জ্বলদর্চি

ইউক্রেন - এক অচেনা দেশের কথা/ সজল কুমার মাইতি

ইউক্রেন - এক অচেনা দেশের কথা 

সজল কুমার মাইতি

ইউক্রেন পূর্ব ইউরোপের একটি দেশ। রাশিয়ার পরে আয়তনে এটি ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। এই দেশের পূর্বে ও উত্তর পূর্বে আছে রাশিয়া। উত্তরে বেলারুশ, পশ্চিমে বিস্তৃত পোলান্ড, স্লোভাকিয়া ও হাঙ্গেরি। আর দক্ষিণে আছে রোমানিয়া ও মলডোভা দেশ। এই দেশের উপকূলবর্তী অঞ্চলে বিস্তৃত রয়েছে আজভ সাগর ও কৃষ্ণ সাগর। এই দেশের আয়তন ৬০৩৬২৮ বর্গ কিলোমিটার। জনসংখ্যা ৪ কোটি ৩৬ লক্ষ। ইউক্রেন ইউরোপের অষ্টম জনবহুল দেশ। দেশের সর্ববৃহৎ শহর কিভ এই দেশের রাজধানী।

ইউক্রেনের জনসংখ্যা জাতিগতভাবে ৭৮ শতাংশ ইউক্রেনিয়, ১৭ শতাংশ রুশ বাকি অন্যান্য ধর্মের মানুষ। ধর্মীয়ভাবে ইউক্রেনে ৮৭ শতাংশ খৃস্টীয় ধর্মাবলম্বী। এই দেশের প্রধান ও সরকারি ভাষা ইউক্রেনিয়। এছাড়াও বেলারুশ, বুলগেরিয়ান, ক্রিমিয়ার তাতার, রুশ ভাষা, গ্রিক,  হিব্রু ও অন্যান্য ভাষা ও প্রচলিত আছে। এই দেশের কারেন্সি হল হার্বনিয়া। জনপ্রতি আয় এই দেশে ৪৯৫৮ ডলার। এটি একটি একদেশীয় রাষ্ট্রপতি শাসিত দেশ। দেশের বর্তমান রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির জেলেনস্কি। ইউক্রেন একটি উন্নয়নশীল দেশ। মানব উন্নয়ন সূচক অনুসারে এই দেশের স্থান ৭৪ তম। ইউক্রেন ইউরোপের মধ্যে দরিদ্রতম দেশ। দারিদ্রের হার এই দেশে অত্যধিক বেশি; এছাড়াও এই দেশ অত্যধিক দুর্নীতির শিকার। তবে এই দেশে প্রচুর পরিমাণে উর্বর কৃষিক্ষেত্র আছে। ইউক্রেন পৃথিবীর মধ্যে সর্বাধিক খাদ্যশস্য রপ্তানিতে অন্যতম উল্লেখযোগ্য দেশ। এই দেশের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতি ছাড়াও আইন সভার সদস্য, প্রশাসক ও বিচার বিভাগের মধ্যে বিভক্ত। এই দেশ রাষ্ট্রসংঘ ও ইউরোপীয় কাউন্সিলের অন্তভুক্ত।

খৃষ্ট পূর্ব ৩২০০০ বছর থেকে আধুনিক ইউক্রেন অঞ্চলে জনবসতি গড়ে উঠেছে। মধ্যযুগীয় সময়ে এই অঞ্চল পূর্ব স্লোভাক কৃষ্টির প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠে। পরবর্তীকালে উপজাতীয় গোষ্ঠী কিভ রুশীয়রা নিজেদের ইউক্রেনিয় পরিচিতি গড়ে তোলে। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বিভিন্ন নীতিগত কারণে ভিন্ন ভিন্ন উপদলে বিভক্ত হওয়া ও মোঙ্গল আক্রমণে এই অঞ্চলের একতা বিনষ্ট হয়। এর ফলে এই অঞ্চল আক্রান্ত ও বিভক্ত হয় ও বিভিন্ন ক্ষমতাশালী দ্বারা শাসিত হতে থাকে। এইসব শাসকের মধ্যে ছিল পোলিশ লিথুয়ান কমন ওয়েল্থ, অষ্ট্রিয়া- হাঙ্গেরি, ওটোমান সাম্রাজ্য, রাশিয়ার জার ইত্যাদি। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দিতে কোশাক হেটমানাটের আবির্ভাব ঘটে ও ক্রমে বাড়তে থাকে। কিন্তু এই অঞ্চল পোলান্ড ও রাশিয়া সাম্রাজের মধ্যে বিভক্ত হয়ে যায়। রুশ বিপ্লবের পরবর্তীকালে আত্ম নির্ধারণের জন্য ইউক্রেনিয় জাতীয় আন্দোলন গড়ে ওঠে। ১৯১৭ সালের ২৩ শে জুন ইউক্রেনিয় গন প্রজাতন্ত্র ঘোষিত হয় ও তা আন্তর্জাতিক অনুমোদন লাভ করে। ইউক্রেনিয় সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র ১৯২২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠনে অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিল। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের অবলুপ্তির পর এই দেশ স্বাধীনতা পুনর্লাভ করে। 

স্বাধীন হওয়ার পর ইউক্রেন নিজেকে এক নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করে। এই দেশ রাশিয়া ও পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন অন্য দেশগুলির সঙ্গে ও সীমিত সামরিক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। ১৯৯৪ সালে ইউক্রেন NATO র সঙ্গে অংশীদারিত্ব স্থাপন করে। ২০১৩ সালে রাষ্ট্রপতি ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ ইউক্রেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যেকার চুক্তি রদ করেন ও রাশিয়ার সঙ্গে  আরও ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে উদ্যোগী হন। এই ঘটনায় ইউক্রেনবাসী সন্তুষ্ট ছিল না। এর ফলে সুদীর্ঘ মাসব্যাপী প্রতিবাদ ও প্রদর্শন আন্দোলন যা ' ইউরোময়দান' নামে পরে পরিচিত হয়ে সারা ইউক্রেন দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে ও সারা দেশকে উত্তাল করে তোলে। এই আন্দোলন পরবর্তীকালে ' মর্যাদার বিপ্লব' বা ' Revolution of Dignity' নামে পরিচিতি লাভ  করে ও রাষ্ট্রপতি ইয়ানুকোভিচকে পদচ্যুত করে নতুন সরকার প্রতিষ্ঠা করে। এই নতুন সরকারের রাষ্ট্রপতি হন ভ্লাদিমির জেলেনস্কি। এইসকল ঘটনাবলীর ফলস্বরূপ ২০১৪ সালের মার্চ মাসে রাশিয়া ক্রাইমিয়া আক্রমণ করে নিজের দেশের অন্তর্ভুক্ত করে। এবং ২০১৪ সালের এপ্রিল মাস থেকে ডনেতস্ক ও হাসনস্ক এ  রাশিয়ার সাহায্যপ্রাপ্ত বিচ্ছিন্নবাদীদের সঙ্গে যুদ্ধ সংঘটিত হতে থাকে। এই সকল দ্বন্দ্বের পরিণতি হিসেবে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করে। এছাড়াও ২০১৬ সালের ১ লা জানুয়ারি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে এক সংঘবদ্ধ মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল গড়ে তোলে ইউক্রেন। আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার ইউক্রেনের এই প্রচেষ্টা রাশিয়া ভালভাবে নেয় নি। এই সকল বিভিন্ন কারণে অধিক শক্তিশালী রাশিয়া নিজ নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। পরিণতি আজকের এই আগ্রাসন যুদ্ধ। এযেন ' দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার চিরকাল সমানে চলে আসছে'।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇





Post a Comment

0 Comments