জ্বলদর্চি

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা ৭৯

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা  ৭৯


সম্পাদকীয়,
অনেকে বলেন, সম্রাট আকবরই বাংলা সন বা বঙ্গাব্দের সূচনা করেন, যার থেকে এই নববর্ষ বা পয়লা বৈশাখ শুরু হয়েছে। এই পয়লা বৈশাখের দিন সকালে পুজো দিয়ে বাঙালিরা দিন শুরু করে। গোগোলরাও তাই করে, সেটা আমরা অনামিকা আন্টির গল্পে পড়ে নেব। ওদিকে তৃষ্ণা আন্টির জয়াবতীর গল্পেও পুজো হচ্ছে। কী পুজো? রাধামাধবের পুজো। পুজো, নববর্ষ মানেই শাড়ি। তাঁতের, ঢাকাই বা ট্যাঙ্গাইল শাড়ি। টাঙ্গাইল শাড়ির নাম মনে এল সুদীপ্তা দিদির ছড়া পড়ে। আমরা ছোটোবেলায় মায়ের তাঁতের শাড়ি পড়ে পয়লা বৈশাখের দিন নাচ করতাম। ছোটোবেলার কথায় মনে পড়ে গেল সন্দীপ কাকু তার নিজের ছোটোবেলার গ্রামের গল্প বলেছেন। আর তোমাদের বন্ধু প্রবাহনীল বলেছে বড়োবাবুর গল্প। কে এই বড়োবাবু জানতে গল্পটার শেষ অবধি পড়তে হবে। প্রতিবারের মতো চলো বাসবদত্তা আন্টির সঙ্গে পাখিদের রাজত্বে ঘুরে আসি। তবে যতই ঘুরি না কেন, গড়ের মাঠে ঘোরার মজাই আলাদা। দেখনা ছোট্ট ইভান কেমন গড়ের মাঠে বেলুন নিয়ে খেলছে। শুরু করেছিলাম, আকবরের কথা দিয়ে, শেষ করব হরপ্পা মহেঞ্জোদাড়োর কথা দিয়ে। আরে আমি না, হরপ্পা মহেঞ্জোদাড়োর কথা জানতে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো ঐতিহাসিকের জীবনী আগে জানতে হবে। এনার কথা শুনে নেব পীযূষ আঙ্কেলের কাছ থেকে। আজ এই পর্যন্তই, ইতিহাসের গল্প শুরু করলে থামতে পারবে না। শুভ নববর্ষ।  -- মৌসুমী ঘোষ।

ধারাবাহিক উপন্যাস
জয়াবতীর জয়যাত্রা
একাদশ পর্ব
তৃষ্ণা বসাক
 
১৫
 
ফিরেই অবশ্য সেসব হয়নি, কারণ সন্ধ্যারতির সময় হয়ে গেছিল। ঠাকমা, খুড়িমা, জগোপিসি সবাই ব্যস্ত ছিল মন্দিরে, তাই পানু নালিশ করবার সুযোগ পায়নি। সেদিন পুরুতমশাই তাঁর ভাগ্নেকে নিয়ে পুজো করতে এসেছিলেন, সে বাসি ফুলের মধ্যে অষ্টধাতুর গোপাল চুরি করে নিয়ে যাচ্ছিল- এ কথা  বেশি লোকের কাছে ছড়াতে দেওয়া হয়নি, কারণ ঠাকুরমশাই এ বাড়ির অনেক পুরনো দিনের লোক, সেনমশাইয়ের বাবার আমল থেকে তিনি রাধামাধবের পুজো করে আসছেন। গোপাল চুরির বুদ্ধি তাঁর ভাগ্নের, তবে তিনি কেন জেনেশুনেও তাকে প্রশ্রয় দিলেন, এ বড় বিস্ময়ের কথা বটে। ঠাকমা এই নিয়ে দিনের মধ্যে কতবার যে আক্ষেপ করেন তার ঠিক নেই। এত মানী মানুষ নিজের গায়ে কালির ছিটে লাগালেন কিনা ঐ অকালকুষ্মাণ্ড ভাগ্নের জন্যে! এ নিয়ে তাঁর বিস্ময় কাটে না।
আজো মন্দিরে এসে জয়াবতী শুনতে পেল ঠাকমা কাকে যেন বলছেন ‘মুনি ভরত নাকি একটা হরিণের জন্যে তাঁর সব পুণ্য খুইয়েছিলেন বউমা, আর আমাদের ঠাকুরমশাই’ অমনি পানু তাঁর কোল ঘেঁষে বসে বলল ‘ আর পিতাঠাকুর যে একটা ঘোড়ার জন্যে সবার সামনে আমার কান মুলে দিলেন, তার বেলা?’
 
মাঠ থেকে কেউই সোজা মন্দিরে আসতে পারেনি, গিয়ে হাত পা ধুয়ে শাড়ি ধুতি পরে তবে এসেছে ওরা। কিন্তু তিনজনেরই চোখ মুখ লাল এখনো। মাঠে কম দৌড়টা দৌড়েছে ওরা? ঠাকমা বলল ‘ কী হয়েছে মানিক আমার? দীনু কান মুলে দিয়েছে, কেন?’
জয়াবতী ঠাকমার ডানপাশটা দখল করে ফিসফিস করে বলল ‘পরে বলব ঠাকমা। সে অনেক কতা। কিন্তু পানু, তুই যে বড় লাগানিভাঙ্গানি হয়েছিস দেকচি। কোন আক্কেলে তুই মন্দিরে বসে এসব ঠাকমার কানে তুলচিস? ঠাকুরের সামনে তুচ্ছু কতা বলতে হয় বুজি?’
পানু অমনি ফোঁস করে বলে ‘তুমি ঠাকুরের সামনে বেন্দার পুঁটলি খুলে হাঁচা করতে পারো, তার বেলা দোষ হয় না ? ও ঠাম্মা, এই মেয়েদুটো আর কতদিন আমাদের বাড়ি থাকবে বলো না? এদের বে থা হবে না?’
জগোপিসি এতক্ষণে একটা মনের মতো কথা পায়। সে বলে ওঠে ‘সে আর বলিসস নি পানু, এরা  হচ্ছেন মেয়ে কোবরেজ, হাতা খুন্তি ধরবেন না এঁরা, লোকের নাড়ী টিপে বেড়াবেন।
বলি কত সাধ যায় রে চিতে
মলের আগায় ঘুন্টি দিতে’
 

বলেই কেমন একটা চিৎকার করে দুম করে মাথা ঘুরে পড়ে গেল জগোপিসি। ঠাকমা হাঁউমাউ করে কেঁদে উঠে বললেন ‘ওমা, জগো যে ভির্মি খেল, ও দীনু’
জয়াবতী ঝাঁপিয়ে পড়ে বলল ‘আহা সরো সরো, বাতাস আসতে দাও, পুণ্যি একটু জল ছড়া দে তো মুখে আর পানু পায়ের তলাটা মালিশ কর। বুঝলি পুণ্যি, দুদিন বাদে তোর এই দশা হবে। শরীর পাত করে রোজ নির্জলা উপোস তিরেস, তার সঙ্গে দিনরাত চিলচিৎকার, ঝগড়া, পারবে কেন? যা তো পানু, সেনমশাইয়ের কাচ থেকে একটু জ্ঞানধ্বজ নিয়ে আয় ছুটে।’
বাকিরা চেঁচাবে কি আর কাঁদবে কি, সবাই অবাক হয়ে দেখছিল জয়াবতীকে। সে যেন দশ হাতের দুর্গা। নিজে কাজ করছে দশ হাতে আর লোককে দিয়ে করিয়েও নিচ্ছে কাজ। দীননাথ সেন আসার আগেই জগোপিসি উঠে বসল, আর উঠতেই ঠাকমা একগাল হেসে বলল ‘ও জগো, মেয়ে কবরেজের হাতেই প্রাণ ফিরে পেলি যে, ফের বাজে কতা বলিস নি যেন, রাধামাধব সাক্ষী রইলেন কিন্তু।’
সেনমশাই পেছন থেকে বললেন ‘আর পানুও নিশ্চয় আর বলবে না মেয়েদুটো কবে বিদায় হবে? সে তো বারোমাসই ভোগে। কবরেজের দরকার তারই সবচে বেশি’ পানু বেচারি আর পালাবার পথ পায় না। ( ক্রমশ)

ছুঁয়ে আসা স্মৃতি
সন্দীপ রায়

সব বড় মানুষদেরই একটা ছোটবেলা থাকে, এবং সেই ছোটবেলার একটা গল্প থাকে। সেইসব নমস্য মানুষেরা যখন সেই ছোটবেলার গল্প শোনান, আমরা তা গোগ্রাসে গিলি!

কিন্তু ছোটবেলা তো শুধু বড় মানুষদের থাকে না, তা আমাদের মতো তুচ্ছাতিতুচ্ছ লোকেদেরও থাকে! তবে সে সব গল্প হারিয়ে যায় বড় বেলার নানা অকাজের ভিড়ে, কেজো হিসেবের খাতার তলায়। ছোটবেলার দরজায় গিয়ে দাঁড়ালে আবার সে সব দিনে উঁকি মারা যায়!

যেমন এবার। একটা বিয়েবাড়ির ছুতোয় হাজির হয়েছিলাম পুরুলিয়ায়, যেখানে আমার ছোটবেলাটা কেটেছে। আমি অবশ্য হয় কথায় নয় কথায় প্রায়ই পুরুলিয়ায় যাই, একটা কারণ খাড়া করতে পারলেই হল!

তো সেই বিয়েবাড়ি  এক্কেবারে আমার পুরোনো পাড়াতেই! তা হলে আমায় আর পায় কে! রইল ঝোলা, চলল ভোলা! 
পুরোনো বন্ধুদের প্রায় সকলেই নানা কাজের তালে এদিক ওদিক ছিটকে গেছে! সব্বাই বড় হয়ে গেছে যে! কিন্তু আমার ছোটবেলা তার সম্ভার নিয়ে বসে আছে আমার অপেক্ষায়!

ওই তো রাজাবাঁধ। আমার অস্থায়ী আস্তানা থেকে গুনে গুনে পঞ্চাশ পা! প্রথমবার একে দেখে গিয়েই মা'কে জানিয়েছিলাম, সমুদ্র দেখে এলাম! পুরুলিয়ায় যে কোনো বড় পুকুরগুলোকেই বাঁধ বলে। আমাদের পাড়ারটার নাম রাজা বাঁধ! সব বাঁধের সেরা! এমনকি যে সাহেব বাঁধ নিয়ে পুরো পুরুলিয়াবাসী জাঁক করে, আমার কাছে সেও দুইয়ে! রাজা একটাই!
যে কোনো বয়স্কদের মতোই রাজাবাঁধেরও চারপাশে ময়লা জড়ো হয়েছে কত্তো, তবু তার রাজমহিমা ক্ষুন্ন হয়নি এতটুকু! আমাকে সে চিনতেও পেরেছে, বুঝলাম ওর টলটলে জল দেখে! গান জানলে আমি ওকে শুনিয়ে দিতাম এককলি রবি ঠাকুর, "মনে হল যেন পেরিয়ে এলেম, অন্তবিহীন পথ, আসিতে তোমার দ্বারে!"

একটু বেলার দিকে বিয়েবাড়িতে হাজিরা দিতে ফিরলাম। তারপর গেলাম আমার প্রাইমারি স্কুল শিশু শিক্ষা নিকেতনে। আটাত্তর সালের পর দু'হাজার বাইশ! আড়ে বহরে বেড়েছে অনেকটাই।
 স্কুলে ঢোকার মুখেই ছিল একটা বড়সড় লোহার নির্মাণ। যার একপাশের সিঁড়ি দিয়ে উঠে অন‍্যপাশে স্লিপ কেটে নেমে যাওয়া যায়। আবার লোহার ধাপ ধরে ধরে ওঠাও যায় অনেকটা। তারপর একটি লোহার রড ধরে ঝুলতে থাকা (লম্বা হবার জন্য)! জন্মভীতু আমি এইসব দুঃসাহসিক কাজে কখনও সখনও নাম লিখিয়ে ফেলতাম! এবার দেখলাম সেই লৌহ নির্মাণ টাই নেই! যেমন নেই সেদিনের মাস্টারমশাই, দিদিমণিরা! খোঁজ করে জানলাম, এঁদের অনেকেই নেই মানে নেই! একেবারেই নেই! পঁচাত্তর থেকে আটাত্তর, এই স্কুলে এই মানুষদের শাসনে-সোহাগে কেটেছে আমাদের! এখন তাঁরা প্রায় সকলেই (সবার খোঁজ পাইনি) 'নেই' হয়ে গেছেন! উঁহু, আছেন তো বটেই! কতদিকে ছড়িয়ে পড়া ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে আছেন তাঁরা!
গিয়েছিলাম কিশোর বেলার স্কুলে। যেখানে কেটেছে ৭৯ থেকে ৮৫ পর্যন্ত। মানভূম ভিক্টোরিয়া ইন্সটিটিউশন। ছোট করে ভিক্টোরিয়া স্কুল। ইয়াব্বড় দালান, স্টেডিয়ামওয়ালা খেলার মাঠ, বিজ্ঞান পরীক্ষাগার, ছাত্রদের হোস্টেল---সব মিলিয়ে একেবারে বুক বাজিয়ে বলার মতো এলাহি ব‍্যাপারস‍্যাপার! আমি অবশ্য খুঁজছিলাম গ‍্যালারির কোন কোণে বসে টিফিন খেতাম স্কুলের জন্মদিনে (রোজ টিফিন নিয়ে যাবার চল ছিল না আমাদের) বা টানা বারান্দার কোন খানে সবচেয়ে বেশিবার নিলডাউন হয়েছি! এই স্কুলের মাস্টারমশাইদের মধ্যে দু'একজনকে প্রণাম করার সুযোগ পেয়েছি!

পরিচয় দেবার পর যখন সেদিনের একজনের মুখে শুনলাম, ওমা! তুই ই সেই! কত ছোট দেখেছি! কত বড় হয়ে গেছিস! বুঝলাম, ছেড়ে আসা সহজ, ছাড়িয়ে আসা নয়!

শনিবার বড়োবেলায় ফেরার গাড়িতে উঠলাম, সোমবার কেজোবৃত্তে সেঁধিয়ে যেতে হবে। আর রবিবার? এই ছুঁয়ে আসার অভিজ্ঞতাটুকু স্মৃতিকোঠা থেকে কলমের ডগায় নামিয়ে আনার দিন!

শিরিনবাড়ি

সুদীপ্তা আদিত‍্য

মেঘমুলুকের ধন‍্যি শিরিনবাড়ি
পটে নিটোল টাঙ্গাইলের শাড়ি
নীলচে এমন।যাচ্ছিল সে নুয়ে
 ফিরতি মেঘে দুর্গমে একফুয়ে।
ভাঙ্গল বাড়ি উড়ুক্কুদের ভয়ে।
তোর্সা হানে চলতি দ্রুতলয়ে।
গর্জে সরোজ আর ফোটে না তবে
না ফুটলে আর,তখন কি তার হবে?
খেলবে তুমি টোপাপানার ভীড়ে?
পা ডোবাবে তোর্সানদীর তীরে?
আকাশকুসুম ভাবতে বসে বসে?
তোর্সা না কি মেঘমুলুকের দোষে!
বিদঘুটে সে বিচ্ছিরি এক মাঝি
নিয়ে যাবে মেঘের বাড়ি।রাজি?
এদিক ওদিক বনবনিয়ে ঘুরে
নামতে হল শিরিনবাড়ি ফুঁড়ে।


"জল ভরা সন্দেশ" (অণুগল্প) 
অনামিকা তেওয়ারী 

সকাল সকাল পূজোর আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন গোগলের মা, কাকিমা।  আজ পয়লা বৈশাখ, দেবতার পায়ে অঞ্জলি দিয়ে বিশেষ পূজোর মধ্যে দিয়ে শুরু হয় গোগলদের নতুন বছর। পরিবারের সবাই আজ নতুন পোশাক পরবে এই রীতিটাই চলে আসছে বংশানুক্রমে।  গোগলদের সব ভাই বোনেরা আজ এক সারিতে খেতে বসেছে। লুচি, আলুর দম আর জল ভরা সন্দেশ এই দিয়েই শুরু হবে ওদের পয়লা বৈশাখের ভূরিভোজ। হঠাৎ গোগলের সাথে ওর দাদা গাগিনের ঝগড়া গেল বেঁধে। গোগলের মনে হয়েছে দাদার পাতে জল ভরা সন্দেশটাই সবচেয়ে বড়,ওর ওটাই চাই। গাগিন'ও জেদ ধরেছে কিছুতেই ভাইকে নিজের ভাগের সন্দেশ দেবে না। শেষে ঠাকুর ঘর থেকে মা'কেই উঠে আসতে হল, ঝগড়া থামাতে। মায়ের কাছে সব সমস্যার সমাধান থাকে যে। মা বললেন, "গাগিনের পাতে যে সন্দেশটা পড়েছে সেটা দুই ভাগ করে দুজনের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হোক, তার সাথে আরও একটা করে সন্দেশ ওদের দেওয়া হোক। "

গাগিন তো কিছুতেই রাজি হতে চায় না! মা ওকে বোঝালেন, " আনন্দ ভাগ করলে বাড়ে। সন্দেশ টা যদি তোমরা দুজনে ভাগ করা খাও, তাহলে ওটার স্বাদ আরও বেড়ে যাবে। " শেষে সন্দেশ ভাগ করেই খেল দুই ভাইয়ে। তখনকার মতো আবার ভাব হয়ে গেল ওদের। সন্ধ্যেবেলা ঠাকুর মশাই এসেছেন সন্ধ্যা আরতি করতে। বাবা সবার জন্য নতুন জামা কিনে এনেছেন। গোগলের ভাগে পড়েছে নীল রঙের পাঞ্জাবি আর সাদা পায়জামা। নতুন পোশাক পরেই আরতি দেখবে সবাই। ঠাকুর মশাইয়ের নির্দেশ মতো এটা, সেটা এনে হাতের কাছে দিচ্ছে টুকাই। গোগলদের বাড়িতে রান্না করেন মিনতি মাসি, টুকাই তাঁরই ছেলে। গোগলদের সমবয়সীই হবে। মা বলে দিয়েছিলেন, " সন্ধ্যেবেলা ছেলেকে নিয়ে এসো মিনতি, পূজো দেখে রাতে খেয়ে যাবে। "  চামর দুলিয়ে, শঙ্খ ধ্বনি, ঘন্টা ধ্বনির মধ্যে দিয়ে খানিক বাদেই শুরু হলো সন্ধ্যা আরতি। পঞ্চ প্রদীপের শিখায় ঝলমল করে ওঠে রাধা মাধবের বিগ্রহ।  গোগলকে কোথাও দেখতে না পেয়ে মা গাগিনকে জিজ্ঞেস করেন, " ভাই কোথায় ? যাও ডেকে নিয়ে এসো এখানে। "
সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় ছুটে যায় গাগিন। একটু পরেই গাগিনের হাত ধরে নেমে আসে গোগল। তবে পরনের নীল পাঞ্জাবিটা নেই তো! দেখে অবাক হলেন মা। ইশারায় কাছে ডাকেন গোগলকে। মুখ নামিয়ে মায়ের কাছে আসে গোগল। মা জিজ্ঞেস করেন, " কি রে, আবার দুষ্টুমি করে পাঞ্জাবিটা ভিজিয়ে ফেলেছিস না কি? "
গোগল টুকাইয়ের দিকে দেখায়। ঘাড় ঘুরিয়ে মা দেখেন সলজ্জ ভাবে একটু দূরেই দাঁড়িয়ে রয়েছে মিনতি, আর মায়ের আঁচলের তলায় মুখ লুকিয়ে দাঁড়িয়ে টুকাই।  পরনে গোগলের নীল, সাদা পায়জামা- পাঞ্জাবিটা! আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে থাকেন মা! গোগলের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই গোগল বলে ওঠে, " টুকাই বললো ওর নতুন জামা হয়নি। তুমি তো সকালে বলেছিলে আনন্দ ভাগ করলে বাড়ে। তাই একবার পরেই আমি পাঞ্জাবিটা ওকে পরতে দিয়ে দিলাম। আমার খুব আনন্দ হচ্ছে মা। " মায়ের চোখের তারায় ভেসে ওঠে গোগলের নিষ্পাপ মুখখানি। ধূপকাঠির সুবাস ছড়িয়ে পড়ে সারা ঘরে। (সমাপ্ত)


বড়োবাবুর মনের কথা
প্রবাহনীল দাস
সপ্তম শ্রেণী, বিদ্যাসাগর শিশু নিকেতন, পশ্চিম মেদিনীপুর

শরীরটা যেন বেশিই ম্যাজম্যাজ করছিল। বারান্দার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, দুষ্টু দোয়েল পাখি দুটো এখনও আসেনি। তার মানে এখনও ভোর হয়নি। সারাদিন শুয়ে থেকে আর ঘুমিয়ে ক্লান্ত লাগছিল, তাই আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে যখন ঘুম ভাঙল, তখন পেটে খুব যন্ত্রণা শুরু হল। দোতলার ঘর থেকে ছাদটা নীচে, একটা ছোট্ট তিন ধাপ সিঁড়ি পেড়িয়ে নামতে হয়। সিঁড়ির নীচে ঢুকে পড়লাম, যাতে কেউ বুঝতে না পারে আমি অসুস্থ। আসলে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ল দাদা আর দিদান খুব ব্যস্ত হয়ে যায়।

এই তো সেদিন, মুখে একটা মাছের কাঁটা ঢুকে গেলো। আসলে বাটা মাছ খেয়ে এমন অভ্যাস করে ফেলেছি, কিছুতেই রুই মাছের বড়ো কাঁটা চিবোতে পারি না। মা তো সারাদিন থাকে না, তাই মা দিদান বাড়ি এলে আমি মায়ের পায়ে পায়ে ঘুরি। মা আমার অবস্থা দেখে বকাঝকা করলেও, পরে আদর করে দিল। দাদু ব্যাপারটা আন্দাজ করেছিল, দাদা বাড়ি আসতেই দাদাকে বলল, “দেখ, তোর বোন আবার মুখে কাঁটা ঢুকিয়েছে।” দাদা যত্ন করে আমার মুখে ওষুধ লাগিয়ে দিল। দিদা গরম দুধ বাটিতে ঢেলে দিল, দাদা আমাকে খাইয়ে দিল।

ভালই দিন কাটছিল, কিন্তু পেটে ব্যাথাটা বাড়তে আমাকে সিঁড়ির নীচে আশ্রয় নিতে হল। কিছুক্ষণ পরে অসম্ভব যন্ত্রণা শুরু হল, আমি অজ্ঞান হয়ে গেলাম। জ্ঞান ফিরতে দেখলাম, আমার কোলে শুয়ে আছে দুটো বাচ্ছা, আমার ফুটফুটে ছানারা। আমি বেশ ভালো আছি এরকম ভান করে বেরিয়ে এলাম সিঁড়ির তলা থেকে। সারাদিন কেটে গেলো। সেদিন দাদু অসুস্থ ছিল, তাই আমাকে কেউই অতটা খেয়াল করেনি।
পরের দিন দাদু সকালবেলা ছাদে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিল। এদিক ওদিক তাকাতে গিয়ে দাদুর চোখ পড়ল আমার ছানাদের উপর। সঙ্গে সঙ্গে দাদাকে ফোন। দাদা তো আনন্দে আত্মহারা। বেলায় পরীক্ষা ছিল, পরীক্ষা দিয়েই চলে এলো আমার ছানা দেখতে। কী খুশি দাদার! বিকেলে বৃষ্টি শুরু হল, দিদান ছাদের সিঁড়ির উপরের একটা ফুটো বন্ধ করতে এলো। কিন্তু তাঁর আগেই আমি ছানাদের মুখে নিয়ে একটা ঘরের ফাঁকা কুলুঙ্গিতে রেখে দিয়েছি। সবাই নিশ্চিন্ত হল।
কয়েকদিন পর ছানাদের চোখ ফুটল। মাঝখানে আমার শরীর ভালো লাগছিল না, তাই কয়েকদিন আমি ছানাদের খাওয়াতে পারিনি। দিদান খুব রাগ করলেও, আমি দিদানকে আমার অসুস্থতার কথা বোঝাতে পারিনি। তবে দাদা যত্ন নিয়ে আমার ছানাদের দিয়ে সিরিঞ্জে করে গরম দুধ খায়িয়ে দিয়েছিল। ভালই সময় কাটছিল, আমার ছানারাও দাদার ছায়ায় বেড়ে উঠছিল।

হঠাৎ এক বিকেলে দেখলাম, দাদা আমার ছানাদের নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল। আমি পিছু নিলাম। দেখলাম দাদা কাজলপিসির বাড়িতে দিয়ে এলো ছানা দুটো। আমি এমনিতেও ওদের বাড়িতে রোজই যাই, কিন্তু দাদা, যে কিনা আমার ছানাদের এত ভালবাসে, সে তো আমার ছানাদের অন্য বাড়িতে রাখতে যাবে না। দেখলাম, দাদা ফেরার পথে হাত দিয়ে চোখ মুছল। কিছু বুঝতে পারলাম না।
ঘরে এসে তার পর শুনলাম, দাদারা নাকি অন্য কোথাও চলে যাবে। সঙ্গে দাদু-দিদানকেও নিয়ে যাবে। আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলাম না। কিন্তু সত্যি দাদা চলে গেলো! আজ দুদিন হয়ে গেলো, দাদা আসেনি। ছুটে এসে কোনদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে আমাকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করেনি। মা বাবা ও আসেনি। দাদু-দিদানকেও হয়ত ওরা কিছুদিন পরে নিয়ে চলে যাবে। আমার খুব কষ্ট হল। আমার একবার অসুখ করেছিল, দাদু আমাকে দুদিন ঘরে ঢুকতে দেয়নি। আমি ছাদের পাঁচিলে বসে দেখেছি, দাদা একা একা কাঁদছিল। হয়ত দাদা এখনও কাঁদছে। আমি তো কাঁদতে পারি না। আমি তো একটা মেনি বেড়াল। আমার নাকের তলার কালো ছোপটার জন্য দাদা আমার নাম রেখেছিল ‘বড়োবাবু’।

স্মরণীয়
(রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়)
কলমে - পীযূষ প্রতিহার

১৮৮৫ সালের ১২ই এপ্রিল রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন মতিলাল বন্দ্যোপাধ্যায় ও মাতা কালীমতি দেবী। বহরমপুরে রাখালদাসের জন্ম হলেও বনগাঁর ছয়ঘরিয়া গ্রামের সঙ্গে তাঁর শৈশবের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে। বহরমপুরের কৃষ্ণনাথ কলেজ ও স্কুল থেকে ১৯০০সালে এন্ট্রান্স পাস করেন তিনি। ১৯০৩ সালে এফ. এ. পাশ করেন। এরপর ভর্তি হন প্রেসিডেন্সী কলেজে ইতিহাসে অনার্স নিয়ে। সেখান থেকে ১৯০৭ সালে অনার্স ডিগ্রি সম্পূর্ণ করেন।  কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯১০ সালে ইতিহাসে এম. এ. পাশ করেন তিনি।
     ইতিহাসের প্রতি গভীর অনুরাগের কারণে পরবর্তী সময়ে হয়ে ওঠেন ঐতিহাসিক ও প্রত্নতত্ত্ববিদ। স্নাতকোত্তর শেষ করেই কলকাতার ভারতীয় জাদুঘরের প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের সহকারী কর্মকর্তা হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি। ১৯১১ সালে তিনি যোগ দেন ভারতীয় পুরাতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণে। এখানে চাকুরী করতে করতেই ১৯১৭ সালে পদোন্নতির মাধ্যমে প্রত্নতাত্ত্বিক তত্ত্বাবধায়ক পদে উন্নীত হন। ১৯২৬ সালে স্বেচ্ছায় চাকুরী থেকে অবসর নেন। ১৯২৮ সালে তিনি বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতির মনীন্দ্রচন্দ্র নন্দী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন এবং আমৃত্যু ঐ পদে ছিলেন। 

       হরপ্পা সভ্যতার প্রধান কেন্দ্র মহেঞ্জোদারো আবিষ্কার(১৯২২) তাঁর অন্যতম প্রধান কীর্তি। কুষাণ সম্রাট কনিষ্ক সম্বন্ধে তিনি যে সমস্ত তথ্যসমূহ আবিষ্কার করেন তা প্রামাণ্য বলে বিবেচিত হয়েছে। বাংলার পাল রাজবংশ সম্পর্কিত বহু তথ্য তিনি আবিষ্কার করেন। প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগে চাকরির শেষ দুবছরে বাংলা ও আসামের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক ভ্রমণ করেন এবং মহাস্থানগড় ও ঘোড়াঘাট অঞ্চলে অনুসন্ধান চালান। ১৯২৪-২৫ সালে পাহাড়পুরের খননকার্যের মূল পরিচালক ছিলেন তিনি। মুর্শিদাবাদ ও ঢাকার ঐতিহাসিক নিদর্শনসমূহ পরীক্ষা করেন। তিনিই প্রথমবারের মতো আসামের প্রাচীন ও মধ্যযুগের প্রাথমিক পর্যায়ের ভাস্কর্য ও কাঠামোগত ধ্বংসাবশেষ সমূহের প্রতি পন্ডিতদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তেজপুরের নিকটস্থ দহপর্বতিয়ার একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দিরের দরজাবাজুর ভাস্কর্য আবিষ্কার করেন তিনি। মুদ্রা ও শিলালিপি সম্বন্ধে বাংলায় প্রথম প্রামাণ্য ঐতিহাসিক গ্রন্থ রচনা করেন তিনি। তাঁর উল্লেখযোগ্য লেখা সমূহ হল - The Origin of the Bengali Scripts, বাঙ্গালার ইতিহাস (২ খণ্ড), পাষাণের কথা, প্রাচীন মুদ্রা, শশাঙ্ক, ধর্মপাল, লুফৎ উল্লা, ময়ূখ, করুনা ইত্যাদি। এরমধ্যে কয়েকটি বাংলা উপন্যাস অন্যান্য ভাষায় অনূদিতও হয়েছে। এছাড়াও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাট্রিক পরীক্ষার পাঠ্যক্রম অনুযায়ী দুটি পুস্তক রচনা করেছিলেন তিনি। সেগুলো হল- History of India (1924) এবং A Junior History of India (1928)। 
     প্রাচীন হস্তলিপি বিদ্যা ও লিপি উৎকীর্ণ বিদ্যায় তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান The Origin of Bengali Scripts(1933) বইটির জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদাপূর্ণ 'জুবিলী গবেষণা পুরস্কার' লাভ করেন। খরোষ্ঠী লিপির প্রতিও তাঁর অসাধারণ অনুরাগ ছিল। ১৯২০ সালে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে তিনি খরোষ্ঠী লিপির বিবরণ তুলে ধরেছেন। ভারতীয় মুদ্রা গবেষণার ক্ষেত্রে প্রাচীন ও প্রাক মধ্যযুগীয় ভারতের মুদ্রাসমূহের বিজ্ঞানসম্মত বর্ণনা ও সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ লিপিবদ্ধ করা তাঁর বড় অবদান। মুদ্রার ওপর বহু প্রবন্ধ তিনি রচনা করেছেন। স্থাপত্য ও মূর্তিতত্ত্বের গবেষণার ওপর তাঁর রচিত গ্রন্থগুলি আজও আকর গ্রন্থ হিসেবে পরিচিত। ভারতীয় শিল্পকলার চর্চায় তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত গ্রন্থ Eastern Indian Mediaeval School of Sculpture (1933) একটি অত্যন্ত জরুরি ও মূল্যবান সম্পদ বলে বিবেচিত হয়। তাঁরই রচিত 'গৌড়ীয় শিল্প' বিষয়ে ছয়টি মূল্যবান প্রবন্ধ ১৯৩০ সালে 'প্রবাসী' পত্রিকায় প্রকাশিত হয় যাতে গৌড়ীয় রীতির শিল্পের ক্রমবিকাশ বর্ণিত হয়েছে। এছাড়াও মূর্তিতত্ত্বের ওপর লিখিত প্রবন্ধে এই বিষয়ে তাঁর গভীর অনুরাগ লক্ষ্য করা যায়। 

     ১৯৩০ সালের ৩০ মে এই ভারতীয় ঐতিহাসিক, প্রত্নতত্ত্ববিদ ও সাহিত্যিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়(আর ডি ব্যানার্জী নামেই বেশি পরিচিত) কলকাতায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

ধারাবাহিক ভ্রমণ
চলো যাই (পাখিদের কাছে) 
পর্ব ৮
কলমে - বাসবদত্তা কদম

সেই যে রাঙা মানিকজোড়ের কথা হচ্ছিল আগের পর্বে, এ পাখিদের সবাই যে গাছের উপরেই বাসা বানায় তা নয়, জলাভূমির আশেপাশে পাড়েও বাসা বানায়। বাসা সব সময়ই শুকনো গাছের ডাল, শুকিয়ে যাওয়া কচুরিপানা, জলজ ঘাস এই সমস্ত কিছু দিয়েই বানায় এরা। বাসাগুলো বেশ বড় বড় হয়।
কিন্তু এই সুন্দর মানিকজোড় পাখি মারা পড়ে প্রচুর এদের সুন্দর পালকের জন্য।
খারাপ লাগছে তো! লাগবারই কথা। কিন্তু যারা ওদের মারে তাদের নিশ্চয়ই খারাপ লাগে না। ওরা মরে গেলে তবেই তো ওদের গায়ের সুন্দর পালকগুলো পাওয়া যাবে। আর তৈরী করা হবে পাখির পালকের সুন্দর সুন্দর টুপি, আরো আরো কত কি! এই ভাবেই পাখি বা অন্যান্য প্রানীরা মরে যায় আমাদের, মানুষদের লোভের জন্য। 

একসময় আমাদের বাঙলায়ও এই পাখি আসতো প্রচুর। ওদের বন্ধুদের মেরে ফেললে ওরাও যে সেখানে নিরাপদ নয়, তা ওরা বুঝতে পেরেছে, তাই শুধু বাঙলা নয় আমাদের দেশের অনেক নদী, খাল, সামদ্রিক খাঁড়ি ওরা পরিত্যাগ করেছে। শুধু খাদ্যই তো নয়; নিরাপদ বাসভূমি না হোলে, ওদের বাচ্চা পাখিরা বড় হতেই পারবে না যে! 
যে অঞ্চলে আমরা প্রচুর রাঙা মানিকজোড় এবং অন্য অনেক পাখি দেখলাম, সেখানে এরা নিরাপদ বোধ করে তাই বছরের পর বছর ঘুরে ঘুরে এখানে আসে নিজেদের পরিবার পরিজন সহ।
তবে শুধু মেরে ফেলাই নয়, বিভিন্ন সময় মাছ ধরার জালের নাইলনের টুকরো, প্লাস্টিকের থলি, বিভিন্ন টিনের ক্যানের ধারালো মুখ এ সমস্তই এই সব পাখিদের মৃত্যুর কারণ হয়; মাছ বা জলের পোকা ধরার সময়। এছাড়া প্রতিবছরই বেশ কিছু পাখি মারা যায় বিভিন্ন জানা বা অজানা রোগে।
এরা খুব দ্রুত হারে কমে যাচ্ছে বলে, পৃথিবীর কিছু দেশে একটি নিরাপদ অঞ্চল তৈরী করে এই মানিকজোড় পাখিদের রাখা হয়েছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশে এ পাখির সংখ্যা এতটাই কমে গেছে যে এখন সেখানে এটি সংরক্ষিত প্রানীর আওতায় পড়ে। তবে এখন এ পাখিটি প্রায় বিপদগ্রস্ত সব দেশেই।      

এই পাখিগুলো যখন ওড়ে, গোল হয়ে ধীর লয়ে উড়তে, উড়তে তারপর অনেক উঁচুতে উঠে যায়। ঠিক যেন উড়ো জাহাজ। এ পাখি ওড়ার সময়, বকেদের মত গলা গুঁজে বা সারসের মত গলা লম্বা করে, না এর কোনটাই করে না। এরা আবার এদের লম্বা গলাগুলো একটু ঝুঁকিয়ে নেয় ওড়বার সময়।
আগেই বলেছি এরা ডিম পাড়ে ১০-১২ বা ১৫ দিনের বিরতিতে। তাই যখন কোনো ছানা মা বাবার আনা অর্ধেক হজম করা খাবার খাচ্ছে অন্য ছানা তখনো হয়তো ডিমের ভেতর অপেক্ষা করছে বাইরে বেরনোর জন্য। 
ছানাদের ডিম ফুটে বাইরে আসতে সময় লাগে কম বেশি প্রায় এক মাস। আর ডিম ফুটে বেরিয়ে বাবা মায়ের এনে দেওয়া খাবার খেয়ে উড়তে সময় লাগে প্রায় দুমাস। ছানারা ঠিকমত উড়তে না পারলে বাবা মা তো ফিরে যেতে পারবে না সেই যেখান থেকে ওরা এসেছিল, শীতের আর ঠান্ডার ভয়ে। ততদিনে সেখানে ঠান্ডা কমে বসন্ত এসে গেছে। নদীতে বরফ গলে জল। গাছে গাছে পাতা, ফুল। জলে আর গাছে কত মাছ আর পোকা।
এ গাছে যদি বকেদের বাসা; ওপাশের গাছটায় সারস; এদিকের টায় এই যে সব রঙ্গিলা বক বা মানিক জোড়েরা। একটার পর একটা কলোনি। এর মাঝে মধ্যে দু একটা অন্য পাখিও আছে, সেগুলোকে দেখার চেষ্টা করছি এক গাছ থেকে আরেক গাছে। আমার মনে হচ্ছে পাখিদের বাড়ির মাঝখানের রাস্তা দিয়ে চুপিচুপি আমি হেঁটে যাচ্ছি। কখনো ওরা টের পেয়ে ঘাড় ঘোরাচ্ছে, কখনো একমনে ডিমে তা দিচ্ছে বা নিজেদের গা পরিষ্কার করছে। 

হটাৎ শব্দ ঝপাং, আবার ঝপাং – কি হল? বাইনোকুলার থেকে চোখ সরিয়ে সামনে তাকাতেই দেখি দুই বিশাল পেলিকান।
জলে যে কালো ছোট হাঁসগুলো ঘুরছিল, তারা অনেক দূরে সরে গেছে। 
ক্যামেরা বাগিয়ে তাদের ফ্রেম বন্দী করার আগেই একজন উড়ে গেলেন।
বড় সড় সবারই মেজাজ আলাদা। সে কি বাঘ ভালুক, কি পেলিকান। ওনার বোধহয় আমাকে তেমন পছন্দ হয় নি তাই উড়ে গেলেন।
হ্যাঁ রে বাবা বড় তো বটেই। বাঘ ভালুকের মতন বড় না হলেও বড় তো বটেই একেকজনের ওজন ১২-১৪ কেজি প্রায়। তাহলেই বুঝে দেখো কি বিশাল পাখি তারা! 
ঐ যে বেশ বড় মানিকজোড়, খুব বেশি হোলে ৩-৪ কেজি
বকেদের? তা হোলে হবে ১-২ কেজি
আর ছোট পাখিদের ওজন তুলনা করছি না, সে বেচারিরা লজ্জা পাবে, তারপর আর আমার ক্যামেরায় ধরা দেবে না। তখন?
পেলিকানদের সবারই একখানা মাছধরা থলে আছে। মাছ ধরে ধরে সেই থলের মধ্যে পুরে ফেলে। হ্যাঁ রে বাবা হ্যাঁ। সত্যি সত্যিই পেলিকানরা মাছ ধরে ধরে থলের মধ্যে ভরে রাখে।
-পাখি মাছ ধরে থলেতে পোরে?
-হ্যাঁ পোরে। পুরোটাই সত্যি একটুও জল মেশানো নেই এই খবরে।
-তারপর কি করে থলের মাছগুলো দিয়ে? ওরা কি বাজারে যায় বিক্রি করতে?
-না সেটা আমি এখনও শুনিনি, পাখিদের মাছের বাজারের কথা। 
-তাহলে থলে তে মাছ ভরে কেন?
-বলছি। বলছি (ক্রমশঃ)


পাঠ প্রতিক্রিয়া 
(জ্বলদর্চি ছোটোবেলা ৭৮ পড়ে কবি ও গল্পকার সোনালি জানা যা লিখলেন)

মৌসুমী ঘোষ সম্পাদিত 'জ্বলদর্চি '- ছোটবেলা ৭৮,সংখ্যাটি যেন এই গরমে এক পশলা শীতল বাতাস।প্রাণের বন্ধু, মনের বন্ধু থাকলে কতো যে আনন্দ।পাখি হোক কিংবা মানুষ, বন্ধু তো সকলেই খোঁজে।চিত্রগ্রাহক কল্যাণবাবুর ছবিটি চমৎকার লাগলো।

তৃষা বসাকের "জয়াবতীর জয়যাত্রা"(দশম পর্ব )পড়ে রূপকথার অনাবিল আনন্দ খুঁজে পেলাম।ছোট্ট জয়ার হাজার প্রশ্ন আর কৌতূহল নিয়ে আমরাও যেন গুটিগুটি পায়ে পথ চলি।

তুষ্টি ভট্টাচার্যের "ডানাওয়ালা ট্রেন "পড়ে শিশু মনের এক গভীর রূপরেখা পেলাম।চরিত্রগুলো বড়ো জীবন্ত। এতো চমৎকার লেখা উপহার দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ জানাই।
স্বপ্ননীল রুদ্রের 'রহস্যময় ছাতা 'বেশ মজার কবিতা। ছন্দে ছন্দে ছাতার নানান ব্যবহার মন ছুঁয়ে গেলো।
রকি হালদারের বর্তমান সময়ের একটি প্রাসঙ্গিক কবিতা 'আধুনিকতা '। কবিতায় নীতিশিক্ষার বার্তাটি লক্ষ্যণীয়।

পীযূষ প্রতিহারের দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের জীবনকাহিনি একটি অনবদ্য প্রবন্ধ।এই লেখা থেকে অনেক কিছু শেখার আছে।

বাসবদত্তা কদমের "চলো যাই "পড়তে পড়তে একেবারে গিয়ে দাঁড়িয়েছি  'পাখিদের কাছে '।সহজ সরল ভাষায় অনন্য সুন্দর একটি রচনা।ছোটো বড়ো সকলেই সমৃদ্ধ হবে।
ছবিগুলোর কথা আলাদা করে বলতেই হয় -সুদীপ্তা আদিত্যর আঁকা 'জয়াবতীর জয়যাত্রা' দারুন।
ঈশিতার বৃক্ষরোপন, ঈশিকার আঁকা মিষ্টি মেয়েটি, ঐশিকীর পাখির ছবি সব গুলোই খুব ভালো চেষ্টা। শুভেচ্ছা রইলো আগামীদিনে আরও ভালো হবে।

আরও পড়ুন 
জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments