জ্বলদর্চি

মাটিমাখা মহাপ্রাণ--১০ /শুভঙ্কর দাস

মাটিমাখা মহাপ্রাণ। দশ

শুভঙ্কর দাস 

" যে আমি ওই ভেসে চলে/ কালের ঢেউয়ে আকাশতলে
ধূলার সাথে,জলের সাথে/ ফুলের সাথে,ফলের সাথে
সবার সাথে চলছে ও যে ধেয়ে "

জীবনে বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখা এবং স্বপ্নের পূরণ হওয়ার মাঝখানে যে পথ পার হতে হয়,তা সবসময় কঠিন এবং দুর্গম। যে পরিশ্রম ও পরিকল্পনা করতে হয়,তাতেই অসংখ্য জীবন লড়াই করতে করতে হার মেনে একদিন হারিয়ে যায়!
কুমারচন্দ্রের জীবনে স্বপ্ন হল,সে পড়াশোনা করে হয় বড় বিজ্ঞানী হবে, না হলে কোনো উঁচু প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক। 
কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণ হওয়া তার মতো মফস্বলি হতদরিদ্র পরিবারের সন্তানের পক্ষে শুধু কঠিন নয়, দিবাস্বপ্ন বলা যেতে পারে।
একদিন দুপুরে সকলের ভাত খাওয়া শেষ হয়ে গেছে,কুমার ভাত খেয়ে গৃহের সামনের বাঁশের ভাঙা বেড়াটি কাছে দাঁড়িয়ে তা কীভাবে ঠিক করবে তা  ভাবছিল।সামনের পুকুরটিরও ভয়ংকর অবস্থা। কুচুরিপানায় একেবারে ভরে ওঠে,জলের চিহ্নমাত্র দেখা যায় না!
সহসা তার রান্নাঘরের দিকে চোখ গেল।লক্ষ্মীদেবী সেখানে এখনও কাজ করছে। মায়ের কাছে ফিরে তার মনে আনন্দের সীমা নেই। মায়ের হাতের ছানার ঝোল খেতে কুমার খুবই ভালোবাসে।
বেশকিছু দিন বিদ্যালয়ে মাস্টারির কাজ হয়েও গেছে। যেরকম সে ভেবেছিল বিদ্যালয় নিয়ে, আসলে তার সেই রকম রূপ নেই, পারিপাট্যতা নেই, সর্বোপরি দুচার খানা বই ছাড়া বিদ্যালয়ের সম্পদ বলতে কিছুই নেই। একটা ভাঙা আলমারি,কয়েকটা নড়বড়ে টেবিল,দুটি চেয়ার এবং তিনখানি খড়ের চালার পর পর কক্ষ।তার ওপর ছাত্রসংখ্যা হাতে গোণা। গৃহস্বামীর বাড়ির ছেলেরা যেদিন অনুপস্থিত থাকে,সেদিন বিদ্যালয় চালানো মুসকিল হয়।কখনো কখনো একাই নিজের ক্লাসরুমে বসে কুমার অধ্যয়ন করে।এখানে কাজ করে যা বেতন পায়,সবই মায়ের হাতে তুলে দেয়।
প্রথমবার বেতন পেয়ে প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে গৃহে ফেরে কুমার। তারপর চালে কাঁকর বাছতে রত মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে, ঠিক যেভাবে লোকে দেবতার চরণে ফুল দেয়,সেইভাবে পাঁচটি কয়েন মায়ের পায়ের সামনে রেখে প্রণাম করে কুমার।
বলে ওঠে,এবার মা একখানা শাড়ি কিনবে, এরকম ছেঁড়া কাপড়ে থাকবে না।
লক্ষ্মীদেবী চাল বাছা পাশে রেখে একটুক্ষণ কুমারের দিকে তাকালেন। একটাই মাত্র ফতুয়া। যার পকেট কবেই ছিঁড়ে কোথাও পড়ে গেছে।বুকের সামনে দুটি তালি।পরনের ধুতিটাও বেশ পুরানো। অথচ নিজের দিকে খেয়াল নেই। 
তিনি মৃদু হেসে বললেন,আচ্ছা, সে হবে খন।দাঁড়া,ঠাকুরঘরে ছুঁইয়ে আসি,তুইও চল,গড় করবি,জীবনে যাতে আরও বড় হতে পারিস।

সে গড় করা আমার হয়ে গেছে,এখন আমাকে যেতে হবে পাঠশালায়,জরুরি দরকার।বলেই কুমার আবার দৌড়াতে দৌড়াতে ফিরল।
পরে দেখা গেল সেই টাকায় লক্ষ্মীদেবী নিজের জন্য কাপড় কেনেনি,কুমারের দিদি ও দাদা এবং কুমারের জন্য একপ্রস্ত কাপড় কিনে দিয়েছেন এবং বলেছেন,তোরা নতুন কিছু পরলেই আমার কাপড় বাড়ে রে.. মনে কোনো অভাব থাকে না!
কুমার এইসব দেখে বিস্মিত হয়ে যায়।
কুমার একটু এগিয়ে গিয়ে রান্নাঘরের জানালার পাশে দাঁড়াল।গিয়ে দেখল,পুঁটলি খুলে তার মা একমুঠো চালভাজা খেয়ে জল খেয়ে নিচ্ছে।
অর্থাৎ তার মায়ের জন্য ভাত নেই। 
তা দেখে কুমারের চোখে জল এসে গেল। গৃহের সকলকে খাইয়ে তার মা নিজেই ভাত খেতে পায় না।
এবং সেই ফকিরের গানটা মনে পড়ে গেল,"মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মায়ের তুলে নে রে ভাই/ দীনদুঃখিনী মা যে তোদের... "
কেঁদে ফেলল কুমার।তার মনে এই গান যেন তার মায়ের জন্য লেখা।সহসা যেন কুমারের চোখ খুলে গেল,তাদের সেই রান্নাঘর কোথায় হারিয়ে গেল,সে দেখল,তার মা শুধু নয়, অসংখ্য বাঙালি মা যেন এইভাবে অনাহারে অর্ধাহারে দুঃখে অভাবে দিন কাটাচ্ছে, এতো সাধারণ মা নয়,এতো দেশ,দেশমাতা। সেই দেশমাতা এতো অভাবে এতো অন্ধকারে কাটাচ্ছে, আর সে কি না নিজের জন্য চিন্তা করছে,স্বার্থপরের নিজের উন্নতির কথা ভাবছে!
না,আর নয়, সে বিদ্যালয়ের পাশাপাশি আরও লোকের বাড়িতে কাজ করবে,টাকা রোজগার করবে,যাতে তার মাকে যেন ভাত না খেয়ে থাকতে না হয়!

কুমার, কি হলরে বাবা,চোখে জল কেন? 

সহসা মায়ের কণ্ঠে সম্বিৎ ফিরে পেলো কুমার।মায়ের মুখের দিকে চেয়ে বলল,মা, ঐ চোখে কী একটা পড়ল,দাঁড়াও
বলেই মুখে একটু জল ছিটিয়ে নিল।তারপর বলে উঠল
আমার ভুল হয়ে গেছে, ঘরের অভাব আমি আগে দূর করব,তারপর অন্য কিছু! 

কীসের অভাব? দোর বোকা,জীবনে বাধা-বিপত্তি থাকবে, অভাব থাকবে,তা না হলে কীসের জীবন?

আমার খুব কষ্ট হচ্ছে যে মা

ওরে এতো ভেঙে পড়তে নেই,জীবন কী অত সোজারে বাবা,জীবন তোকে দুঃখ-কষ্টে বেঁকাতে চাইবে,মাড়াই করতে চাইবে,তোকে কিন্তু ভেঙে পড়লে চলবে না,সোজাই থাকতে হবে। চল চল কাজ করতে হবে
বলেই লক্ষ্মীদেবী নিজে একটা দা নিলেন এবং ছেলের হাতে দা দিলেন।
সেই পানাভর্তি পুকুরের সামনে এসে দাঁড়ালেন। 
তারপর জলে নেমে কচুরিপানা পরিষ্কার করতে লাগলেন।
কয়েক ঘন্টায় মা-পুত্রের চেষ্টায়  সেই কচুরিপানা পরিষ্কার হল।জলের রোদ পড়তে পুকুর যেন খিলখিল করে হেসে উঠল।
পুকুরপাড়ে ডাঁই হয়ে উঠল কুচুরিপানা।
সেই দিকে আঙুল তুলে লক্ষ্মীদেবী জিজ্ঞেস করলেন,কী দেখছিস্? 

কুচুরিপানা,উত্তর দিল কুমার।

না,এই হচ্ছে দুঃখ-কষ্ট আর আঘাত,পুকুর হল জীবন,এইভাবে এগুলো সরিয়ে আলো আনতে হবে,এগিয়ে যেতে হবে,বুঝলি..

হঠাৎ একটা কণ্ঠ ভেসে এলো,কুমার কুমার কোথা গেলি?
দেখা গেল, কুমারের দাদা দেবেন ঘরের ভিতর ছুটতে ছুটতে পুকরধারে হাজির।

ওরে বাপ্ তুই এখানে মায়ের কাছে,তোকে কোথায় না খুঁজছি! বলেই হাঁপিয়ে উঠল দেবেন।

কেন রে?  কী হল? জিজ্ঞেস করলেন লক্ষ্মীদেবী।

মাগো, দারুণ খবর, বলেই দেবেনও পুকুরের জলে নেমে গেল।বলতে লাগল,কুমার পাশ করেছে মাইনর পরীক্ষায়, একবারে সেকেন্ড হয়েছে। এ কি কম কথা!

সেই সময় কলকাতায় একটি নর্ম্যাল স্কুল ছিল।যাঁরা মাস্টার, তাঁদের জন্য প্রশিক্ষণের স্কুল।পুরো নাম,Middle Vernacular or Middle English, সংক্ষেপে একেই মাইনর বা  নর্ম্যাল কোর্স বলা হয়।এই সংস্থা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা নিত।যারা পাশ করত, তারা নিখরচায় থাকা-খাওয়ার সুযোগ পেত।এবং পাশ করার পর, ছাত্রদের কলকাতায় পড়তে যেতে হতো।সেখানে পড়ানো হতো,বাংলা, অংক,ইতিহাস ও ভূগোল।এছাড়াও চিত্রাংকন ও ড্রিল শিক্ষা দেওয়া হত। সময়কাল তিনবছর। 

কুমার কথাগুলো শুনে মায়ের দিকে তাকালো।
লক্ষ্মীদেবী কুমারের মাথায় হাত রেখে বলে উঠলেন,দেখলি তো,জীবনে কুচুরিপানা জমতে দিবি না,এগিয়ে যাবি..
কুমারের চোখে আবার জল এসে গেল।

এ জল আনন্দের..  এক আশ্চর্য দরজা খুলে যাওয়ার আনন্দের... 

কলকাতা যেতে হবে।
সেই জব চার্নকের কলকাতা।ইংরেজ সরকারের রাজধানী কলকাতা।ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি সাবর্ণ জমিদার রামচাঁদ রায়,মনোহর রায় প্রমুখের কাছ থেকে ১৩০০ টাকায় সুতানুটি,কলকাতা,গোবিন্দপুর গ্রাম তিনটির প্রজাস্বত্ব কিনলেন।সে এক আশ্চর্যের আশ্চর্য মহানগর।বিনয় ঘোষের বর্ণনায়," পলাশীর যুদ্ধের পর নবাবী আমল অস্ত গেল।ইতিহাসের এক যুগ শেষ হল আর এক যুগ এল, যেমন পুরুষের পর আর এক পুরুষ আসে তেমনি।পুরুষাক্রমের সঙ্গে যুগানুক্রমের এই জৈবিক সাদৃশ্য একেবারে অর্থহীন নয়।"
সেই যে পুরাতনী খোলনলচে তৈরি হয়েছিল,তা তলে তলে প্রবহমান। 
এইভাবে কলকাতায় সৃষ্টি হল চোখ ধাঁধানো ধনাঢ্য,এরা মূলত বেনিয়ান এবং মুচ্ছুদ্দিরা। সেই সঙ্গে আছে কনট্রাকটারি,এজেন্সি দালালি এবং স্বাধীন ব্যবসাদার।
তৈরি হল মধ্যবিত্ত।
এরা দরিদ্র কিন্তু ভদ্রলোক। কেউ বাজার সরকার,কেউ মুহুরি,কেউ কেরানি,কেউ বা ছোট দোকানদার।
আর যানবাহন ছ্যাকরা গাড়ি।
তুর্কি শব্দ ছক্কড় থেকে ছ্যাকড়া।ঘোড়ায় টানা।আর অভিজাত হলেই পালকি। ছুটছে তো ছুটছেই...
বাকিদের জন্য পয়দল।
সেই সময়ের একটি পত্রিকা লিখেছিল,
" কত শত ফতো বাবু কলকাতা সহরে
বাবু বটে তনু বাবু দত্তবাবুর ঘরে।
গাজীপুরের গোলাপ জলে উঠানেতে ছড়া,
পাইখানাতে থাকে তাঁর আতর ঘড়াঘড়া।
ঢাকাই এর পাড় ছিঁড়ে লাগান কোমরে,
ভয় হয় পাশে লাগে কিংবা দাগ ধরে
সোনার থালে সোনার বাটী,পঞ্চাশ ব্যঞ্জন
রূপোর গাড়ুতে তাঁর পদ-প্রক্ষালন।
দত্ত বাবুর তত্ত্বকথা বড়ই চমৎকার 
কাঙালির তরে সদা দরোজা খোলা তাঁর"

এই হল বাবুকালচার। 
তারই পাশে এখনও বাতাসে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে কবিয়াল অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির গান,
"খৃষ্টে আর কৃষ্টে কিছু ভিন্ন নেই রে ভাই 
শুধু নামের ফেরে মানুষ ফেরে
এও কথা শুনি নাই।
আমার খোদা যে হিন্দুর হরি সে 
ঐ দ্যাখ শ্যাম দাঁড়িয়ে আছে
আমার মানবজমন সফল হবে
রাঙা চরণ যদি পাই"

সেই সঙ্গে মনে পড়ে যায় 'সংবাদ প্রভাকর' এর মুখর সাংবাদিক সম্পাদক এবং কবি ঈশ্বর গুপ্তের কলকাতা নিয়ে অন্ত্যমিল,
"ঘরে হাঁড়ি ঠনঠনান্তি
মশা মাচি ভনভনান্তি
শীতে শরীর কনকনান্তি
একটু কাপড় নাইক পিটে
দারা পুত্র হনহনান্তি 
অস্তি, নাস্তি ন জানন্তি
দিবে রাত্রি খেতে চান্তি
আমি ব্যাটা মরি খেটে।।"

মানবজমন সফল করতে গাঁ-গঞ্জ থেকে কাতারে কাতারে লোক বাসা গড়েছিল কলকাতায়।কত ঘটনা,কত সমাচার,কত আন্দোলন, কতরকম কারবারি, কতকিছুই না নতুন নতুন জীবনের সন্ধান মেলে কলকাতায়।
এই ভাবে চলতে চলতে নানা ঘটনার স্রোতে একদিন ভারতবর্ষের ভরকেন্দ্রে কংগ্রেস নামক একটি দলের ২৭ তম অধিবেশনে ঠাকুরবাড়ির বিখ্যাত পুত্র কবিবর গেয়ে উঠলেন,
"জনগণমন অধিনায়ক জয় হে"
অন্যদিকে এই পরিবারের একটি আগুনে মেয়ে, তার নাম সরলা দেবী চৌধুরানী,কংগ্রেসের ভেতর 'ভারত স্ত্রী মহামণ্ডল' গঠন করে সারা কলকাতাকে চমকে দিয়েছে।অন্যদিকে আলিপুর বোমা মামলা চলছে, সেই সঙ্গে চলছে বিপ্লবীদের একের পর বদলা নেওয়ার রোমহর্ষক অভিযান।
এর মাঝখানে একজন শান্ত সমাহিত সন্ন্যাসী সংসারী, যাঁকে সবাই মাস্টারমশাই বলে।তিনি প্রকাশ করলেন দক্ষিণেশ্বরের সেই পাগলা ঠাকুরের কথামৃত, তার চতুর্থ ভাগ। 
সেই রকম পরিস্থিতিতে কুমার চলল কলকাতায়...
একদিন মেদিনীপুরের এক দামাল ছেলে বীরসিংহ থেকে পায়ে হেঁটে কলকাতায় পড়তে গিয়ে কলকাতা তথা ভারতবর্ষের সুপ্রাচীন কুসংস্কারের খোলনলচে পালটে আধুনিক করে দিয়েছিল।
আবার একজন মেদিনীপুরের বাসুদেবপুর গ্রামের, সেও পায়ে হেঁটে যাত্রা শুরু করল মহানগরের দিকে...
কাঁধে একটা কাপড়ের পুঁটলি।আর বুকে অদম্য স্বপ্ন... 
এখানেই যেন পথদেবতা শোনায় কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের অমর পংক্তি,

" মহাজ্ঞানী মহাজন / যে পথে করে গমন
হয়েছেন প্রাতঃস্মরণীয় 
সেই পথ লক্ষ করে/ স্বীয় কীর্তি-ধ্বজা ধরে
আমারও হবো বরণীয়। "

ক্রমশ....

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 

Post a Comment

0 Comments