জ্বলদর্চি

গওহরজান- এক বিস্মৃত অধ্যায় - ২/দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

গওহরজান- এক বিস্মৃত অধ্যায়   
পর্ব - ২                                                                                                       
 
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী     

গত পর্বে যে বিখ্যাত বাঈজীর কথা উল্লেখ করেছিলাম তিনি হলেন উনবিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত বাঈজী গওহরজান। তাঁর আমলে তিনি তার রূপের জৌলুসে, বুদ্ধিদীপ্ত কথাবার্তায়, কন্ঠে সুরের মায়াজাল বিস্তার করে এবং সর্বোপরি বিভিন্ন ভাষার গানে পারঙ্গম হওয়ার সুবাদে যেমন শ্রোতা-দর্শকদের মনের মনিকোঠায় স্থান করে নিতে পেরেছিলেন, অনুরূপভাবে তিনি ভীষণ দেমাকীও ছিলেন। কতগুলি ভাষায় তিনি যে গান গাইতে পারতেন কলকাতায় তাঁর একবারের অনুষ্ঠানের গায়কীতে তিনি তা পরিস্ফুট করেছিলেন। সেই ঘটনার কথা এখানে উল্লেখ করছি। 

কলকাতার জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত মল্লিক ভবনে ১৯১৩ সালে মতিলাল মল্লিকের বড় ছেলে মুরারিমোহন মল্লিকের বিবাহ অনুষ্ঠানে এক সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ইংরেজ, বাঙালী, মাড়োয়ারী, রাজস্থানী ও পাঞ্জাবী সম্প্রদায়ের লোকজন। অনুষ্ঠান শুরুর আগে গওহরজান উদ্যোক্তাদের অনুরোধ করেছিলেন ভাষার ভিত্তিতে যেন দর্শকদের বসার ব্যবস্থা করা হয়। উদ্যোক্তারা যদিও তাঁর এই বিশেষ অনুরোধের তাৎপর্য অনুধাবন করতে পারেননি তথাপি তাঁর অনুরোধে উদ্যোক্তারা দর্শকদের সেইভাবে বসার অনুরোধ করেছিলেন। তিনি দর্শকদের প্রত্যেক গোষ্ঠীর কাছে যেয়ে আলাপ করে ইংরেজি সাহেবে-মেমদের কাছে ইংরেজিতে গান গেয়েছিলেন এবং গানের পরে নাচ করেছিলেন। অনুরূপভাবে পাঞ্জাবীদের কাছে যেয়ে পাঞ্জাবি টপ্পা, মাড়োয়ারি ও রাজস্থানীদের জন্য হিন্দি ও উর্দুতে ঠুমরী ও দাদরা গান এবং বাঙ্গালীদের আছে যেয়ে দুটি বাংলা গান গেয়েছিলেন। দুটি বাংলা গানের মধ্যে আবার একটি রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে ছিলেন। যে গানটি হল 'কেন চোখের জলে ভিজিয়ে দিলেম না.........'। সেই অনুষ্ঠানে প্রত্যেক ভাষাভাষীর দর্শকদের মনে হয়েছিল তিনি যেন তাদের জন্যই গান গাইলেন। তাঁর এই গুণের জন্য তিনি সেই সময়ের অন্যান্য বিখ্যাত শিল্পীদের থেকে অনন্য ছিলেন। তাঁর গাওয়া বাংলা গান শুনে কারও পক্ষে বোঝার উপায় ছিলনা যে তিনি বাঙালী নন। 

আবার একবার বোম্বের এক অনুষ্ঠানে আগ্রার বিখ্যাত জোহরা বাঈয়ের পরে তাঁর গান গাওয়ার কথা ছিল। জোহরা বাঈ ছিলেন খেয়াল গানের এক অতুলনীয় শিল্পী যে খেয়াল গানের মধ্য দিয়ে তিনি ঘন্টার পর ঘন্টা একটি রাগের রূপকে ফুটিয়ে তুলতেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত শ্রোতারা জোহরা বাঈয়ের গান শুনে অধৈর্য্য হয়ে বিরক্তি প্রকাশ করতে লাগলেন। গওহরজানও খেয়াল গান পরিবেশন করবেন বলে মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন, কিন্তু দর্শকদের বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখে তিনি আসরে উপস্থিত হয়ে মারাঠি নাট্য সংগীত দিয়ে তার গানের ডালি সাজিয়ে তোলেন এবং প্রত্যাশামতো দর্শকেরা সঙ্গে সঙ্গে তাঁর গান শুনে আকৃষ্ট হয়ে হাততালি দিয়ে তাঁকে অভিনন্দন জানান। এর পরে অবশ্য গওহরজান বিলম্বিত, অতি বিলম্বিতএবং বিশদ বিস্তারের অংশ বাদ দিয়ে খেয়াল গানের ভারী উপস্থাপনা না করে ছোট ছোট গানের কোলাজ তৈরি করে দর্শকদের হৃদয় জয় করে নিলেন।           

কোন আসরে কি গান গেয়ে দর্শকদের মন জয় করতে পারবেন গওহরজানের থেকে বুদ্ধিমতী গায়িকা ভূ-ভারতে আর কেউ ছিলেন না। লক্ষ্মৌয়ের চৌধুরী বোনেরা এই সময়ে বিখ্যাত ছিলেন। একবার লক্ষ্মৌয়ের এক অনুষ্ঠানে চৌধুরী বোনেরা, যারা 'নানুয়ান' ও 'বাচ্চুয়ান' নামে বিখ্যাত ছিলেন, তাদের কোঠায় এক সান্ধ্য আসরের আয়োজন করেছিলেন যেখানে জোহরা বাঈ ও গওহরজান উপস্থিত ছিলেন। নানুয়ান ও বাচ্চুয়ানের গান দিয়ে আসরের সূচনা হওয়ার পরে জোহরা বাঈ একটি অসাধারণ খেয়াল গান গেয়ে উপস্থিত দর্শকদের তারিফ আদায় করেছিলেন। স্বভাবতঃই গওহরজান চিন্তা করলেন জোহরা বাঈয়ের অসাধারণ খেয়াল গানের পরে দর্শকেরা আর তাঁর খেয়াল গান শুনতে চাইবেন না। কিন্তু তিনি তো আর দমবার পাত্রী নন। তিনি আরম্ভ করলেন তাঁর বিখ্যাত ঠুমরি গান 'রস কে ভরে তোলে নয়না'। ভাইয়া গণপতরাওয়ের শিষ্য বসির খান গওহরের সঙ্গে হারমোনিয়ামের সঙ্গত করে ঠুমরির গানের ছোট ছোট আবেগঘন অভিব্যক্তি ও সুরের মূর্ছনা ফুটিয়ে তুলেছিলেন। গওহরের অনুষ্ঠানের শেষে দর্শকরা যেন ভুলে গিয়েছিলেন যে তাঁর আগে জোহরা বাঈয়ের অসাধারণ খেয়াল গানের কথা।                      

১৯০২ সালে গ্রামোফোন কোম্পানির শুরু করা গানের রেকর্ডিংয়ের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন সুপারস্টার। কে ছিলেন এই গওহরজান এবং তাঁর জন্ম পরিচয়ই বা কি সে সম্বন্ধে আলোকপাত করার জন্য আমরা ফিরে যাব উনবিংশ শতকের প্রথমার্দ্ধে। 
                                                               



উনবিংশ শতকের তৃতীয় দশকে তৎকালীন ভারতবর্ষের যুক্তপ্রদেশের পূর্বদিকে দুর্গ ঘেরা এক শহর আজমগড়। মুঘল সম্রাট শাহজাহানের অধীনস্থ প্রতাপশালী জমিদার আজম খান এই শহরের গোড়াপত্তন করেছিলেন। আজম খানের নাম অনুসারে শহরের নাম হয়েছিল আজমগড়। শহরতলীর দুর্গ ও বাজার অঞ্চলটি জমিদার আজম খানের ভাই আজমত খান তৈরি করেছিলেন। আজমগড়ে অসংখ্য ব্রিটিশ বাসিন্দাদের ন্যায় হার্ডি হেমিংস নামে একজন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ সামরিক অফিসার এখানকার 'নীলকুঠি' নামের একটি বাংলোতে থাকতেন। কিছুদিন এখানে থাকার পরে উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্দ্ধে ব্রিটিশ আর্মি অফিসার রুক্মিণী নামে এক ভারতীয় সুন্দরীকে বিয়ে করেন। ধর্মান্তরিত হওয়ার পরে রুক্মিণীর নাম হয় এলিজা হেমিংস। তাদের দুজনের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সম্পর্ক বজায় ছিল। কয়েক বছরের মধ্যে রুক্মিণী দুটি ফুটফুটে কন্যা সন্তানের জন্ম দেয়। ১৮৫৭ সালে জন্ম হয় প্রথম মেয়েটির, যার ডাকনাম ছিল বিকি। চার্চে  ব্যাপটাইজড্ হওয়ার পরে তার নাম হয় ভিক্টোরিয়া এবং এর দু'বছর পরে ছোট মেয়েটির জন্ম হয় যার ডাকনাম ছিল বেলা। দুই মেয়ে ও ভারতীয় স্ত্রী রুক্মিণী ওরফে এলিজা হেমিংসকে নিয়ে হার্ডি হেমিংসের দিনগুলি আনন্দেই কাটছিল। কিন্তু আকস্মিকভাবে হার্ডি মারা যেতে রুক্মিণী দুই মেয়েকে নিয়ে অকূলপাথারে পড়লেন। তখনকার দিনে ব্রিটিশ আইনে কোন ভারতীয় মহিলা ব্রিটিশ কোন বাসিন্দাকে বিয়ে করলে তার সম্পত্তি উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত হতেন না। যতদিন জীবিত থাকতেন ততদিন খাওয়া-পরা, বাসস্থান এবং আমোদ আহ্লাদে থাকতেন। স্বামীর মৃত্যুর পরে তিনি কিন্তু নিঃস্ব, রিক্ত, অসহায় হয়ে যেতেন।                        

এই অবস্থায় রুক্মিণী গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য স্থানীয় একটি বরফ কলে শ্রমিকের কাজ নিলেন যাতে তাদের খাওয়া বা থাকার সমস্যার সমাধান হলো, কিন্তু মেয়েগুলির পড়াশোনার কোন সুবন্দোবস্ত হলো না। এই সময়ে বরফ কারখানাতে রবার্ট উইলিয়াম ইয়েওয়ার্ড নামে একজন সুদর্শন তরুণ আর্মেনীয় ইঞ্জিনিয়ার কাজে যোগদান করলেন। কিছুদিনের মধ্যে রবার্ট একদিন রুক্মিণীর বাড়িতে যেয়ে বিকিকে দেখে খুব পছন্দ হয় এবং তার মায়ের কাছে রবার্ট বিকিকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেন। ১৮৭২ সালের ১০ই সেপ্টেম্বর রবার্ট ও বিকি ওরফে ভিক্টোরিয়ার মধ্যে বিবাহ হল এলাহাবাদের হোলি ট্রিনিটি চার্চের যাজক রেভারেন্ড জে, স্টিভেনসনের তত্ত্বাবধানে। রবার্ট ও ভিক্টোরিয়ার মধুর দাম্পত্য জীবনে অল্প কয়েকদিনের মধ্যে এক ফুটফুটে শিশু কন্যার জন্ম হলো ১৮৭৩ সালের ২৬শে জুন, যার নাম খ্রীষ্টান ধর্মের প্রথা অনুযায়ী ব্যাপটাইজড্ করে রাখা হয় এলিনা অ্যাঞ্জেলিনা ইয়েওয়ার্ড। এই অ্যাঞ্জেলিনা পরবর্তীকালে ধর্মান্তরিত হয়ে ভারত বিখ্যাত গায়িকা গওহরজান রূপে আত্মপ্রকাশ করলেন। কিন্তু তার পূর্বে যে ঘটনাগুলি ঘটেছিল যেগুলি প্রকাশ না করলে পাঠক ভাবতে পারেন অ্যাঞ্জেলিনা কিভাবে গওহরজান হলেন। 
                                                               ক্রমশঃ…….

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments