জ্বলদর্চি

অশোক মহান্তীর কবিতা : জীবন ভাঙা পথে ঈশ্বরের গান- ৪দিলীপ মহান্তী

অশোক মহান্তীর কবিতা : জীবন ভাঙা পথে ঈশ্বরের গান- ৪

দিলীপ মহান্তী
                                                                  
অশোক মহান্তীর দ্বিতীয় কবিতার বই 'ধৃতরাষ্ট্রের মা'। এই সময়ের  'ধৃতরাষ্ট্রের মা',  'মদনভস্ম', 'কুমারী গর্ভ' ইত্যাদি অনেক কবিতা মিথনির্ভর। এই ধারা পরে আরো এগিয়ে গেছে ও শক্তিশালী হয়েছে 'কুরুক্ষেত্রের শ্বেতপত্র', 'উত্তর কুরুক্ষেত্র', 'রাষ্ট্রনীতি' প্রভৃতি অসামান্য শিল্পসার্থক কবিতার মাধ্যমে। সমকালকে, রাজনীতিকে, ব্যক্তিগত জ্বালা-যন্ত্রণাকে মিথের বর্মের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। শিল্পের আয়নায় যা কখনো অসঙ্গত নয়। পাশাপাশি সরাসরি সমকাল নির্ভর উল্লেখযোগ্য কবিতাও অনেক। যেখানে তেমন কোনো আড়াল নেই। যেমন 'গর্ভপাত ১', 'গর্ভপাত ২'-এর কথা বলতেই হয়। এখানে সমস্ত সভ্যতার বেদনা কবিতার পংক্তিমালায় ঝরে পড়েছে। এই গ্রন্থে তিনি ব্যক্তি যন্ত্রণার পরিধি বাড়িয়ে সভ্যতার সংকটকে ধরলেন। আর সেই মহাকাশকে আগুনে পুড়ে যেতে দেখলাম। এই বিষয়টি আরো জোরালো ভাবে ফুটে উঠলো 'দ্বিতীয় সঙ্কেত' কাব্যগ্রন্থে। 'দ্বিতীয় সঙ্কেত' প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯২-এ। এই গ্রন্থটি তিনি উৎসর্গ করেছিলেন 'আবহমান যুদ্ধ ও দাঙ্গায় মৃত শিশুদের'। এই প্রসঙ্গে আরও একটি তথ্য জেনে নেওয়া জরুরি। কবির মৃত্যুর পর ‘যুদ্ধের বিকেল’ নামে যুদ্ধ বিষয়ক কয়েকটি কবিতা নিয়ে একটি কবিতা সংকলন প্রকাশ করেছিলেন তাঁর স্ত্রী। যার বেশির ভাগ কবিতাই পূর্বে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া। সেগুলির সঙ্গে কয়েকটি অগ্রন্থিত কবিতা নিয়ে সংকলনটি প্রকাশিত হয়েছে। যেমন: 'যুদ্ধের বিকেল', 'দেরি', 'জ্বর', 'কথা থাকে না', 'যুদ্ধ শেষে' এই কবিতাগুলি ‘দ্বিতীয় সঙ্কেত’ কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া। ‘সন্তানের চিতা সাজাচ্ছে মা’ আছে ‘ঘাস রঙয়ের আকাশ’ কাব্যগ্রন্থে আর ‘জেনারেল’ ও ‘যুদ্ধ’ আছে ’৪৮ বছরের স্বীকারোক্তি’ কাব্যগ্রন্থে।  উপসাগরীয় যুদ্ধ তাঁকে কিভাবে আন্দোলিত করেছিল তার ছাপ রয়েছে এই সমস্ত কবিতায়। এখানে তিনি অতিরিক্ত সময় সচেতন, আন্তর্জাতিক সমস্যা তাঁকে ভাবাচ্ছে। সেইসঙ্গে প্রখর ইতিহাস সচেতনও। সেই সূত্রেই এই পৃথিবীর মাটি ও মানুষ নিয়ে তাঁর চেতনালোকে সুন্দরের ও মাধুর্যের জন্ম হয়। সেই সুন্দরের আবির্ভাবে তিনি পৃথিবীর জটিল সমস্যা নিয়ে আতঙ্কিত হন এবং শুশ্রূষার বার্তা ছড়িয়ে দিতে চান। আমেরিকা ও ইরাকের যুদ্ধের পটভূমিতে সারা পৃথিবীর আবহমান যুদ্ধের বিরুদ্ধে ক্রোধ ও ঘৃণা ফুটে উঠতে দেখলাম এবং সমগ্র মানব জাতির প্রতি মধুর ভালোবাসার আশ্বাস দিয়ে জড়িয়ে ধরতে চাওয়ার আন্তরিক আবেদন চোখে পড়ল। এই গ্রন্থের বহু কবিতাই উল্লেখযোগ্য:

 ১. 'এখন চোখের সামনে ছড়িয়ে রয়েছে এক উদভ্রান্ত বিকেল।
       এ-মুহূর্তে ভারতের মাটি থেকে ক্ষেপণাস্ত্রবাহী কোন বিমান উড়ছে না
       তবু ভয়, যে কোন মুহূর্তে হয়তো উড়ে যেতে পারে।

      যে শিশুটি এ-মুহূর্তে ইরাকে জন্মালো তার সদ্য পাটভাঙা বিছানায়
      অমল প্রসূতিগন্ধ। তার চোখে সূর্য নাকি আগুন বন্দনা
      একথা জানার আগে সেকি আজ অন্ধ হয়ে যাবে?

      আমি সমস্ত আলোর দৃশ্য তার জন্য মুক্ত করে রাখি।

     আজ আগুন ও জলের কাছে অবিরত আমাদের একই প্রশ্ন জাগে বারবার
     আমরা এ পৃথিবীকে আজও কেন স্বদেশ ভাবিনি। চারিদিকে মহাশূন্য
     মহানীল মৃত্যুর ভেতর থেকে যে মানুষ উঠে এলো তার হাতে মৃত্যু, রক্তচিহ্ন
     সেকি এই যুদ্ধ চেয়েছিলো?

     সহসা হাতের মুঠো শক্ত হয়ে আসে।
     এ মুহূর্তে কেউ যদি বলে- তুমি এই যুদ্ধে কার সমর্থক ?
      আমি নিশ্চিত বিশ্বাসে ওই ভারিবুট-পরা জওয়ানের
      হাতের রাইফেল থেকে যে গুলি ঢুকেছে ওই ইরাকের শিশুটির গায়ে
      তাকে প্রতিপ্রশ্ন রাখবো, তুমি কি এমন মৃত্যু সমর্থন করো?
      তুমি কি নিজের মৃত্যু সমর্থন করো?

      আমি কারো সমর্থক নই
      যেহেতু নিজের মৃত্যু আমি নিজে স্বাক্ষর করিনি।
         (যুদ্ধের বিকেল: দ্বিতীয় সঙ্কেত)

২. ' ইরাক সীমান্তে আজ ঝড়।
     ভারতের বুকে আজ জাতপাত, যুদ্ধবিমানের তেল নিয়ে
     কুটিল ও বিশ্রী গল্প। দেখতে দেখতে বছর পেরিয়ে যাচ্ছে
     অস্ত্রমুক্ত হলো না পৃথিবী, আগ্রাসন এক ইঞ্চি কমলো না।

    আমারও তো কথা ছিলো- পৃথিবীকে শান্তি ফিরে দেবো
    আমারও তো কথা ছিলো- মানুষে মানুষে এই ভয়ংকর, রক্তপাত থেকে
     আরেক নিখিল অস্তি, শুভবোধ 
     আরও এক নবীন নির্মাণ ভ্রাতৃত্বের।

    অথচ বিশ্বাস করো, এক বিশ্ব থেকে আমি আরেক বিশ্বের কাছেই ঋতু
    এক বিশ্ব থেকে আমি আর এক বিশ্বের কাছে -মাটি
    আমি অস্ত্র,  আকাশ,  আগুন, বায়ুজল
    আমি শান্তি, শান্তির ভেতরে নীরবতা।
    আমি মরুর উদ্যানে ফুল, বসন্তগুটিকা, আমি ক্রোধ
    আমি নির্বীর্য শয়তান না, কবিকর্মী, শব্দ দিয়ে গড়ি
     আমার রঙীন বিশ্ব।'
                (কথা থাকে না: দ্বিতীয় সঙ্কেত)

জ্বর,  দাঙ্গার রাত,  দেরি,  যুদ্ধ শেষে প্রভৃতি কবিতায় তাঁর প্রতিবাদী ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি আমাদেরও শিক্ষা দিয়ে যায়। তাঁর কবিতায় তিনি প্রায় সময়ই মানুষের কথা বলেন। শোষিত,  নিপীড়িত, সর্বহারা,  খেটে খাওয়া মানুষের কথা। কিন্তু তিনি নিজে কখনো মিছিলে হাঁটেননি। অর্থাৎ বলতে চাইছি সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন না। কোনো রাজনৈতিক দলের সমর্থনে শ্লোগানধর্মী কবিতাও তিনি রচনা করেননি। তিনি পাবলো নেরুদার মতো শ্রমিকদের সামনে কবিতা পড়ে তাদেরকে সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করার জন্যও কবিতা লেখেননি। তিনি শুধু দূর থেকে মানুষ কে  লক্ষ্য করে তার সংগ্রামে, শোষণে,  অত্যাচারে,  ক্ষত-বিক্ষত হৃদয়ে একটু সহানুভূতি স্পর্শ একটু সহমর্মিতার বাতাস বুলিয়ে দেন:

১.  'সারারাত উন্মত্ত সাগর থেকে ছুটে আসছে হাওয়া
      সারারাত তোমার কঠিন -চোখে প্রতিজ্ঞা জ্বলেছে।
      দূর-বাংলায় বসে আমি দেখছি ফসলে- ফসলে মরছে গ্রামদেশ
      আকাশে- আকাশে ভরছে তারা। আর তুমি মৃত শিশুটির চোখে
       গরম ভাতের স্বপ্ন দেখতে দেখতে শেষরাতে ঘুমিয়ে পড়েছো।

       আমি ভারতের এক কবি, নগণ্য মানুষ একজন
      যাকে তুমি চেনো না কখনো।
       তবু আমি তোমাকেই সমর্থন করি।
       আমার সমস্ত দ্বিধা, সংশয় অন্ধতা পার হয়ে তোমাকেই জেনে গেছি
       এ বিশ্বের নতুন একজন, হুমকিকে যে পরোয়া করেনা।
       যে একা দাঁড়াতে পারে, হাঁটতে পারে, বুঝতে পারে
       নিজের ইচ্ছার মূল্য বুশের ইচ্ছার চেয়ে দামি
       যে নিজেকে স্বাধীন জেনেছে।

      ভারতের স্বাধীন মানুষ আমি- স্বাধীনতাবোধটুকু তোমাকে দিলাম
      ভারতের দরিদ্র মানুষ আমি- অপরাজেয় মন্ত্র তোমাকে দিলাম
      ভারতের শক্তি আর সামর্থ্যের কাছ থেকে যে বিশ্বাস পেয়েছি জীবনে
      একজন ভারতীয় কবি হয়ে সে বিশ্বাস তোমাকে দিলাম
      তুমি জাগো। কিউবার স্বাধীন মানুষ, জাগো।
      অদম্য প্রাণের শক্তি, জাগো।'
          (কিউবা: দ্বিতীয় সঙ্কেত)

২.  'উঠে এলো শ্রমজীবী, ক্ষুধাতুর
      তবু এক অমলিন-মনুষ্যত্বে ভর-করা ক্রাচে
      বুকে বিপ্লবের বীজ বুনতে বুনতে 
      বিগত দিনের সেই স্মৃতি আর রক্তের উদ্দাম নৃত্য
      দেখতে দেখতে একেবারে সভ্যতার শেষ প্রান্তে
    দাঁড়াতে দাঁড়াতে হয়তো বলে উঠলো:
    'আমার সম্মুখ থেকে ক্ষুধাকে তাড়াও,আমি দেখি
    আর এতদিন যা শেখালে আমি সব ভুলে যেতে চাই

     ক্ষুধা নয়, ভেতরে ভেতরে ছিল বসন্তের অমোঘ-কামনা
     কাম্য ছিল মহত্ত্বও।'
        ...
     কত মৃত্যু এখানে ফেলেছে পা।
     কত সুদীর্ঘ জীবন ইতিহাস হয়ে আছে।
     যুদ্ধ-উন্মাদনা, ক্রমাগত শ্রমিক বিদ্রোহ-
     আর রাজাবদলের দিন।'
           (চিরকালীন:আলোক শিশির)

        বিশিষ্ট কবি ও সমালোচক প্রভাত মিশ্র ২০.৪.৯৬ এর এক চিঠিতে অশোক মহান্তীকে জানাচ্ছেন!
প্রিয় অশোকবাবু,
মার্জনা করবেন। আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে এত ব্যস্ত থাকি যে, সময়মত বন্ধু-বান্ধবদের পত্রোত্তর দেওয়া যায় না। আপনার কবিতার বই পেয়েছি। তবে তিনটি নয়, দুটি  'মাটির মন'   এবং 'দ্বিতীয় সঙ্কেত'। যতদূর মনে হয় 'আলোক শিশির' পাইনি। আমার একান্ত অগোছাল বইপত্তর থেকে আপনার দুখানা বই ই পেলাম। জানিনা, হারিয়ে ফেলেছি- কিংবা কেউ নিয়ে গেছে কিনা।
অশোকবাবু আমি সেই সাতের দশক থেকে আপনার কবিতা পড়ছি। কোন পত্রিকায় পেলেই পড়ে ফেলি। আপনি যখন দীর্ঘ বাক্যবন্ধে কবিতা নির্মাণ করতেন- সেইসময় থেকেই আমি আপনার কবিতার একজন মনোযোগী পাঠক।
সাম্প্রতিককালে আপনি অনেক সহজ হতে চাইছেন। অথচ তীব্র জীবনবোধের রসে আপনার কবিতার বাক্যগুলি উজ্জীবিত। বিশেষ করে এই নয়ের দশকের কিছু অতি তরুণ কবির শব্দ নিয়ে লড়ালড়ির কবিতা দেখে দেখে যখন মনে হয় এ আমরা কোথায় চলেছি, তখন আপনাদের মত দু-একজনের সাবলীল জীবনরস সম্পৃক্ত কবিতা পংক্তি কবিতার প্রতি পুনরায় বিশ্বস্ত করে তোলে। আপনার 'দ্বিতীয় সঙ্কেত' ও' মাটির মন' বই দুটি পড়েও একই কথা বলতে ইচ্ছে হল। তবে কেন জানি না মাটির মনের তুলনায় দ্বিতীয় সঙ্কেত আমার কাছে প্রিয় কবিতার বই হয়ে উঠল। দ্বিতীয় সঙ্কেতের প্রতিটি কবিতায় যেমন সুবাস তেমনি জীবন্ত। স্রোতটান, নক্ষত্র, দাঙ্গার রাত,বা জ্বর কবিতা অসাধারণ। আমি জানি আপনি বাংলা কবিতার একটি একক কন্ঠস্বর। জিজ্ঞাসায় আপনার কবিতা পড়লাম। বেশ ভালো কবিতা। চিঠি দেবেন।
      ভালোবাসায়
       প্রভাত মিশ্র।

        অশোক মহান্তীর কবিতাচর্চায় শুধু বাংলা কবিতার ইতিহাসই নয় বিশ্ব সাহিত্যের সুচারু পরিক্রমা ও অনুশীলন গভীরভাবে কাজ করেছে। স্বভাবে ও চর্চায় তিনি আপাদমস্তক কবি,  বিভোর, আত্মমগ্ন,এক মায়াবী ব্যক্তিত্বের অধিকারী; যাঁর উপস্থিতি বা আকর্ষণ অগ্রাহ্য করা যায় না আবার কখনো নিঃসঙ্গ কিন্তু শব্দের প্রতি সৎ ও গভীরভাবে অনুরক্ত। তেমনভাবে কোন রাজনৈতিক কর্মযজ্ঞে অংশগ্রহণ করেন না, সামাজিক-মানবিক আনন্দযজ্ঞে অংশগ্রহণের অতি উৎসাহে আপন পর ভুলে মাতামাতি করেন না। সেই হৈ হুল্লোড়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন না কিন্তু আমাদের চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলি দেখে তিনি চুপ করে বসে থাকেন না। উদাসীন যোগী সাজেন না। সেইসব ঘটনা তাঁর কবিতার বিষয় হয়ে যায়, কোনো ভান ছাড়াই। তাঁর জীবিকা, তাঁর সংসারও হয়ে ওঠে কবিতার বিষয়। তিনি হয়তো বিশ্বাস করতেন কবিতার দ্বারা পৃথিবীকে পবিত্র ও জীবনকে মহৎ করে তোলা যায়। সেই চেষ্টাই তিনি করতেন। এক বাসযোগ্য আগামী পৃথিবীর কথা ভাবতেন:

১. কী চেয়েছি আমরা, আর কী চাইনি
      সেসব কোনকিছুই জরুরি নয় এখন।
      একমাত্র জরুরি হলো আগামী বিশ্বে কেমন করে  মানুষ বাঁচবে
      তারই একটা ইস্তাহার প্রচার করা।
      যার মধ্যে থেকে যাবে গাছ, পশুপাখি, ফলমূল, নদী-পাহাড়
      আর আজকের দেখা পুরো একটা জগতের ছবি।'
               (যুগান্তর: মাটির মন)

২. 'সম্ভবত একটি মশাল জ্বলে উঠবার প্রতীক্ষা। এই সামান্য অবসরে
    যখন কচি কচি মধুমন্তী ঘাস জেগে উঠছে জমির আলকিনারায়
    তখনো সূর্যোদয়ের সময় হয়নি। ভোর...ভোর... শুধু ভোরের দিকে তাকিয়েই
    এমন অক্ষম রাত্রি চলে যায়।
    মশাল জ্বলে উঠবে। সমস্ত আকাশ আলো করে জ্বলে উঠবে মশাল।
     ব্যক্তিগত এই আমার সীমাহীন অন্ধকারে তাই কুঁজো হয়ে উঠছে মৃৎপাত্র
     মেয়েমানুষ হয়ে উঠছে মা।

    আর আমার সমস্ত মুগ্ধতা সেই মশালের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে বলেই 
     হৃদয়ে এত অগ্নুৎপাত, এত লাভা, এত জলস্রোত।
                          (মশাল: মাটির মন)

    আমাদের মনে পড়তে পারে ভিক্টর হুগোর কথা। তিনি মনে করতেন সেই কবিতাই প্রকৃত কবিতা যার ভিতর থাকে বৃহতের ভাব। অশোক মহান্তীও ছোটো ছোটো কবিতা লিখেছেন প্রচুর, কিন্তু তাঁর কবিতা একটু যত্ন সহকারে পড়লেই বোঝা যায় তিনি এই ছোটো ছোটো কবিতার মাধ্যমে এক বড় কিছুকে ধরতে চাইতেন। ভাবনার গভীরতায় ও পরিবেশনের মৌলিকতায় ছোটো পৃথিবীর সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে পৌঁছাতে চাইতেন বড় পৃথিবীর গভীর রহস্যের মধ্যে। প্রকৃতি-মানুষ-জন্ম-মৃত্যু-মহাকাশ-ঈশ্বর এই গভীর রহস্যে। সৃষ্টির মুহূর্ত থেকে বয়ে চলা জাগতিক বিষ্ময়কে ছুঁতে চাইছেন:

১. 'যে বালিকা নারী হলো- তারও লজ্জা এখনো ঘোচেনি।
    আড়ালে সে বেঁধে রাখে বেণী-

     লজ্জা সীমন্তের।

    শাদা সিঁথি রাঙা হয়, আরো শাদা, আরো লজ্জা দেয়।'
         (বামা: মাটির মন)

২. 'আছি । কিন্তু ,থাকবো না। বজ্রগর্ভ মেঘে
    প্রত্যহ নিজেকে দেখা, সুতীব্র আবেগে

   আমি যে ছিলাম-এই পরাবাস্তবতা
   জলের অক্ষরে দেখে, জলের কবিতা।'
       (জলের কবিতা: ঘাস রঙয়ের আকাশ)

৩. 'গায়ের পোশাক খুলে দিলে, যে রকম অন্ধকারে
                       জ্বলে ওঠে নারীর শরীর

          
                    সেভাবেই জ্বলে উঠলো চাঁদ
                   আকাশের দুর্গম আড়ালে।
            (চন্দ্রোদয়: ঘাস রঙয়ের আকাশ)

৪. 'তোমাকে যে ভালোবাসি -এই কথা উচ্চারণ করতে হলে 
                      শ্মশানের শান্তি চাই,
             মালিনী নদীর জলে ভেসে যাওয়া শিবসন্ধ্যা
                 এক হাজার রাত্রির নিঝুম
    আমি কোথায় তা পাবো?

    আঙুল ছুঁয়েছি তাই,
     আঙুলেই তোমাকে চমকাবো।’
          (স্পর্শ:ঘাস রঙয়ের আকাশ)

৫.  'যতদূর যেতে যেতে তোমার হৃদয়গন্ধ পাবো
      ততদূর জেনো আমি অমোঘ এ-মৃত্যুকে আটকাবো।'
          (পিপাসা:ঘাস রঙয়ের আকাশ)

     নিবিড়ভাবে লক্ষ্য করলে বোঝা যায়    ছোটো ছোটো এইসব কবিতা যেন বাস্তব পৃথিবীর সংকীর্ণ গন্ডীবদ্ধ জীবনের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে যেতে চায়। এক শিল্পের মহাকাশ রচনা করতে চায়। আসলে তিনি কয়েকটি শব্দের স্থাপত্যে রচনা করে চলেছেন মহৎ কবিতা। যা চিরকালীন। যিনি পরবর্তী প্রজন্মের কাছে, পাঠকের কাছে তীব্রতর করে তুলবেন জীবন জিজ্ঞাসা। জীবনকে দেখার এক নান্দনিক দৃষ্টিভঙ্গি।
   ‌‌     এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে জীবনানন্দ দাশের কথা। তিনি 'কবিতার কথা'য় বলেছেন:'মহৎ কবিতা জ্ঞানে গভীর নয় শুধু, অথবা প্রাকৃত জীবনের ব্যাপার নিয়ে নিবিড় নয় কেবলমাত্র, কিন্তু এই দুই জিনিস মিলে এক হয়ে গেছে সেখানে এমনই আত্মিক নিবিড়তায় ও গাণিতিক শুদ্ধতায় যে সহসা মনে হতে পারে যে মিলোনোৎপন্ন কবিতা জ্ঞান নয় আর, জীবনও নয় যেন, জীবনের সঙ্গে সমান্তরাল জিনিস।'
    
জীবনের সমান্তরাল বলেই কবি অশোক মহান্তীর জীবন এত সংবেদনশীল ও সহানুভূতিশীল, এত সৃষ্টিধর্মী। আর এসবের মধ্যে থেকে যায় একটা ব্যথা ও অভাববোধ, একটা বুক নিঙড়ানো কান্নার চোরা স্রোত। যেখান থেকেই শুরু হয় এক অনন্য সৃজন প্রক্রিয়া। শিল্পের প্রতি এই আগ্রহ ও সত্যনিষ্ঠায় তিনি সত্যিকারের জীবন শিল্পী। শিল্পের আগুনের আঁচে তিনি নিজে পোড়েন, অন্যকেও পোড়ান।
     ( ক্রমশ )

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments