জ্বলদর্চি

উরস পাক /ভাস্করব্রত পতি

পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব - ৮

উরস পাক

ভাস্করব্রত পতি

'উরস' তথা 'ওরস' আরবি শব্দ 'উরুস' [ عرس] থেকে উদ্ভুত। আর 'পাক' অর্থে নির্মল, নিষ্কলঙ্ক, পবিত্র, শূচি, পূত, বিশুদ্ধ বোঝায়। এটি অবশ্য ফারসি শব্দ। কাজী নজরুল ইসলামের রচনায় পাই, "এসমে আজম তাবিজের মত আজো তব রুহ পাক"!

দক্ষিণ এশিয়ার সুফী সাধকদের মৃত্যুদিনকে স্মরণ করাকেই বলে উরস বা ওরসবা উরুস। সাধারণত সাধু দরগায় তথা মাজার বা সাধুর সমাধীতে এই উরস উৎসব পালিত হয়। ভক্তকূল এইসব সাধুসন্তদের ঈশ্বরের প্রেমিক বলেই সম্মান করে। অলি ও দরবেশদের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে দোয়া, কালাম, জিকির আজকারের ব্যবস্থা এবং ভোজের আয়োজনকেই বলে উরস। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বুখারী, সোহরাওয়ার্দিয়া, নকশবন্দীয়া, চিশতিয়া, কাদিরিয়া ইত্যাদি উরস ধারণা রয়েছে। 

গবেষক শামসুজ্জামান খান এই 'উরস পাক' সম্পর্কে লিখেছেন, "পির সাহেবদের অলৌকিক ক্ষমতা, বিশেষ করে তাঁদের সর্বপ্রকার ব্যাধি নিরাময় ক্ষমতার প্রসিদ্ধির জন্য প্রতি বৎসর তাঁদের দরগাহ বা মাজারে বসে মেলা। মহাধুমধানের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হয় ‘উরস'। এই উপলক্ষে সেখানে সমাগম হয় বহু ভক্তের। পীরের শারীরিক বা অন্য কোনরূপ স্মারক চিহ্ন রক্ষিত মসজিদ বা মাজারকে গণ্য করা হয় বিশেষ পবিত্র এবং ভক্তিশ্রদ্ধার বস্তু বলে।" উল্লেখ্য যে, আজমীরের দরগাহ শরীফের খাজা মইনুদ্দিন চিশতির উরসে প্রতিবছর চার লক্ষের বেশি ভক্ত জমায়েত হয়। 
পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় এই লৌকিক উৎসব লক্ষ্য করা যায় বিভিন্ন সময়ে। মেদিনীপুর শহরের জোড়া মসজিদে মওলাপাকের তিরোধান দিবসে ( ৩ - ৫ ই ফাল্গুন ) নমাজ পাঠ, মিলাদ পাঠ, ধর্মীয় আলোচনার সাথে সাথে আগত মানুষজন যে যাঁর মনোস্কামনা পূরণে দোয়া চান। সিরনি প্রসাদ দেন। আশীর্বাদ প্রার্থনা করেন। সেই সিরনি প্রসাদ মহান আল্লাহর আশীর্বাদধন্য ভেবে বাড়িতে নিয়ে যান। কোথাও কোথাও উরস উৎসব উদযাপনে কাওয়ালি গানের আয়োজনও করা হয়। 

প্রায় ২৫০ বছর আগে ১৭৬৮ সালে হজরত মহম্মদের বংশধর হজরত বড়পীর গওসল আজম আলা জাহেদ্দীর ইরাকের বাগদাদ শরিফ থেকে তাঁর পরিবারকে নিয়ে দিল্লি আসেন। তিনিই সুফী সাধনার আদিগুরু। পরবর্তীতে তাঁর বংশধররা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েন এদেশের চারদিকে। সেই বংশের একজন সৈয়দ শাহ মুর্শেদ আলি আল কাদরি। যিনি মহান নবি হজরত মহম্মদের ৩৩ তম বংশধর ছিলেন এবং বড়পীর গওসল আজমের প্রপৌত্র। তিনিই পরবর্তীকালে 'মওলা পাক' নামে বিখ্যাত হন। তিনিই 'বড় হুজুর পাক' নামেও পরিচিত। দীর্ঘ কৃচ্ছ্বসাধনার পর নিজের জীবন জনসেবার কাজে উৎসর্গ করেন। ১৯০১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি তাঁর তিরোধান হয়। তাঁরই মাজার রয়েছে মেদিনীপুরের জোড়া মসজিদে। আধ্যাত্মিক জগতের অসীম ক্ষমতার অধিকারী এই মওলাপাকের মৃত্যুদিনে প্রতি বছর বার্ষিক উরস উৎসব পালিত হয় এখানে।

মেদিনীপুর শহরের মিঞাবাজার এলাকায় তিন গম্বুজ যুক্ত পূর্বমুখী এই জোড়া মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন জনৈক বাকের শাহ। গবেষক চিন্ময় দাশ জানিয়েছেন, "অপশক্তির উৎপাতে এই মসজিদে নামাজ পড়া বা প্রার্থনা করা দুরূহ হয়ে উঠেছিল। সেকারনে তিনি যুগাবতার হজরত সৈয়েদোনা সৈয়দ শাহ মেহের আলী আল কাদেরির হাতে মসজিদটি অর্পণ করে দেন। সুফি সম্প্রদায়ের এই মহান সাধক সারা বিশ্বে আলা হুজুর নামেই সুপরিচিত। এই সাধকের তপোপ্রভাবে সমস্ত অপশক্তি দূরীভূত হয়ে মসজিদটি পুনরায় প্রার্থনার উপযুক্ত হয়ে ওঠে। তখন থেকেই এই মসজিদ সারা বিশ্বে খ্যাতিলাভ করতে থাকে। পরবর্তীকালে আলা হুজুরের পৌত্র কুতুব উল ওয়াক্ত হজরত সৈয়দ এরসাদ আলি আল কাদেরী তাকাল্লুষ জামিল এই মসজিদটির সংস্কার সাধন করে এর সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে গেছেন।" তারাপদ সাঁতরা লিখেছেন, "খ্রীষ্টীয় সতের শতকে নির্মিত পূর্বমুখী জোড়া মসজিদটি এক উল্লেখযোগ্য পুরাকীর্তি। পূবদিকের ইমারতটি অবশ্য খানকা শরিফ নামে পরিচিত মহম্মদ মৌলানা হজরত সৈয়দ শা মেহের আলী আলকাজুরীর মাজার।" এখানে মওলাপাকের ধর্মপত্নী সৈয়দা সালেহা এবং বোন সৈয়দা সাগরার সমাধীও রয়েছে।

১৯০২ থেকে এই উরস উৎসবে বাংলাদেশ থেকে বিশেষ ট্রেন আসে মেদিনীপুরে। সেখানকার ধর্মপ্রাণ মুসলমান মানুষ জন প্রতি বছর সেই ট্রেনে চেপে আসেন এই বাংলার এক ঐতিহ্যশালী লৌকিক উৎসবে। একসময় অবিভক্ত বাংলার শেষ প্রধানমন্ত্রী সৈয়দ হাসান সুরাবর্দি  জন্মগ্রহণ করেছিলেন এই মেদিনীপুর শহরেই। তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা। একদিকে ধর্মীয় লোক ঐতিহ্য এবং অন্যদিকে ইতিহাস সমৃদ্ধ শহরের মাটি - বাংলাদেশের মানুষের কাছে উরস উৎসব হয়ে ওঠে আত্মিক উৎসব। 

বাংলাদেশের ঢাকা, চট্টগ্রাম, রংপুর, পাবনা, কুষ্টিয়া, মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর, রাজবাড়ি থেকে এই উরসে আসেন মানুষজন। এরাজ্যের সবচেয়ে বড় উরস উৎসব এটি। বিশিষ্ট লেখক এবং গবেষক কামরুজ্জামান বলেন, এ ধরনের লৌকিক উৎসব উরস মেদিনীপুর বৃত্তের অনেক এলাকায় আয়োজিত হয়। আসলে ধর্মপ্রাণ মুসলমান মানুষজনের কাছে সুফী সাধকদের মাজার হয়ে উঠেছে পরম ভক্তির আদর্শ যায়গা। তাই সুদূর বাংলাদেশ থেকেও মানুষ আসেন উরস পাক উৎসবে।  

দুই বাংলার মুসলিম মানুষেরা এখানে এসে জোড়া মসজিদে তাঁদের ধর্মীয় আচার গুলি প্রতিপালন করেন। গোটা মেদিনীপুর শহর ঘুরে বেড়ান। এখান থেকে তাঁরা কিনে নিয়ে যান মাদুর, অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি, কড়াই, গামলা, কম্বল, ব্যাগ, বড় বড় ব্যারেল ইত্যাদি। আর বিক্রি হয় মনসুরা, আঙ্গুরি মোরব্বা, আগ্রা মোরব্বা, আনারসা, মুসুর পাক, করাচী হালুয়া, স্পেশাল খোয়া বরফি, গাজর হালুয়া, সোহান হালুয়া, বোম্বে হালুয়া, মিহিদানা, তিলের নাড়ু, ক্ষীরের গজা, পাপড়ি ইত্যাদি। প্রায় কোটি টাকার জিনিসপত্র বেচাকেনা চলে এখানে এইসময়।
জোড়া মসজিদ ছাড়াও খেজুরীর তাজ খাঁ মসনদ ই আলার তিন গম্বুজ বিশিষ্ট সমাধি মসজিদে (১০৫৮ হিজরীতে তৈরি ) চৈত্রের প্রথম শনিবার বিশাল ওরস হয়। খড়গপুরের পির লোহানির সমাধীতে ১১ শরিফের চাঁদে ২৭ তারিখে ওরস হয়। পাঁশকুড়ার প্রতাপপুর দরবার শরিফের হজরত সৈয়দ মুহাম্মদ জাফর কুদ্দিসাসুররহু তথা হজরত দিউয়ানজী হুজুরের (জন্ম ১৬৫০ হিজরী) সমাধীকে ঘিরে বিশাল ওরস হয়‌। পয়লা বৈশাখ থেকে চারদিনের ওরস হয় পটাশপুরের মখদুম শাহ পিরের আস্তানাতে।

অম্বুবাচিতে এক সপ্তাহের উরস হয় ঘুটিয়ারী শরিফের বড় খাঁ গাজী বা পির মোবারকের দরগাহতে। উত্তর ২৪ পরগনার হাবড়ার মণ্ডলপুরে আবালসিদ্ধ পিরের মাজারে, ভাঙড়ের বাবন পিরের থানে এবং নদীয়ার করিমপুরের জঙ্গলী পিরের থানে পৌষ সংক্রান্তিতে পালিত হয় উরস। তিরোধান দিবসকে মান্যতা দিয়ে মহরম মাসে বীরভূমের মুরারইতে আরেক জঙ্গলী পিরের আস্তানায় উরস হয়। বারাসতের আনোয়ারপুরে একদিল শাহর বাৎসরিক উরস হয় পৌষ সংক্রান্তির আগের রাতে। ১৯ শে পৌষ ওরস হয় মুর্শিদাবাদের ভগবানগোলার দাতা পির শাহ সুফী সৈয়দ হজরত নাসের আলির থানে। হুগলীর চণ্ডীতলার শাহ সুফী পিরের উরস হয় ১ লা মাঘ। মাঘ মাসের শ্রীপঞ্চমী তিথিতে রাণাঘাটের মাজদিয়ার গোরা শহীদ পির এবং হবিবপুরের মীর মহম্মদ ফকিরের মসজিদে উরস হয়। হবিবপুরে যে উরস হয় তা পরিচিত 'এ্যালা' উৎসব নামে। মাঘের প্রথম বৃহস্পতিবার বাঁকুড়ার ওন্দার নিরগিন শাহ পিরের উরস হয়। ২৫ শে ফাল্গুন ওরস আয়োজিত হয় দেগঙ্গার গোরা সইদ পিরের দরগায়। ফাল্গুনের প্রথম সপ্তাহের প্রথম বৃহস্পতিবার পাণ্ডুয়ায় পির আলীমন সাহেবের স্মৃতি উৎসব তথা উরস হয়। চৈত্রের কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশী তিথিতে বাদুড়িয়ার রওসন বিবির দরগায় উরস হয়। ৭ ই চৈত্র মগরাহাটের মুন্সী পানাউল্লা শাহ পিরের দরগাহতে উরস হয়। 

বাংলাদেশের লোক গবেষক শামসুজ্জামান খান লিখেছেন, "দরগাহ, খানকাহ, মাজারগুলি ধার্মিক ধনীদের দানে সমৃদ্ধ। কারণ এইসব প্রতিষ্ঠানের পিছনে অর্থ ব্যয় করা সর্বদাই বিবেচিত হয়েছে পুণ্যের কাজ বলে। মেলা বা উরসের সময় পির আউলিয়ার দরগাহ হিন্দুদের তীর্থস্থানের রূপ ধারণ করে। সেখানে সমাগম হয় নানা শ্রেণীর লোকের — ভক্ত, গায়ক, সাধক, দোকানদার, ব্যবসায়ী, বাজীকর, জুয়াড়ী, বেশ্যা, বাইজী, কর্মহীন ভবঘুরে, জুয়াচোর, বদমাইশ। কাজেই ওয়াহাবি নেতারা যে এ জাতীয় অনুষ্ঠানকে মুসলিম সমাজের অধঃপতন বলে আখ্যায়িত করেছিলেন, তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। এঁদের প্রচারিত একটি পুস্তিকায় নির্ভুলভাবে বলা হয়, ‘মঠগুলিতে যেমন মহান্ত, গোঁসাই থাকে, তেমনি মুসলিম দরগাহগুলিতে থাকে খাদিম, মুজাওয়াবির আর পীরজাদারা।' এই পুস্তিকায় আরও বলা হয়, হিন্দুরা তাঁদের দেবতার জন্য তৈরি করে মন্দির। এ ব্যাপারে পিছিয়ে থাকতে আদৌ ইচ্ছুক না হওয়ায় মুসলমানরা নির্মাণ করে গম্বুজশোভিত মকবরা তাঁদের আউলিয়াদের সমাধির উপর। ১১৬ আপদমুক্তি বা শোকরানা জ্ঞাপনের জন্য মুসলমানরা যেসব দরগাহে সমবেত হয়ে থাকে, কালক্রমে সেগুলি পবিত্র স্থানে পরিণত হয়েছে হিন্দুদের অনুরূপ তীর্থস্থানে। দরগাহে পিরের নিকট মুসলমানেরা আবেদন জানায় সন্তান, স্বাস্থ্য, ব্যাধি নিরাময়, সম্পদলাভ ও মামলা জিতবার প্রত্যাশায়। এমনকি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার জন্যও।"

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments