জ্বলদর্চি

দহন /বিবেক বাউলিয়া

দহন 
বিবেক বাউলিয়া 


                                       এক 
- কাকিমা, অরণ্য দা কোথায়? 
- কেন রে, কি হয়েছে? 
- দরকার আছে। পরে বলবো। ও কোথায় তাই আগে বলো?
- ওপরে দোতলার ঘরে রণজয়ের সাথে ক্যারাম খেলছে দেখ গে যা। 
রিমি হন্তদন্ত হয়ে ছুটতে ছুটতে সটান দোতলায় গিয়ে - রণ দা, তুই এখন বাড়ি যা। 
রণজয় মাথা মুন্ডু কিছু না বুঝে চোখ বড়ো বড়ো করে ভ্রু কুঁচকে ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে!
- কেন রে রিমি আমি বাড়ি যাবো কেন? ক্যারাম  খেলতে এলাম কতদিন পরে। এখন তো তেমন মাঠে খেলা হয় না। অরণ্য বলছিল অনেক দিন খেলা হয় না। সেই মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে পর্যন্ত যা খেলা হত। তারপর কদিন দেখলাম অনেকে মাঠে খেলতে যাচ্ছে, আমরাও গেলাম। মাস খানেক খেলে সব দেখি যে যার মতো। শুধু ফোন আর ফোন। এখন ফার্স্ট ইয়ারের পরীক্ষা শেষ হল, ছুটি আছে ক'দিন। তাই খেলতে এসেছি। তারপর তো আবার যা তাই। আচ্ছা,ওসব বাদ দে। তা তুই এরকম হঠাৎ পাগলের মতো ছুটতে ছুটতে চলে আসলি কেন? 
- তোর অত জেনে লাভ নেই। তুই এখন বাড়ি যা। 

রণ কি করবে ভেবে না পেয়ে অরণ্য ওকে ইশারা করে চলে যেতে বলে। যাওয়ার সময় পেছন ফিরে একটু তাকাতেই দেখে রিমি এমন ভাবে তাকাচ্ছে যেন ও সত্যি সত্যি এক্ষুনি যদি না যায় তো ওকে বাঘের থাবা বসিয়ে দেওয়ার মতো করে মেরে ফেলবে। 

রণ এটা বরাবরই জানে রিমি একটু এরকম ধরনের। অরণ্য আর রণ ক্লাস ফোর পর্যন্ত একই স্কুলে পড়েছে। তারপর ওকে একটা হাই স্কুলে ভর্তি করায়। আর অরণ্য পড়ে অন্য স্কুলে। কিন্তু কি আর করা যাবে! বন্ধু অন্ত প্রাণ। যাকে এক কথায় বলে, ইয়ে দোস্তি হাম নেহি তোড়েঙ্গে। বন্ধু এক স্কুলে গেছে আমি কেন অন্য স্কুলে পড়বো? সেই তো একই ব্যাপার। ক্লাস ফাইভে ওঠার সময় রণ কে যা হোক ধরে বেঁধে সেই স্কুলে রেখে ক্লাস সিক্সে ওঠার আগে অরণ্য যে স্কুলে পড়ে সেখানে আনা হল। তারপর আর কি? মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে পর্যন্ত বিশেষ করে বর্ষাকালে একটু বৃষ্টি হলেই অমনি ছুটে চলে আসত রণ ক্যারাম খেলার জন্য। এখন আবার নতুন করে খেলার বাহানা জেগেছে। 

ওরা দুজন এক পাড়ায় থাকে। অরণ্যের বেশ কয়েকটা বাড়ির পরে রণজয়ের বাড়ি। এদিকে রিমিরা এই পাড়ায় নতুন বাড়ি করে এসে কয়েক বছর হচ্ছে। রিমি ক্লাস ফাইভ থেকেই গার্লস স্কুলে পড়ছে। আগে একটা ভাড়া বাড়িতে থাকত। অরণ্যদের পাড়ায় জায়গা জমি কিনে রেখে একটু একটু করে তৈরি করতে করতে একেবারে সাজিয়ে গুছিয়ে গৃহপ্রবেশ করেছে। ওরা যখন আসে তখন রিমি ক্লাস এইটে পড়ে। কারণ ভাড়া বাড়ি থেকে স্কুল যাতাযাতে দূর হয়ে যাওয়ার জন্য। 

রিমি এখন ইলেভেনে পড়ছে। আর্টস নিয়ে,ওই গার্লস স্কুলেই। আর ওরা সেকেন্ড ইয়ার পড়ছে। তবে একটা জিনিস, রিমি গার্লস স্কুলে পড়ে বটে কিন্তু মেয়েদের কে তেমন বন্ধু মনে করে পাত্তা দেয় না। অরণ্যদের বাড়ির একটু পিছনের দিক বরাবর রিমিদের বাড়ি। মানে এক কথায় ছাদে উঠলে অর্ধেক কথা বলা হয়ে যায়। তা সত্ত্বেও প্রায় প্রায় রিমি লাফাতে লাফাতে অরণ্যদের বাড়ির পিছন দিকের পাঁচিল অনায়াসে লাফিয়ে পার করে চলে আসে। সামনের দিকের গেট খুলে কে আবার অত কষ্ট করে বারবার আসবে। কিন্তু এবারে এসেছে একেবারে গেট খুলে। 

রণজয় তখন চলে যাওয়ার পর -
- তুই কি ধরনের মেয়ে রে হুটহাট করে যখন তখন আসিস বটে। তাই বলে ওকে তাড়িয়ে দিলি কেন? (অরণ্য কিছুটা তোতলামি করে বলতে থাকে, যদিও ততটা তোতলা না) 
অরণ্য মাঝে মধ্যে ভাবে এই মেয়ে কি নিছক বন্ধুত্ব সুলভ আচরণ করে এমন করে নাকি সে একেবারে আমায় সবটুকু বলে দিতে চায়। সে কি কিছু বলতে চায় নাকি আমার থেকে কিছু জানতে চায়? এই যে প্রায় প্রায় আমাদের বাড়ি তে চলে আসে কোন উদ্দেশ্যে? সে কি সব কিছু বুঝে সুঝে করছে নাকি সেই সাথে আমার ভিতরের কথাকেও জেনে ফেলেছে? ও যা মেয়ে। তাতে অনায়াসে সব কিছু করে ফেলতে পারে। অরণ্য মনে মনে ভাবতে থাকে, কেউ কিছু বোঝে না তা নয়, বোঝে। পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে সবই বোঝে। বোঝার পর তার ভিতরে ভিতরে উচাটন হতে থাকে। মুহুর্তে মুহুর্তে যেন তার অন্তরাত্মা পুড়তে থাকে। চোখ চায়। দু হাত ভরে পেতেও চায়। মন দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। তার জন্য দু পা এগিয়েও যেতে পারে না। বুঝেও ঠায় কাঠ পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। 

রিমিরা আসার পর থেকে দুটো বাড়িতে ভালোই প্রতিবেশী সুলভ মনোভাব প্রগাঢ় হতে থাকে। অরণ্য একটু ইন্ট্রোভার্ট টাইপের। নেহাত রণ-র সাথে বন্ধুত্বের খাতিরে এক সাথে পড়াশুনো করে বলে ওর সাথে একটু মেশে আর কলেজ যায় বা কোথাও ঘুরতে যায়। রিমিরা আসার পর থেকে সব ওলট পালট হয়ে গেল। এখন রণ যত না অরণ্যের বাড়ি তে আসে দিনে অন্তত দু’বার করে রিমি আসে। সে কারণ থাকুক বা না থাকুক। ক্যারামও খেলে। থাকেও বটে। বলা কওয়া লাগে না মাঝে মধ্যে ফ্রিজ খুলে এটা ওটা মুখের মধ্যে পুরে গবগব করে খেয়ে ফেলে। আর অরণ্যের মাও তেমন কিছু বলে না। বলতে গেলে মেয়ের মতো দেখে। আর যদি বারণ করতে যায় তাহলে তো হইরই কারণ কান্ড বাঁধাবে। যে পরিমাণ দস্যি। অরণ্যের আবার এসব একদম ভালো লাগে না - কারোর বাড়ি গিয়ে লাফালাফি করা, উৎপাত করা, যা ইচ্ছা তাই করা। মাঝে মধ্যে রিমিদের বাড়িতে সেও যায়, তা বলে ওদের বাড়িতে গিয়ে এরকম করে না। ওকে যদি বসতে বলে তো বসবে। আর না হয় বসবে না। তবে যখনই আসে তখন এসেই ছাদে চলে যায়। অনেক দিন থেকে রিমি এটা লক্ষ্য করতে করতে একদিন ওর পিছন পিছন আস্তে আস্তে গিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছিল কি করে ও ছাদে এসে? কি এমন আছে? দেখে, কিছুই তো করে না। চুপচাপ দক্ষিণ মুখো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সেই দিনই রিমি পিছন দিক থেকে ধরে ফেলে।
- কি ব্যাপার বলতো অরণ্য দা? তুই যখন আমাদের বাড়ি তে আসিস তখনই ছাদে আসিস। কি করিস এসে? 
- কিছুই না। ছাদে এলে ভালো লাগে। তাই আসি।
- তুই ফালতু কথা বলছিস। এমনি এমনি কেউ বাড়িতে এসে ঘরে না বসে ছাদে আসে?
অরণ্য চুপ করে রিমির মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে আবার মুখ ঘুরিয়ে ভিতরে ভিতরে ভাবতে থাকে - মানুষ নিজেকে নিজের ভিতর লুকিয়ে রাখে বটে। কিন্তু সে চায় তার ভিতরকার অব্যক্ত কথা কে কেউ না কেউ টেনে বের করুক। তার মন অনেক কিছু বলতে চায়। অথচ বলা হয়ে ওঠে না। অলিখিত সাদা কাগজ কে পুড়িয়ে ফেললে সেই কাগজ ভিতর ভিতর নিজেও পুড়তে থাকে। কারণ সে জানে, কিছু না কিছু লেখার ছিল। তবুও লেখা হয়ে উঠল না। 
- ওসব ছাড়। নীচে চল। 
- বলবি না তাই তো? ঠিক আছে। পরে সব বোঝা যাবে। এখন থাক। 
- পরে বোঝা যাবে মানে! বুঝলাম না। 
নীচে নেমে এসে সোফায় বসে পড়ল।

                                    দুই 


অরণ্য মনে মনে বলতে থাকে - না, না, এসব ফালতু কথা। 
- হ্যাঁ, যেটা বলার জন্য এলাম। 
- কি? 
- কাল কে আমার জন্মদিন। মনে আছে তো? 
- ও, হ্যাঁ হ্যাঁ! আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম! 
- ওই জন্য মনে করাতে আসলাম। বিশেষ করে প্রতিবারের মতো তোকে একটু আলাদা করে... 
- আলাদা করে আবার কি? এমন করে বলছিস যেন আগের বছর গুলোতে আমি থাকিনি?
- যাই হোক, যাওয়ার সময় কাকিমা কে বলে যাবো। আগে ভাগে গিয়ে মায়ের সাথে হাতে হাত লাগাবে। আর তুই বিকেল বেলা খুব তাড়াতাড়ি চলে আসবি। অনেক কাজ আছে। আর রণ দার বাড়ি গিয়ে বলে আসি। 
- তোর বন্ধু বান্ধবীদের কাউ কে বলিসনি?
- হ্যাঁ। ওই নয় দশ জন কে বলেছি। জানিস তো আমি আবার মেয়েদের সাথে বেশি পিরিত করি না। আর ছেলেরা তো কোন দূরে। আমার অত শত ভালো লাগে না। মনের মতো একজন বন্ধু হলেই হল। 
- স্পেশাল কেউ আছে নাকি? 
- স্পেশাল মানে! 
- সব বলা যাবে না। একটু বুঝে নিতে হবে। 
- আচ্ছা, যাক গে। তুই কিন্তু এখনো বললি না রণ কে চলে যেতে বললি কেন? 
- আছে অনেক কারণ আছে। রণ দা তোর সাথে থাকে ঠিকই। কিন্তু সবসময় থাকুক এটা ভালো লাগে না। 
- তোর ভালো লাগা না লাগার সাথে কি সম্পর্ক? বুঝলাম না তো! আগেও একবার এরকম করেছিস। দেখ, রণ আর আমি বলতে গেলে একসাথে বড়ো হয়েছি। পড়াশুনা করছি। দীর্ঘদিনের একটা ব্যাপার। আমরা একসাথে থাকলে তুই এরকমই করিস কেন? তুই যখন আমাদের বাড়িতে প্রথম আসতে শুরু করলি তখন এরকম করতিস না। গত দু’বছর ধরে কমবেশি এটা আমি ভালোই লক্ষ্য করছি। যাই হোক, সোজাসুজি তো কিছু বলবিও না। আর পাগলামি করবি শুধু। তুই যার কপালে জুটবি না, সে একদম... 
- রিমি এদিকে মনে মনে বলতে থাকে, তুম ক্যায়া জানোগে মেরে দুলহান। যাবসে তুমকো দেখা থা পহেলে দিন সে তো... 
অত এখন সব কিছু বলা যাবে না। দেখে মনে হয় যেন ভাজা মাছ টা উল্টে খেতে জানে না।
- কি বললি? 
- কিছু না। অনেক কথা হয়ে গেল। সময় মতো চলে আসিস। আর তুই আগে আসবি। কাকু অফিস থেকে বাড়ি ফিরলে ভাইয়ের সাথে আসতে বলবি। কাকিমা আগে থেকেই কাজে ব্যস্ত থাকবে। মনে থাকে যেন।


                                   তিন 
সব কিছু তৈরি? তাহলে এবার কেক কাটা যাক? 
- আরে, অরণ্য দা কোথায়? 
- কাকিমা অরণ্য দা কোথায় ! আমি তো ওকে অনেক আগেই আসতে বলেছি। সবাই এসেছে। তখন দেখলাম ঘরে ঢুকল। ভাবলাম এসেছে, আমার ঘরে আসবে। এবারে তো কেক কাটা হবে। একমাত্র ওকেই দেখছি না। আচ্ছা তোমরা সবাই একটু অপেক্ষা করো আমি ছাদে গিয়ে দেখে আসি ওখানে আছে কিনা। 
- ওর তো আবার আমাদের বাড়িতে এসে ছাদে যাওয়ার অভ্যাস আছে। 
রিমি দেখল, সত্যিই ছাদে গিয়ে সেই একই ভাবে দাঁড়িয়ে আছে অন্ধকারে। 
- এই অরণ্য দা, তোকে কখন থেকে খুঁজছি। এদিকে কেক কাটা হবে। সবাই এসে গেছে। একমাত্র তুই ওখানে নেই। চল নিচে চল। 
- যাচ্ছি, চল। 
- কি রে তোর গলাটা ওরকম লাগছে কেন! 
-  সরি, কিছু মনে করিস না - আমার কাছে তেমন ভালো মতো জমানো টাকাও নেই। সেই কারণে তোর জন্য কিছু কিনে আনতে পারলাম না। 
- আরে, অদ্ভুত তো! তাতে কি হয়েছে? তুই হয়তো জানতিস না ওই কেক টা কাকিমা অর্ডার করে এনেছে। ব্যস, আর কি দরকার? কেক তো দিয়েছে। আর আমি সবাই কে বলে দিয়েছিলাম যে আমাকে যেন খুব দামি গিফট না দেয়। আমি বই পড়তে ভালোবাসি বলে অনেকে বইও দিয়েছে। সাথে কাকুও দেখি একটা খুব মোটা মতো একটা বই দিয়েছে। কি বই তা জানি না। খুলে দেখলে জানা যাবে। আর এদিক ওদিক করে বাকিরা টুকটাক কিছু দিয়েছে। যাক গে, ওসব বাদ দে। তা তুই এতে এতো আফসোস করছিস কেন? 
- উপহার তো দিতে পারলাম না। সেই দামে শুধু একটা কথা দিতে চাই। 
- কি কথা? 
- সব কথা কি ভাষায় প্রকাশ করা যায়? চোখের দিকে তাকালেও তো সে ভাষা পড়ে নেওয়া যায়।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments