জ্বলদর্চি

গভীর মগ্নতার সুরে মোড়া গৌতম মাহাতোর খোয়াহিশের ধুন /ঋত্বিক ত্রিপাঠী

গভীর মগ্নতার সুরে মোড়া গৌতম মাহাতোর খোয়াহিশের ধুন

ঋত্বিক ত্রিপাঠী 

জীবনের প্রতি অনুরাগ আছে বলেই রাগও আছে। আছে বলেই ধ্বনি স্বধ্বনি হয়ে ওঠে। উৎসর্গ করেছেন 'জীবনের সেরা বিরোধীকে'। এ কথা না উল্লেখ করলেও চলতো। কারণ, বিষয় ও প্রকরণ, বাক্য ও শব্দ সমবায় যাবতীয় বিরোধিতার সামনে লড়াইয়ে প্রস্তুত। এ লড়াই অন্তরে বাহিরে। 

স্বাভাবিক ভাবেই এসেছে মগ্নতা। তিনি মগ্ন। তাই তাঁর সব কবিতাই একবার পাঠে অধরা। বহুপাঠে আস্তে আস্তে খুলতে থাকে শেকল। পৌঁছানো যায় শেকড়ে। সে শেকড় এক দর্শনে স্থিত। ওপরে ডালপালা, ফুল ফল। অপ্রচলিত শব্দ, উপমা, ব্যঞ্জনা। রূপে অরূপের খেলা জানেন বলেই তাঁর ব্যবহৃত শব্দ অপ্রচলিত হয়েও প্রায়োজনিক। তবে পাঠক যদি না মনোযোগী হন, যদি না খুঁজে পান শব্দ-চাবি তবে পথ হারাবেন। পাঠককেও হতে হবে মগ্ন।

 'খোয়াহিশের ধুন' বইতে গৌতম মাহাতো ধরেন নিজস্ব ধ্বনি, অস্তিত্ব, বিশেষ মুহুর্তকে। যে মুহুর্তের মধ্যে লুকিয়ে হাজারো দ্বিধা দ্বন্দ্ব। কিন্তু সেখান থেকেই উঁকি দেয় সম্ভাবনা। 'হাত থেকে খসে পড়ে জোয়ান কলম, এ লেখায় কোনও কুটুম্ব আসবে বোধহয়।' পরক্ষণেই জানালেন - 

'ঝুঁকে আসে মিতিনের স্তন,  মিতিন আমার কোনও কুটুম্ব নয়/তবু এলো শেষমেশ তার বারুদ কুম্ভ, হীরার মিনার। এলো কারণ / ওরই ভেতর জুড়ে যাচ্ছে এ শহর তরুণাস্থির মতো, হোর্ডিং, আমার জোয়ান কলম,'

যাঁরা কবিতার ভূমিকা উপসংহারে বিশ্বাসী, গল্পে আস্থাশীল তাঁরা হতাশ হবেন। সমকালীন কবিতাধারা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা গৌতমের শব্দ সমবায়।

'এ শরীর আমার মতোই ময়লা হয়েছে ততটা শুদ্ধ হয়েছ তুমি/ যেভাবে ধোঁয়াধার বৃষ্টি শুদ্ধ ছোঁয়াল বনভূমি।'

চমৎকার প্রয়োগ দক্ষতায় অনন্য গৌতম নির্মাণ করেছেন ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের 'কালকুঠরির চাবি',  'জাহান্নামের ঘোড়া', 'চার্বাক', 'চক্রবাক' ইত্যাদি সিরিজ। তাঁর রাগ ও অনুরাগের চিত্রকল্পে জড়িয়ে থাকে অতিচেতনা ও নিজস্ব এক ব্যাকরণ। তাই গৌতমই লিখতে পারেন :  

'রোদ্দুরের পর যে দু'টো ফোঁটা পাশাপাশি পড়বে/ জেনো সেগুলোই আমরা নিছক'

শব্দশিল্পী গৌতম রাগের কথাও বলেন। অহং, ধ্বংসের বিপরীতে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট বলেন- 'এই অগ্নি বমনকারী আমার নয়...আগেরও নয়, পরেরও না...।' এই দৃঢ় ব্যতিক্রমী দর্শন আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয় ভূত ভবিষ্যতের মাঝে। বর্তমানের মুখ চিনে নেয় মুখোশ।  সাধক কবি। ছায়া ধুলো বালির কবি সহজেই প্রার্থনা করেন:  'শ্মশানের শান্তি ঠেকাও দুই চোখে; হাতে দাও মৃত নামাবলি।'

এ সময় যাঁরা কারণে অকারণে কবিতা লিখছেন, যাঁরা একের পর এক কবিতার বই প্রকাশ করছেন, যাঁরা কবিতা লিখে নিজে নিজেই হয়ে উঠছেন কবি, যাঁরা মঞ্চে লাফিয়ে বেড়াচ্ছেন, দেশ উদ্ধারে সচেষ্ট, যাঁরা কবিতার অভিধান রচনা করতে রাত জাগছেন কিংবা যাঁরা ধ্যানমগ্ন, গোপন, অন্তর্মুখী পাঠক কিংবা আমার মতো ফাঁকিবাজ হয়ে কবিতার মধ্যে শব্দ-চাবি খুঁজে পেতে চান, যাঁরা এই পর্যন্ত পড়ে না জানি কি ভাবলেন-- আসুন, একবার পড়ি এই বইটি। দুবার, তিনবার পড়ি। কবিতা কতখানি চমৎকৃত, আধুনিক ও অন্তর্লীন স্বভাবের হতে পারে, কতখানি অন্তর ও বাহিরের হতে পারে, বিরোধিতার জট কাটাতে নিজস্ব ধ্যান ও অনুশীলন কত গভীর হতে পারে, আসুন দেখি।

পিনাকীরঞ্জন বেরার প্রচ্ছদও দেখতে বাধ্য হই বারবার। 

খোয়াহিশের ধুন/ গৌতম মাহাতো/ দারুহরিদ্রা পাবলিকেশন / আসাম/১২০/-

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments