জ্বলদর্চি

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ উপমামৃত-২৩/সুদর্শন নন্দী

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ উপমামৃত   
পর্ব-২৩
সুদর্শন নন্দী 

২২শে অক্টোবর, ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দ (৭ই কার্তিক, ১২৯২, শুক্লা চতুর্দশী)। শ্যামপুকুরে শ্রীরামকৃষ্ণ — দুতলা ঘরের মধ্যে। ডাক্তার সরকার শ্রীযুক্ত ঈশানচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও ভক্তেরা রয়েছেন।সাকার নিরাকার বিষয়ে বোঝাতে একের পর এক উপমা দিচ্ছেন। 
উপমা হিসেবে এবার একটি গল্প বললেন ঠাকুর। একজন বাহ্যে গিছিল — দেখলে, গাছের উপর একটি সুন্দর জানোয়ার রয়েছে। সে ক্রমে আর একজনকে বললে, ‘ভাই! অমুক গাছে আমি একটি লাল রঙের জানোয়ার দেখে এলুম।’ সে লোকটি বললে, ‘আমিও দেখেছি, তা সে লাল রঙ হতে যাবে কেন? সে যে সবুজ রঙ।’ আর একজন বললে, না, না; সে সবুজ হতে যাবে কেন, কালো ইত্যাদি। শেষে ঝগড়া। তখন তারা গাছতলায় গিয়ে দেখে একজন লোক বসে। জিজ্ঞাসা করায়, সে বললে, ‘আমি এই গাছতলায় থাকি, আমি সে জানোয়ারটিকে বেশ জানি। তোমারা যা যা বলছো সব সত্য, সে কখনও লাল, কখনও সবুজ, কখনও হলদে, কখনও নীল আরও সব কত কি হয়। আবার কখনও দেখি কোন রঙই নাই!’
এবার ব্যখ্যা করে বোঝালেন তিনি-যে ব্যক্তি সদাসর্বদা ঈশ্বরচিন্তা করে, সেই জানতে পারে, তাঁর স্বরূপ কি। সে ব্যক্তিই জানে যে ঈশ্বর নানারূপে দেখা দেন। নানাভাবে দেখা দেন। তিনি সগুণ আবার নির্গুণ। গাছতলায় যে থাকে সেই জানে যে, বহুরূপীর নানারঙ, আবার কখন কখন কোন রঙই থাকে না। অন্য লোকে কেবল তর্ক ঝগড়া করে কষ্ট পায়। তিনি সাকার, তিনি নিরাকার। কিরকম জানো? যেন সচ্চিদানন্দ-সমুদ্র। কূল কিনারা নাই। ভক্তিহিমে সেই সমুদ্রের স্থানে স্থানে জল বরফ হয়ে যায়, যেন জল বরফ আকারে জমাট বাঁধে; অর্থাৎ ভক্তের কাছে তিনি সাক্ষাৎ হয়ে কখন কখন সাকাররূপ হয়ে দেখা দেন। আবার জ্ঞানসূর্য উঠলে সে বরফ গলে যায়।
ঈশ্বরলাভ হলে কেমন অবস্থা হয় তা ঠাকুর বোঝাচ্ছেন উপমা ফিয়ে। বললেন ঈশ্বর লাভ হলে পাঁচ বছরের বালকের স্বভাব হয়। ‘বালকের আমি’ আর ‘পাকা আমি’। বালক কোন গুণের বশ নয়। ত্রিগুণাতীত। সত্ত্ব রজঃ তমঃ কোন গুণের বশ নয়। দেখ, ছেলে তমোগুণের বশ নয়। এইমাত্র ঝগড়া মারামারি করলে, আবার তৎক্ষণাৎ তারই গলা ধরে কত ভাব, কত খেলা! রজোগুণেরও বশ নয়। এই খেলাঘর পাতলে কত বন্দোবস্ত, কিছুক্ষণ পরেই সব পড়ে রইল; মার কাছে ছুটেছে। হয়তো এখখানি সুন্দর কাপড় পরে বেড়াচ্ছে। খানিকক্ষণ পরে কাপড় খুলে পড়ে গেছে। হয় কাপড়ের কথা একেবারে ভুলে গেল — নয় বগলদাবা করে বেড়াচ্ছে! 
যদি ছেলেটিকে বল, ‘বেশ কাপড়খানি, কার কাপড় রে?’ সে বলে, ‘আমার কাপড়, আমার বাবা দিয়েছে।’ যদি বল, ‘লক্ষ্মী ছেলে, আমায় কাপড়খানি দাও না।’ সে বলে, ‘না, আমার কাপড়, আমার বাবা দিয়েছে, না আমি দেবো না।’ তারপর ভুলিয়ে একটি পুতুল কি আর একটি বাঁশি যদি দাও তাহলে পাঁচটাকা দামের কাপড়খানা তোমায় দিয়ে চলে যাবে। আবার পাঁচ বছরের ছেলের সত্ত্বগুণেরও আঁট নাই। এই পাড়ার খেলুড়েদের সঙ্গে কত ভালবাসা, একদণ্ড না দেখলে থাকতে পারে না। কিন্তু বাপ-মার সঙ্গে যখন অন্য জায়গায় চলে গেল, তখন নূতন খেলুড়ে হল। তাদের উপর তখন সব ভালবাসা পড়ল; পুরানো খেলুড়েদের একেবারে ভুলে গেল। তারপর জাত অভিমান নাই। মা বলে দিয়েছে, ও তোর দাদা হয়, তা সে ষোল আনা জানে যে, এ আমার ঠিক দাদা। তা একজন যদি বামুনের ছেলে হয় আর-একজন যদি কামারের ছেলে হয়, তো একপাতে বসে ভাত খাবে। আর শুচি-অশুচি নাই, হেগোপোঁদে খাবে! আবার লোকলজ্জা নাই, ছোঁচাবার পর যাকে-তাকে পেছন ফিরে বলে — দেখ দেখি, আমার ছোঁচানো হয়েছে কি না?
জ্ঞানযোগ ভক্তিযোগ নিয়ে বিচার হচ্ছে। 
ডাক্তার বললেন— আগে ঘোড়ার চক্ষের দুইদিকে ঠুলি না দিলে, ঘোড়া কি এগুতে চায়? রিপু বশ না হলে কি ঈশ্বরকে পাওয়া যায়?
শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন — তুমি যা বলছো, ওকে বিচারপথ বলে — জ্ঞানযোগ বলে। ও-পথেও ঈশ্বরকে পাওয়া যায়। জ্ঞানীরা বলে, আগে চিত্তশুদ্ধি হওয়া দরকার। আগে সাধন চাই, তবে জ্ঞান হবে। ভক্তিপথেও তাঁকে পাওয়া যায়। যদি ঈশ্বরের পাদপদ্মে একবার ভক্তি হয়, যদি তাঁর নাম গুনগান করতে ভাল লাগে, ইন্দ্রিয় সংযম আর চেষ্টা করে করতে হয় না। রিপুবশ আপনা-আপনি হয়ে যায়। যদি কারও পুত্রশোক হয়, সেদিন সে কি আর লোকের সঙ্গে ঝগড়া করতে পারে, না, নিমন্ত্রণে গিয়ে খেতে পারে? সে কি লোকের সামনে অহংকার করে বেড়াতে পারে, না, সুখ সম্ভোগ করতে পারে? বাদুলে পোকা যদি একবার আলো দেখতে পায়, তাহলে কি সে আর অন্ধকারে থাকে? 
ডাক্তার হেসে জবাব দিলেন — তা পুড়েই মরুক সেও স্বীকার।
তা শুনে উপমা  দিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণ বোঝালেন— না গো! ভক্ত কিন্তু বাদুলে পোকার মতো পুড়ে মরে না। ভক্ত যে আলো দেখে ছুটে যায়, সে যে মণির আলো! মণির আলো খুব উজ্জ্বল বটে, কিন্তু স্নিগ্ধ আর শীতল। এ-আলোতে গা পুড়ে না, এ-আলোতে শান্তি হয়, আনন্দ হয়।
১৮৮৫, ২৬শে অক্টোবর।শ্যামপুকুর বাড়িতে ডাক্তার সরকার, নরেন্দ্র, শশী, শরৎ, মাস্টার, গিরিশ প্রভৃতি। ভক্তসঙ্গে
ঠাকুর ‘গোপাল!’ ‘গোপাল!’ নামের ভক্তের কথা পাড়লেন । 

ডাক্তার জানতে চাইলেন যা — ‘গোপাল!’ ‘গোপাল।’ সে ব্যাপারটা কি?
শ্রীরামকৃষ্ণ হেসে হেসে শোনালেন সেই  কাহিনী। বললেন— একটি স্যাকরার দোকান ছিল। বড় ভক্ত, পরম বৈষ্ণব — গলায় মালা, কপালে তিলক, হস্তে হরিনামের মালা। সকলে বিশ্বাস করে ওই দোকানেই আসে, ভাবে এরা পরমভক্ত, কখনও ঠকাতে যাবে না। একদল খদ্দের এলে দেখত কোনও কারিগর বলছে ‘কেশব!’ ‘কেশব!’ আর-একজন কারিগর খানিক পরে নাম করছে ‘গোপাল!’ ‘গোপাল!’ আবার খানিকক্ষণ পরে একজন কারিগর বলছে, ‘হরি’, ‘হরি’, তারপর কেউ বলছে ‘হর; হর!’ কাজে কাজেই এত ভগবানের নাম দেখে খরিদ্দারেরা সহজেই মনে করত, এ-স্যাকরা অতি উত্তম লোক। — কিন্তু ব্যাপারটা কি জানো? যে বললে, ‘কেশব, কেশব!’ তার মনের ভাব, এ-সব (খদ্দের) কে? যে বললে ‘গোপাল! গোপাল!’ তার অর্থ এই যে আমি এদের চেয়ে চেয়ে দেখলুম, এরা গরুর পাল। 

যে বললে ‘হরি হরি’ — তার অর্থ এই যে, যদি গরুর পাল, তবে হরি অর্থাৎ হরণ করি। যে বললে, ‘হর হর!’ — তার মানে এই — তবে হরণ কর, হরণ কর; এরা তো গরুর পাল! 
হাসির রোল উঠল এই উপমা শুনে।
 ১৮৮৫, ২৭শে অক্টোবর l
জ্ঞান ও বিজ্ঞান বিচারে ব্রহ্মদর্শন নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন — নিত্যশুদ্ধবোধরূপম্‌। তা তোমায় কেমন করে বুঝাব? যদি কেউ জিজ্ঞাসা করে, ‘ঘি কেমন খেলে?’ তাকে এখন কি করে বুঝাবে? হদ্দ বলতে পার, ‘কেমন ঘি না যেমন ঘি।’ একটি মেয়েকে তার সঙ্গী জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘তোর স্বামী এসেছে, আচ্ছা ভাই, স্বামী এলে কিরূপ আনন্দ হয়?’ মেয়েটি বললে, ‘ভাই, তোর স্বামী হলে তুই জানবি; এখন তোরে কেমন করে বুঝাব।’ পুরাণে আছে ভগবতী যখন হিমালয়ের ঘরে জন্মালেন, তখন তাঁকে নানারূপে দর্শন দিলেন। গিরিরাজ সব রূপ দর্শন করে শেষে ভগবতীকে বললেন, মা, বেদে যে ব্রহ্মের কথা আছে, এইবার আমার যেন ব্রহ্মদর্শন হয়। তখন ভগবতী বললেন, বাবা, ব্রহ্মদর্শন যদি করতে চাও, তবে সাধুসঙ্গ কর।ব্রহ্ম কি জিনিস — মুখে বলা যায় না। একজন বলেছিল — সব উচ্ছিষ্ট হয়েছে, কেবল ব্রহ্ম উচ্ছিষ্ট হন নাই। এর মানে এই যে, বেদ, পুরাণ, তন্ত্র, আর সব শাস্ত্র, মুখে উচ্চারণ হওয়াতে উচ্ছিষ্ট হয়েছে বলা যেতে পারে; কিন্তু ব্রহ্ম কি বস্তু, কেউ এ-পর্যন্ত মুখে বলতে পারে নাই। তাই ব্রহ্ম এ পর্যন্ত উচ্ছিষ্ট হন নাই! আর সচ্চিদানন্দের সঙ্গে ক্রীড়া, রমণ — যে কি আনন্দের তা মুখে বলা যায় না। যার হয়েছে সে জানে। খানিক পরে ঠাকুর বললেন সাধনের প্রয়োজন — ঈশ্বরে একমাত্র ভক্তিই সার ]কেবল শুনলে কি হবে? কিছু করো। সিদ্ধি সিদ্ধি মুখে বললে কি হবে? তাতে কি নেশা হয়? সিদ্ধি বেটে গায়ে মাখলেও নেশা হয় না। কিছু খেতে হয়। কোনটা একচল্লিশ নম্বরের সুতো, কোনটা চল্লিশ নম্বরের — সুতার ব্যবসা না করলে এ-সব কি বলা যায়? যাদের সুতার ব্যবসা আছে, তাদের পক্ষে অমুক নম্বরের সুতা দেওয়া কিছু শক্ত নয়! তাই বলি, কিছু সাধন কর। তখন স্থূল, সূক্ষ্ম, কারণ মহাকারণ কাকে বলে সব বুঝতে পারবে। যখন ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করবে, তাঁর পাদপদ্মে একমাত্র ভক্তি প্রার্থনা করবে।
                                                 (ক্রমশঃ)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments