জ্বলদর্চি

পদ্মপাতায় শিমুল-১০/সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়

পদ্মপাতায় শিমুল-১০

সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়

-ডাক্তারকাকা-

মন যেন পায়রার খোপের মত গর্তে ভর্তি, সেখানে মনের সব গল্প ভাগে ভাগে রাখা থাকে।

--দুপুরবেলা দিদিয়ার সাথে স্কুলে ভর্তি হতে যাব ক্লাস ওয়ান-এ। তখন এক ধরণের সোনালি রঙের কাঁচের চুড়ি পাওয়া যেত, তার ভেতরে ফুটো থাকত। সেই ভাঙ্গা চুড়ি জোগাড় করতাম ছোটরা। আর সেগুলোর ভেতর সুতো ঢুকিয়ে চুড়ি, হার তৈরি করে পুতুলকে পরাতাম। নিজেরাও পরতাম। সেইদিন ও তাই করছি। করতে করতে হঠাত আমার খুব বমি পেল। বাড়ির ভেতর ছুটে গেলাম বমি করতে। খুব বমি করার ফলে, একটু যেন নেতিয়ে পড়লাম। আর সেদিন স্কুলে ভর্তি হতে যাওয়া হল না। রাত্রে তুমুল জ্বর। কোনরকমে জলপটি আর কিছু হোমিওপ্যাথিক ওষুধ খেয়ে রাত কাটল। পরেরদিন বাবার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু ডাক্তারকাকা জ্ঞ্যানেন্দ্র নাথ ঘোষদস্তিদারকে ডাকা হল। আমরা সবাই 'ডাক্তারকাকা” বলে ডাকতাম ওনাকে। উনিও খুব লম্বা চওড়া ছিলেন। বাবার হাইটের-ই বলা যায়। কোঁকড়ানো চকচকে কাঁচা পাকা চুল পাটে পাট করে আঁচড়ানো। পেটের কাছে পাট করা কোঁচা ঢোকানো থাকত। সাদা ধবধবে শার্ট গুঁজে পরতেন সব সময়ে। আর একটা কালো কোট শার্টের ওপর। ডাক্তারকাকার ভাগ্নে খোকাদা ছিলেন ওনার কম্পাউন্ডার। ডাক্তারকাকার বিশাল বাড়িতেই থাকতেন উনি। এখন তো গর্ভমেন্ট নিয়ে নিয়েছে সে বাড়ি। একেবারে গোল বাড়ি। না দেখলে বিশ্বাস হবে না। সেই বাড়ি উনি কাউকেই দিয়ে যান নি। পাঁচ ছেলে আর তিন মেয়ে ছিল ওনার। কেউ বিশেষ পড়াশুনা করেন নি। বড় ছেলে হরিদা খালি হোমিওপ্যাথিক পাশ করেছিলেন। বাবার অঢেল পয়সায় গা ভাসিয়ে দিয়েছিলেন তাঁরা।

বিহারী রুগীকে নাকি জিজ্ঞেস করতেন, “কয়টো খোঁকি হুয়া?” সেই রুগী হয়ত বয়স্ক। সে যত বলত, “ডাকদার সাব, অভি খোঁকী কাঁহান সে হোগা।” আসলে উনি বলতে চেয়েছিলেন কটা কাশি হয়েছে । মানে “কতবার কেশেছো”। মজার হিন্দী বলতেন বাবা এবং ডাক্তারকাকা দুজনেই।অথচ জন্মের সময় থেকেই ওনারা দুজনেই বিহারের বাসিন্দা ছিলেন। বাংলা বললেও বিহারীরা বাংলা ভালই বুঝতে পারত। কিন্তু বাবা আর ডাক্তারকাকা কিছুতেই বিশুদ্ধ হিন্দী ছাড়া বলবেন না। এখনঅ মনে পড়লে হাসি পায়। আমাদের সময় অসময়ের বন্ধু ছিলেন। ওনারা মেজদাদার ভিক্ষে মা-বাবা হয়েছিলেন। উনি নামকরা অ্যালো-হোমিও ডাক্তার বলতে পারো পুরো বিহারের। রেডিও-এ ওনার মৃত্যুসংবাদ জানানো হয়। তখন তো টিভি ছিল না। গুগল সার্চ করলে দেখতে পাবে।

আমরা তখন ছিলাম জব্বলপুরে। আমরা এই বেতার মারফত খবর পাই। আজও মনে আছে আমার। ১৯৭৬ সালে বাবা মারা যাবার পরের বছরই উনি মারা যান। ওনারা দুজনে ছিলেন হরিহর আত্মা। জামালপুরের এম. ই. স্কুলে পড়ার সময় ওনার ছোট মেয়ে খুকুদি সবাইকে বলত যে, “শিমুল তো আমার বোন।”

সবাই যখন আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করত, “কি করে হয়? শিমুল তো ব্যানার্জ্জী আর তোরা ঘোষ দস্তিদার।” তখন খুকুদি উত্তর দিত সবাইকে যে, “আমার পিসিমার লাভ ম্যারেজ। একদম যেন এক পরিবারের আমরা ছিলাম।” ...দারুণ তাই না? আগেকার কত সহজ সরল জীবন ছিল সকলের।

উনি আগেই আমাদের বাড়ি এসে আমাকে অসুস্থ দেখে বললেন, “মুঙ্গের থেকে বড় ডাক্তার কে আনতে হবে।” সবাই চিন্তিত হয়ে পড়লেন। মনে আছে বেশ চার পাঁচজন ডাক্তার এসেছিলেন আমাদের বাড়ি। তারপর ধরা পড়ল 'বিকলয়'। বেশ দুই থেকে তিন বছর ভুগেছিলাম তখন। তাই দিদিয়াকে আর আমার স্কুলে ভর্তির হওয়ার কথা মা বলেন নি। বাড়িতেই পড়াশুনা করেছি।

ছোদ্দি সেতার আর আমি নাচ শিখি 'মিনতি' স্কুলে নামকরা সব শিক্ষকদের কাছে। বিহারে শিল্প প্রতিযোগীতা হলে 'বর্ষামঙ্গল'-নেচে পেয়ে গেলাম শ্রেষ্ঠ নাচের পুরস্কার। কলকাতা থেকে সব স্টেজ সাজাবার জন্য আর্টিস্ট আনা হয়েছিল। শ্যাডো নাচ নেচেছিলাম। যদিও খুবই ছোট ছিলাম। আজও যত্ন করে রেখে দিয়েছি। ১৯৯১ সালে ঝাড়্গ্রামে মেজদার( এখনকার বড়দা) কাছে বেড়াতে গেলে সেইসব প্রাইজ আমাকে দিয়ে দিয়েছেন।

– “আর কত সারপ্রাইজ আছে তোমার ঝুলিতে? পড়াশুনায় শুনেছি তুমি অনেক প্রাইজ পেয়েছিলে? সেগুলো এখনও আছে? কোথায় আছে?” পলাশ কথার মাঝে বলে উঠল।

– “হ্যাঁ! সে কথা পরে আসছি। নিজের গুণকীর্তি গাইতে ভালো লাগে না। কিন্তু এটা তো জীবনের 'ক' ঘন্টা-বলতেই হবে সব। নাহলে কি ভাবে বোঝানো যাবে যে, জীবন একটা হিসেবের খাতা। গোপনীয়তা কিছু থাকলেও সে যে শুধু আমারই। আমার সম্পূর্ণ নিজস্ব। নিজেকে প্রকাশ করতে না পারার যন্ত্রণা আরও কষ্টের। সে কষ্ট আমি জানি। একটু ধৈর্য নিয়ে শোনো, প্লিজ। কথার মাঝখানে বললে আমি আবার খেই হারিয়ে ফেলি। এর মাঝে ঘটে গেছে অনেক ঘটনা। বড়দের কাছ থেকে শুনে গায়ে কাঁটা দেয়। ভাবি আমার বুদ্ধিমতী, সুন্দরী মা এর কথা। অসীম ধৈর্য, ভালোবাসা, আর সহানুভূতির মিশ্রণে যে একটা সংসারের কাঠামো শক্তপোক্ত হয়, তা মা দেখিয়ে দিয়ে গেছেন। মা-এর কথা একটু বলে নি।

-মা-

মধ্যই শ্রীরামপুরের চ্যাটার্জ্জী বাড়ির সবচেয়ে আদুরী ছোট মেয়ে নির্মলা। ডাকনাম ছিল নিরু। মাত্র দশ বছর বয়সে মাথায় ঘোমটা দিয়ে এসে হাল ধরেছিলেন ব্যানার্জ্জী বাড়ির। বিয়ের সময় দাদু মায়ের জন্য গরুও যৌতুক হিসেবে দিয়েছিলেন। মা নাকি দুধ খেতে খুব ভালোবাসতেন। এখন ভাবি এদেশে কত রকমের দুধ পাওয়া যায়। সয়া মিল্ক, চকলেট মিল্ক, এলমন্ড মিল্ক, রাইস মিল্ক, কোকোনাট মিল্ক, ওট মিল্ক। কিন্তু মা তো কবেই আকাশের তারা হয়ে গেছেন।

বাবার চেয়ে বেশ খানিকটা ছোট ছিলেন মা। কাকার সাথে নাকি ঠিক মত ম্যাচ হত। কিন্তু কাকার রং কালো ছিল আর বাবা ছিলেন খুব ফর্সা, সাথে সমুদ্রের নীল রঙের চোখ। কিন্তু দুজনেই ছয় ফুট লম্বা। শুধু রঙের জন্য আলাদা করা না হলে একদম যমজ ভাই মনে হত দেখে। আমি কাকাকে ভালো করে দেখেছিলাম যখন কাকার মেয়ে ভানিদির বিয়েতে গেছিলাম দানাপুর এ। তবে মনে নেই সে সব কথা । আবছা আবছা মনে পড়ে। খুবই ছোট ছিলাম তখন। বড়দি, বড়দা, নদা আর কাকার মেয়ে ভানিদিকে দেখতে ছিল আমাদের বাবার মত।

মা এর বিয়েরও একটা মজার গল্প আছে। সেজদা মা কে সব সময় দুষ্টুমি করে বলত, “ও মা শুনেছি তোমাদের লাভ ম্যারেজ? বলো না মা? আমরা কিচ্ছু মনে করব না।”

-“কে বলেছে?” মা মুখ টিপে হেসে সেজদাকে জিজ্ঞেস করতেন।

-“ঐ যে তোমরা এক গাঁয়ে তো থাকতে।”

-“ওরে না:! উপন্যাসেই ওইসব প্রেমের জয়জয়কার। জীবনে শুধু লাভ-ক্ষতি, দেনা -পাওনা। আসলে আমার নদি (বীনাপাণি) বাল্য বিধবা হয়ে আমাদের বাড়িতে চলে আসে। তারপর সেই বাড়ির কর্ত্রী ছিল। আমি যখন জন্মালাম, তোর বাবার বাড়িতে গিয়ে তোর ঠাকুমা কে বলে এসেছিল যে, “আমার ছোট বোন(মা) নিরুকে তোমাদের বাড়ি দিয়ে যাব।”

তারপর যখন আমি বড় হলাম একটু। তোর মাসু আবার গিয়ে বলে আসল যে,

-“তোমাদের শিবুর (মানে বাবার ডাক নাম) সাথে আমার ছোট বোন নিরু-র বিয়ে দিতে চাই।”

-তোর ঠাকুমা বললেন, “তা কি করে হয়? শিবু বেশ খানিকটা বড় তো নিরুর চেয়ে তার চেয়ে বরং আমার কানুর সাথে বিয়ে দেওয়া যেতে পারে।”

-নদি(মাসু) বলেছিলেন, “ধ্যুস! কালো মেয়ের কালো ছেলের সাথে বিয়ে দেওয়া ঠিক না। শিবুর সাথে যদি দাও তাহলে আমরা রাজি আছি।” বলে মা নাকি খুব হেসেছিলেন। সেজদা্দার মুখে শুনেছি।

মা-এর এক্কা-দোক্কা খেলার বন্ধু ছিলেন পিসিমারা। তাই বিয়ের আগে পিসিমাদের সাথে আম কুড়োতে গেলে বাড়ি ফেরার সময় বাবার কাঁধে চড়ে বাড়ি ফিরতেন মা। হঠাৎ মেঘে সারা আকাশ ছেয়ে গেছে। বৃষ্টি আসছে খুব তোড়জোড় করে। ধুলোর ঝড়ে তো সামনের দিকেই কিছু দেখা যাচ্ছে না। এমন দিনে আমাকে কাঁধে না নিলে তো আমি ভিজে সুপসুপে হয়ে যেতাম। দুই পিসীমা তো আমার চেয়ে বড় ছিল, ওরা দৌড়ে বাড়ী চলে যেত। আমাকে দেখতে পেয়ে তোর বাবা কাঁধে তুলে নিত।” বলে মা নাকি লজ্জা পেয়েছিলেন।

দাদা দিদিদের কাছে মা ছিলেন প্রিয় বান্ধবী। সেজদা পুনায় মেকানিক্যাল ইঞ্জিনীয়ারিং পড়ার সময় মারাঠি মেয়েদের দেখে খুব ভালো লেগেছিল। ছুটিছাটাতে বাড়ি এলে মা-এর কোলে মাথা রেখে বলেছিল, “আচ্ছা মা, আমি যদি মারাঠি মেয়ে বিয়ে করি?” মা বলেছিলেন, “করলে করবি তবে আমার ছেলে মেয়েরা কেউ নিজেদের পছন্দে বিয়ে করবে না জানি।”

রোজ খবরের কাগজ পড়তেন দুপুরে। আমার ছোদ্দিকে বলেছিলেন যে, “ এইরকম যদি কোনদিন ঘটে যে, অমুক ব্যানার্জ্জীর ছেলে উচ্চশীক্ষার্থে বিদেশে যাচ্ছে-সেদিন আমার খুব ভালো লাগবে।” আজ মা-এর সব ছেলে মেয়েরা উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশের বাসিন্দা।

(চলবে)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments