জ্বলদর্চি

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম /পর্ব-৪৮/সন্দীপ কাঞ্জিলাল

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম 
পর্ব-৪৮

সন্দীপ কাঞ্জিলাল

ভারতবর্ষ ও ধর্ম 

মানুষ এক অজ্ঞেয় শক্তির অংশ এবং নিত্য নিয়ন্ত্রিত; সে কোনোভাবেই স্বাধীন নয়। এক অদৃশ্য মহাজীবনের ধারক বিশ্ব-নিয়ন্ত্রক সত্তাকে অবলম্বন করে পাপ-পূণ্যকে গুরুত্ব দিয়ে নিজের ব্যাক্তিজীবনকে নৈতিকতার আধার হিসেবে গণ্য করে এবং পরজন্মে বিশ্বাসী হয়ে নৈতিক অবক্ষয়ের সঙ্গে পূর্বজন্মকৃত পাপের সম্পর্ককে সূচিত করে। তার দৃঢ় বিশ্বাস মানুষের মধ্যেই সেই পরম এক যিনি, তার লীলা চলছে এবং তিনি তাকে পূর্ব নির্ধারিত লক্ষ্যের দিকে পরিচালিত করেছন। ভারতবর্ষে নৈতিকতাকে পুষ্টি দেওয়ার জন্যে যত উপায় উপকরণ ক্রিয়া বর্তমান, মানুষের দৈনন্দিন কার্যকলাপে, আচার-আচরণে ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনে তার যত বিস্তার, পৃথিবীতে অন্য ক্ষেত্রে এমনটি লক্ষ্য করা যায় না। মতাদর্শের বিভিন্নতা থাকলেও শেষ পর্যন্ত মতানৈক্য প্রতিষ্ঠা পায়নি। পাশ্চাত্য জীবনদর্শনে এই নৈতিকতার বিচার ধর্মের সঙ্গে কোনোভাবেই সম্পৃক্ত নয়। মানুষ তার সামাজিকবোধ এবং প্রকৃতিগত গুণে নিজেকে সাধারণ ভাবেই শুভ কর্মের দিকে প্রভাবিত করে। এর সঙ্গে ঐশ্বরিক বিচার কোনোভাবেই যুক্ত হতে পারে না। নৈতিকতার নির্দিষ্ট মানদণ্ডও সব ক্ষেত্রে বিচার্য বিষয় নয়। একদিন যা গ্রীসবাসীদের নৈতিকতার অঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হত, তা সেই সময়ে রোমানদের ক্ষেত্রে স্বীকৃত নৈতিকতার প্রকরণ হিসেবে বিবেচিত হত না। ঈশ্বর ও পরজন্মে বিশ্বাস এবং পূর্বজন্মার্জিত কর্মফলকে আশ্রয় করেই ভারতীয় জীবন ধারা অব্যাহত। 

ভারতীয় নৈতিকতার আধার হল বেদ। এই মহাবিশ্ব এক মহানিয়ামকের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং ঋত ও সত্যই এই মহাবিশ্বের সঞ্চালক। ভারতবর্ষের এই বিশ্বাসের সঙ্গে প্রভূত মিল রয়েছে ইরানের Avestaর যিনি বিশ্বের অভিভাবক সদৃশ দেবদূত; এবং Ahura-Mazda বলেই তিনি বিশ্বজীবনের আলো এবং তার বিশ্বশরীর এই আলো ও সত্য দ্বারা বিধৃত। ভারতীয় ধর্মে যজ্ঞাগ্নিতে আহুতি দানের প্রথায় মানুষের সারাজীবনের তপস্যার পূর্ণতা প্রকাশ পায় এবং সত্য ও ঋতকে ধারণ করার শক্তি বিচার করার সুযোগ আসে। এই অগ্নি শুধু বাহ্যাগ্নি নয়। মানুষের অন্তরাগ্নি, যা তাঁর সমগ্রজীবনকে পরিশুদ্ধ করার প্রেরণা দান করে, ব্যবহারিক জীবনের আচার-আচরণকে সুনিয়ন্ত্রিত করার শক্তি দান করে। মানুষ তখন নিজেকে সত্য ও ঋত-র অংশ মনে করে। নৈতিক জীবনের সোপান ধরে আধ্যাত্মিক জীবনের সর্বোচ্চস্তরে উন্নীত হবার সাধনায় হিন্দু-বৌদ্ধ জৈনধর্মের ভূমিকা ভারতীয় মানুষের আবির্ভাবকে ত্বরান্বিত করেছে শুধু নয়, বিশ্বমহামানবের আবির্ভাব পথটিকেও সুগম করেছে। ভারতীয় ধর্মে যা পাপকাজ বলে চিহ্নিত তার থেকে মুক্ত হওয়ার লক্ষ্যে মানুষ বাসনা ক্রোধ লোলুপতা মোহ অহংকার ঈর্ষা প্রভৃত্তি প্রবৃত্তি থেকে কীভাবে মুক্ত হয়ে আত্মশুদ্ধির পথে নিজেকে পরিচালিত করবে- তার উপায়গুলি বিচার-বিশ্লেষণ করেই গ্রহণ করা হয়েছে। 
সাধারণ মানুষের জীবনে যে চারটি উদ্দেশ্যকে প্রতিফলিত হতে দেখা দেয় তা হল; ধর্ম অর্থ কাম ও মোক্ষ। স্বধর্ম পালনের ক্ষেত্রে বৃত্তিমূলক কর্মের মধ্য দিয়ে অর্থ সঞ্চয় করে সংসার জীবন নির্বাহ, সংসার ধর্ম পালন করে প্রজন্মকে রক্ষা করা এবং পরিশেষে আত্মমুক্তি লাভ। হিন্দুশাস্ত্রে দুটি শব্দের প্রয়োগ মানুষের শরীর ও মনকে সুস্থ রাখার জন্যে অপরিহার্য বলে স্বীকৃত হয়েছে। এই শব্দ দুটি হল তন্ত্র ও মন্ত্র। তন্ত্র তনুকে ত্রাণ করার বা রক্ষা করার প্রণালী। শরীর সুস্থ থাকলেই মানুষ তার ঈপ্সিত লক্ষ্যে উপনীত হতে পারে এবং তার আধ্যাত্বিক জীবন লাভ করা সম্ভব হয়। মন্ত্র মনকে ত্রাণ করে। পূজ্য বা আরাধ্য দেবতার চরণে আত্মনিবেদন করতে মন্ত্রশক্তি মানুষকে উজ্জীবিত করে এবং সে পরমের চরণে প্রার্থনায় নত হয় বা হওয়ার শিক্ষা অর্জন করে। মন্ত্র ও তন্ত্র একে অপরের পরিপূরক। 

'ভারতমানুষ' যুগে যুগে প্রতি জাতি ও ধর্মের নিজস্ব ধর্মীয় ও আচরণিক দিনগুলিতে মান্যতা দিয়ে এসেছে এবং সকল জাতি ধর্মের মানুষকে নিজের করে নিয়েছে। এই একাত্মতা বোধ থেকেই সে পরমার্থিক জীবনলাভের পথকে প্রশস্ত করতে পেরেছে। নৈতিক ও ধর্মীয় সাধনার দ্বারা সে অর্জন করেছে সর্বধর্ম সমন্বয়ের বাণী। বেদের যুগ থেকেই ভারতীয় মানুষের মানসভাবনাগুলি মুকুলিত হয়েছে তার প্রাথমিক ভাবনায়- ঈশ্বর ও প্রকৃতি সমার্থক। এর ফলে বহু ঈশ্বরে বিশ্বাস এবং পরবর্তী স্তরের ভাবনায় একেশ্বর। উপনিষদে ব্রহ্মার ধারণা ও সাধনা তার পরিণতি। 

ভারতীয় দর্শনে দুটি পৃথক ধারা- একটি প্রচলিত মতের বিরুদ্ধাচারী মুক্তমনা ঈশ্বর অবিশ্বাসী (নাস্তিক);অপর ধারা ঈশ্বরবিশ্বাসী আস্তিক। প্রধান নাস্তিক্যবাদীরা হলেন চার্বাক জৈন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীগণ; দ্বিতীয় ধারার প্রধানগণ হলেন সাংখ্য পতঞ্জলি ন্যায় বৈশেষিক পূর্বসীমানা ও উত্তরমীমাংসায় যারা বিশ্বাসী। আদি বৌদ্ধদর্শনে ঈশ্বরতত্ত্ব বিষয়ে কোন বিচারই ছিল না, যা ছিল তা সবই মানব সম্বন্ধীয়। মানুষের দৈনন্দিন জীবনে দুঃখ-দুর্দশা পরিণামে মৃত্যু- এই সবই এই দর্শনের প্রধান বিচার্য বিষয়। দৈনন্দিন জীবনের সমস্যাগুলি থেকে মুক্তি পেতে এই দর্শনে অন্য কোনো ঐশ্বরিক শক্তির স্থান নেই। মানুষ বোধিসত্ত্ব জীবন অর্জন করে এই সব সমস্যাগুলি থেকে পরিত্রাণ পেতে পারে। পরবর্তীকালে মানুষের বিশ্বাসকে প্রাধান্য দিয়ে এই ধর্মে হিন্দু দেবতাগণের অনুপ্রবেশ ঘটে এবং বুদ্ধ স্বয়ং এই দেবতাগণের অধীশ্বর হয়ে ওঠেন। এই ধর্মের দুটি শাখা-  হীনযান ও মহাযান কালান্তরে প্রসিদ্ধি লাভ করে। মহাযান শাখায় বুদ্ধ স্বয়ং চরম ও ও পরম মহাঅস্তিত্ব, ধর্মাক্ষ, যিনি অবতার রূপে প্রজ্ঞা ও করুণার আধার ও বিগ্রহমূর্তি। জৈন ধর্ম নিরীশ্বরবাদী ধর্ম হলেও বহু উপদেবতায় বিশ্বাসী। যাদের সবার ওপরে রয়েছেন জিন, যিনি সদামুক্ত 'পরমদেবতা', তিনি কোনো ভক্তের প্রার্থনায় কান দেন না বা তার কোনো সুকর্ম কুকর্মের জন্যে আশীর্বাদ শাস্তি দেন না। কিন্তু সদাচারী প্রার্থনাকারীর মুক্তি পথের প্রদর্শক হন।(ক্রমশ)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments