জ্বলদর্চি

ভারতীয় সংগীতের ক্রমবিকাশ--১১/দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

ভারতীয় সংগীতের ক্রমবিকাশ

দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

পর্ব – ১১

ঠুমরি গানের ক্ষেত্রে এবারে আমরা আলোচনা করব ঊনবিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত গায়িকা গওহরজানের ভূমিকা সম্বন্ধে। ঠুমরি গানের ভূমিকায় গওহরজান বিস্ময়কর ভাবে একাধিক গায়ন শৈলী উদ্ভাবন করেছিলেন। ১৯০২ সালে গ্রামোফোন কোম্পানির রেকর্ড চালু হওয়ার পরে বোল বনাও ঠুমরির বিস্তৃত পরিসরের গানকে কিভাবে রেকর্ডিংয়ের তিন মিনিটের মধ্যে উপস্থাপনা করা যায় সে সম্বন্ধে তিনি একটি কাঠামো তৈরি করে দিয়েছিলেন যা পরবর্তীকালে বহু শিল্পীই অনুসরণ করেছিলেন। হিন্দুস্তানি সংগীতে গ্রামোফোন কোম্পানির প্রথম রেকর্ডিং শিল্পী হওয়ার সুবাদে তাঁর যেন একটি দায়িত্ব হয়ে গিয়েছিল যে কিভাবে স্বল্প সময়ের মধ্যে গানটি তৈরি করে তিন মিনিটের কঠিন বাধাকে অতিক্রম করে একটি রোল মডেল তৈরি করা যায়। তাঁকে নিশ্চিত করতে হয়েছিল যে এই স্বল্প সময়ে গানের ঐতিহ্যগত বৈশিষ্ট্যের কোনো রকম ক্ষতি হবে না এবং সেইসঙ্গে রাগের একটি সম্পূর্ণ ও গভীর রূপ প্রকাশ পাবে, ঠিক যেমন তাঁর সারা রাত্রিব্যাপী অনুষ্ঠানগুলির ক্ষেত্রে ঘটে। তাঁর খেয়াল রেকর্ডিংকে বিশ্লেষণ করে দেখা যায় কিভাবে নির্দিষ্ট সময়ের সীমাবদ্ধতার মধ্যেও রাগের পরিপূর্ণ প্রকাশের ক্ষেত্রে একটি পরিষ্কার গঠন ও সামঞ্জস্য রক্ষা করেছিলেন। একটি নির্দিষ্ট গঠনের গানে ঘড়ির কাঁটার সাথে সামঞ্জস্য রেখে গানের বিস্তার করতেন। 'সা'এর উপর ভিত্তি করে আরো দু'তিনটি স্বর যোগ করে কয়েক সেকেন্ড আলাপ করার পরে গানের প্রথম অংশ স্থায়ীর প্রথম পংক্তি দিয়ে একটি 'মুখরা' তৈরি করতেন। গানের রচনার ক্ষেত্রে স্থায়ী একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ কারণ সম্পূর্ণভাবে গানের ছন্দটি স্থায়ীর মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠিত হয়। স্থায়ী অংশটি দু-তিনবার গাইবার পরে মসৃণভাবে 'অন্তরা'তে চলে যেতেন। এরপর এক দুবার 'অন্তরা'র পুনরাবৃত্তি করে স্থায়ীতে চলে আসতেন।                                         
  
তার গায়কীর সবচেয়ে স্বতঃস্ফূর্ত অংশ ছিল 'ব্রভুরা তান'। কণ্ঠস্বর অত্যন্ত উঁচু স্বরে অনায়াসে সঞ্চালনায় সক্ষম হওয়ার কারণে তিনি কণ্ঠস্বরের যেকোনো রকম কারুকার্য করে গতির সঙ্গে বৈচিত্র রেখেও একটি নির্দিষ্ট সময়ের পরে সহজেই স্থায়ীর মুখরায় ফিরে আসতে পারতেন। পুরো স্থায়ীটি আরো একবার গাইবার পরে তিনি গান শেষ করতেন। হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সংগীতের উপযুক্ত কাঠামো এবং একইসঙ্গে স্বতঃস্ফূর্ততার মিশ্রণ করে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তিনি দেশের বৃহত্তর শ্রোতাদের কাছে পৌঁছাতে পেরেছিলেন।    
  
গওহরজান এবং মউজুদ্দিনের রেকর্ডিংয়ে দেখা যায় বোল বনাও ঠুমরির ক্ষেত্রে তাঁরা অনেকখানি গতি বাড়িয়ে আরো জোর দিয়ে এবং কিছু ক্ষেত্রে লঘুতর সঞ্চালনার আশ্রয় নিতেন, যার সঙ্গে বন্দিশ ঠুমরির শেষ অংশের অনেকখানি মিল দেখা যেত, তবে এর সঙ্গে মিলিত হতো বোল বনাও ঠুমরির বিস্তারের সৌন্দর্য। গওহরজানের রেকর্ডিং করা রাগ ভৈরবী আশ্রিত একটি ঠুমরি 'ছোড়ো ছোড়ো মোরি বইয়াঁ'র গতি ও গঠনের উপর ছোট খেয়ালের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। তিন তালে নিবদ্ধ এই গানটি সপাট তানের পরিবেশনা সহ গানের কথার বৈচিত্রময় প্রকাশ ছিল অসাধারণ। তার কিছু কিছু টান ছিল টপ্পা ধরনের এবং সেগুলি বেশিরভাগই হয়েছে সিতারখনি তালে মধ্য লয়ে।                                                
  
১৯০২ থেকে ১৯২০ সালের মধ্যে গওহরজান তার সঙ্গীতজীবনে প্রায় ছশোর মত গান কুড়িটি ভাষায় রেকর্ড করেছিলেন যেগুলির মধ্যে ছিল খেয়াল থেকে ধ্রুপদ, ঠুমরি থেকে দাদরা, ভজন, গজল, হোরি, ধামার,তারানা এবং চৈতি ছাড়াও কিছু কর্ণাটকী ও দক্ষিণ ভারতীয় শাস্ত্রীয় গান এবং ইংরেজী ভাষার কিছু গান। এখনো যে গানগুলি বাজারে পাওয়া যায় তার মধ্যে রয়েছে জৌনপুরি, ভূপালী, মুলতানি রাগের খেয়াল, কাফি, ভৈরবী, সোহিনী, পাহাড়ী, পিলু, পিলু-কাফি, পাহাড়ী- জৌনপুরী এবং দেশ রাগে গাওয়া ঠুমরি ও হোরি। কাফি রাগে কিছু টপ্পা অঙ্গের হোরিও রেকর্ড করেছিলেন যেমন, 'ক্যায়সি ইয়ে ধূম মচাই'। এছাড়াও তিনি নিজে অনেক ঠুমরি গান রচনা করেছিলেন যেমন, 'খেলত কৃষ্ণকুমার, সব সখিয়াঁ মিল গাওয়ত নাচত অউর বাজাত মৃদঙ্গ, গওহর পেয়ারি কি করছ ইয়ে হি হ্যায়, কৃপা কর তার' ইত্যাদি। অর্থাৎ ছোট কৃষ্ণ আনন্দে তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে খেলছেন, সবসখীরা মিলিত হয়ে আনন্দে গান গাইছে নাচছে এবং মৃদঙ্গ বাজাচ্ছে, হে ঈশ্বর, গওহরের একমাত্র প্রার্থনা তিনি যেন তাকে কৃপা করেন। তাঁর গাওয়া মালকোষ রাগের ভজন 'কৃষ্ণ মাধো শ্যাম' এবং খাম্বাজ রাগের 'শ্যামসুন্দর কি দেখি সুরতিয়া, ম্যায় ভুল গয়ি সুধা সারি' ইত্যাদি ঠুমরি গান গুলি সারাদেশে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল। তিনি নিজে যে সব গান রচনা করেছিলেন এবং গেয়েছিলেন তাতে প্রমাণিত তাঁর গভীর কৃষ্ণভক্তি ছিল। এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য মাদ্রাজের সালেম গোদাবরী নামের এক দেবদাসী যিনি জনপ্রিয়তায় ও গ্রামোফোন কোম্পানির রেকর্ড তৈরীর সংখ্যার নিরিখে গওহরজানের সমকক্ষ ছিলেন।                      
  
স্বতঃস্ফূর্ততার দিক থেকে বিচার করলে অনেক সমালোচনাকার তাঁর গাওয়া গানের উপস্থাপনাতে পুনরাবৃত্তি হয়েছে বলে মনে করতেন। কিন্তু বিরাট শিল্পের বৈশিষ্ট্যকে একত্রিত করে তাকে একটি নির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে এনে সংক্ষিপ্ত অথচ নিখুঁতভাবে পরিবেশন করার যে দুঃসাহসিক প্রচেষ্টা তিনি দেখিয়েছিলেন তার জন্য কোন প্রশংসাই যথেষ্ট নয়। অনেক রক্ষণশীল শিল্পীদের কাছ থেকে গওহরজান তাঁর গায়কী শৈলীর বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছিলেন। রক্ষণশীল গায়কদের মনে হয়েছিল এত সুন্দর ও পবিত্র শিল্পকে সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে আবদ্ধ রাখার ফলে সেই শিল্পকে শুদ্ধতার সঙ্গে আপস করতে হচ্ছে এবং তার গভীরতা নষ্ট হচ্ছে। কিন্তু গওহরের রেকর্ডিং করা গানগুলি দেশের অগণিত শ্রোতৃবর্গের কাছে অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছিল। এর ফলে ধীরে ধীরে দেখা গেল যারা তাঁর রেকর্ডিংয়ের বিরোধিতা বা সমালোচনা করেছিলেন সেই সমস্ত রক্ষণশীল গায়কেরাও গওহরের পথে পা ফেলেছিলেন। সৌভাগ্যক্রমে পরবর্তীকালে রেকর্ডিংয়ের সময়সীমা বৃদ্ধির প্রযুক্তিগত কৌশল আবিষ্কৃত হয়েছিল যার ফলে রক্ষণশীল শিল্পীদের গানের শুদ্ধতার প্রসঙ্গের আশঙ্কা দূর হয়েছিল। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত গওহরের গাওয়া গানের রেকর্ড বিক্রি সর্বোচ্চ ছিল, অস্ট্রিয়াতে তৈরী দেশলাই বাক্সের উপরে তাঁর ফটো দেখা যেত, পিকচার পোস্টকার্ডে তাঁর ছবি বেরিয়েছিল। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে গওহর বিপুল খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন এবং একজন সম্রাজ্ঞীর মত ভারতের সংগীত জগতে বিচরণ করেছিলেন।      
  
সংক্ষেপে এই হলো ভারতীয় সঙ্গীতের ক্রমবিবর্তনের রূপ। অবশ্য বর্তমানে চটুল আধুনিক ও হিন্দী গানের দৌলতে এই সমস্ত সঙ্গীত প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে।
                                                                   সমাপ্ত


তথ্যসূত্র -  
১) 'My name is Gauharjan'- The life and times of a musician - by Vikram Sampath 
২) 'Thumri as feminine voice' in Economic and Political weekly' dated 28th April, 1990 - by    Dr. Vidya Rao. 
৩) Thumri in historical and stylistic perspectives - by Peter Mannuel

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 

Post a Comment

0 Comments