ভারতীয় সংগীতের ক্রমবিকাশ
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী
পর্ব – ৯
১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পরে ভারতবর্ষে এক নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আবির্ভাব ঘটল যাদের মধ্যে ছিলেন উচ্চশিক্ষিত সিভিল সার্ভেন্ট, উকিল, শিক্ষক, কেরানী, ডাক্তার, ব্যবসায়ী ও জমিদারেরা। এরা অল্পদিনের মধ্যে প্রভূত পসার করার ফলে এবং ব্রিটিশ প্রভুদের সাথে মেলামেশার ফলে ভারতের সংগীতের ধারাকে বিশেষ করে প্রকাশ্যে নৃত্যগীতকে অপেক্ষাকৃত নীচু চোখে দেখতেন। তাদের কাছে এইসব প্রকাশ্য নৃত্যগীত সামন্ততান্ত্রিক প্রথার সমার্থক ছিল যেখানে গণিকা, পতিতা, নবাব ও জমিদারদের আধিপত্য। তারা ঠুমরি গান ও কত্থক নাচকে একেবারে অশিক্ষিত এবং সস্তা বিনোদন বলে মনে করতেন এবং এই সকল শিল্পী ও তাদের সহযোগীদের মনে করতেন সমাজের আবর্জনা স্বরূপ। এদের উস্কানিতে ব্রিটিশ প্রশাসন ভারতীয় সংস্কৃতির ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে চাইলেন। তারা আইন করে ঘোষণা করলেন এই ধরনের কলা রীতিগুলি আসলে অবাধ যৌনতার প্রদর্শন এবং খ্রিস্টান বিরোধী মনোভাবের উদ্রেককারী। নৈতিকতা ও অশ্লীলতা সম্পর্কে এক ধরনের প্রাচীন ভিক্টোরীয় মনোভাব এই সমস্ত কলা শিল্পীদের উপরে চাপিয়ে দেওয়া হলো, অথচ এরা প্রেম ও যৌনতা সম্পর্কে নিজেদের জ্ঞান ও মানসিক উদারতার পরিচয় দিয়ে আসছিলেন।
বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বন্দিশ ঠুমরী ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে থাকে যা একসময় লখনৌয়ের নবাব দরবারে বা রাজাদের ব্যক্তিগত আসরে বিশেষ স্থান লাভ করেছিল। বন্দিশ ঠুমরি 'ছোটা খেয়ালে' বিলীন হয়ে গেল এবং বোল বনাও ঠুমরি গ্রামোফোনের আগমনের ফলে প্রায় শেষ হয়ে যেতে বসেছিল, কারণ প্রথম দিকে রেকর্ড গুলিতে দুতিন মিনিটের বেশী 'ডিস্ক টাইম' থাকতো না। ফলে বোল বনাও ঠুমরির ধীর,স্থির লয়কে ধরে রাখা সম্ভব হতো না। কিন্তু ভাইরা গণপত রাওদের মত গায়কেরা যারা বোল বনাও ঠুমরি গানের জন্য বিখ্যাত ছিলেন তারা সারেঙ্গীর পরিবর্তে সহযোগী বাদ্যযন্ত্র হিসেবে হারমোনিয়াম ব্যবহার করে ঠুমরির মধ্যে দ্রুত তানের প্রচলন করেছিলেন। তিনি ও তাঁর ছাত্র-ছাত্রীরা যেমন মউজুদ্দিন বা গওহরজান প্রভৃতিরা ব্যক্তিগত আসরে বা প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে বোল বনাও ঠুমরির ধারা বজায় রেখেছিলেন।
এই সময় বেনারসী রীতি বা বোল বনাও ঠুমরির বেনারসী অঙ্গ বা ঘরানা খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। এতে ঠুমরি ধীরলয়ে গাওয়া হতো এবং গানের কথাকে বিস্তৃত করা হতো। লোকশিল্পের বা লোক প্রচলিত উৎসবের ছায়া এবং বিভিন্ন ঋতুর উৎসবের যেমন - কাজরী, ঝুলা, সাওয়ান এবং চৈতি ইত্যাদির দীর্ঘ ঐতিহ্য দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়ে বেনারসী ঘরানা বিভিন্ন উৎসের এক অসাধারণ মিশ্রণ হয়ে উঠেছিল।
এই ঘরানার পথিকৃৎ ছিলেন গুরু জগদীপ মিত্র যিনি মউজুদ্দিনের প্রথম শিক্ষাগুরু। লখনৌয়ের ঠুমরি রচয়িতারা যারা মলহার, মালকোষ বা দরবারীর মত ভারী ও শাস্ত্রীয় রাগকে বন্দিশ ঠুমরিতে ব্যবহার করতেন তাদের মত না করে বেনারসী ঠুমরি রচয়িতারা হালকা রাগ ও শাস্ত্রীয় তিনতালের পরিবর্তে লোকগীতিতে প্রচলিত দাদরা ও কাহারবা তালে রচনা করতেন। বেনারসী ঘরানার ঠুমরির মধ্যবর্তী অংশ একটি বিশেষ ছন্দে গাওয়া হতো যাকে বলা হত 'লাগি', যাকে সরাসরি লোকগানের রকমফের বলা যেতে পারে। এই পর্যায়টি খুব গভীরভাবে দ্রুতলয়ে গাইবার জন্য সৃষ্টি করা হতো যেখানে দুই বা চার পর্বের একটি কেন্দ্রীয় অংশের পুনরাবর্তন করতে হতো। এই পর্যায়ের পুরোটাই আট বা ষোল মাত্রায় তালবদ্ধ হতো এবং তার সাথে আসল ঠুমরিটি যে তালে চলত তার সাথে কোন যোগ থাকত না।
দক্ষিণ ভারতে সংগীত ও নৃত্যের প্রধান ধারক ও বাহক ছিলেন দেবদাসীরা। অল্প বয়সেই তাদের মন্দিরের দেবতার কাছে 'উৎসর্গ' করা বা বিবাহ দেওয়া হতো এবং সঙ্গীত ও নৃত্য পরিবেশনায় ছিল তাদের উপাসনা। অবশ্য মন্দিরের পুরোহিতদের হাতে তারা যৌন নির্যাতনের শিকার হতেন।
১৯০২ সালে গ্রামোফোন কোম্পানি এ দেশে আসার পরে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের জগতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এলো। ৮ই নভেম্বর, ১৯০২ দিনটি ইতিহাসের পাতায় উজ্জ্বল হয়ে আছে কারণ সেই দিনে এ দেশে প্রথম নেটিভ শিল্পীর গান রেকর্ডিং হয় প্রথম দিনে থিয়েটারের দুই 'নচ গার্ল' - মিস শশীমুখী ও মিস ফণীবালার গান রেকর্ডিং হয়। ১১ই নভেম্বর কিন্নরকণ্ঠী গওহরজানের গান প্রথম রেকর্ডিং হয় এবং তার গানের রেকর্ড প্রকাশিত হবার পরই গ্রামোফোন কোম্পানিকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। গ্রামোফোন কোম্পানির কর্তা গেসবার্গ নিশ্চিত হয়েছিলেন ভারতের প্রথম গ্রামোফোন সেলিব্রিটি হতে চলেছেন গওহরজান। তাঁর গাওয়া সুরমল্লারে বাঁধা একটি বিখ্যাত গান "ঘুরঘুর বরসাত মেহেরবা, বিজুরিয়া চমকি অনেকবার,গুন গাও মোরে পিহরবা, আপ জাগে অউর মোহি জাগাভে ভর ভর সুরভ, ঘুর ঘুর বরসাত মেহরবা"। গানটির অর্থ হল - ' আকাশ থেকে নামে বৃষ্টিধারা, বিদ্যুৎ চমকায়, অনেকবার গান গাও হে প্রিয়, সজাগ তুমি, আমাকেও ঘুমোতে দিওনা, আর একি বর্ষার জলধারা নাকি সঙ্গীতের স্বর?' ক্রমবর্ধমান লয়ে একটার পর একটা স্বর যোগ করে তিনি এমন এক রাগের সৃষ্টি করেছিলেন যেখানে বৃষ্টি, বজ্র আর বিদ্যুতের প্রতীকী উপস্থিত এবং গানটি শোনার পরে রেকর্ডিংয়ের দায়িত্বে থাকা কলাকুশলীরা স্বতঃস্ফূর্ত উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েছিলেন।
রেকর্ডিং করার ক্ষেত্রে গ্রামোফোন কোম্পানির কাছে পুরুষ শিল্পীদের চেয়ে মহিলা শিল্পীদের চাহিদা ছিল বেশি। উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের পুরুষ শিল্পীরা রেকর্ডিংয়ের ব্যাপারে ছিলেন সন্দিহান কারণ যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যাপারে তাদের উৎসাহ ছিল কম। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের জগতে যে পুরুষ শিল্পীদের আধিক্য ছিল রেকর্ডিংয়ের ক্ষেত্রে কিন্তু মহিলা শিল্পীর ঝড়ের গতিতে প্রবেশ করে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন। কোঠাবাড়ির চৌহদ্দিতে আবদ্ধ বাঈজীদের গান অন্তঃপুর থেকে এবং বাবুদের জলসার আসর থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছিল এবং আমজনতা মহিলা শিল্পীদের বিখ্যাত গানগুলি রেকর্ডিংয়ের মাধ্যমে নিজেদের বাড়িতে বসে শুনতে পেয়েছিলেন। মহিলাদের গানের বাণিজ্যিক সাফল্য দেখে পুরুষ শিল্পীরা নিজেদের আভিজাত্য ও কুসংস্কারকে বিদায় জানিয়ে তারাও এরপরে রেকর্ডিংয়ের ক্ষেত্রে এগিয়ে এলেন। তবে প্রথম দিকে তারা মহিলা শিল্পীদের গাওয়া বিখ্যাত গান গুলি নিজেদের কণ্ঠে গাইতে আরম্ভ করলেন। পন্ডিত মল্লিকার্জুন মনসুরের মত বিখ্যাত শিল্পীও 'বিন বদরা বিজুরি কাঁহা চমকে' গানটি রেকর্ড করেছিলেন যে গানটি বহুবছর আগে গেয়েছিলেন জানকী বাঈ। এই সময় থেকে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ক্ষেত্রে চালু হয়েছিল 'ক্ল্যাসিক্যাল', 'লাইট', 'সেমি ক্ল্যাসিক্যাল' নাম। মজার ব্যাপার হল যে শিল্পীরা গানের আসরে নির্ভেজাল শাস্ত্রীয় সংগীত ঘন্টার পর ঘন্টা ব্যাপী গাইতেন তিনি আয়ত্ত করলেন কিভাবে সেই শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের রাগকে 'লাইট ক্লাসিক্যাল' করে তিন মিনিটে রেকর্ডিং করতে।
ক্রমশঃ
জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


0 Comments