জ্বলদর্চি

মাটির বুকের মাঝে বন্দী যে জল মিলিয়ে থাকে /আবীর ভট্টাচার্য

মাটির বুকের মাঝে বন্দী যে জল মিলিয়ে থাকে

আবীর ভট্টাচার্য 

"মাটির বুকের মাঝে বন্দী যে জল মিলিয়ে  থাকে,মাটি পায় না,পায় না, মাটি পায় না তাকে॥..."-কবিগুরুর লেখা এই গানটির সঙ্গে নারী জীবনের কি আশ্চর্য সাদৃশ্য!
বাস্তবিকই, 'নারী'-এই ছোট্ট শব্দবন্ধটি আজন্মকাল থেকেই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে এক ইউটোপিয়ান আদর্শে আবর্তিত। অর্ধেক মানবী,অর্ধেক কল্পনাময় বিশ্বে তার নিয়ত সঞ্চরণ; ফলস্বরূপ, নারীও যে মানুষ, তারও যে স্বকীয় জৈবিক অস্তিত্ব আছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আমরা সবাই তা ভুলে যাই। তাই ঘটা করে দিবস উদযাপন,দেবী পূজার মাধ্যমে নারীকে 'লার্জার দ্যান লাইফ' দেখাবার যে প্রথা চলে আসছে, বিশেষতঃ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে, প্রতিদিনের জীবনে তার ছায়া পড়ছে কই!
ইতিহাসের দিকে আলতো চোখ ছোঁয়ালে দেখতে পাই, সভ্যতার আদিলগ্ন থেকেই  মানবজীবন নারীর ওপরে অনেকাংশে নির্ভরশীল। প্রাথমিক পর্যায়ে, পুরুষ বাইরে যেত শিকারে, জীবন-সমিধ ও খাদ্যসংগ্রহে, নারীর দায়িত্বে ছিলো ঘর,সন্তান,পশুপালন এবং চাষবাস। স্বাভাবিক ভাবেই, কৃষি অর্থনীতির উত্থান এবং সেখান থেকেই মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার উৎভব। ক্রমে সভ্যতা এগিয়েছে। কি বিদেশে,কি দেশে,গার্গী,মৈত্রেয়ীদের পাশাপাশি হাইপেশিয়ারাও স্বমহিমায় আলো ছড়িয়ে গেছেন বোধির আলোকবৃত্তে। শাস্ত্রে, সমাজে এবং দৈনন্দিন জীবনযাপনে নারীর সমানাধিকার ও মর্যাদা তখনও স্বীকৃত ছিলো।
ক্রমে নামে আঁধার। মধ্যযুগে নিরাপত্তা ও অপেক্ষাকৃত দুর্বল শারীরিক অক্ষমতার অজুহাতে  নারীকে গৃহবন্দী করে কূপমন্ডুক একদল পুরুষ; সমাজের অর্ধাংশ ঢেকে যায় অন্ধকারে। নানা বিধিনিষেধের অর্গলে পর্দাবৃত হয় ফেলে আসা আকাশগঙ্গা আলোপথ। কেড়ে নেওয়া হয় শিক্ষার অধিকার; পড়ে থাকে বিধিনিষেধ, ঘরকন্না আর কান্না।
সে এক ভয়ানক পরিক্রমা…
তবে,আঁধারের গহীনেও লুকিয়ে থাকে আলো, মাটির গহীনে জল। ইতিহাস কিংবা সময়ও থেমে থাকেনা। মহাকালের পথপরিক্রমায় পৃথিবীব্যাপী মহাযুদ্ধ ও শিল্পবিপ্লবের কারণে নারীকে আবার বেরোতে হয় ঘর ছেড়ে, নামতে হয় পথে, সংসারের প্রয়োজনে। কলে, কারখানায়,অফিসে, রাস্তায় পুরুষের সঙ্গে সমান তালে কাজে ফেরে তারা। তবু সেখানেও অসাম্য, একই কাজে বেতন বৈষম্য, শ্রম-বিভাজন। কিন্তু এবার আর অতীতের ভুল নয়, মেনে নেওয়া নয়, সমানাধিকারের প্রশ্নে পূর্ণমাত্রায় আন্দোলনে নামে নারী, কখনও একক, কখনও যৌথভাবে।

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে,এদেশে যখন ইংরেজদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামছে আপামর জনগন, মনে-মনে জ্বলছে বন্ধনমুক্তির এক মহাবিদ্রোহের আগুন;  রাজা রামমোহন রায়ের সতীদাহ প্রথারোধ, অনুবর্তী রাজনারায়ণ বসু ও বিদ্যাসাগরের স্নেহপ্লাবী অপার সৌজন্যে এদেশের মেয়েরাও আকাশ দেখার অধিকার ফিরে পাচ্ছে ধীরে ধীরে, অতিদূর সমুদ্রের পারে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের সুতা কারখানার নারী শ্রমিকেরা তখন ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন মজুরি-বৈষম্য, কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা, কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে, সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে। শুধুই সে দেশে নয়, পৃথিবীর সর্বত্রই কর্মী মানুষ, বিশেষতঃ মহিলা কর্মীদের ওপর চলেছে শাসকগোষ্ঠীর  দমন-পীড়ন, অত্যাচার, ছাঁটাই…
সব চলেছে, কিন্তু সুখের কথা, কোনও ভাবেই কখনও প্রতিহত করা যায়নি মুক্তি-আন্দোলন। বরং আঘাত যত তীব্র হয়েছে,শাসন যতই ঘিরে ধরেছে, ঐক্য এবং বিপ্লব আরও সাফল্যমন্ডিত হয়েছে, ইতিহাসের নিয়মেই।
নারীর নিজস্ব আন্দোলনের ক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় হয়নি। পথ চলতে চলতে, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, এভাবেই ১৯০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি নিউইয়র্কের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট নারী সংগঠনের পক্ষ থেকে আয়োজিত নারী সমাবেশে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন হয়। ক্লারা ছিলেন জার্মান রাজনীতিবিদ; জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির স্থপতিদের অন্যতমা। সেই সম্মেলনের রূপকথা পার হয়ে , আবার ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে, ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। ১৭টি দেশ থেকে ১০০ জন নারী প্রতিনিধি একসঙ্গে বসে ভাগ করেছিলেন তাঁদের কথা, সমস্যা এবং সাফল্যের গল্প। এ সম্মেলনেই ক্লারা প্রতিবছর ৮ মার্চ দিনটিকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব দেন।
যদিও কোনো আন্দোলনই কোন বিশেষ রূপক পছন্দ করেনা, তবু যাপনে তো উদযাপনও জরুরী। তাই সর্বান্তকরনে সবাই এই প্রস্তাব স্বীকার করেন, এবং সিদ্ধান্ত হয়, ১৯১১ খ্রিস্টাব্দ থেকে নারীদের সম-অধিকার প্রতিষ্ঠার স্মারক-দিবস হিসেবে এই বিশেষ দিনটি বিশেষ ভাবে পালিত হবে, জাতিসংঘও এই প্রস্তাব মেনে নেয়, প্রতিষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক শ্রম-নারীদিবসের স্বীকৃতি।

পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে,পৃথিবীময় এই 'বার্তা রটি গেল ক্রমে'...এদেশেও তার ঢেউ এসে লাগলো। 
দেশ তখন পরাধীনতার বন্ধনমুক্তির প্রয়াসে আকুল, দিকে দিকে জ্বলে উঠেছে বিদ্রোহের আগুন। শিক্ষা, সাহিত্য,আন্দোলন সহ সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এগিয়ে আসছে মেয়েরাও; এই শুভকর্মপথে  তারাই বা পিছিয়ে থাকে কেন?
১৯২১-২২ সালে, এই বাংলায়, সরলাবালা সরকার, সন্তোষকুমারী দেবীদের মতো বিশেষ কয়েকজন দুঃসাহসী মহিয়সী  একক চেষ্টায় অসংখ্য সঙ্গোপাঙ্গো নিয়ে চটকলের শ্রমিকদের স্বার্থে প্রকাশ্য রাস্তায় আন্দোলনে নামলেন, বিপুল জনসমর্থন পেলেন। নিজেদের তো বটেই, আড়ালে থাকা অসংখ্য নারীর গহনা, স্ত্রীধন, মানসিক সখ্য তাঁদের সাফল্যপথে আলো দিলো... এদেশের মুক্তিকামী মানুষের আন্দোলনে এসব কথা স্বর্ণাক্ষরে লেখা রইলো।

ক্রমে দেশ স্বাধীন হলো... অনেক পাওয়া এবং না পাওয়া,আশা এবং আশাভঙ্গের গল্প রচিত হলো; সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক অনেক সাফল্য পেলেও মেয়েদের ওপরে অবিচার বা অত্যাচার কিন্তু বন্ধ হলো না। তথাকথিত মৌলবাদী ধর্মান্ধতা,আগ্রাসন জড়িয়ে থাকলো পায়ে পায়ে, কাঠুয়া-হাসরথে জ্বলতে লাগলো পাশব পৌরুষ-কামাগ্নি; অবলীলায় চলতে লাগলো নারীমেধযজ্ঞ, অবজ্ঞা,অসম্মান। পাশাপাশি অনেক অনেক বরুন বিশ্বাসেরাও রইলেন বইকি নিজের প্রাণের বিনিময়ে অমর্ত্য আলো জ্বেলে। উদাহরণের ভারে লেখা ভারীকৃত না করেও তাঁদের দেবত্বের কথা ভুলি কি করে!

শেষের আগে এইটুকুই বলার, এই সমস্ত কিছু নিয়েই বয়ে চলেছে নদীসদৃশ বৃহত্তর নারীজীবন ও নারী আন্দোলনের পথপরিক্রমা। কখনও সাফল্য, কখনও ব্যর্থতায়, কখনও সদ্ভাবে, কখনও বিভাবে। তবে,অসুখের কথা এই যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সমাজ,এমনকি নারী নিজেও নিজেকে 'মেয়েমানুষ' ভাবে, শুধুমাত্র মানুষ নয়। তাই ফর্সা হওয়ার ক্রীমের এত্তো রমরমা,অথচ স্যানিটারি ন্যাপকিনের বিজ্ঞাপণে আজও ঢালতে হয় নীলরঙ!
তাই আজকের দিনেও, অর্থনৈতিক ভাবে স্বাধীন এবং শিক্ষিত নারীও সামাজিক ও গার্হস্থ্য নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন, আদালতের নিরাপত্তা সত্ত্বেও ঘটে যাচ্ছে নানা বিশ্রী অঘটন। তাই, শুধুমাত্র ব্রতপালন নয়, দোষারোপও নয়, মনে রাখি, অগ্রজার দেওয়া আপনার কাছে আপন নিজস্ব প্রতিশ্রুতি: একমাত্র প্রকৃত শিক্ষা এবং চেতনার বিকাশই পারে মেয়েদের তথা সমাজের মুক্তি আনতে। কারণ,'যে হাত দোলনা দোলায়,সে হাতই পৃথিবী শাষন করে।' 
স্বশিক্ষিতা,স্বাভিমানী,শরীরে-মনে সুস্থ নারীই একমাত্র পারেন এক উন্নত উজ্জ্বল সমাজ গড়তে; প্রায় দুশো বছর আগে জন্মানো চিরসখার সুরে সুর মিলিয়ে কৈফিয়েত চাইতে…'নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার কেন নাহি দিবে অধিকার!…'
       তবে, অধিকার তো কেউ দেয় না, অধিকার কেড়ে নিতে হয়।  আজকের পূণ্যদিনে রাখি তাই এই অঙ্গীকার: প্রেমে,দ্রোহে,বাৎসল্যে,প্রতিজ্ঞায় যেন সহযাত্রিনী হতে পারি পুরুষের, দেবীর পূজা নয়,দাসীর অনুকম্পা নয়, চাই আসঙ্গসুখ, চাই স্নিগ্ধ ভরসা…''সংসারগহনে নির্ভয়নির্ভর,নির্জনসজনে সঙ্গে রহো
…''। ত্রিভূবনের আলো যাত্রাপথে একসঙ্গে চলতে হবে 'সাবধানে জ্বালিয়ে অন্তরপ্রদীপখানি'...জয় হোক জীবনের,জয় হোক মানুষের। ধন্য হোক আন্তর্জাতিক নারী দিবসের উদযাপন।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 

Post a Comment

0 Comments