পাঞ্জির গানে সে মুগ্ধ হবে কি? ক্রিকেট মাঠের মেক্সিকান তরঙ্গ কি পারবে ওদের শতাব্দী প্রাচীন ঘুম ভাঙাতে? সোনা ব্যাঙ কি ঝাঁপিয়ে পড়বে শান্ত পুকুর (পড়ুন, পৃথিবী)-এর পাড় থেকে অনিশ্চিত অন্ধকারের (পড়ুন, মহাশূন্যে) অতল গভীরে? তখন বুঝি সে 'ক্যাঁকর ক্যাঁ' 'ক্যাঁকর ক্যাঁ' রবে কান ঝালাপালা করবে?

আচ্ছা, জীবনের চিহ্ন আর পালসার-এর কী কোন শব্দ আছে? কেমন করে পাখিরা প্রেম নিবেদন করে? দলছুট হাতি কী ইশারা দেয় তার সঙ্গিনীকে? কেমন করে গভীর সমুদ্রে শিকার ধরে নীল তিমি? কেমন করে হেসে ওঠে মানুষ? সবকিছু হিসেবে থাকা চাই। অন্তত কোনও কিছু যেন বাদ না পড়ে।

(৩)
ইউনিভার্সাল লাভ (Universal Love)

'নমস্কার, বিশ্বে শান্তি হোক' ― স্পষ্ট বাংলা উচ্চারণ। জনৈক সুব্রত মুখার্জির কণ্ঠ। সুন্দর বাচনভঙ্গি। বিশুদ্ধ বাংলায় বলা এ হেন শুভেচ্ছা বার্তার ব্যাপ্তি কাল যৎসামান্য, মাত্র ১.০৮ সেকেন্ড। 

হিন্দিতে জনৈক অজ্ঞাত ব্যক্তি ওমর আলজল বলছেন― 'পৃথ্বীবাসীদের তরফ থেকে নমস্কার।' বার্তার সময় ১.৪৮ সেকেন্ড। আরও আছে।

এ রকম চারটি চাইনিজ, বাংলা-উড়িয়া-পাঞ্জাবি-গুজরাটি-হিন্দিসহ বারোটা দক্ষিণ এশিয় ভাষা এবং পাঁচটা প্রাচীন ভাষাসহ মোট ৫৫ টি ভাষার শুভেচ্ছা বার্তায় গমগম করছে যন্ত্র। 

সব ক'টি বার্তার উৎস দ্বিতীয় ট্র্যাক। সে-ট্র্যাকের সর্বশেষ বার্তাটি ইংরেজিতে বলা। ৪.১৮ সেকেন্ডের বার্তায় বছর সাতেকের নিক সাগন বলে উঠল― 'Hello from the children of planet Earth'। অর্থাৎ, মেদিনী গ্রহের সকল শিশুর পক্ষ থেকে নমস্কার। ছোট্ট নিক বৈজ্ঞানিক কার্ল সাগন-এর পুত্র। 

(৪)
প্রেমের আমি, প্রেমের তুমি

আড়াই হাজার বছরের পুরনো মিউজিকের একটি কলি 'ফ্লোয়িং স্ট্রিম' (Flowing Stream)। চাইনিজ ভাষায় বাজানো। তিল তিল করে খুঁজে মিলেছে এ ধরনের এক ইউনিক পিস আইটেম। খুঁজে পেতে কালঘাম ছুটে গেছে মিস অ্যান ড্রুয়ান-এর। ওফ! বহু কষ্টে পাওয়া গেছে সেটি। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন তিনি। সত্যিই এক রেয়ার কালেকশন! এ হেন দুর্লভ মিউজিক উদ্ধার করে রীতিমত উত্তেজিত মিস ড্রুয়ান। নিজের উত্তেজনা গোপন রাখা মুশকিল হচ্ছে তাঁর। সেটা ১৯৭৭ সালের গ্রীষ্মের ঘটনা। খুশির খবরটা শুনলে আনন্দে নির্ঘাৎ বাকরুদ্ধ হবেন প্রোজেক্ট হেড ড. কার্ল সাগান। ড. সাগন'কে তথ্যটি শেয়ার করতে ল্যান্ডফোনে ডায়াল করলেন মিস ড্রুয়ান। অন্যথায় তাঁর এ উত্তেজনা প্রশমিত হবার নয়। গুরুত্বের দিক থেকে অজ্ঞাত বৈজ্ঞানিক ঘটনা আবিষ্কারের তুলনায় কোনও অংশে কম নয় তাঁর এ অনুসন্ধান। ওদিকে, হোটেলের রুমে টেলিফোন বেজে বেজে কখন যে বন্ধ হয়ে গেল! ফোনকল কেউ রিসিভ করল না। অগত্যা হোটেলের রিসেপশনে টেলিফোন মারফত একটি সংলাপ-মেসেজ রেখে নিজের কাজে মন দিলেন ড্রুয়ান। যদিও অস্থিরতা তাঁর মনে, হৃদয়ে।
     

ঘণ্টা খানেক বাদের ঘটনা। হোটেলে ফিরে এসেছেন ড. সাগন। রিসেপশনে মেসেজ দেখে তক্ষুনি ফোন ডায়াল করলেন তিনি:
― 'হ্যালো! মিস ড্রুয়ান, বলুন?'
―'মি. সাগন, সত্যি বলছি একটি গ্রেট ইউরেকা মোমেন্ট! একটি বড় সায়েন্টিফিক আবিষ্কারের মতো ঘটনা ঘটেছে আজ'― চিৎকার করে গড় গড়িয়ে সব কথা বলে গেলেন মিস ড্রুয়ান; ফোনের ও প্রান্ত থেকে। কারণ তখনও তাঁর উত্তেজনা স্তিমিত হওয়ার লক্ষণ নেই। এ হেন ফোনকলের একটি ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে বৈকি! ওই ফোনকলের সূত্র ধরেই মিস অ্যান ড্রুয়ান আর ড. কার্ল সাগন প্রেমে পড়লেন। একঘণ্টা আগেও দুজনে সম্পূর্ণ প্রফেশনাল এবং ভালো বন্ধু ছিলেন। ড. সাগন ভয়েজার গোল্ডেন রেকর্ড প্রোজেক্টের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর আর মিস ড্রুয়ান তার ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর। অথচ, ফোনকলের অব্যাহতি পরে দুজন দুজনের অন্তরঙ্গ হলেন। কোয়ালিটি সময় ব্যয় করতে শুরু করলেন তার পর। চার বছরের প্রেম পর্ব শেষে চার হাত এক হল ছাতনা তলায়। সেটা ১৯৮১ সালের ঘটনা। চার্চে বিয়ে সারলেন তাঁরা। বহুচর্চিত তাঁদের শাশ্বত প্রেমের গোল্ডেন সময়ের বাতি নেভে ১৯৯৬ সালে, ড. সাগন-এর মৃত্যুতে। তবে তাঁদের বিখ্যাত প্রেমের কাহিনী শেষ হয়েও শেষ হল না। কারণ প্রথম প্রেমে পড়ার মিস অ্যান ড্রুয়ান-এর সেই দুর্দান্ত অনুভূতিকে অমরত্বের শিরোপা দিয়েছে মহাকাশ যান ভয়েজার। গভীর প্রেমের সুক্ষ্ম অনুভূতি ধরা রয়েছে ভয়েজারের গোল্ডেন প্লেট রেকর্ডে। যদিও আইডিয়াটা সম্পূর্ণ মিস ড্রুয়ান-এর। নারী কিংবা পুরুষ― যে কেউ প্রথম প্রেমে পড়লে তার সুক্ষ্ম আবেশ কেমন হয়, হৃদয়-মন কতটা উৎফুল্ল থাকে, মস্তিষ্কের কোষ কেমন আচরণ করে, প্রেমের টিউনে কতটুকু উত্তেজিত থাকে ব্রেনের নিউরনগুলি ― এমন সব উদ্ভট আজগুবি অথচ সত্যিকারের প্রতিচ্ছবি ধরে রেখেছে ভয়েজার।

আড়াই বছরের পুরাতন ওই চাইনিজ সংগীতটি একজন বৈজ্ঞানিকের জীবনে গ্রেট সায়েন্টিফিক আবিষ্কারের চাইতে তাই কোনও অংশে কম নয়! এমনই এর ক্রেজ! মাহাত্ম্য! কারণ এর হাত ধরে নতুন করে তাঁর প্রেমে পড়া। মিষ্টি প্রেমের সদর্ভ ঘোষণা দুজনের। সেই বিখ্যাত প্রেমালাপের কয়েক দিন পরের ঘটনা। ৩-রা জুন ১৯৭৭ সাল। নিউইয়র্ক সিটির বেলভিউ হসপিটালের উদ্দেশ্যে ছুটলেন ড্রুয়ান। উদ্দেশ্য খুব সিম্পল ― মানুষের ব্রেন ও নার্ভ সিস্টেমের ইলেকট্রিক্যাল পালস্ গণনা। সেই পালস'কে প্রথমে শব্দ তরঙ্গে রূপান্তরিত করা। তারপর উৎপন্ন তরঙ্গকে ভয়েজার-এর গোল্ডেন রেকর্ডে ধরে রাখা। হাজার মিলিয়ন বছর পরে রেকর্ডটি যখন দূর গ্রহস্থিত কোনও এলিয়েন-এর হাতে পড়বে, তখন তার মধ্যে সদ্য প্রেমে পড়া মিস ড্রুয়ান-এর অনুভূতির টাটকা তথ্যখানি সহজে যেন চিন্তায় বদলে ফেলতে পারে অজানা প্রাণীটি― হাসপাতালের বেডে শুয়ে এ কথা ভাবছিল সে। একটু বাদে তাঁর মেডিটেশন শুরু হল। মেডিটেশন চলাকালে সারাক্ষণ 'The wonder of love, of being in love' ভাবছিল সে। অর্থাৎ, প্রেমে পড়া সে তখন প্রেমের বিস্ময়ের কথা ভাবছে। একটু পরেই তাঁর শরীর, মন ও ব্রেনের সাউন্ড রেকর্ড করা হবে কিনা!
         

মিস অ্যান ড্রুয়ান আর ড. কার্ল সাগন এক ঢিলে দুই পাখি বধ করলেন অনায়াসে। একদিকে যেমন নিজেদের নিঃসঙ্গ জীবনে ভালোবাসার জোয়ার আনলেন, হৃদয়ের অপূর্ণ পাত্র প্রেম রসে কাণায় কাণায় পূর্ণ করেছেন; অন্যদিকে তেমনি তাঁদের প্রেমময় ভালোবাসার গাঢ় বন্ধনের সিগন্যাল মহাবিশ্বে ভাসিয়ে দিয়ে এক পার্থিব প্রেমকে বিশ্বজনীন প্রেমের আখ্যা দিয়ে গেল। মহাশূন্যের হৃদয় ভেদ করে কুমারী অ্যান ড্রুয়ান-এর প্রেমের সেনসেশন আজও এগিয়ে চলেছে মহাবিশ্বের এক কোণ থেকে আরেক কোণে। লক্ষ নিযুত কোটি বছর পরে হয়তো বা রেড এলিয়েন যুগে কেউ খুঁজে পাবে শাশ্বত প্রেমের সে-ভাষা; রিটার্ন প্রেমপত্র লিখে পাঠাবে পৃথিবী অথবা অন্য কোনও গ্রহের মানুষ কিংবা জীবকে। সার্থক হবে তাঁদের ভালোবাসা। ধন্য হবে বিচিত্র এ প্রয়াস।

ভালো কথা বলেছেন ড্রুয়ান―'Whenever I'm down, I'm thinking: And still they move, 35,000 miles an hour, leaving our solar system for the great open sea of interstellar space.'

(৫)
প্রথম দেখা

সালটা ১৯৭৪। নিউইয়র্ক শহরে স্ক্রিন-রাইটার নোরা এফ্রন-এর সুসজ্জিত বাড়ির অন্দরমহল। সন্ধ্যায় জমে উঠেছে ডিনার পার্টি। অভিজাত সে-পার্টিতে গেষ্টরা একে একে আসতে শুরু করেছে। আমন্ত্রিত বিখ্যাত সব মানুষজন। জমকালো পার্টিতে এসে পৌঁছলেন সদ্য চল্লিশ পেরোনো এক বৈজ্ঞানিক। ড. কার্ল সাগন। আমেরিকার নামকরা অ্যাস্ট্রো-ফিজিসিস্ট। কসমোলজিস্ট। অ্যাস্ট্রো-বায়োলজিস্ট। সবচেয়ে বড় কথা― বছর খানেক পূর্বে 'দি কসমস কানেকশন' বইখানির অভূতপূর্ব সাফল্যের সৌজন্যে একজন সত্যিকারের পাবলিক ফিগার। বিভিন্ন পার্টিতে বেশ পরিচিত নিয়মিত মুখ তিনি।

পার্টির আর একজন আমন্ত্রিত মিস অ্যান ড্রুয়ান। আমেরিকান ডকুমেন্টারি ফিল্ম প্রডিউসার। বিজ্ঞান বিষয়ক চিত্রপরিচালক। সায়েন্স কম্যুনিকেশনে বিশেষ পারদর্শী। তা, পার্টিতে মিস ড্রুয়ান-এর সঙ্গে প্রথম আলাপ হয় বৈজ্ঞানিকের। সেই প্রথম বার। তারপর যোগাযোগ বাড়ে। ঘটনাচক্রে তাঁদের আবারও সাক্ষাৎ ঘটে যায় কাকতলীয়ভাবে। বাচ্চাদের একটি জনপ্রিয় বিজ্ঞান বিষয়ক টেলিভিশন শো-এর সৌজন্যে। যদিও ওই প্রোগ্রাম কখনও টেলিভিশনের মুখ দেখেনি, টিভি পর্দায় বাস্তবায়িত হয়নি; খাতায় কলমের চৌহদ্দির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। একটা কাজ সফল হল। মিস ড্রুয়ান আর ড. সাগন-এর প্রেম পর্ব পূর্বের প্রাথমিক আলাপচারিতা হয়ে রইল। একান্তে গোপন প্রেম কখন কোথায় ওৎ পেতে রয়, জানে সে কোন জনা! 

(৬)
টুইন ভয়েজার ও গোল্ডেন রেকর্ড

১৯৭৭ সালের গ্রীষ্ম। ততদিনে টুইন স্পেসশিপ 'ভয়েজার' প্রোগ্রাম শেষের পথে। সব জল্পনার অবসান ঘটিয়ে নাসা'র জেট প্রপালশন ল্যাবরেটরি থেকে মহাকাশে প্রথমে পাড়ি জমাল 'ভয়েজার-২'; ১৯৭৭ সালের ২০শে আগস্ট। চব্বিশ দিন পর, ৫ই সেপ্টেম্বর ১৯৭৭ 'ভয়েজার-১' মহাশূন্যে রওনা দেয়। ভয়েজার-১ মিশনের আপাত লক্ষ্য ছিল সৌর পরিবারের বড় দুই গ্রহ বৃহস্পতি আর শনি সম্পর্কিত তথ্য আহরণ ও পৃথিবীতে প্রেরণ। অপরপক্ষে, ভয়েজার-২ মিশনের প্রাথমিক লক্ষ্য ইউরেনাস ও নেপচুন গ্রহের তথ্য সংগ্রহ। ভয়েজার মিশনে পরে যোগ হয় গোল্ডেন পাত রেকর্ডের আইডিয়া। এ হেন রেকর্ডের সূত্রে মিস অ্যান ড্রুয়ান-এর ভয়েজার পরিবারে আসা।
       

ভয়েজার গোল্ডেন রেকর্ডের বিষয়বস্তু কী হবে তা ঠিক করে একটি কমিটি। ওই কমিটির চেয়ারপারসন বৈজ্ঞানিক ড. কার্ল সাগান, করনেল ইউনিভার্সিটির খ্যাতনামা একজন অধ্যাপক। তিনি ও তাঁর সাগরেদরা মিলে একজন ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর নিয়োগ করেন। ভয়েজার মিশনের ওই পোস্ট অলংকৃত করেন মিস অ্যান ড্রুয়ান। ভয়েজার গোল্ডেন রেকর্ডের পুরো টিম ১১৬ টি ছবি এবং বাতাস, বজ্রপাত, নানান রকমের পাখি, সামুদ্রিক তিমি-সহ আরও অনেক প্রাণীর ন্যাচারাল আওয়াজ সংযুক্ত করে গোল্ডেন পাতে। রেকর্ডে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নানা রঙের ও বর্ণের সংগীত। গানগুলি মূলত ভিন্ন ভিন্ন সংষ্কৃতি ও যুগ থেকে নেওয়া। এছাড়া ৫৫টি পার্থিব ভাষায় শুভেচ্ছা বাণী জ্ঞাপন করা হয়েছে পৃথ্বীবাসী মানুষ ও প্রকৃতির পক্ষ থেকে। আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মি. কার্টার আর ইউনাইটেড নেশনস-এর সেক্রেটারি জেনারেল মি. ওয়ালধেইম-এর প্রিন্টেড মেসেজ খোদাই করা আছে সে-প্লেটে। 

গোল্ডেন প্লেট রেকর্ডে চার রকমের জিনিস প্রাধান্য পেয়েছে― বহু ভাষাভাষী পার্থিব শুভেচ্ছা বার্তা, সাউন্ড অব আর্থ, বিটলস বেঠোভেন-সহ আরও অনেক কিংবদন্তী মিউজিক এবং একগুচ্ছ ছবি। ভারতের ট্র্যাডিশনাল ভৈরবী সংগীত স্থান পেয়েছে রেকর্ডে। হারমোনিয়াম, তবলা আর তানপুরা যন্ত্র সহযোগে তিন মিনিট তিরিশ সেকেন্ডের একটি ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত গাইছেন শ্রীমতী কেশরবাই কারকার। ১৯৫৩ সালের এপ্রিল মাসে অধুনা মুম্বাইয়ে রেকর্ড করা হয়েছিল গানটি। 

রেকর্ডটি একটি শক্ত পোক্ত অ্যালুমিনিয়াম জ্যাকেটে মোড়া। জ্যাকেটের বাইরে একটি কারট্রিজ আর একটি সুঁচ যুক্ত আছে। সাংকেতিক ভাষায় কিছু নির্দেশ লিপিবদ্ধ আছে জ্যাকেটের গায়ে। সে নির্দেশে বলা রয়েছে কোত্থেকে স্পেস-প্রোবটির আগমন আর কীভাবে রেকর্ডটি বাজবে। ১১৬ টি ইমেজকে অ্যানালগ মোডে এনকোড করা হয়েছে। রেকর্ডের বাকি অংশগুলি অডিও টেপ-এ রেকর্ড করা। গ্রামোফোন রেকর্ড যেভাবে চলে; ভয়েজারের গোল্ডেন রেকর্ডটিও ঠিক সেভাবে বাজবে, চলবে। প্রতি মিনিটে গোল্ডেন রেকর্ডের টেপ ১৬.৬৭ বার পূর্ণ আবর্তন সম্পূর্ণ করবে। রেকর্ড একবার বাজা শুরু হলে প্রথমেই লুপ্ত আক্কাডিয়ান ভাষার শুভেচ্ছা কণ্ঠ ভেসে উঠবে। বিভিন্ন ভাষায় সৌহার্দ্য বিনিময়ের অন্তিমে রয়েছে 'উ' (Wu); একটি আধুনিক চাইনিজ আঞ্চলিক ভাষা। এর পরে যুক্ত হয়েছে পৃথিবীর প্রকৃতি আর বিভিন্ন পশুপাখির মনোরম শব্দ। সবার প্রথমে 'একলেকটিক' যুগের নব্বই মিনিটের একটি দার্শনিক সংগীত আছে। প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের ক্লাসিক্যাল মিউজিকের মেলবন্ধন ঘটেছে গানের লিরিকে। গোষ্ঠীগত গানের ভ্যারাইটিও লক্ষণীয়। 
         

এ হেন গোল্ডেন রেকর্ড সংবলিত ভয়েজার-এক আর ভয়েজার-দুই প্রোব দুটি সৌর পরিবার অতিক্রম করেছে ১৯৯০ সালে। বর্তমানে সে ইন্টারস্টেলার স্পেসে গতিশীল। আগামী চল্লিশ হাজার বছর পরে হয়তো অন্য গ্রহের জগতে ক্লোজ অগ্রগমন ঘটবে তাদের। ড. কার্ল সাগান-এর কথায়―
'The spacecraft will be encountered and the record played only if there are advanced spacefaring civilizations in interstellar space. But the launching of this bottle into the cosmic ocean says something very hopeful about life on this planet.'

কার্ল সাগান ও অ্যান ড্রুয়ান যৌথ উদ্যোগে একটি টিভি শো হোস্ট করেন। খুব জনপ্রিয়তা অর্জন করে সে-টেলিভিশন শো 'কসমস'। 

দুজনের নামে আলাদা আলাদা দুটি গ্রহাণুর নামকরণ করা হয়েছে। অ্যাস্টরয়েড '৪৯৭০ ড্রুয়ান' আর অ্যাস্টরয়েড '২৭০৯ সাগান'। অ্যাস্টরয়েড দুটি একই অরবিটে পাশাপাশি ঘুরে বেড়ায় আজও, নিভৃতে। 

(৭)
কসমিক প্রেম

সালটা ২৩৪৭। টিপিক্যাল গ্রীষ্ম কাল। আকাশে মাথার উপর দুইটা স্টার চক্কর কাটে অনবরত। একটা পূর্বে। অন্যটা অল্প উত্তরে হেলান দেওয়া। তারা দুটির পরস্পরের মধ্যে ষাট ডিগ্রি কোণ। দুই তারার দাপটে তাপমাত্রা পঁয়ষট্টি ডিগ্রি সেলসিয়াস ছুঁই ছুঁই। প্রচণ্ড দাবদাহে ফুটিফাটা মাঠ-ঘাট-ক্ষেত। বড় বড় গভীর ফাটল। যতদূর দৃষ্টি যায়, কোথাও সবুজের ছোঁয়া নেই। উচুঁ নিচু ধূসর খাটো পাহাড়ি উপত্যকা শুধু। লালচে-নীলাভ-ফ্যাকাশে টুকরো টুকরো শিলাখণ্ডের ছড়াছড়ি যত্রতত্র। শুধু চোখ ঝলসানো লালচে উত্তাপ। সেই গরমে ফাঁকা মাঠের মধ্যে, দূরে যেখানে ঢালু মালভূমি অঞ্চল জুড়ে তাপের আতসবাজি ফুটছে, সেখানে বসে রয়েছে রকিয়ন। দুই হাত শরীরের দুপাশে ছড়ানো, ঠিক যেন উড়ে যাওয়া পাখির ডানা। হাত দুটো বেশ লম্বা। তুলনায় পা'গুলি একটু খাটো। তার পা দুটো সামনের দিকে বিছানো। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে ফাঁকা মাঠে বসে বসে রোদ পোহাচ্ছে সে। কাছে পিঠে কেউ কোত্থাও নেই। জনপ্রাণী শূন্য প্রান্তর।

তার মুখ আকাশের দিকে নিক্ষিপ্ত। বন্ধ চোখ, লাল। বন্ধ চোখের উপর কোত্থেকে এক ছায়ার আবির্ভাব হয় হঠাৎ। রকি সামান্য বিরক্ত। সে-ছায়া মুখের'পর সরাসরি লাল আলো আসতে বাধা দেয়। বন্ধ চোখ নিমেষে খুলে মেলে ধরতেই সে দেখল অদ্ভুত দর্শন এক যন্ত্র তার মাথার উপর মাটি থেকে বেশ কিছুটা উপরে চক্কর কাটছে। শরীরের চৌম্বক ক্ষেত্র কাজে লাগিয়ে যন্ত্রটিকে সে নিজের দিকে আকর্ষণ করল। আসলে রকি নিজের শরীরে ইচ্ছে মত চৌম্বক ক্ষেত্র ও তড়িৎ তৈরি করতে পারে। এতক্ষণ সে এইজন্য রোদে পুড়ে তারার আলো শরীরে গ্রহণ করছে। শরীরে আলো পড়লে যে বৈদ্যুতিক কারেন্ট তৈরি হয়, তা কাজে লাগিয়ে সে সহজেই ম্যাগনেটিক ফিল্ড তৈরি করতে পারে দেহে। ওই ম্যাগনেটিক ফিল্ডের প্রভাবে যন্ত্রটিও বাধ্য ছেলের মত সুড়সুড় নেমে এল মাটিতে। যন্ত্রের কাছে যেতেই একটি গোল্ডেন প্লেট তার নজরে পড়ে। প্লেটের ওপর আঁকচিরা কাটা। এলোমেলো লাইন। আর কিছু ছবি, ছোট থেকে বড় পর পর সাজানো। যন্ত্র থেকে পেড়ে গোল্ডেন পাতটা সে হাতে তুলে ধরল। দেখে বোঝার চেষ্টা করে কী লেখা আছে প্লেটে! পড়বার জন্য যেই পাতের একদম কাছে চোখ নিয়ে গেল, অমনি একটি বিদঘুটে শব্দে চমকে উঠে সামান্য সরে এল সে। ভিন্ন ভিন্ন সুরের অনেক গুলো শব্দ এক এক করে বেজে চলেছে। তা প্রায় পঞ্চান্ন রকম আওয়াজ। যেন কিছু বলতে চায় মুক বধির সেই পাতের শব্দগুলি! কী বলতে চায় সে? রকি গভীর চিন্তায় ডুবে।

এমন সময় হঠাৎ একটা শব্দ 'চকাৎ'। 'উউউমমমমুউউহা'। একবার নয়, বার বার বেশ কয়েকবার 'চকাৎ' 'চকাৎ' শব্দ। এইবার লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল রকি'র নরম গাল। এ ভাষাটা সে চেনে। কারণ শব্দটা তার বেশ পরিচিত। এ যে চিরন্তন ভালোবাসার শব্দ। বাঁধন হারা প্রেমের খাঁটি বাহ্যিক প্রকাশ। সফল অভিব্যক্তি। কিন্তু এ তো বসন্ত প্রেম! পোড়া গ্রীষ্মকাল এখন। এ অসময়ে কে তাকে বসন্ত প্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে চায়? গভীর চিন্তায় পড়ে যায় সে। তারপর আঁকা বাঁকা টানা লাইনগুলি ভালো ভাবে লক্ষ্য করে। রেখাগুলি যাচাই করার পর তার চোখ কপালে উঠবার জোগাড়! আরে! এ তো ভিন গ্রহ থেকে আসা কোড ল্যাঙ্গুয়েজ। লক্ষ নিযুত কোটি কিলোমিটার দূরের গ্রহ 'পৃথিবী' থেকে এসেছে। যদিও কয়েক আলোকবর্ষ আগে পাঠানো মেসেজ এটি, তবুও অক্ষয় অমর হয়ে রয়েছে ভালোবাসার সে-ভাষাগুলি। এতটুকু নষ্ট হয়নি। পৃথ্বীবাসী এলিয়েনদের (পড়ুন মানুষ) থেকে আগত। মহাবিশ্ব প্রেমের বার্তা বিশ্বের চরাচরে ছড়িয়ে দিতে বদ্ধ পরিকর তারা। 

রকিও চায় ওদের দুনিয়ার ভালোবাসার সংকেত-চিহ্ন ভয়েজারের গোল্ডেন পাতে এঁকে দিতে। একটি হাই-ফ্রিকোয়েন্সি ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক কলম বার করল রকি। ওই কলম দিয়ে খচখচ করে লিখে ফেলল কিছু একটা কথা। ভয়েজার-এর গোল্ডেন প্লেটে উচ্চ কম্পাঙ্কে সে যে কথাটা লিখল, তার বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায়― 'নমস্কার, বিশ্বের শান্তি হোক'।

(৮)
পাতা ঝরার দিন শেষ। লাল-নীল-সবুজে ছেয়ে আছে শাল-মহুল-পলাশ। ফেব্রুয়ারি মানে বসন্তে রাঙা প্রেম। ভালোবাসার পরব। রঙিন সকল ভাবনা। মধ্য-ফেব্রুয়ারি জুড়ে প্রেমের হাট বসে হৃদয়ে। অবুঝ মনের কেনাবেচা চলে চোদ্দোই ফেব্রুয়ারি। বিশুদ্ধ প্রেমের দিন। তার পর একুশে ফেব্রুয়ারি― বিশ্বের ভাষা দিবস। মাতৃভাষার প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার দিন। চোদ্দো থেকে একুশ― এই আটদিন বসন্ত প্রেমের ম ম গন্ধে বিশ্বজুড়ে শান্তির বাতাবরণ। প্রেমের আবহাওয়া। প্রেমময় অল্প চাহুনি। আঙুলে একটু ছোঁয়া। আলতো স্পর্শে শিহরণ জাগে হৃদয় অন্তরে। কিন্তু এ সকল প্রেম-ই পার্থিব। অথচ, ভয়েজার স্পেসশিপের গোল্ডেন রেকর্ড যে পার্থিব প্রেমের সংকেত বয়ে নিয়ে চলেছে অপার্থিব জগতে, প্রতিটি ক্ষণ সেখানে চোদ্দোই ফেব্রুয়ারি কিংবা একুশে ফেব্রুয়ারি।

ভালোবাসার এ হেন কসমিক ওয়ার্ল্ডে উপরের সব ক'টি তথ্যই খাঁটি; একমাত্র প্রথম ও সপ্তম পরিচ্ছদ ছাড়া। কারণ উপরে উদ্ধৃত অনুচ্ছেদ দুটি লেখকের কাল্পনিক মনের অস্থায়ী প্রোপাগান্ডা। আসলে স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে মন। স্বপ্ন দেখতে পয়সা লাগে না কিনা। সময় একটু ব্যয় হয় এই যা। কল্পনায় ভর করে সুদূরের সওয়ারি হতে কে না চায়? ছেলেবেলার সব কল্পনাগুলো সত্যি হয় না। সত্যি হতে পারে না। সবসময় চাওয়া পাওয়ার হিসাব কষতে নেই। নইলে, চাওয়ার মধ্যে সন্দেহ ঢুকে সম্পর্ক বিনষ্ট করে। 

শুভ হোক চোদ্দোই ফেব্রুয়ারি। শুভ হোক একুশে ফেব্রুয়ারি। মূর্ত হোক ভয়েজারে ভালোবাসার অমর বাণী। শূন্যে ভাসিয়ে দিলাম একগুচ্ছ ফ্লাইং চুম্বন। লিখে পোস্ট করলাম প্রেম পত্রখানি। ঠিকানা দিলাম― এলিয়েন, ডার্ক সমুদ্র, ইন্টারস্টেলার স্পেস, বিগ-ব্যাঙ। অপেক্ষায় পথ চেয়ে বসে থাকি মিলিয়ন বছর― কেউ হয়তো নিশ্চিত সাড়া দেবে অ্যান্ড্রোমিডা কিংবা আকাশ গঙ্গা কাঁটাতারের ওপার থেকে। অনন্ত প্রতীক্ষায় যৌবন।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments