জ্বলদর্চি

গ্রামের শহুরে রূপকথা--৯/ সুরশ্রী ঘোষ সাহা

গ্রামের শহুরে রূপকথা

নবম পর্ব : মিলন মেলা 

 সুরশ্রী ঘোষ সাহা 


'আমাদের দেশ প্রধানত পল্লীবাসী। এই পল্লী মাঝে মাঝে যখন আপনার বাড়ির মধ্যে বাহিরের বৃহৎ জগতের রক্তচলাচল অনুভব করিবার জন্য উৎসুক হইয়া উঠে, তখন মেলাই তাহার প্রধান উপায়। এই মেলাই আমাদের দেশে বাহিরকে ঘরের মধ্যে আহ্বান। এই উৎসবে পল্লী আপনার সমস্ত সংকীর্ণতা বিস্মৃত হয়। তাহার হৃদয় খুলিয়া দান করিবার ও গ্রহণ করিবার এই প্রধান উপলক্ষ্য। যেমন, আকাশের জলে জলাশয় পূর্ণ করিবার সময় বর্ষাগম, তেমনি বিশ্বের ভাবে পল্লীর হৃদয়কে ভরিয়া দিবার উপযুক্ত অবসর মেলা'। ('আত্মশক্তি' / রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) 


 আমাদের গ্রামের জীবনে সত্যিই সবচেয়ে আনন্দের জিনিস ছিল মেলা। সারাবছর ধরে কিছু না কিছু মেলা চলতেই থাকত। পৌষ সংক্রান্তির মেলা, চড়ক মেলা, রথের মেলা, রাসের মেলা এমন আরো কত কত মেলা। এ গ্রামে কোন মেলা বসেনি তো কী হয়েছে, আমরা বাড়ির সবাই মিলে অন্য যে গ্রামে মেলা বসেছে সেখানে ছুটতুম। পৌষ পার্বণ চিরকালই আমার বাপের ভিটে আর শ্বশুর ভিটের এক বড় উৎসব আজও। পরের দিকে ঢেঁকির ব্যবহার সারা বছর না হলেও এই মকরসংক্রান্তিতে ঠিক ঢেঁকির শব্দ উঠত ঢেঁকিঘরে। যদিও গত কয়েক বছর হল সেই শব্দ পুরোপুরি ঘুচেছে। এখন মেশিনে ভাঙা চালের গুড়ি দিয়েই কাজ চালানো হয়। বাস্তুদেবতার উদ্দেশ্যে তিল কিংবা খেজুড় গুড় দিয়ে তৈরি তিলুয়া এবং নতুন ধান থেকে উৎপন্ন চাল থেকে তৈরি পিঠের অর্ঘ্য প্রদান করা হয়। পৌষ সংক্রান্তিকে তাই তিলুয়া সংক্রান্তি বা পিঠে সংক্রান্তিও বলি আমরা। অনেক ধরনের পিঠে হয় আমাদের বাড়িতে। পুলি পিঠে, পাটিসাপটা, গোকুল, সরু চাকলি, সেদ্ধ পিঠে, এমন আরো কত। তবে আগেকার মতন এখন আর পৌষ সংক্রান্তির মেলায় যাওয়া হয় না। 

 বাড়িতে পিঠে পুলি ও পুজো করেও কত এনার্জি থাকত তখন সবার। বাচ্চাদের মেলায় ঘোরাতে নিয়ে যাওয়ার উপলক্ষ তুলে মেয়ে - বউরাও ছুটত। গ্রামের সব মেয়ে - বউরা মেলায় গিয়ে ভিড় জমাতো সেইসব দোকানে, যেখানে আলতা - সিঁদুর - স্নো - পাউডার - গায়ের সাবান, ঘর-গেরস্থলির টুকিটাকি জিনিস ঝুলছে কিংবা সাজিয়ে রাখা রয়েছে। দোকানিরা তাদের সুপটু হাতে মেয়েদের হাতে কাচের চুড়ি, আর বউ-গিন্নীদের হাতে শাঁখা-পলা পরিয়ে দিত। তারপর দরদাম চলত বহুক্ষণ। শিশু-কিশোররা ছুটতো খেলনার দোকানের দিকে। মাটির পুতুল, কাঠের ঘোড়া, টিনের জাহাজ পাবার জন্য মেলার মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে হাত-পা ছুঁড়ে কান্নাকাটি জুড়ত। কোন কোন বাচ্চা তো আব্দার মেটা না অব্দি মাটির ধুলোয় শুয়ে গড়াগড়িও দিত। বাবা অন্য কিছু বলে যতই ভোলাক না কেন, কিছুতেই ভুলত না। আবার শুধু খেলনাই নয়, মুড়ি-মুড়কি, খই-বাতাসা, জিলিপি-রসগোল্লা এইসব কিছুই তার চাই। আর সবার উপরে চাই, 'তালপাতার ভেঁপু'। যে ভেঁপুবাঁশি একবার হাতের নাগালে এসে গেলে পোঁ-পোঁ আওয়াজ করে দিনরাত বাজাতেই থাকত। কিংবা কখনো বাচ্চাগুলো রাস্তা দিয়ে দৌড়াত হাতে কাগজের ঘূর্ণি-চড়কি ধরে। যত হাওয়া লাগবে তাতে, ততই ঘুরবে বোঁ-বোঁ। 

 মনের মত খাওয়া পাওয়া মিটে গেলে বাচ্চাদের বায়না শুরু হত, নাগরদোলায় চাপার জন্য। তখন ছিল হাতে ঘোরানো কাঠের নাগরদোলা। যা ছিল মেলার মধ্যেকার সবচেয়ে আকর্ষণীয় জিনিস। বহু দূর দূর থেকে মানুষকে হাতছানি দিয়ে ডেকে আনত এই নাগরদোলা। এ গ্রামের মেয়ে ঐ গ্রামের ছেলের সাথে নাগরদোলায় চেপে ভয়ে-আনন্দে হেসে গড়িয়ে পড়ত। এখন যদিও মোটর চালিত আরো বড় বড় নাগরদোলা দেখতে পাওয়া যায়।   

 মেলায় কোথাও মঞ্চ খাটিয়ে ম্যাজিক দেখানো হত। তাসের ম্যাজিক, রুমালকে পায়রা করে দেওয়া, একটা বাক্সের মধ্যে মানুষকে ঢুকিয়ে অন্য বাক্স থেকে বের করা কিংবা হাতসাফাই ম্যাজিক দেখে কত কত দিন আমরা ঘোরের মধ্যে কাটিয়েছি। যেন অন্য কোন জগত মাথার ভিতরে চলে ফিরে বেড়াত। ম্যাজিকের প্রভাব মনের মধ্যে যে কতদিন থাকতে পারে, তা যাদের অভিজ্ঞতা নেই, তাদের বোঝানো মুশকিল। ঘরের চাল উড়ে গেছে, কী হাঁড়িতে ভাত নেই ভুলিয়ে দিতে পারে। মেলার মাঠের মধ্যে কোথাও ধুলো উড়িয়ে লাঠিখেলা বা কুস্তি লড়াই হত। ষাঁড়ের লড়াই, মোরগ লড়াইও চলত। ভিড় করে মানুষ সেসব দেখত। এছাড়া পুতুলনাচ, যাত্রা, কবিগান, বাউল-ফকিরি গান, জারিগান, বায়োস্কোপ তো থাকতই। কখনো কখনো সার্কাসের তাঁবুও পড়ত মেলায়। সঙ বা জোকারের কৌতুক-মসকরা সারা মেলাকে মাতিয়ে রাখত দিনের পর দিন। 

 মেলায় দেখতাম জাতপাত - ধর্ম কিংবা গরিব-বড়লোক কোন ভেদাভেদ নেই। সবাই এক হয়ে গেছে। মেলায় এসে দোকান সাজাত কামার, কুমোর, ছুতোর, কৃষাণ, কাঁসারু, বেদেনী, গালাইকর, হালুইকর সবরকম পেশার মানুষ। মেলা মানে তো কিছু শ্রেণীর মানুষের হাতে বেশি পয়সা আসা। এমন কত ব্যবসাদার ছিল, যাদের নির্দিষ্ট কোন দোকানই থাকত না। সারা বছর মেলায় ঘুরে ঘুরেই তারা উপার্জন করে বেড়াত। কেউ মনোহারী দোকান দিয়েছে। কেউ খেলনা ও মাটির পুতুলের দোকান খুলেছে, কেউ-বা তেলেভাজা পাপড় ঘুগনির দোকান বসিয়েছে, কেউ হাঁড়ি - কুলো - কাস্তে - কাটারির দোকান খুলে বসে আছে। এছাড়াও জামা কাপড়ের দোকান, মিষ্টির দোকান, চায়ের দোকান, ঠাকুরের ছবির দোকান, বাঁশির দোকান, চুড়ি-ফিতে কাঁটার দোকান, সস্তা বইয়ের দোকান, টুপি কিংবা ছাতার দোকান কী নেই! আর সবখানেই ভিড় লেগে থাকত সবসময়। প্রতিদিন নানা গ্রাম ঝাঁপিয়ে মানুষ ঐ মেলায় এসে জুটত। তখন তো আর মানুষের জীবনে তেমন প্রচুর কিছু আনন্দ পাবার উপকরণ ছড়ানো ছিল না, তাই যে কটাদিন মেলা থাকত, সেই কদিন যেন গ্রামজুড়ে উৎসব চলত। আর মেলা উঠে গেলেই আবার একঘেয়ে জীবনের লড়াই শুরু হয়ে যেত। 

 আমাকে মেলায় সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করত সেই ম্যাজিক আয়না ঘর। যেখানে একবার ঢুকে পড়লে আর বেরুনোর পথ বের করা মুশকিল হত। কতবার ঐ ঘরে গিয়ে কতদিকে ঠোকা খেয়েছি। মনে হত যেন একটা আমি নয়, আরও কত কত আমি চলে ফিরে বেড়াচ্ছি। 

 প্রতিবার মেলায় গিয়ে দেখতাম, ঠিক কেউ না কেউ হারিয়ে গেছে। এটাই যেন মেলার রেওয়াজ। মাইকে অনবরত বলা হত, ওমুক গ্রামের বাসিন্দা এই নাম যেখানেই থাকুন মেলার এই জায়গায় চলে আসুন। বাড়ির লোক আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। কে জানে, হয়ত এভাবেই কেউ হারিয়ে গিয়ে দেখতে চাইত, এই পৃথিবীতে তার নাম ডেকে খুঁজে চলা কেমন দেখতে লাগে! কিংবা আদৌ কি তাকে মানুষ খুঁজছে? হারানো বস্তু নতুন করে খুঁজে পেলে আমাদের আনন্দ যেমন শতগুন বেড়ে যায়, হারানো মানুষকে ফিরে পেলেও নিশ্চয়ই ভালবাসা আর আগলে আগলে রাখার টান বেড়ে যায়। আমার ইচ্ছা হত, হারিয়ে যাওয়া মানুষের আপন জনকে ফিরে পাওয়া দেখতে। কিন্তু দেখতে আর পেতাম না। মাইকের সেই ডেকে চলা কথাগুলো আমার সাথে সাথে ঘরে ফিরত। 

 সকল মেলাই একরকম চরিত্রের হয়। মেলায় মেলায় ফারাক আজও নেই। তবে মানুষের মনের মধ্যে আগেকার মতন সেই বিস্ময় আর আনন্দটা এখন আর নেই। গ্রামের প্রায় বেশিরভাগ বাচ্চাদের হাতেই এখন মোবাইল ফোন। মুঠোর মধ্যে তারা প্রতি মূহুর্তে পৃথিবীর কত বিস্ময়কর জিনিস দেখতে পাচ্ছে আর আনন্দ নিচ্ছে। 

 শিশুরা একা ঘরে ছোট্ট স্ক্রিনের আনন্দে এখন ডুবে থাকছে। তারা বেশি হাঁটতে চায় না। এখনকার বাবারাও কাঁধে, পিঠে নিয়ে তাদের ঘোরাতে জানে না। ওদের চাহিদাগুলোও সকল বদলে বদলে গেছে। আজও গ্ৰামগঞ্জে বছরে এক-দুখানা মেলা আসে বৈকি, কিন্তু সেই মেলার মধ্যে আর আগেকার মতন প্রাণ দেখতে পাওয়া যায় না। 
                                                                         ক্রমশ... 

ছবি :  অধ্যয়ন সাহা

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments