জ্বলদর্চি

পদ্মপাতায় শিমুল-৯ /সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়

পদ্মপাতায় শিমুল-৯

সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়

-বেনুদাদা-

মোরাদাবাদ-এ ট্রান্সফার হবার জন্য বাবা সাহেব পাড়ার বাংলো ছেড়ে বাড়ির সবাইকে তাড়াতাড়ি কাছাকাছি একটা খালি বাড়িতে থাকার বন্দোবস্ত করেছিলেন। কারণ দুই দাদা তখন উঁচু ক্লাসে পড়ে। একজনের আবার স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা। দিদিয়া কলেজে আর বড়দির তো আগেই বিয়ে হয়ে গেছে খুব ছোট বয়সে। খুব সুন্দরী ছিল বড়দি। ভালো নাম প্রতিভা আর ডাক নাম ছিল পাঁচুনী। বাবা ডাকতেন আদরের বড় মেয়েকে 'পুটকুলু”। আর বড়দিও একেবারে আহ্লাদে ঠসঠসে ছিল। টকটকে গায়ের রঙ, সাধারণ মেয়েদের চেয়েও উচ্চতায় একটু যেন বেশি, এক মাথা মিশকালো চুলে ছোট্ট কপালটা ঢেকে থাকত।

বড় জামাইবাবু সিনেমা দেখতে গিয়ে মায়ের সাথে বড়দিকে দেখেছিলেন। ওনার মা -ও ছিলেন সাথে। বড়দি পড়াশুনায় কোনদিন সেকেন্ড হন নি। 'প্রতিভা' নাম রাখা সার্থক হয়েছিল বড়দির। বাবা নিজের মায়ের নামে স্কুলে প্রাইজ দিলে বড়দি সেই প্রাইজ বাড়িতে নিয়ে আসতেন। কারণ পুরো স্কুল মিলিয়ে যে প্রথম হবে সেই পাবে সেই আওয়ার্ড। ভারী মজার ব্যাপার। সেই প্রাইজের 'ইংলিশ ডিক্সনারি' বইটা আজও বাড়িতে রাখা আছে। প্রত্যেক সরস্বতী পুজোয় ঠাকুরের সামনে সেই বই আগে রাখা হত। এত ভারী যে এক হাতে ধরা যেত না।

এবার আসি বেনু দাদার কথায়। আমার সেই দাদার বয়স তখন ছিল মাত্র দেড় বছর। খুব সুন্দর দেখতে ছিল, তাই তার নাম রাখা হয়েছিল বেনু। তার আবার সব সময় একটা বাঁশি হাতে থাকত। সেই বাঁশি ছাড়া সে খেত না, ঘুমোত না পর্যন্ত। শুনেছি জামালপুরে সেইসময়ে বেবি শো তে প্রথম হয়েছিল। একেবারে গল্পের মতো। সাথে থাকলে ছবি দেখাতাম। এত জায়গায় যাওয়ার দরুন সব এলোমেলো হয়ে গেছে।

মাঝে মাঝে দুটো বেড়ালের ঝগড়ার আওয়াজ বা কান্নার আওয়াজ শোনা যেত সেই বাড়িতে। অথচ কেউ কোন বেড়াল দেখতে পেত না। আবার মাঝে মাঝে কোথা থেকে একটা তীব্র আলো এসে বাথরুম এ যাবার জায়গাটায় পড়ত। কিন্তু আশেপাশে কোন লাইটপোস্ট ছিল না। দুদিকে ধু ধু মাঠ ছিল।

বাড়ীর সবাই মাঝে মাঝে আরও অদ্ভুত অদ্ভুত সব জিনিস লক্ষ্য করত। মা কে বলত ছোট ছোট দাদা/দিদিরা তখন। কিন্তু মা বলতেন “ওসব কিছু না। পড়াশুনা করো।”

মা ও একদিন রান্না করার সময় দেখেন যে, একজন মহিলা চুল খোলা অবস্থায় সাদা শাড়ি আর লাল পাড় পরে বাথরুমের দিকে চলে গেল। দেখতে দেখতে আমার সেই বেনুদাদা অসুখে পড়ল। আর বেসিলারি ডীসেন্ট্রিতে মারা গেল মাত্র দুইদিনের মধ্যে। মারা যাবার সময় দোষ পেয়েছিল তাই পণ্ডিত ডাকা হলে তিনি জানান: "এই বাড়িতে অতৃপ্ত আত্মা আছে।” আর যেখানে আমার বেনুদাদা শুতো সেই খাটের নিচে একটা পেরেক পোঁতা আছে দেখা গেল। শোনা গেল, ওখানেই খাটে শুয়ে মারা গিয়েছিল এক অল্পবয়সী ভদ্রমহিলা। রেখে গিয়েছিল তার ছোট্ট ছেলেকে। অকালে চলে যেতে হয়েছিল সেই বেনুদাদাকে।

যখন পণ্ডিত ডাকা হয়েছিল, তিনি পূজার বিধি দিলেন। অদ্ভুত লাগে শুনতে যে, সেই সময় একটা পাথরের শিল নাকি আচমকা দু ফাঁক হয়ে গেছিল। আছে আছে ...কিছু আছে এই সব বিধানে। অঘটন আজও ঘটে।

তারপর আর অবশ্য কিছু দেখা যায় নি, তবে মা সবাইকে নিয়ে অন্য বাসায় চলে গেছিলেন পাড়ার সবার কথায়। মা-এর কথা বলতে গেলে মনে হয় সত্যি সর্বংসহা ছিলেন আমার মা। এখন ও ছবি দেখলে অবাক হয়ে যাই এত সুন্দর ছিলেন মা আমার। এত শোক, তাপ-যন্ত্রণা পেয়েও সর্বদা হাসিখুশি। আমার মনে দুঃখ এলে তাই নিজেকে বোঝাই মা এত সহ্য করেছেন আর আমি তাঁর মেয়ে হয়ে অল্পেতে কেন ভেঙে পড়ছি।

দিদিয়ারা অনেক জোরজার করে বেনুদাদার জন্মদিন পালন করেছিল ওর এক বছর বয়সের সময়। মা বারণ করেছিলেন, কিন্তু দিদিয়া আর ওর বান্ধবীরা মিলে করেছিল সব ব্যবস্থা। মাকে রাজি করিয়েছিল ওরা যে ওদের পয়সা দিয়ে জন্মদিন হবে। কিন্তু সেই দাদা মারা যাওয়াতে এখন আমাদের বাড়ী জন্মদিন হলে বাইরের লোকজনকে ডাকা হয় না। মানে কোন সেলিব্রেট করা হয় না। বাড়িতেই হয় পায়েস আর যার জন্মদিন সে যা ভালোবাসে তাই রান্না করা হয়। সব দাগহীন অসহায়তার ছবি গো।

চলো এবার লাঞ্চ সেরে নি। না 'চিলিস' রেস্তোরাঁতে খেতে খেতে গল্প করা যাবে। অনেকদিন খাওয়া হয় নি রাইস অ্যান্ড স্যামন ফিস উইথ ম্যাঙ্গো সস। দারুণ খেতে তাই না? সাথে তোমার প্রিয় বয়েল্ড ব্রকলি ও থাকে। “তুমি আমার তাল-ডোঙাটি, আমি হলাম লগি”।

-একটা নিঃশ্বাস ফেলে পলাশ বলল, “ঠিক হ্যায় জী। ওটাই হোগা।” পলাশ কাঁধটা ঝাঁকাল, “ এ্যজ ইউ উইশ। তারপর আবার আমরা ডাউন-মেমোরি -লেনে ফিরে যাব”।

পলাশ গাড়ী থেকে নেমে বাড়িতে ঢুকে গেল। সাথে শিমুল ও। চান, পুজো সেরে ওরা গাড়ি নিয়ে আবার বাড়ির কাছেই 'চিলিস' রেস্তোরাঁতে ঢুকল। গাড়ি পার্ক করে রেস্তোরাঁতে ঢুকে খাবার অর্ডার দিয়ে নিজেদের চেয়ার টেবিল এ বসে পড়ল। “গড গিভস মিল্ক, বাট নট দ্য পেল” কথা কটা বলে হা হা করে হেসে উঠল পলাশ। পলাশ মদ খায় না। একবার কোন একটা পার্টিতে পানীয় হাতে নিয়ে খেয়াল করেছিল ওখানকার মানুষেরা অন্য গ্রহের মানুষ। আর শিমুল তো নিরামিষাশি ও বলা চলে।

বাড়ীতে আমার আদর দেখে একই বয়সী বন্ধুরা বলত, “পরের জন্মে তোদের বাড়ীতে শিমুল হয়ে জন্মাব।” হাসতাম ওদের কথা শুনে। কারুর সাথে কখনই বিবাদ করা একেবারেই স্বভাববিরুদ্ধ ছিল। মনে পড়ে না, ঝগড়া করেছি কোনদিন কিনা কোন বন্ধুর সাথে। খুব শান্ত ছিলাম তো। মুখ দিয়ে নাকি কথাই বেরুত না। যতটা পারতাম 'হুঁ-হ্যাঁ' করে ছেড়ে দিতাম।

এখনও লিখতে গিয়ে নানা রকম বাধা বিপত্তি আসে-কিন্তু প্রকাশ করতে পারি না। খুব ইচ্ছে বই প্রকাশের। করেছি-পাঁচখানা বই। সেখানেও অনেক বাধা। থাকি দেশ থেকে বহুদূরে। দেশে সেরকম জানাশোনা নেই। তাহলে লিখি কেন? ভালো লাগে তাই লিখি। মন খারাপ হলে লিখি। আবার আনন্দ হলে লিখি।

ছোট্টবেলা থেকেই একটু ছিলাম দিদিয়া ঘেঁষা। কেন ছিলাম জানি না। দিদিয়া ছাড়া খাব না, জামা কাপড় পরব না, শোব না। ওর কাছেই পড়াশুনা, সেলাই ও গান বাজনার হাতেখড়ি। আমি নাচতে খুব ভালবাসতাম। এখনও আছে সেই রুপোর মেডেল-টা। মাঝে মাঝে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখি। একটুখানি তালিম পাবার পর থেকেই সারা বাড়ি ঘুরেঘুরে নেচে বেড়াতাম। পায়ের নূপুর বাজত, ছমছম ছমছম। কখনও গ্রীষ্মকালের সকালে উঠোন জুড়ে নেচে বেড়াচ্ছি। উঠোনে ছিল কাঁঠাল গাছ আর পেয়ারা গাছ। সেই কাঁঠাল গাছের গায়ে টমি বাঁধা থাকত। আমি নাচ করলে সেও দু পা-এ দাঁড়িয়ে হাত দুটো নিয়ে জানাত সেও নাচতে চায়। আকাশে মেঘ, হয়ত ঝড় উঠবে। সেসবে হুঁশ নেই। মা হাসতে হাসতে বলতেন, “ও সিমটি, আর ভিজিস না মা, বৃষ্টি নামল যে।” মেয়ে ছুটে এসে মায়ের কোলে ঢুকে পড়ত। বাজকে বড্ড ভয় পেত যে মেয়ে। মাও ছোটমেয়েকে একমুহূর্ত চোখের আড়াল করতেন না। তাই ছোটবেলাতে পড়াশুনো বাড়িতেই। মানে প্রাইমারী স্কুলে যাই নি বলতে গেলে। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়াশুনা দিদিয়ার কাছেই। অবশ্য এর পেছনে আবার একটা গল্প আছে। বলি শোনো। স্মৃতি ছাড়া কিছু নয়-অতীতের বিঘ্নও মধুর।

--নিশ্চয়-ই বলবে। বলো । আর দেখো, বাইরের আবহাওয়াও কিন্তু খুব সুন্দর আজ। তাই না? পলাশ বাইরের দিকে একবার তাকিয়ে নিল। পলাশ রাঙাতে জানে। 

টেরেনের ঘাস কাটা হয়ে গেছে। খুব সুন্দর লাগছে বাগান টা এখন। এমনি খুব ঝকঝকে তকতকে এই ডালাস শহরটা, তাই না?
(চলবে)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments