রাশিয়া – ইউক্রেন এবং বিপর্যস্ত মানবতা
বিজন সাহা
১৮ জানুয়ারির পর গত ২৭ ফেব্রুয়ারি আবার মস্কো গেলাম। গত কয়েকদিন যাবত সর্বত্র শুধু যুদ্ধ আর যুদ্ধ। টিভি, ফেসবুক। বেচারা করোনা! হুট করেই উধাও হয়ে গেছে রুপালী পর্দা থেকে। না, কাজকর্ম - কোথাও যুদ্ধ নিয়ে কোন কথা নেই। সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত। মস্কোয় কোন ব্যতিক্রম দেখলাম না। মেট্রো, ট্রেন - কোথাও না। বরাবরের মতই সবাই বইয়ে বা টেলিফোনে মুখ গুঁজে বসে আছে। ভার্সিটিতে সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত। আমাদের দেশে ভার্সিটির ছেলেমেয়েরা সবচেয়ে বেশি রাজনীতি সচেতন। এখানে কাউকে এ নিয়ে কোন কথা বলতে শুনলাম না। মনে হয় জীবনে কোনই পরিবর্তন আসেনি। এরপর ইচ্ছে করেই গেলাম সুপার মার্কেটে – দেখতে, লোকজন কেনাকাটি করছে কিনা। না, সেখানেও একই অবস্থা। শুনেছি অনেকেই ব্যাংক থেকে টাকা ওঠাচ্ছে। ২৭ মার্চ নাকি মানুষ ১,৩ ট্রিলিয়ন রুবল ক্যাশ করেছে। মনে হয় বড় বড় পার্টি। কেননা কোথাও কোন ভিড় চোখে পড়েনি। তবে সেটা সাময়িক বলেই মনে হয়। অন্তত টাকা উঠিয়ে কেউ কিছু কিনছে না। হ্যাঁ, ডলারের দাম বাড়ছে হু হু করে। এমতাবস্থায় লোকজন বিভিন্ন টেকনিক্স, যেমন টিভি, কম্পিউটার এসব কেনে। মানে টাকাটা ইনভেস্ট করে। এবার সেটা দেখলাম না। আজ দুবনায় দোকানে গিয়ে চোখ ছানাবড়া, অনেকেই পে করছে ক্যাশে, তাও আবার ৫ হাজার রুবলের নোট দিচ্ছে। ক্যাশিয়ার বলল তার ভাংতি নেই। তাই যেন সবাই কার্ডে পে করে। এখন হয়ত এরা যাবে ক্যাশ আবার কার্ডে ভরতে।
পয়লা বসন্তে ভোলগার তীরে গেলাম হাঁটতে। তারও কোন দুশ্চিন্তা দেখলাম না। লোকজন ঘুরছে নদীর ধারে। কেউ বাচ্চাদের নিয়ে, কেউবা কুকুর। আসলে দেশ বিদেশ থেকে কত লোক ফোন করছে, ফেসবুকে লিখছে - কিন্তু এখানকার সাধারণ মানুষের মধ্যে এ নিয়ে আগ্রহ তেমন দেখছি না।
মনিকাকে জিজ্ঞেস করলাম, মিশাকে। কেউ এসব নিয়ে তেমন একটা ভাবছে না। আন্তন, সেভা কেউ না। শুধু ক্রিস্টিনা বলল, প্রথম দুই দিন পিতেরবুরগে ওরা বন্ধুরা সবাই এক সাথে ছিল। ঐ ভয় থেকে - কে জানে কী হয়। তবে অন্যদের দেখে বা কথা শুনে মনে হয় না কেউ খুব একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে।
যুদ্ধবিরোধী দু একটা প্রতিবাদ সভাও হচ্ছে। তবে এখানকার নিয়ম অনুযায়ী আগে থেকে অনুমোদন না নিলে এসব করা নিষেধ আর করোনা কালে এ অনুমতি কেউ দেয়না। তাই মিটিং থেকে লোকজনকে পুলিশের গাড়িতে তুলে নিয়ে যায় আর থানায় নাম ঠিকানা লিখে ছেড়ে দেয়। এবারও এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে বিভিন্ন শহরে।
সেদিন দেখি এক মহিলা ১০ বোতল তেল কিনছেন। সেটা দেখে আমিও ভাবলাম দু বোতল কিনব কিনা, যদিও বাসায় এক বোতল তেল এখনও আছে। জানি না কি মনে করে মহিলা নিজে থেকেই বললেন
- ভেব না যে আমি ইউক্রাইনের ঘটনার জন্য কিনছি। বসন্ত এসে গেছে। প্রায়ই দাচায় মানে গ্রামের বাড়িতে যাব, থাকব। তাই এ সময় আমি এসব জিনিস কিনে দাচায় নিয়ে যাই।
আরও পড়ুন
যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা / বিজন সাহা
সেদিন ক্লাস নিয়ে বেরিয়েছি বাসায় ফিরব, দেখি একজন হুইল চেয়ারে করে গাড়ির সামনে দিয়ে রাস্তা ক্রস করছেন। একটু অবাক হলাম। এরপর দেখি ট্রাম আসছে। তিনি হুইল চেয়ারে এদিক সেদিক যাতায়াত করতে শুরু করলেন। আমি অবাক হয়ে ভাবলাম কী চাইছেন উনি। কারণ সেই গতিবিধি ছিল আমার বোধগম্যের বাইরে। একটু পরে দেখলাম ট্রামের ড্রাইভার নেমে একটা সিঁড়ি পেতে তাঁকে ট্রামে তুলে নিলেন। রাশিয়ায় এরকম জিনিস খুব একটা দেখা যায় না। তবে ইদানীং কালে ট্রাম, বাস ইত্যাদিতে এসব সুযোগ থাকে। সেটা দেখে মনটা ভাল হয়ে গেল।
আসলে জীবন তো শুধু যুদ্ধ নিয়ে নয়, এই যুদ্ধটা জীবনের একটা অংশ মাত্র। প্রথম শকটা হয়তো ইতিমধ্যে কেটে গেছে। তবে এটাও ঠিক প্রতিদিন নিত্য নতুন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে। এই তো সেদিন কেনাকাটি করে দাম দিতে গেলাম, দেখি গুগল-পে কাজ করছে না। সাথে কার্ড থাকায় বাঁচা গেল। শুনেছি সোমবার মস্কোয় অনেকেই এই সমস্যায় পড়েছে পাবলিক ট্র্যান্সপোর্টে। পে করতে পারছিল না। তবে কর্তৃপক্ষ দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ায় সমস্যা এড়ানো গেছে। এখন সুপার ও হাইপার মার্কেটগুলোয় ঘোষণা দিচ্ছে গুগল-পে, আপেল-পে, স্যামসাঙ-পে - এসব কাজ করে না তাই লোকজন যেন ক্যাশ বা ব্যাংক কার্ড ব্যবহার করে। ব্যাংক থেকে এসএমএস করে জানাচ্ছে কি করতে হবে। কোন অসুবিধা হচ্ছে না। তবে রুবলের ফ্রি ফলের ফলে ব্যবসায়ীরা প্রমাদ গুনছে। করোনার কারণে ব্যবসা, বিশেষ করে ছোট ব্যবসা অনেক দিন হালে পানি পাচ্ছে না। কাজাখস্তানে ক্যু প্রচেষ্টার পরে চীন থেকে কাপড় আসতে দেরি হওয়ায় নতুন সমস্যা দেখা দিয়েছে। এর উপর ডলারের মহাকাশ যাত্রা নতুন করে আঘাত হেনেছে। যেসব মার্কেটে চীনারা মাল সাপ্লাই করে ওরা সেটা বন্ধ করে দিয়েছে কারণ ডলারের ঊর্ধ্বগতির কারণে অনেক ক্ষতি হচ্ছে। শুধু ওরা কেন, মস্কোর স্টক একচঞ্জ পর্যন্ত তার কাজ স্থগিত রেখেছে।
আসলে আমার ৩৮ বছরের বেশি সোভিয়েত ও রুশ জীবনে এমন কোন সময় ছিল না যখন এদের উপর কোন না কোন স্যাঙ্কশন ছিল না। তাই এসব মনে হয় লোকজনের গা সওয়া হয়ে গেছে। তবে গত কয়েক বছরে স্যাঙ্কশন আরোপ করা হত মূলত হোমরা চোমরা লোকদের উপর। এবার মনে হয় ইচ্ছে করেই এমন ভাবে স্যাঙ্কশন দেওয়া হচ্ছে যাতে সাধারণ মানুষ সেটা ভালভাবেই অনুভব করে। তাদের হিসাব অনুযায়ী এতে করে এরা প্রেসিডেন্ট বা এলিটদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে। তবে আমার দেখা মতে যতবারই বাইরে থেকে এদের উপর চাপ সৃষ্টি করা হয় এরা ততই ঐক্যবদ্ধ হয়। তবে এটাও ঠিক বিগত কয়েক বছরে সারা বিশ্বে নতুন জেনারেশন অনেক বেশি ভোগবাদী হয়ে উঠেছে। তাদের কাছে দেশের চেয়ে আই-ফোনের দাম অনেক বেশি। তাই রুস্কি দুখ বা রাশান সোল এবার কী জবাব দেবে সেটা দেখার বিষয়।
যদি রাশিয়া উল্টা স্যাঙ্কশন দিয়ে ইউরোপে তেল গ্যাস রপ্তানি বন্ধ করে সেটা ইউরোপ সামাল দিতে পারবে কি? সেখানে ১৯৪৫ সালের পর থেকে মানুষ যুদ্ধ কি জানে না, কষ্ট কি জানে না। কিন্তু রাশিয়া এই পদক্ষেপ নেবে বলে মনে হয় না। মনে রাখা দরকার - এই যুদ্ধ আসলে বাজারের জন্য। ইউরোপের এনার্জি সেক্টর আমেরিকা দখল করতে চায় বলেই তো এত কান্ডকারখানা, বলতে গেলে জোর করে রাশিয়াকে যুদ্ধে নামানো। এরপর যদি রাশিয়া সেই মার্কেট ছেড়ে আসে তাহলে এই যুদ্ধের কী দরকার ছিল?
যদিও যুদ্ধ শুরুর আগে এরা বলেছিল এর পরিণাম সম্পর্কে তারা ওয়াকিবহাল আমার মনে হয় সেখানে কিছু ভুল ছিল। হ্যাঁ, অনেক দিন থেকেই ওরা বলে আসছে সুইফট থেকে এদের ডিসকানেক্ট করে দেবে, আসবে আরও রঙ বেরঙের এম্বারগো - তাই অর্থনৈতিক দিক থেকে প্রস্তুতি ছিল। সামরিক দিক তো আছেই। যদিও এদের ৬৫০ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভের সিংহভাগ বিদেশে আর সেন্ট্রাল ব্যাংকের আসেট আটকানোয় মাত্র ২২০ বিলিয়ন এদের নাগালের মধ্যে আছে তার পরেও এ নিয়ে এরা তেমন বিচলিত বলে মনে হয় না। তবে এটা ঠিক এরাও চাইলে বিদেশি আসেটের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে। ইতিমধ্যে এরকম কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এদের বইদেশিক ঋণ যথেষ্ট, তাই ওরা এদের আসেট আটকালে এরাও বিদেশি ঋণ পরিশোধ স্থগিত করতে পারে। জাকে দলে সব কিছুর আন্টিডোট আছে।
গত কয়েক বছরে এরা সুইফটের অনুরূপ লোকাল সিস্টেম ডেভেলপ করেছে যেখানে এদের তিনশ’র বেশি ব্যাংক যুক্ত। তাই আভ্যন্তরীণ অর্থ লেনদেনে সমস্যা হচ্ছে না, হবেনা। চাইলে বিদেশি ব্যাংক এই সিস্টেমের সাথে যুক্ত হতে পারে। গতকাল একবন্ধু বলল ও যখন ব্যাংক থেকে ডলার তুলতে যায় ভেবেছিল ঝামেলা হবে, বিশেষ করে বড় অংকের টাকা তুলতে গেলে আগে থেকে বুকিং দিতে হয়। তবে কিছু জিজ্ঞেস না করেই ওর টাকাটা দিয়ে দিয়েছে। তার মানে সরকার চেষ্টা করছে যেকোনো ধরণের প্যানিক সিচুয়েশন এড়াতে। তাছাড়া বর্তমানে সব ব্যাংক সুইফট থেকে ডিসকানেক্ট করে দেয়নি, কারণ তেল গ্যাস কেনার জন্য হলেও ওদের কোন না কোন সিস্টেম খোলা রাখতে হবে। তবে যেটা ছিল না, সেটা মানবিক প্রস্তুতি।
এখন ইউরোপ, আমেরিকার বিভিন্ন ভার্সিটিতে রাশিয়ান ছাত্রদের বহিষ্কার করা হচ্ছে। এখানে বিভিন্ন ইউনিভার্সিটি তাদের নেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। মস্কো স্টেট, পিতেরবুরগ বিশ্ববিদ্যালয়, হায়ার স্কুল অফ ইকোনোমি, গন মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয় এদের অন্যতম। কিন্তু ঐসব ছাত্রদের অনেকেই যারা পশ্চিমা আদর্শে বিশ্বাস করত এই পশ্চিমা বিশ্বের পদক্ষেপ তাদের মানসিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করবে। ফ্রান্সে এক স্কুলে শিক্ষক রাশিয়ান ছাত্রদের ক্লাস থেকে বের করে দিয়েছে। আমেরিকায় পাঁচ বছরের এক রুশ মেয়ের উপর তার সাথীরা মানসিক আক্রমণ করেছে। তার ১৫ বছরের ভাইও বাদ যায়নি। ইউরোপের অনেক হোটেল, রেস্টুরেন্ট রুশদের জন্য বন্ধ। হয়তো এদের একটা বিরাট অংশই যুদ্ধ বা পুতিন বিরোধী। রাশিয়া থেকে অনেকেই চিকিৎসার জন্য ইউরোপ আমেরিকায় যায়, বিশেষ করে শিশুরা। কিছু কিছু দেশের ডাক্তাররা ক্যান্সারে আক্রান্ত রুশ শিশুদের চিকিৎসা করতে অস্বীকার করেছে। বিভিন্ন দেশে রুশ ভোদকা বয়কট করা হচ্ছে। তার মানে রুশ বা রাশিয়ান হওয়াই তাদের অপরাধ। এটা অনেকটা উপমহাদেশে বিধর্মী বা কয়েক যুগ আগে আমেরিকায় কালো হবার মত। রুসোফোবিয়া এসব দেশে সব সময়ই ছিল, তবে এবার সেটা অকল্পনীয় রূপ ধারণ করেছে। আর এটা র্যাসিজম। তাহলে কি আমরা আবার সেই র্যাসিজমের যুগে ফিরে যাব? মানবতার এ কেমন রূপ? মানবতার কথা বলে আমরা নিজেরা আর কত অমানবিক হব। আজ রুশ দেশ, এদেশের মানুষকে ঘৃণা করা সহজ। একদিন যুদ্ধ শেষ হবে, কিন্তু ঘৃণা থেকে যাবে। এই ঘৃণা থেকে যাবে সেই সব শিশুর মনে যারা তাদের সহপাঠীকে রুশ বিধায় নাজেহাল করল। এই ঘৃণা যে একদিন সেই সব মানুষের জন্ম দেবে না যারা বন্দুক হাতে স্কুলে বিনা বিচারে মানুষ মারে - তা কে জানে? মানবতার নামে আমরা আর কত অমানুষ তৈরি করব?
রুশ আকাশ আজ ইউরোপের জন্য বন্ধ, ঠিক যেমন ইউরোপের আকাশ রুশ বিমানের জন্য। বিভিন্ন দেশে এখন প্রায় ১৫০ হাজার রাশান নাগরিক আটকা পড়ে আছে। এদের ফেরানোর ব্যবস্থা চলছে। অনেকে এয়ারপোর্টে ঘুমুচ্ছে বাচ্চাদের নিয়ে। রুশ বিধায় তাদের জন্য সামান্য সহানুভূতি পর্যন্ত দেখানো হচ্ছে না। কিন্তু সমস্যা এখানে শেষ নয়, সবে শুরু। বর্তমানে রাশিয়ার বিভিন্ন এয়ার লাইন্স প্রায় ৭০০ বোয়িং ব্যবহার করে। এয়ার বাসের সংখ্যায়ও নেহায়েত কম নয়। ওরা বলেছে এরপর থেকে আর এসব প্লেনের জন্য স্পেয়ার পার্টস সাপ্লাই দেবে না। তাহলে? এই বিমানের অধিকাংশ লিজে নেওয়া। এরা যদি এসব প্লেন ফিরিয়ে দেয় এই অতিমারির সময় কী করবে তারা এত প্লেন দিয়ে? এর ফলে বোয়িং আর এয়ার বাসের বানিজ্যিক ক্ষতি হতে বাধ্য। তাছাড়া যেহেতু রাশিয়া আর পশ্চিমা বিশ্ব একে অন্যের আকাশ পথ বন্ধ করেছে তখন এই বিমানগুলো তারা নিবেই বা কেমনে। যেহেতু ওদের রাজনীতির কারণেই রাশিয়ার কোম্পানিগুলো চুক্তি স্থগিত করতে বাধ্য তাই এখন আর এ ব্যাপারে তাদের কোন দায়দায়িত্ব নেই। ফলে অনেক লিজিং কোম্পানি ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। বিভিন্ন বিদেশী কোম্পানি যারা এ দেশে গাড়ি তৈরি করত তারাও নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছে। রাশিয়ার গাড়ির বাজার যথেষ্ট বড়, সেটাও প্রভাব ফেলবে বিশ্ব বাজারে। তবে সেই সাথে রাশিয়ায় বেকারের সংখ্যা বারবে, কেননা এই সমস্ত কম্পানিতে অনেক রুশ কাজ করত। গ্যাসের দাম ইতিমধ্যে ঊর্ধ্বমুখী। পোল্যান্ডের প্ররোচনায় ইউরোপ রাশিয়া থেকে কয়লা কিনবে না। রাশিয়া ইতিমধ্যে চীনের সাথে কয়লার ব্যাপারে চুক্তি করেছে, যেমন করেছে গ্যাসের ব্যাপারে। রাশিয়া এখন কোন পদক্ষেপই নেয়নি তাতেই জ্বালানীর বাজার ঊর্ধ্বমুখী, এমনকি যুদ্ধ থেকে অনেক দূরে বাংলাদেশেও জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে। ইউরোপ কি নিজে নিজের পায়ে কুড়ল মারতে যাচ্ছে? ২০১৪ সালের পর থেকে রাশিয়ার উপর আরোপিত স্যাঙ্কশনে অর্থনৈতিক ভাবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ ইউরোপ। মনে রাখতে হবে ইউরোপে রাশিয়ার গ্যাস সরবরাহের পরিমাণ ৪০% আর তেলের ৩০%। আমেরিকায় রাশিয়ার তেল ১০%। ইতিমধ্যেই এসবের দাম বাড়ছে। ফলে বিশ্ব বাজারে যে ধ্বস নামবে এবং প্রচুর কোম্পানি ধ্বংস হয়ে যাবে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। বড় অর্থনীতির দেশগুলো সেটা কাটিয়ে উঠলেও ছোট ও মধ্য অর্থনীতির দেশ বিপদে পড়বে। এছাড়া নিজেদের অবস্থা নাজুক হওয়ায় বড় বড় দেশগুলো ছতদের সাহাজ্যে এগিয়ে আসতে পারবে কিনা সেটাও সন্দেহ। ইউরোপ ইতিমধ্যেই নজিরবিহীন অর্থনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। তবুও তারা রাশিয়ার উপর চাপ সৃষ্টি করেই যাচ্ছে।
অনেক দিন যাবত রুশ খেলোয়াড়রা নিজেদের পতাকা নিয়ে খেলতে পারে না। এখন একটার পর একটা ফেডারেশন রুশ দল বা খেলোয়াড়দের আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে দিচ্ছে না। এর ফলে শুধু যে রাশিয়ার স্পোর্টস ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে তাই নয়, ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গন। আজ এইমাত্র খবর এল যে রুশ ও বেলারুশ জাতীয় দল প্রতিবন্ধী অলিম্পিক গেমে অংশ নিতে পারবে না।
মুক্তচিন্তার ও বাক স্বাধীনতার দেশ বলে কথিত পশ্চিমে আজ রুশ বাক্য রুদ্ধ। এদের সব সংবাদ মাধ্যম ব্লক করা হচ্ছে। আরটি অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন দেশে ডিসক্রিমিনেশনের শিকার হয়েছে, এখন অন্যান্য অনেক মাধ্যম একই পথে এগুচ্ছে। দনবাসের ১৫ হাজার মৃত্যু তাদের কাছে গনিমতের মাল। এদের দুঃখের কথা ওসব দেশের কাগজে আসেনা। এই বিশ্ব কি আপনি চেয়েছিলেন যখন একদল মানুষ সামান্য মানবিক মর্যাদা পর্যন্ত পাবে না? দনবাসের শিশু, বৃদ্ধ – এরা তো কোন দোষ করেনি। তাহলে? তাদের একটাই দোষ তারা রুশ অথবা রশ সমর্থক। মহারাজ যুধিষ্ঠির জীবনে একবার মাত্র মিথ্যা কথা বলে মিথ্যুক হয়েছিলেন আর আপনারা দিন দিন প্রতিদিন এমন হৃদয়হীন কাজ করে মানবিক সাজতে চান? আপনাদের মত লকেরাই বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া সার্টিফিকেট নেয়। ধিক!
আমি যুদ্ধের পক্ষের লোক নই, যুদ্ধ সমর্থনও করি না। তবে কার্যকরণ সম্পর্ক খোঁজার চেষ্টা করি। ১৯৯১ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত কেউই আমেরিকার মুখের উপর কথা বলার সাহস পায়নি। ২০০৭ সালে মিউনিখে পুতিন প্রথম বলেন যে রাশিয়া পশ্চিমের হেজেমনি মানবে না। এখান থেকেই শুরু। এরপর বাংলাদেশও আমেরিকার হুমকি উপেক্ষা করে পদ্মা সেতু তৈরি করে। এটা সম্ভব হয়েছিল পুতিনের রাশিয়া সেদিন আমেরিকার সাথে দ্বিমত প্রকাশ করা যায় সেটা দেখানোর কারণেই।
আমরা অনেকেই এই রুশ আক্রমণের বিরুদ্ধে বলছি। বলা উচিৎ। তবে একটা ব্যাপার আমাকে ভাবায়। এটা সর্বজন বিদিত (যারা ২০১৪ সাল থেকে ইউক্রাইনের রাজনীতি ফলো করছেন) যে বিগত সাত বছরে আসলে হিটলারকে সমর্থনকারী বান্দেরার অনুসারীরা মানে উগ্র জাতীয়তাবাদী ও ফ্যাসিবাদী শক্তি পেছন থেকে সরকার চালাচ্ছে, যদিও মূল চাবিকাঠি মার্কিন দূতাবাসের হাতে। আমেরিকা সোভিয়েত ইউনিয়নকে হঠানোর জন্য আফগানিস্তানে যেমন তালেবান ও আল কায়েদা সৃষ্টি করেছিল, একই ভাবে ইউক্রেনকে আন্টিরুশ বানানোর জন্য তারা তৈরি করেছে এসব জাতীয়তাবাদী ও ফ্যাসিবাদী সংগঠন। এদের একটাই আদর্শ – রুশ বিরোধিতা। সত্যি বলতে কি বিগত প্রায় আট বছর সে দেশ আর দেশের জনগণ এদের হাতে জিম্মি। এরা যে কোন রকম মানবতার ধার ধারে না তার প্রমাণ ওদেসায় জনা পঞ্চাশ মানুষকে পুড়িয়ে মারা। শোনা যাচ্ছে বিদেশিরা যখন যুদ্ধের হাত থেকে বাঁচতে ইউক্রেন ত্যাগ করে পোল্যান্ড বা হাঙ্গেরি যাচ্ছে, সেখানে সাদাদের বিনা বাক্যে যেতে দিলেও রঙিন মানে ভারতীয় বা এশিয়ানদের বিভিন্ন ভাবে হ্যারাস করছে। অনেক বিদেশীরা এই সব জাতীয়তাবাদীদের দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে। আর এদের হাত থেকে দেশ মুক্ত করাই এই অভিযানের লক্ষ্য। এখান থেকেই সেই প্রশ্ন। আমরা জানি বিএনপি আমলে মূলত জামাত পেছন থেকে কলকাঠি নাড়িয়েছে। এখন যদি কখনও দেশে এমন অবস্থা সৃষ্টি হয় যে জামাতই মূল ক্ষমতার অধিকারী হয় আর তখন নিরাপত্তার অজুহাতে কোন দেশ তা সে ভারত, চীন, মিয়ানমার, আমেরিকা - যেই হোক, জামাতকে হঠাতে অভিযান শুরু করে তখন আপনার স্ট্যান্ড কি হবে সেটা কি জানেন?
আমেরিকার পরবর্তী সৃষ্টি হচ্ছে ইসলামিক স্টেট। শোনা যাচ্ছে আমেরিকা ও ব্রিটেন প্ল্যান করছে সিরিয়া, লিবিয়া থেকে ইসলামিক স্টেটের যোদ্ধাদের ইউক্রাইনে নিয়ে আসবে রুশদের মোকাবিলায়। প্রশ্ন জাগে সেটা কতটুকু যৌক্তিক। এখন ইউক্রাইনে সবার হাতে শুধু কালাশনিকভ নয়, স্ট্রিঙ্গার সহ বিভিন্ন ভারি অস্ত্র তুলে দেওয়া হচ্ছে। এই সব যোদ্ধারা যদি কিছুদিন পরে ইউরোপের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করে? বিশেষ করে যখন শরণার্থীর বেশে আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া থেকে প্রচুর জিহাদি এসব দেশে অবস্থান করছে তখন এ ধরণের পদক্ষেপ কি খুবই রিস্কি না?
অনেকের ধারণা যদি হলকস্ট না হত পশ্চিমা বিশ্বে আজ হিটলার একজন কুশলী সেনাপতি হিসেবে পুজিত হত। নেপোলিয়ন কি কম রক্ত ঝরিয়েছে? নাৎসিদের হাতে ২৬ মিলিয়ন সোভিয়েত নাগরিক প্রাণ দিয়েছে যার সিংহভাগ রুশ। জিপসিদের সংখ্যাই কি কম? কিন্তু কে বলে তাদের কথা? শুধু ইসরাইলের আর সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা ইহুদীদের অবিরাম চেষ্টা পৃথিবীকে হলকস্ট ভুলে যেতে দেয়নি। এটা আবার প্রমাণ করে যে পশ্চিমা বিশ্ব যতই গণতান্ত্রিক, যতই মানবিক পোশাক পরুক না কেন, তাদের কাছ থেকে মৃতদের অধিকার আদায় করতে হলেও জীবিতদের সংগ্রাম করতে হবে।
অনেকেই প্রশ্ন করেন রাশিয়া এত সময় নিচ্ছে কেন ইউক্রেন জয় করতে। তাহলে কি এরা হেরে যাচ্ছে? নিজেকে প্রশ্ন করলে জানতে পারবেন আমেরিকা আর পশ্চিমা বিশেষজ্ঞরাই বার বার বলেছে ইউক্রেন দখল করতে রাশিয়ার তিন দিন লাগবে। যেহেতু তিন দিন পার হয়ে গেছে তাই আপনারা রাশিয়ার পরাজয় দেখছেন, পশ্চিমা প্রোপ্যাগান্ডাও তাই বলছে। কিন্তু রাশিয়া কিন্তু এটা কখনও বলেনি। একটা কথা মনে রাখা দরকার যুদ্ধে শুধু ফ্রন্ট থাকে না, থাকে রেয়ার। সাপ্লাই না থাকলে যুদ্ধ চলে না। ট্যাঙ্ক যত দ্রুত এগিয়ে যেতে পারে সরবরাহকারী গাড়িগুলো তত তাড়াতাড়ি পারে না। যাতে ফ্রন্ট আর রেয়ারের মধ্যে ব্যাপক গ্যাপ তৈরি না হয় তাই এরা এগুচ্ছে প্ল্যান মাফিক। বহির্বিশ্বে হয়ত ইউক্রেন থেকে প্রচুর খবর পাওয়া যায় যার সত্যতা প্রশ্ন জাগায়। রাশিয়ায় এ নিয়ে খুব বেশি বলে না। মিলিটারি প্রেস ব্রিফিং হয়। ঠিক ততটাই বলে যা না বললে নয়। যুদ্ধে অনেক সিক্রেট ইলিমেন্ট থাকে। সেটা তারা বজায় রাখে। তবে সব দেখে মনে হচ্ছে পশ্চিমা বিশ্ব যুদ্ধটা বিলম্বিত করতে চায়। কিন্তু সেটা কতদিন সম্ভব? কারণ যদি এভাবে চলতে থাকে তবে অবস্থা এমন হতে পারে যখন দুই শক্তির সরাসরি সংঘর্ষ অনিবার্য। তখন এর পারমাণবিক রূপ নেওয়া অসম্ভব কিছু নয়। অনেকেই বলছেন যুদ্ধে যখন রাশিয়া নেমেছেই তাহলে অনেক লোকজন মারা যাবে সেটা মেনে নিয়েই যুদ্ধ করতে হবে। তা ঠিক। তবে এটা নির্ভর করে দৃষ্টিভঙ্গির উপর - যুদ্ধটা ধ্বংসের হাতিয়ার নাকি ধ্বংস থেকে নতুন জীবনের উত্থানের উপায়? লড়াইটা যদি জীবনের জন্য হয় তাহলে যত বেশি সম্ভব জীবন রক্ষা করেই কাজটা করতে হবে।
ইউক্রাইনের মূল সেনা সমাবেশ দনবাসে। ওদের সেখানে ঘিরে ফেলা হচ্ছে। ইতিমধ্যে ইউক্রাইনের রেগুলার আর্মির অনেকেই আত্মসমর্পণ করেছে, করছে। তাদের কাছ থেকে বন্ড সই নেওয়া হচ্ছে আর যুদ্ধ করবে না বলে। এদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। বাড়িতে ফোন করতে দিচ্ছে। বলা হচ্ছে যুদ্ধ শেষে এদের ফেরত পাঠানো হবে। রাশিয়া বলছে তাদের ইচ্ছা নেই ইউক্রেন দখল করার। সেখানকার সামরিক শক্তি ধ্বংস করে আর উগ্র জাতীয়তাবাদীদের সাজা দিয়ে এরা ফিরে আসবে। তখন তাদের দরকার হবে ইউক্রাইনের নাগরিকদের যারা রাশিয়াকে ঘৃণার চোখে দেখবে না। তাই যদি আমেরিকান স্টাইলে কার্পেট বোম্বিং করে দ্রুত ইউক্রেন দখল করা হয় তাহলে সেখানে বন্ধু বলে কেউ থাকবে না। তাই তাড়াহুড়োর কিছু নেই। এটা বুঝে বলেই হয়ত এরা মানে রুশ নাগরিকরা এত শান্ত।
আমেরিকা সব দিক থেকেই রাশিয়ার চেয়ে শক্তিশালী, তা সে অস্ত্রেশস্ত্রে হোক, অর্থনীতিতে হোক আর বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে হোক। আর আছে প্রায় অর্ধশত বন্ধু দেশ। সেদিক থেকে রাশিয়ার সাথে কে আছে? বেলারুশ? চীন? ভারত? তবে অনেক সময় দুর্বলতাই সবলতার রূপ নেয়। আমেরিকার পাশে দাঁড়ানো এই অর্ধশত দেশের সাথে রাশিয়ার সম্পর্ক বিভিন্ন রকম। সেখানে বন্ধু আছে, আছে শত্রু, আছে বিভিন্ন রকমের ব্যবসায়িক পার্টনার। এই সব দেশের অর্থনীতিও বিভিন্ন রকম। তাই যেকোনো ক্রিটিক্যাল অবস্থায় এই জোটের ঐক্য কতটুকু অটুট থাকবে সেটা দেখার বিষয়। তাছাড়া এরকম সময়ে যখন দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবার প্রশ্ন আসে সেটা রাশিয়ার জন্য যত সহজ ওদের জন্য তত সহজ নয়।
আচ্ছা আমেরিকা যে লক্ষ্যে রাশিয়াকে এই যুদ্ধে নামাল তার সবই কি অর্জিত হয়নি? এতদিন রাশিয়া আর ইউক্রাইনের সরকার বা এলিট এই যুদ্ধে জড়িত ছিল, এখন জনগণ জড়িত হল। দুই ভ্রাতৃপ্রতিম জাতি একে অন্যের শত্রু হল। আমেরিকা এর চেয়ে বেশি আর কী আশা করতে পারে? নর্থস্ট্রীম-২ যাকে নিয়ে ঘটনা সেটা বন্ধ। ভ্লাদিমির পুতিন কয়েক দিন আগেও বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় নেতা ছিলেন, আজ বিশ্বনিন্দিত। আর কি চাই? আমেরিকা যদি ইউক্রাইনের জনগণের কথা ভাবত, দু’ মিনিটেই যুদ্ধ বন্ধ করতে পারত। হচ্ছেনা। বরং ন্যাটো ও অস্ট্রেলিয়া ইউক্রাইনে সামরিক সাহায্য পাঠাচ্ছে? কেন? তোমরা রুশদের হত্যা কর। না পারলে নিজেরা নিজেরা লড়াই করে মর। ইতিমধ্যে সাধারণ মানুষ, এমন কি বিভিন্ন অপরাধীদের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া হয়েছে। এরপর শুরু হয়েছে লুটপাট। ইউক্রেন আর্মি নিজ শহরে ঘনবসতি পূর্ণ এলাকায় ট্যাঙ্ক, মর্টার ইত্যাদি ভারী অস্ত্র বসিয়েছে শহরে যুদ্ধ করবে বলে। রাশিয়া যাচ্ছেনা, কারণ তাতে প্রচুর লোকক্ষয় হবে। মানুষকে বর্ম হিসেবে ব্যবহারের এই নীতি কী বয়ে আনে কে জানে? তবে সবাই জানে এজন্যে দায়ী হবে রাশিয়াই। কোন কোন ইউক্রেন নেতা বলছে রুশদের হত্যা করার জন্য। প্রথমে উক্রাইনে, তারপর রাশিয়ায়। এখনই উক্রাইনে অফিসিয়াল হিসেবে ১৮% রুশ বাস করে। এখানে উল্লেখ্য যে আমাদের দেশে জাতীয়তা আমরা লিখি বাংলাদেশি, ভারতীয়, আমেরিকান। সোভিয়েত ইউনিয়নে নাগরিকত্ব লিখত সোভিয়েত আর জাতীয়তা যার যার এথনিক্যাল আইডেন্টিটি, মানে রুশ, ইউক্রেনিয়ান, বেলারুশ, কাজাখ, তাতার ইত্যাদি। তবে এখন অনেক সময় রুশদের জোর করেই ইউক্রেনিয়ান লেখা হয়, তাই আসল সংখ্যা আরও বেশি। তারপরেও ৪৫ মিলিয়নের ইউক্রাইনে ১৮% প্রায় ৯ লাখ। তবে মানবাধিকারের প্রবক্তারা এ নিয়ে কিছু বলার কথা ভাবছে বলে মনে হয় না।
এটা ঠিক ইউক্রেন সত্যিই চরম দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সেখানে বিনা বিচারে সবার হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে কিয়েভ, খারকভ ইত্যাদি শহরে শুরু হয়েছে লুটপাট। এমনকি কিয়েভের মেয়র দুর্বৃত্তদের সরাসরি গুলি করার নির্দেশ দিয়েছে। এক কথায় এই মুহূর্তে মনে হয় ইউক্রাইনের উপর কারই কন্ট্রোল নেই। এই পাওয়ার ভ্যাকুমও যুদ্ধটাকে দীর্ঘায়িত করতে পারে।
এটা অনেকেই বলেন বা বোঝেন যে ভ্লাদিমির পুতিন এখানে কোন ব্যাপার নন, রাশিয়াকে ধ্বংস করাই পশ্চিমাদের একমাত্র লক্ষ্য। কথাটার সত্যতা অস্বীকার করা যায় না। পুতিন সম্পর্কে বলা হয় তিনি আজীবন ক্ষমতায় থাকতে চান। আচ্ছা নেহরু, মেরকেল এরা কি কম সময় শাসন করেছেন। ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট চার বার আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। আমার মনে হয় সাংবিধানিক সুযোগ থাকলে অনেক আমেরিকান প্রেসিডেন্টই বার বার ক্ষমতায় ফিরে আসতে চাইতেন। অনেক সিনেটর যুগের পর যুগ ক্ষমতায় থাকেন, সেটাই প্রমাণ করে যে ক্ষমতার ব্যাপারে সব দেশের মানুষই এক রকম। রুশ সংবিধান এক সময় আমেরিকার সংবিধানের অনুকরণে তৈরি হয়েছিল, কিন্তু সেটা যে এখানে কাজ করবে তা কে বলল। তারা নিজেদের সংবিধান পরিবর্তন করেছে আর সেই সংবিধান যদি কাউকে বার বার নির্বাচিত হবার সুযোগ দেয় অসুবিধা কি? এক সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন চেষ্টা করেছে নিজের মডেল সবার উপর চাপিয়ে দিতে, এখন আমেরিকা সেটা করছে। আবার একই ব্যক্তির প্রেসিডেন্ট ও প্রিমিয়ার মিনিস্টার হওয়ার উদাহরণ কি পুতিনের আগে ছিল না। মনে করিয়ে দিই। শেখ মুজিবুর রহমান এই দুই পদেই ছিলেন। তবে পুতিন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট বলেই না অন্য দিক থেকেও পশ্চিমাদের রোষের কারণ। সাল্ভাদর আলিয়েন্দে, শেখ মুজিব, জামাল নাসের, একাত্তরের ইন্দিরা গান্ধি – নামের কোন শেষ নেই যারা আমেরিকার চক্ষুশূল হন নাই। কেন? সবাই স্বাধীনচেতা, কেউই আমেরিকার কাছে মাথা নত করতে চায়নি। আর ব্যক্তিস্বাধীনতার দেশ আমেরিকা এদের কাউকেই তাই ক্ষমা করতে পারেনি। শোনা যায় স্বয়ং ঈশ্বর আদমের অবাধ্যতা সহ্য করতে পারেনি। আমেরিকা তো আর পরম করুনাময় নয়, সে পারবে কিভাবে?
পশ্চিমা বিশ্ব একের পর এক স্যাঙ্কশন আরোপ করে খুব দ্রুত হাতের সব তাস খুইয়ে ফেলছে। এরপরও যদি রাশিয়া শায়েস্তা না হয়? আসলে মানব সভ্যতার ইতিহাস অনেক যদি, কিন্তু, তবে ইত্যাদির বিশাল মিছিল। তারপর? যুদ্ধ? আসলে ঈশ্বরের নামেই কিছু সবচেয়ে বেশি বলি হয়, সব চেয়ে বেশি মানুষ খুনও হয় ঈশ্বরের নামেই। আমাদের মানবতা, গণতন্ত্র এসবই বা কম কিসে? গণতন্ত্রের নামে জীবন উৎসর্গ করার জন্যই তো এশিয়া আর আফ্রিকায় এত গাদি গাদি শিশু জন্মায়। শয়তান নাকি এক সময় দেবতাদের পালের গোদা ছিল। তাহলে গণতন্ত্রের পালের গোদার শয়তান হতে সমস্যা কি? শুনেছি রাস্তায় নারী অধিকার রক্ষার অনেক সৈনিক ঘরে নাকি অত্যাচারী। নিজের ঘরের গণতান্ত্রিক আমেরিকা বহির্বিশ্বে ঠিক তার উল্টো। এটাই যুগের হাওয়া।
নেপোলিয়ন রাশিয়া আক্রমণ করেন সমস্ত ইউরোপীয় শক্তি একত্রিত করে। হিটলারের জার্মানি এসেছিল একই ভাবে সমস্ত ইউরোপিয়ান শক্তি নিয়ে। আজ ইউক্রেন একা নয়। ন্যাটো, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন তার সাথে। ইউক্রেন শিখণ্ডী মাত্র। এই যে পঁচাত্তরটা বিমান দেওয়া হল সেটা কারা চালাবে? ইউক্রাইনে ফরেন লেজিওনের কথা বলা হচ্ছে। ওখানে মনে হয় ন্যাটোর সৈন্যরাই ভাড়াটে বা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে নাম লিখিয়ে যুদ্ধ করবে। এর রূপ কী নেবে কে জানে? সেই যুদ্ধে যে প্রচুর প্রাণহানি হবে তাতে সন্দেহ নেই। আর এতে যদি রাশিয়া হেরে যায় আগামী অন্তত ৫০ বছরের জন্য সব প্রতিবাদী কণ্ঠ রুদ্ধ হবে। তখন ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, লিবিয়া এসব হবে দৈনন্দিন ব্যাপার। যুদ্ধের বিরুদ্ধে বলুন, কিন্তু মনে রাখবেন সেটা যেন হাজারটা ছোট যুদ্ধের জন্ম না দেয়। অবশ্য সেটা ভুল। বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর আক্রমণ নিয়ে যেমন বলে - ওখানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয় না, ওখানে হিন্দুরা মার খায়। হ্যাঁ, নতুন সেই বিশ্বে যুদ্ধ হবে না, শুধু একটার পর একটা দেশ ধ্বংস স্তুপে পরিণত হবে।
বিভিন্ন জন এই যুদ্ধটা বিভিন্ন ভাবে দেখছেন। তবে এটা সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ, এটা মুনাফাখোরদের যুদ্ধ। মানুষের উপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ। সভ্য পৃথিবী নিজেদের স্বার্থে একে ডেকে এনেছে। আর এর মাশুল দিতে হবে সারা পৃথিবীকে। যুদ্ধের কারণগুলো না জানিয়ে, আমাদের যুদ্ধ বিরোধী না করে পুতিন বা রুশ বিরোধী হতে বলা হচ্ছে। যদি আমরা সেই ফাঁদে পা দিই তাহলে তাহলে এটা হবে জাস্ট আর একটা যুদ্ধ, কিন্তু কারণ বুঝে আমরা যদি যুদ্ধ বিরোধী হই তাহলে এটাকে আমরা শেষ যুদ্ধে পরিণত করতে পারি। মনে করতে পারেন আমরা তো অতি নগণ্য মানুষ, আমরা কী করতে পারি? আমাদের সেন্টিমেন্ট, আমাদের সমর্থন দরকার বলেই তো এত ফেক নিউজের ছড়াছড়ি। অনেকেই বলছেন রাশিয়া প্রোপ্যাগান্ডা যুদ্ধে হেরে গেল। ঠিক। তবে এর দুটো দিক আছে। প্রোপ্যাগান্ডা করে যুদ্ধে জেতা যায় না, বরং একসময় নিজেরাই প্রোপ্যাগান্ডায় বিশ্বাস করে বসলে সত্যটাই ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায়। পরিস্থিতির সঠিক মূল্যায়ন তখন সে করতে পারে না। আর এটাই ডেকে আনে চূড়ান্ত পরাজয়। তাই প্রোপ্যাগান্ডার ব্যাপারেও সাবধান থাকা দরকার।
একদিকে ওরা বলছে ইউক্রাইনের স্বাধীনতা আছে যার সাথে ইচ্ছা যোগ দিতে, অন্যদিকে তারাই ভারতকে চাপ দিচ্ছে রুশ বিরোধী স্যাঙ্কশনে যোগ দিতে। স্বাধীনতা ব্যাপারটা খুবই আপেক্ষিক। আলো বাতাসে ভরা বিশাল পৃথিবীর চেয়ে মাছ যেমন এক বালতি জলে নিজেকে বেশি স্বাধীন মনে করে মানুষ তেমনি নিজেকে বেশি স্বাধীন মনে করে তার পরিচিত পরিবেশে যা তার দেশের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বাইরে থেকে কোন মত বা পথ জোর করে চাপিয়ে দিলে সেটা আর স্বাধীন পছন্দ বা চয়েজ হয় না। আর সবাই তখনই স্বাধীন হতে পারে যখন প্রত্যেকে প্রত্যেকের পছন্দকে শ্রদ্ধা করে, কিন্তু পছন্দ করতে গিয়ে তাকে অন্যের সুবিধা অসুবিধার কথাও ভাবতে হবে। ইচ্ছে হলেই আমি নিজের ঘরে আগুন লাগাতে পারি না, কারণ এতে প্রতিবেশী ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। বলে না মানুষ অধিকার অন্য মানুষের নাকের ডগায় শেষ হয়ে যায়।
ইতিমধ্যে রাশিয়া ও ইউক্রাইনের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে। যদিও আমেরিকা বলেছে তারা ইউক্রাইনের পছন্দকে সমর্থন করবে, কিন্তু ইউক্রেন যেভাবে বার বার আলোচনার সময় পিছিয়ে দিচ্ছে তাতে মনে হয় আমেরিকা এখনও তাদের আলোচনার ব্যাপারে পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়নি। যেকোনো পরনির্ভর দেশের এটাই সবচেয়ে বড় সমস্যা।
ইউক্রাইনের বিভিন্ন শহরে খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলো সেখানে হিউমানিটেরিয়ান সাহায্যের চেয়ে অস্ত্র পাঠাতেই বেশি আগ্রহী। আর এটাই প্রমাণ করে আসলে কারা এই যুদ্ধ চায়। এতদিন তারা রাশিয়াকে প্ররোচনা দিয়েছে যুদ্ধে নামতে, এখন ইউক্রেনকে ঢালাও ভাবে অস্ত্র সরবরাহ করে যুদ্ধের আগুনে ঘি ঢালছে। তাই বিশ্বের সচেতন মানুষকে প্রশ্ন করতে হবে, জানতে হবে যুদ্ধের উৎস। কোন প্রোপ্যাগান্ডা নয়, শুধু ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করে কারণ খুঁজতে হবে, পেতে হবে সঠিক উত্তর। মনে করবেন না যে যুদ্ধ অনেক দূরে। যুদ্ধ আপনার ঘরে। এমনকি যদি সেটা পারমাণবিক যুদ্ধ নাও হয়। কেননা প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে এই যুদ্ধ আপনার পকেট কাটবে, আপনার রান্না ঘরে উঁকি মারবে। প্রথমে দুশিন্তা, তারপরে সন্তানের শুকনো মুখ। তখন খুব বেশি দেরি হয়ে যাবে।
তবে এত কিছুর মধ্যেও রাশিয়া থেকে ইউরোপে গ্যাস যাচ্ছে, যাচ্ছে ইউক্রাইনের পাইপ লাইন দিয়েই। এর অর্থ সব সম্পর্ক এখনও ছিন্ন হয়ে যায়নি। এই ছোটখাটো সম্পর্ক থেকেই একদিন তৈরি হবে নতুন পৃথিবী যেখানে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান হবে মূল মন্ত্র – এই আশা আমরা করতেই পারি।
দুবনা, ০৩ মার্চ ২০২২
গবেষক, জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ
শিক্ষক, গণ মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়, মস্কো


0 Comments