জ্বলদর্চি

ডাবর /শ্রীজিৎ জানা

ডাবর

শ্রীজিৎ জানা


বাজারের উত্তর কোণটায় ভিড় দেখে সাইকেল থামিয়ে দ্যায় সুরঞ্জন। চারদিকে লোকজন কাউকে যেন ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। একধরনের ধাতব গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে বাজারময়। সাইকেলটা স্ট্যান্ড করে  ভিড়ের দিকে সে  হাঁটা দ্যায়।
গ্রাম থেকে কয়েক কিমি দূরে জেলাশহরগামী পিচ সড়কের পাশে গড়ে ওঠা বাজার। ক্রমে মারাত্মক জৌলুস বেড়েছে তার। গুচ্ছের দোকানপাট। খাবারদাবার, সাজপোশাক, ঘরগেরস্থের হাবিজাবি জিনিসপাতির সম্ভারে নজরকাড়া তাদের লোভনীয় আমান্ত্রণ! বাহারি নামের হোর্ডিং লাগানো সামনে। চা দোকানের নাম টি এন্ড টক অথবা চায়ে পে চর্চা। ফাস্টফুডের নামে হ্যাংলা, খাইখাই অথবা পেটুক। কসমেটিক অথবা বিউটি পার্লার মানেই রূপলাগি,সাইন এন্ড সাইন ইত্যাদি কত নাম! রাতে বাজার দুধসাদা আলোয় থইথই করে। দোকানের মুখমণ্ডল রঙিন আলোর বিচ্ছুরণে আরো মোহময়ী সাজে প্রলুব্ধতা ছড়ায়। 
বাজারের চেহারাতে যত চেকনাই এসেছে, লাগোয়া জায়গার দরদাম বেড়েছে হু হু করে। সামনেই বিষ্ণুপ্রিয়া উচ্চ বিদ্যালয়। পিঠোপিঠি একটা প্রাইমারি স্কুল আর একটা বেসরকারি ইংলিশ মিডিয়ম স্কুল। কয়েক পা হাঁটা দিলেই অঞ্চল অফিস। গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র। ধানিজমি গিলে খাচ্ছে কংক্রিট দেয়াল। আশেপাশের গ্রাম উঠে এসে বাসা বাঁধছে আধা শহরমার্কা বাজারে। গেঁয়ো গন্ধ মুছে দিতে চাইছে চাকুরে এবং স্বর্ণশিল্পীরা। সাথে একটা ভালো সংখ্যক ব্যাবসায়ীরাও। 
সুরঞ্জন গ্রাম থেকে উঠে এসে এখানেই জমি কিনে নীড় সাজিয়েছে। বাড়ির নাম রেখেছে 'স্বপ্নপূরণ'। যদিও এই স্বপ্ন সুরঞ্জনের নয়- অমৃতার। বহুদিন ধরে তার এই স্বপ্ন গোছানো ছিল মনে। বিয়ের পর থেকেই তার স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে রণনীতি সাজিয়েছে কৌশলে। 
তিন ভাইয়ের মধ্যে ছোট সুরঞ্জন। বাবা অনেক আগেই গত হয়েছে তার। গাঁয়ের যৌথ পরিবার বলতে যা বোঝায়, সুখ-দুঃখের মিশেল দেওয়া সংসার। তার পড়াশুনা করার পেছনে দুই দাদার অবদান কম নয়। তার উপর মা'কে ছেড়ে কিছুতেই আসতে মন চাইছিল না তার। অমৃতাও গাঁয়ের মেয়ে। কিন্তু গাঁ নামের আত্মগৌরব টুকু সে ঝেড়ে ফেলে দিতে চায়। তার কাছে পরিবার মানে স্বামী- সন্তান আর সে। খুব বড় জোর বাপের বাড়ি পর্যন্ত এগোতে পারে তার সম্পর্ক গুছানোর ফিতে। ব্যাস্ ওইটুকু মাত্র, তার বেশি না।
গাঁয়ের ছেলেমেয়েদের মুঠোতে একটু রোজগার আসা মাত্রই বাড়তি  আদৃশ্য দুটো ডানা জুড়ে যায় শরীর ও মনে।অম্নি সব বাঁধন ছিঁড়ে দে ছুট্। সাফাই দেবার নানা ফর্দ পকেটে নিয়ে ঘোরে তারা। সুরঞ্জন তার সাফাইজবাবে কোনকিছু বলতে পারে না। তার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। অমৃতার প্রবল জেদের কাছে পরাজিত সুরঞ্জন যুদ্ধনীতি মোতাবেক বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য হয়।তবে বাকযুদ্ধ কম হয় নি!
---মা বেঁচে থাকতে আমি কোথ্থাও যেতে পারবো না।
---বেশ যেও না। তবে আমার লাশটাকেই এঘর থেকে বের কোরো।
----কেনো তুমি জয়েন্ট ফ্যামিলির এমন আনন্দ- হুল্লোড়  ছেড়ে একাকীত্বকে বেছে নিতে চাইছো?
---তুমি যাকে একাকীত্ব বোলছো আজকের টাইমে সেটাই রিয়েল লাইফ। তুমি মান্ধাতার আমলে পড়ে আছো তাই…!
--ছেঁড়া শিকড়ের গাছ নতুন মাটিতে বেঁচে থাকে মাত্র, অন্তর্গত  প্রাণের স্ফূরণ মরে যায়।তুমি কি একটা প্রাণহীন লাশের সঙ্গে সহবাস করবে?
--এখানে থাকলে তুমিও সেইরকম একটা লাশকেই পাবে জেনো রেখো
অশান্তি দেয়াল ভেদ করে  পৌঁছে যায় কানে কানে। সুরঞ্জন মায়ের কাছে নিজে থেকেই কথাটা বলে।ছেলেকে বাধা দ্যায় না।অদ্ভূত এক হাসি এঁকে সরয়ূ বলে,
---ভাবতম্ আঁচলের খুঁটে সবাইকে বেঁধে রেখেছি,কিন্তু খালের পেটে কখন যে গিঁটটা ঢিলা হয়ে গ্যাছে বুঝতে পারিনি। যা ভালো বুঝু তা কর। তরা ত আর সেই ছোটটি নাই। তবে চোখ বুজালে যেতে পারতু। আমি শান্তি পেতম।
কথা শেষ করেই দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে সরয়ূ।  সেই শ্বাসবায়ুর বিষাদময় গনগনে আঁচ সুরঞ্জনকে পোড়াতে থাকে প্রতিনিয়ত। শুধু অমৃতার ফর্সা ত্বকের স্তর ভেদ করে মর্মে প্রবেশ করতে পারে না।  একপ্রকার বাধ্য হোয়েই জমি দেখা শুরু করে সুরঞ্জন।

 নিত্যদিন কোন না কোন চমকপ্রদ ঘটনার সাক্ষী হতে হয় বাজারকে। দোকানদার সহ চলতি লোকজন তার থেকে পরিমাণ মতো আনন্দ অথবা বিষাদ নিয়ে বাড়ি ফেরে। ফিরতি পথের মাঝে সেই ঘটনা আড়েদিঘে কয়েক হাত ফুলেফেঁঁপে যায়। সুরঞ্জন এমন বহু ঘটনার কথা বলতে পারে। তার স্কুল যাবার এই একটাই পথ। ইদানীং বাইককে বিদায় জানিয়েছে। শরীরে নানা উপসর্গ উঁকিঝুঁকি মারছে। ডাক্তারের নির্দেশ 
--একটুআধটু ঘাম ঝরান। মর্নিং ওয়াক কিম্বা সাইক্লিং করতে পারেন। চল্লিশ পেরুলেই দেহে চেল্লাচিল্লি স্টার্ট।
অগত্যা সাইকেল করেই যাতায়াত। বাজারে খোকনদার টি স্টলে খানিকক্ষণ রেস্টো তারপর ব্যাক টু দ্য প্যাভিলিয়ন। আজ ভিড় দেখে জিরাফের মতো গলা বাড়িয়ে দেখার চেষ্টা করে। 
একজোড়া যাযাবর দম্পতি গাঁয়ে যাদের বলে হাগরি, তারা পিতল-কাঁসা গলিয়ে অদ্ভূত কায়দায় দেবদেবীর মূর্তি গড়ছে। বাড়ি থেকে পুরানো পিতল-কাঁসার বাসনকোসন আনলে সামান্য টাকার বিনিময়ে তৈরী করে দিচ্ছে তারা। তাদের এই আশ্চর্য পেশা দেখতেই যত ভীড়। অনেকেই ইতিমধ্যে গড়তেও দিচ্ছে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে সুরঞ্জন।
রাতে খাবার টেবিলে ঘটনার ল্যাজামুড়ো সবিস্তারে অমৃতাকে শোনায়। ঘরে লোক বলতে যদিও তিনজন,তাও আবার কয়েকমাস হোলো ছেলে থাকে স্কুল- হস্টেলে। হাফ সেঞ্চুরি ছুঁইছুঁই জোড়া প্রাণীর মধ্যে তাই খুঁটিনাটি  কথা বিনিময় চলে বিস্তর। আজকের পরিবেশন একটু ভিন্ন স্বাদের। কিন্তু অমৃতাকে প্রভাবিত করে। গৃহিণী বলে কথা!ঘর গেরস্থালীর কথাতে বাড়তি মনযোগ তো দেবেই। 
তার ঠাকুরঘরে পেতলের লক্ষ্মী ঠাকুর নেই। ফিবছর মাটির ঠাকুর বাজার থেকে এনে নিজেই পুজো করে। কিনবো কিনবো করেও কেনা হোয়ে ওঠেনি তার। সুরঞ্জনের মুখের কথা শেষ না হোতেই তার মুখ থেকে কথা উপচে পড়ে,
--ওরা কদ্দিন থাকবে? জেনেছো?
---কেন? তুমি আবার কী গড়াবে?
---বহুদিন থেকেই তো বলছি একটা পেতলের লক্ষ্মী প্রতিমা ঠাকুরঘরের সিংহাসনে রাখবো। কেনাই তো হোলো না। ঘরে কত্ত পুরানো বাসনকোসন ডাঁই হোয়ে আছে। ওর থেকে দুটো দিয়ে গড়িয়ে নেব ভাবছি।
----তা করতেই পারো। সেই কবে থেকে বস্তা বন্দী হোয়ে পড়ে আছে সব। 
সুরঞ্জনের সম্মতিতে বাড়তি খুশির ঝলক ছলকে পড়ে অমৃতার চোখমুখ থেকে।
হালফিলে পিতল- কাঁসার ব্যবহার এক্কেবারে উঠে গ্যাছে বলা যায়। গাঁগাওলিতেও সচরাচর দেখা যায় না। হাতেগোনা কয়েকটা পারিবারিক অনুষ্ঠানে বাঙালিয়ানার বিজ্ঞাপন সোশ্যাল মিডিয়ায় ছাপাতে কেউ কেউ সোৎসাহে অন্নব্যঞ্জন সাজায় পিতলের থালাবাসনে।
যৌথপরিবারের অনেক বাসনকোসন ছিল সুরঞ্জনদের। মাঝে সেসবের ভাগবাটোয়ারা হলে বেশকিছু তার ভাগেও পড়ে। তার উপর অমৃতার বাপের বাড়ি থেকে দেওয়া দানবাসন তো আছেই। সেগুলো পড়ে পড়ে নষ্ট হওয়ার চেয়ে মাতৃমূর্তি গড়ার কাজে লাগলে মন্দ হয় না। সুরঞ্জন মনে মনে অমৃতার ইচ্ছেকে বাহবা দেয়।

স্কুল যাওয়ার আগে হুকুম মতো চিলেকোঠার কাছে ঘুপচি একটা কুঠরি থেকে দুটো বস্তা টেনে আনে সুরঞ্জন। বিস্তর ভারী বস্তাদুটো। অমৃতাও হাত লাগায়। এককাঁড়ি থালাবাসন!  পিতলের ঘটিবাটি,জঁক,প্রদীপ,রেকাব! আর একটা পানের ডাবর। সুরঞ্জন দেখামাত্রই ডাবরটাকে ছোঁ মেরে তুলে নেয়। হাতে নিয়ে গোল গোল করে ঘুরিয়ে কি যেন খুঁজতে থাকে। অমৃতা অবাক হোয়ে জিজ্ঞেস করে,
---কী খুঁজছো ওতে
--চিনতে পরছো?  এটা মায়ের পানের ডাবর। পিতলের গায়ে কলঙ্ক ধরে মায়ের নামটাকে ঢেকে দিয়েছে। লতাপাতার নক্সায় ঘেরা মায়ের নাম খোদাই ছিল এতে-সরয়ূবালা। তুমিও তো দেখেছো?
---দেখেছিলাম বোধহয়। মনে নেই।
বলেই অমৃতা বস্তা থেকে আরো সব তৈজসপাত্র বের করে। সুরঞ্জন কোলের কাছে ডাবরখানা আঁকড়ে হাত বুলোতে থাকে তার গায়ে।
 পান খাওয়ার বড় শখ ছিল তার মায়ের। তখন সুরঞ্জন খুব ছোট। কী সুস্বাদু জর্দা দেওয়া মিঠাপতার মিষ্টি পান সাজতো তার মা। কতবার আড়িপেতে সেই পান খেয়েছে সে। বাবা ঘাটালের বাজার থেকে তার মায়ের জন্য এই পানের ডাবর কিনে আনে। দোকানে বসে মায়ের নাম খোদাই করিয়ে নেয়। সেদিনের মা'র খুশিমাখা মুখখানা আজও চোখে লেগে আছে সুরঞ্জনের।
ক্রমেই তার  দৃষ্টির সামনে ভেসে উঠছে কত ছায়াছবি। দু'একদিন ছাড়াই বিকেলে দু'পা ছড়িয়ে বসে তেঁতুলপাতা আর বালি দিয়ে,কখনো কেরোসিন তেল ছড়িয়ে খড় দিয়ে ডাবর মাজতে বোসতো তার মা। এত চকচক্ কোরতো যে তাতে মুখ দেখা যেত। বাড়িতে কেউ এলেই তক্তপোশের তলা থেকে ডাবর,রেকাব,জাঁতি,জর্দা-দোক্তা- খয়েরের কৌটো বের হোতো। সাথে চুনের ভাঁড়। আর শুধাতো,
---কী পান সাজবো বলো--কালিঢল  নাকি মিঠাপাতা?
মায়ের পাশে বসে কত পানের নাম শিখেছিল সে- বর্গাইপান,ছাঁচিপান,বাংলাপান,কোড়াপান। 
সুরঞ্জনের চোখ ভারী হোয়ে উঠে। অমৃতার ডাকে ঘোর কাটে তার,
---কোথায় হারিয়ে গেলে তুমি? ডাবরটাকে ওভাবে আঁকড়ে ধরে আছো কেনো?
---ও তুমি বুঝবে না।তবে এটাকে যেন গলিয়ে ফেলো না।
কথাটা বলেই চকিতে উপর থেকে নেমে আসে।

স্কুলে কিছুতেই মন বসাতে পারছিল না সুরঞ্জন। ওই ডাবরটুকুই মায়ের শেষ  স্মৃতিচিহ্ন। গৃহ প্রবেশ অনুষ্ঠানের কদিন পরেই হঠাৎ স্ট্রোকে তার মা মারা যায়। সেই থেকে আজ অব্দি সুরঞ্জন নিজেকেই মায়ের মৃত্যুর দোষী মানে।  লক্ষ্মী প্রতিমার মতো মায়ের মুখে যেন কালবৈশাখীর মেঘ দেখতে পায় যেদিন তারা নতুন বাড়িতে আসে। একপ্রকার অভিমানেই গৃহপ্রবেশ অনুষ্ঠানে মা তার আসেনি। এতসব ক্ষতযন্ত্রণ তার বুকের তলায় চোরা স্রোতের মতো বয়ে চলেছে। সে তো মায়ের শেষ ইচ্ছেটুকু রাখতে পারেনি। দাদা- বৌদিদের সাথে গাঁয়ে থেকে যেতে পারে নি। নিজেকে কাপুরুষ নাকি স্ত্রৈণ বলবে ভেবে পায় না। কেন অমৃতা তার জন্মভিটের সঙ্গে নিজের গাঁটছড়া বাঁধতে রাজি হোলো না! অথচ তার মা স্বামীর ভিটেমাটি আঁকড়ে পড়ে রইলো আজীবন! সময় কী তবে এভাবেই সম্পর্কের ভিতকে নাড়িয়ে দ্যায়!নতুন সমীকরণ রচনা করে আত্মিক বন্ধনের!

কত কথা সুরঞ্জনের মাথায় জট পাকায়। স্কুল থেকে একটু আগে বেরিয়ে এলেও মাঝপথে নদী বাঁধের শিমূলতলায় অনেকটা সময় ধরে দাঁড়িয়ে যায়। কখন বেলা গড়িয়েছে বুঝতে পারেনি সে।  সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দিয়ে দ্রুত ঘোরাতে থ্কে। বাড়ি ফিরেই ডাবরের খোঁজ শুরু করে। তার অস্থিরতা দেখে কিছুটা থমকে যায় অমৃতা। তারপরে হাত ধরে টেনে আনে তাকে ঠাকুরঘরে। সুরঞ্জনের বুঝতে অসুবিধা হয়না।একে চরম অঘটন বলবে নাকি নৃশংসতা ঠিক করতে পারে না। অমৃতার হাত থেকে নিজের হাতটা এক ঝটকায় ছিনিয়ে নিয়ে ছুটে যায় কাঠের সিংহাসনের দিকে। চোখের সামনে কাকে দেখছে সুরঞ্জন! অদ্ভূত সেই হাসিমাখা মুখ! যে হাসির ধারালো দ্যুতি তাকে বিদ্ধ করেছে বারবার! সে স্পষ্ট অনুভব করছে ঠাকুরঘর জুড়ে গনগনে নিশ্বাসের আঁচ!
অমৃতা সেদিনও  টের পায়নি,আজও পারবেনা ভিতর মনের সেই দহন- উত্তাপ।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments