জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা-২১/প্রীতম সেনগুপ্ত

পর্ব ২১
শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

প্রীতম সেনগুপ্ত

ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণদেবের অন্তর্ধানের সাত আট মাস পরে, ১৮৮৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষে বরানগর মঠ থেকে পরিব্রাজকরূপে নিষ্ক্রান্ত হলেন স্বামী অখণ্ডানন্দ বা গঙ্গাধর মহারাজ। গয়া, কাশী, অযোধ্যা ও নৈমিষারণ্য দর্শনপূর্বক এসে উপস্থিত হলেন হরিদ্বারে। কলকাতা থেকে এখানে পৌঁছতে দু-তিন মাস সময় লেগেছিল। সেখান থেকে তিন-চারদিন পরে হৃষীকেশ। এই স্থানটি বিষয়ে তিনি লিখছেন--“হিমালয়ের পাদমূলে হৃষীকেশের তুল্য রমণীয় ও পবিত্র তপোবন আর নাই। ৺বদরিকাশ্রম যাত্রার এইটি প্রধান দ্বার। কার্তিক মাস হইতে জ্যৈষ্ঠ মাসের দশহরা পর্যন্ত এই হৃষীকেশ নানা সম্প্রদায়ভুক্ত সাধুসমাগমে পূর্ণ হয়।” (তিব্বতের পথে হিমালয়ে--স্বামী অখণ্ডানন্দ)। পরম আনন্দ ও পবিত্রতাময় অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে গঙ্গাধর মহারাজের জীবনের মুখ্য কয়েকটি দিন এখানে অতিবাহিত হয়। এখান থেকে তিনি মুসৌরি, দেরাদুন হয়ে যমুনোত্রী, গঙ্গোত্রী ও কেদার-বদরীনারায়ণ যাত্রার সঙ্কল্প গ্রহণ করেন। যদিও তাঁর মূল গন্তব্যস্থল ছিল তিব্বত। এই বিষয়ে অভিজ্ঞতার কথা লিখছেন এইরকম--“তিব্বতযাত্রার পথে হিমালয়ের যে সকল স্থানের সন্দর্শনে আমার মন নিতান্ত মুগ্ধ ও অনুরক্ত হইয়াছিল, সেই সকল শান্তি ও পুণ্যময় স্থানের বিষয়ে স্মরণ করিলেও চিত্ত স্থির হয় ও হৃদয় অতিশয় পবিত্রভাব ধারণ করে। সুতরাং তিব্বতে পৌঁছিবার পূর্বে আমাকে বাধ্য হইয়া অতি সংক্ষেপে ৺বদরিকাশ্রম যাত্রা সম্বন্ধে কয়েকটি কথা লিখিতে হইবে। 

 কিছুদিন হইতে বঙ্গবাসীদের মধ্যেও কেহ কেহ প্রতিবৎসর ৺বদরিকাশ্রম যাত্রা করিয়া আসিতেছেন। পূর্বে বাঙ্গালী যাত্রীর সংখ্যা খুব কম ও পাঞ্জাবী যাত্রীর সংখ্যাই খুব বেশী হইত। বঙ্গদেশের সুশিক্ষিত সন্ন্যাসী পরিব্রাজক যুবকগণ লিখিত ভ্রমণবৃত্তান্ত আজকাল মধ্যে মধ্যে মাসিক পত্রিকাদিতে দেখিতে পাওয়া যায়। এই সকল প্রবন্ধ পাঠ করিয়া এক্ষণে হিমালয়ের প্রধান প্রধান তীর্থগুলি সম্বন্ধে অনেকেই অনেক কথা জানিতে পারিতেছেন। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সাধু মহাপুরুষ যাত্রীদের নিকট একই উত্তরাখণ্ড সম্বন্ধে পৃথক পৃথক বৃত্তান্ত শুনিতে পাওয়া যায়। কালের প্রভাবে একস্থানেই কত পরিবর্তন ঘটিয়া থাকে! আবার অবস্থাভেদে ও পর্যবেক্ষণ শক্তির পরিমাণ ভেদে এক সময়ে দৃষ্ট একই স্থান বিভিন্ন পর্যটক দ্বারা বিভিন্ন আলোকে দৃষ্ট ও তদনুযায়ী বর্ণিত হইয়া থাকে। সেইজন্য আমরা প্রত্যেক যাত্রীর নিকট একই উত্তরাখণ্ড সম্বন্ধে নতুন কিছু শুনিবার আশা করিয়া থাকি। বহুপূর্বে যাঁহারা “মনভঙ্গ ও চিৎভঙ্গের” রাস্তায় ৺বদরিকাশ্রম যাত্রা করিতেন, তাঁহাদের ভ্রমণবৃত্তান্ত আজকালকার কেদার-বদরী-যাত্রীদের বৃত্তান্ত হইতে সম্পূর্ণ পৃথক। তাঁহাদিগকে যেরূপ বিষম পার্বত্য পথ অতিক্রম করিয়া ৺কেদার-বদরীতে পৌঁছিতে হইত, তাহা আজকালকার যাত্রীদের কল্পনাতীত। সে পথ যে কিরূপ ভয়ঙ্কর ও দুর্গম ছিল, তাহা ঐ নামেই প্রকাশ পাইতেছে। এমন কি; অল্পদিনের কথা ৺হরিদ্বারে রেল যাইবার পূর্বেও যাঁহারা তথায় গিয়াছেন তাঁহারা এখন আর হরিদ্বারের সে শোভা ও সৌন্দর্য দেখতে পান না। এখন আর ৺বদরী-কেদার ও গঙ্গোত্রীর পথে যাত্রীদের ত্রাসজনক নিত্য দোলায়মান পাহাড়ী ঝোলা নাই, সর্বত্রই পাকা সাঁকো ও রাস্তা হওয়ায় এক্ষণে ৺বদরিকাশ্রম যাত্রা পূর্বাপেক্ষা বিবিধ প্রকারে সুগম হইয়াছে। প্রতি বৎসর সেইজন্য বিভিন্ন দেশীয় বিভিন্ন প্রকৃতির বহুলোক-সমাগম হওয়ায় স্থানমাহাত্ম্য ভিন্নরূপ ধারণ করিয়াছে।”(তিব্বতের পথে হিমালয়ে-- স্বামী অখণ্ডানন্দ)। এখানে একেবারে একজন পর্যটকের দৃষ্টি নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন অখণ্ডানন্দজী। যা অতি প্রাঞ্জল ও মনোগ্রাহী। হৃষীকেশ থেকে দেরাদুন যাত্রার সময় জনৈক সাধু তাঁকে উত্তরাখণ্ড প্রবেশের আগে একজোড়া জুতো নেওয়ার পরামর্শ দেন। দু'দিনেই হৃষীকেশ পৌঁছৈ যান। সাধুর পরামর্শ মতো এক জোড়া জুতো কিনে নিয়েছিলেন। দেরাদুনে মাত্র দু'দিন বিশ্রামান্তে সেখান থেকে কিছুটা দূরে রাজপুর গ্রামে পৌঁছান। মুসৌরি পর্বতের নীচেই রাজপুর গ্রাম। এই পর্যন্ত তাঁর কাছে কয়েক আনা মাত্র পয়সা ছিল। সেই পয়সা এইখানেই ব্যয় করে সম্পূর্ণ রিক্তহস্ত হলেন। একাকী নিঃসম্বল অবস্থায় উত্তরাখণ্ড ভ্রমণের প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করলেন। কোনও সাধু বা গৃহস্থ যাত্রীর সঙ্গে ভ্রমণ করবেন না এবং ক্ষুণ্ণিবৃত্তির সময় ছাড়া ভবিষ্যতের জন্য কিছু সঞ্চয় করবেন না এই বিষয়ে দৃঢ়সংকল্প হলেন।
 মুসৌরি থেকে টিহরিতে তিনদিনে পৌঁছলেন গঙ্গাধর মহারাজ। সেখানে ৺গঙ্গোত্রীর পাকা রাস্তায় বেশ দীর্ঘ পথ অতিক্রমান্তে ধরাসু নামের ক্ষুদ্র ‘ঘরবাড়ি কনফোড়’ যোগীর গ্রামে পৌঁছলেন ঠিক মধ্যাহ্নে। এই গ্রাম থেকেই পাকা রাস্তা ছেড়ে যমুনোত্রী যাওয়ার একটি পাকদণ্ডী রাস্তা রয়েছে। হিংস্র জন্তু পরিপূর্ণ নির্জন অরণ্য এটি। তাই অপরিচিত জনের পক্ষে এই পথে একাকী ভ্রমণ করা নিতান্ত দুরূহ। স্বভাবতই কেমনভাবে এই পথ একাকী অতিক্রম করবেন তা ভেবে চিন্তিত হয়ে পড়লেন। কিন্তু ধরাসুতে পৌঁছনোমাত্র দেখলেন যে প্রায় দশবারো জন যমুনোত্রী অঞ্চলের পাহাড়ি মানুষ বিঁড়ের মতো টুপি মাথায় দিয়ে সেখানে বসে বিশ্রাম করছে।

 অতঃপর তাদের পরিচয় জেনে যারপরনাই আনন্দিত হলেন। কারণ এরা ছিল যমুনোত্রী অঞ্চলের জামদগ্ন্যজী মকাম গ্রামের অধিবাসী। দেরাদুন থেকে হাটবাজার করে নিজেদের গ্রামে ফিরছে। ভগবান সহায় হলেন, কারণ অখণ্ডানন্দজী ভাবছিলেন সহযাত্রী-প্রদর্শকের অভাবে তাঁর বুঝি আর যমুনোত্রী দর্শন সম্ভব হল না!
 মুসৌরি পর্বত পরিভ্রমণকালে একটি বিশেষ প্রকার খাদ্যাভ্যাসের উল্লেখ করেছেন, যেটি বেশ অভিনব। এই বিষয়ে তিনি লিখছেন--“মসুরী হইতে পথে এ পর্যন্ত আমার সহিত দুই একটি মাত্র পার্বতীয় পথিকের সাক্ষাৎ হইয়াছিল। তাহাদিগকে পথিপার্শ্বস্থিত অসংখ্য বৃক্ষে প্রস্ফুটিত সুন্দর রক্তবর্ণ পুষ্পগুচ্ছ হইতে মধু আহরণ করিয়া খাইতে দেখিলাম। তাহারা কেবল 
মধু খাইয়া তৃপ্ত নহে, মধুভাণ্ড পুষ্পগুলি পর্যন্ত আহার করিতেছে। অনুসন্ধানে জানিলাম যে পাহাড়ীরা ইহাকে “বোরাস” বলে। হিমালয়ের উচ্চ শিখর-প্রদেশে এই জাতীয় পুষ্প বিস্তর জন্মে। এই পুষ্পবৃক্ষগুলি বেশ বড় এবং ইহার কাণ্ড ও শাখা প্রশাখাসকল প্রায়ই এক প্রকার শৈবালে(moss)ঢাকা থাকে। এক এক গুচ্ছে অনেকগুলি পুষ্প, বর্ণ ঠিক রক্তজবার মত। মধ্যে বক ফুলের ন্যায় মধু থাকে। পাহাড়ী পথিকেরা একটু লঙ্কা ও লবণ মিশ্রিত করিয়া এই পুষ্পের অতি উপাদেয় চাটনী প্রস্তুত করিয়া রুটির সহিত পরম তৃপ্তিসহকারে আহার করে। আমিও প্রথমে এইখানেই এই বোরাস ফুলের সহিত রুটি খাইয়াছিলাম। হিমালয়ভ্রমণের প্রথম দিনেই পরম উপাদেয় জ্ঞানে কাঁচা ফুল খাইয়া মনে করিলাম, এই রাজ্যের সকলই অদ্ভুত!”

 যাই হোক উপরোক্ত পাহাড়িদের সঙ্গে রওনা হওয়ার পরদিন সন্ধ্যায় জামদগ্ন্যজীর মকামে পৌঁছলেন অখণ্ডানন্দজী। দেখলেন এই গ্রামটিতে কতকগুলি প্রাচীন দেবদেবীর মূর্তি সম্বলিত একটি প্রাচীন মন্দির আছে। এখানে দুই রাত্রি বাস করে তৃতীয় দিনে যমুনোত্রী অভিমুখে রওনা দিলেন।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments