জ্বলদর্চি

বাসুদেব ঘোষ (মেদিনীপুরের আদিকবি) /ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব - ১

বাসুদেব ঘোষ (মেদিনীপুরের আদিকবি ), তমলুক

ভাস্করব্রত পতি

“চাঁচর চিকুর চারু ভালে। / বেঢ়িয়াছে মালতীর মালে। তাহে দিয়া ময়ূরের পাখা। / পত্রের সহিত ফুল শাখা।  কষিত কাঞ্চন জিনি অঙ্গ। / কটি মাঝে বসন সুরঙ্গ। চন্দন তিলক শোভে ভালে। / আজানুলম্বিত বনমালে। নটবর বেশ গোরাচাঁদে। / রমনী কূলের কিবা ফাঁদে। 
তা দেখিয়া বাসুদের কাঁদে। / প্রাণ মোর স্থির নাহি বাঁধে।” ---
এক সময় এই তমলুকে বসেই লিখেছিলেন এই পদাবলী। তিনি বাসুদেব ঘোষ। মেদিনীপুরের 'আদি কবি' হিসেবেই তাঁর পরিচিতি। কিন্তু কে এই বাসুদেব ঘোষ? তিনি কেন তমলুককেই বেছে নিয়েছিলেন তাঁর পদাবলী রচনার ক্ষেত্র হিসাবে? 

 মোট ২২১ টি পদ রচনা করেছিলেন বাসুদেব ঘোষ। সেই পদাবলীতে শ্রীমন মহাপ্রভুর বর্ণনা ছত্রে ছত্রে। বাসুদেব ঘোষ তাঁর পদাবলী রচনা করেছিলেন এখানেই। 

  তমলুকের হরির বাজারে (জেলখানা মোড়) রয়েছে মহাপ্রভুর মন্দির। জেলা সদর সংশোধনাগারের দক্ষিণে এই শ্রীল বাসুদেব ঘোষ ঠাকুর গোস্বামীর শ্রীপাট শ্রীমান মহাপ্রভুর মন্দির। প্রথমেই পড়বে নবরত্ন রাসমঞ্চ। তারই পাশে বকুলমঞ্চ। বকুলমঞ্চের পূর্ব উত্তর কোণে নবরত্ন মন্দিরটির অবস্থান। এই বকুলমঞ্চ হল কবি বাসুদের ঘোষের সমাধি মন্দির। একে বলা হয় ‘সিদ্ধ বকুল’ । জনশ্রুতি রয়েছে, সমাধি মঞ্চের ওপরে কেউ যদি শয়ন করতেন তবে তাঁকে ফেলে দেওয়া হত। ফুল, মালা, ধূপ, চন্দনে প্রতিদিনই এই সিদ্ধ বকুলের তলায় আরাধনা করা হয় আজও। লোকজন এখানে এসে মনের কামনা বাসনা পূরণের জন্য এই গাছে ‘দাগা' বাঁধে। এই সিদ্ধ বকুল গাছের তলাতেই সমাধি দেওয়া হয় কবি বাসুদেব ঘোষকে। 

 পূর্বমুখী মহাপ্রভুর মন্দিরের নাটমন্দিরের কাছে বাসুদেব মঞ্চের সামনেই সিদ্ধ বকুল গাছের অবস্থান। ডালপালা মেলে থাকা এই বকুল গাছটি জানিয়ে দিচ্ছে বহু বছর আগেকার এক সাধক কবিকে। যিনি ভক্তি রসে ডুবে ছিলেন। মগ্ন ছিলেন শ্রী চৈতন্যের তরে। মহাপ্রভুর স্মরণে তিনি যে পদাবলী রচনায় হাত দিয়েছিলেন তা আজ রীতিমতো আলোচনার বিষয়। মেদিনীপুরে জন্ম না হয়েও তিনি হয়ে উঠেছেন 'মেদিনীপুরের মানুষ'!

  মহাপ্রভুর মন্দিরের মধ্যে রয়েছে বেশ কিছু মূর্তি। মাঝখানে অধিষ্ঠিত গৌরাঙ্গের মূর্তি। এটির প্রতিষ্ঠা করেন কবি বাসুদেব ঘোষ। ডানপাশে পুরীর মাধবী দাসী প্রতিষ্ঠিত শ্যামচাদের মূর্তি এবং বামপাশে জগন্নাথ দেবের মূর্তি। এটির নির্মাণ করেন বৈষ্ণবচরণ দাস বাবাজী। গৌরাঙ্গের মূর্তিটি দারুমূর্তি অর্থাৎ কাঠ দিয়ে তৈরি। এছাড়া এখানে আছে রাধা গোপীনাথ, রাধা শ্যামসুন্দর, গোপাল জিউর পাঁচটি মূর্তি এবং ১২ টি শালগ্রাম শিলা। গৌরাঙ্গের দারুমূর্তিটি আসলে অভয়বরদ মূর্তি। তমলুকের মানুষকে তিনি অভয় দেন বলেই ভক্তগণের দৃঢ় বিশ্বাস।

  দোলের দিনই মহাপ্রভুর জন্মদিন। ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে ফাল্গুনী পূর্ণিমার তিথিতে নবদ্বীপে শচীদেবের কোলে জন্মগ্রহণ করেন জগন্নাথ মিশ্রের পুত্র শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য। এই শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্যর যোগ্য শিষ্য ছিলেন কবি বাসুদেব ঘোষ। চৈতন্যদেবের জন্মদিন দোলের দিন বলেই এদিন এখানে পালিত হয় মহাপ্রভুর জন্মোৎসব। আর চৈত্র মদন ত্রয়োদশীতে কবি বাসুদেব ঘোষের উৎসব হয় তাঁর মৃত্যুদিনকে স্মরণ করে। উৎসব চলে সাত দিন ধরে। এ সময় এখানে বসে বাসুদেব ঘোষের মেলা। আর সেই মেলায় হাজির হন ২০ ২৫ হাজার মানুষ।

  শ্রী মহাপ্রভুর পদাবলী রচনায় কবি বাসুদেব ঘোষ প্রেরণা পেয়েছিলেন শ্রীখণ্ড নিবাসী নরহরি ঠাকুরের নিকট। এই নরহরি ঠাকুর হলেন নরহরি দাস সরকার। তিনি ছিলেন বৈষ্ণব পদাবলী রচনায় পুরোধা পুরুষ। কিন্তু একথা মেনে নেওয়া যায় যে শ্রী মহাপ্রভুর লীলা রচনায় নরহরি দাস সরকারের তুলনায় কবি বাসুদেব ঘোষের ছিল বহুমুখিতা। তিনি যে এ বিষয়ে অগ্রগণ্য তা তাঁর পদাবলীতেই প্রমাণ মেলে। অর্থাৎ নরহরি দাস সরকার না-থাকলে আমরা কবি বাসুদেব ঘোষকে পেতাম না। 

  বাসুদেব ঘোষের পদাবলীতে যেমনি মিলবে বৈচিত্র্য, তেমনি শৈল্পিক গুণাবলীও খুব একটা কম পরিমাণে নেই। তাই গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদাবলী রচনায় তমলুকের কবি বাসুদেব ঘোষের কৃতিত্ব বেশি এবং তা সর্বজনবিদিত। প্রাবন্ধিক ইন্দুভূষণ অধিকারীও কবি বাসুদের ঘোষের কথা কাব্য বা পদাবলী রচনার প্রেরণাস্থল হিসাবে চিহ্নিত করেছেন শ্রীখণ্ডের নরহরি নাম সরকারকে। কবির লেখনিতে মেলে ‘শ্রী সরকার ঠাকুরের পদামৃত পানে / পদ্য প্রকাশিত বলি ইচ্ছা কৈল মনে।”

  তমলুকে কবি বাসুদেব ঘোষের শ্রীপাট হলেও আদপে তিনি অন্য জেলার মানুষ। কিন্তু কর্মগুণে তাঁকে মেদিনীপুরের মানুষ চেনে "মেদিনীপুরের মানুষ রতন" হিসেবে। হাওড়া স্টেশন থেকে মেন লাইনে বর্ধমান যাওয়ার পথে পড়বে ব্যাণ্ডেল স্টেশন। এই ব্যাণ্ডেল থেকে কাটোয়া যাওয়ার পথে মধ্যবর্তী রেলস্টেশন অগ্রদ্বীপ পড়বে। 'শ্রীপাঠ পৰ্য্যটন’ বইতে লেখা আছে ‘অগ্রদ্বীপে তিন ঘোষ লভিলা জনম'। এখানে ‘তিন ঘোষ’ বলতে বোঝানো হয়েছে বাসুদেব ঘোষ, মাধব ঘোষ এবং গোবিন্দ ঘোষকে। এঁরা সম্পর্কে তিন ভাই। বাসুদেব ঘোষের বাবার নাম বল্লভ ঘোষ। 

  তবে অনেকেই এই অগ্রদ্বীপকে কবি বাসুদেব ঘোষের জন্মস্থান বলে মেনে নেননি। বরং ভিন্নমত পোষণ করেছেন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। 'শ্রী শ্রী বৈষ্ণব ইতিহাস' গ্রন্থে হরিলাল চট্টোপাধ্যায় কবি বাসুদেব ঘোষের জন্ম বাংলাদেশের শ্রীহট্ট জেলার ‘বুরঙ্গী’ গ্রামে হয়েছে বলে উল্লেখ করেন। ড. সুকুমার সেন তাঁর 'বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস' গ্রন্থে লিখেছেন গোবিন্দ, মাধব এবং বাসুদেব তাঁরা মাতৃবংশ শ্রীহট্ট থেকে এসেছে। যদিও সুকুমার সেন লিখেছেন বাসুদেব ঘোষের পিতৃবংশ চট্টগ্রামে। কেউ কেউ বলেছেন, বাসুদেব ঘোষ শ্রীহট্টতেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর বাবার নাম সুকদেব ঘোষ। অথচ পাঁচথুণীর মুরারিলাল অধিকারী তার 'বৈষ্ণব দিগদর্শন' গ্রম্বে বাসুদেব ঘোষের বাবা হিসাবে বল্লভ ঘোষকেই চিহ্নিত করেছেন। সেই সঙ্গে তিনি লিখেছেন কবির আদিনিবাস পূর্ব মেদিনীপুর জেলার কাঁথি থানার রসোড়া গ্রামে। অথচ 'শ্রী শ্রী শ্যামানন্দ প্রকাশ' গ্রন্থে শ্রীকৃষ্ণ দাস লিখেছেন, 'বর্ধমান জেলার অগ্রদ্বীপে আবির্ভাব'। জনৈক হরিদাস বাবাজির লেখা 'গৌড়ীয় বৈষ্ণব অভিধান' অনুসারে কবি বাসুদেব ঘোষের বাবার নাম গোপাল ঘোষ। ওই গ্রন্থতে কবির আদি নিবাস বর্ধমানের কুমারহট্টতে উল্লিখিত হয়েছে। 'সুবর্ণবনিক কথা ও কীর্তি” গ্রন্থের দ্বিতীয় ভাগে নরেন্দ্রনাথ লাহা লিখেছেন 'কেহ কেহ বলেন, বাসু ঘোষের মাতুলালয় শ্রীহট্ট জেলার অন্তর্গত বুড়ন ও বুরাকী গ্রামে ছিল, ওই স্থানেই বাসুদেব ঘোষের জন্ম হয়।' অর্থাৎ নরেন্দ্রনাথ লাহার বক্তব্য কিছুটা ড. সুকুমার সেনের বক্তব্যের সাথে মিললেও জন্মস্থান সম্পর্কে তথ্য আলাদা হয়েছে। কবি বাসুদেব ঘোষের প্রকৃত জন্মস্থান কোথায়? শ্রীহট্ট, চট্টগ্রাম, রসোড়াগ্রাম নাকি বর্ধমানের কুমারহট্ট কিংবা অগ্রদ্বীপ? কুমারহট্টতে হয়েছে বলে মত প্রকাশ করেছেন প্রাবন্ধিক ড. সুস্নাত জানা। 

 কবি বাসুদেব ঘোষ দ্বাপর যুগে ব্রজলীলার শ্রীমতী রাধারাণীর সখী ছিলেন। সে সময় তাঁর নাম ছিল গুণতুঙ্গা। বিশাখা রচিত গীত কীর্তন করতেন এই গুণতুঙ্গা তথা বাসুদেব ঘোষ। ‘বৈষ্ণবাচার্য দর্পণ' গ্রন্থে এ তথ্য লিপিবদ্ধ এভাবে ‘গুণতুঙ্গা সখী এব বাসু ঘোষ খ্যাতি / গৌরাঙ্গের শাখা তমলুকেতে বসতি'। ব্রজলীলার গুণতুঙ্গা সখীই গৌরাঙ্গলীলার বাসুদেব ঘোষ নাম ধারণ করেছেন। এই পূর্বাবতার বিষয় কর্ণপুরের ‘শ্রীগৌরগনোদ্দেশ দীপিকা' গ্রন্থের ১৮৮ তম শ্লোক থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া যায়— 'কলাবলী রসোন্নোসা গুণতুঙ্গা ব্রজেস্থিত। / বিশাখা কৃত গীতং গায়ন্তী স্মাদ্যতামতাঃ। / গোবিন্দ মাধবানন্দ বাসুদের যথাক্রমং।'

'কবি বাসুদেব ঘোষের শ্রীপাট' হিসেবে পূর্ব মেদিনীপুরের তমলুককেই বোঝাবে এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই । ‘শ্রী শ্যামানন্দ প্রকাশ’ গ্রন্থের অষ্টম পরিচ্ছদে মেদিনীপুর (পূর্ব) জেলার তমলুকে কবি বাসুদের ঘোষের সেবা প্রকাশের কাহিনি লিপিবন্ধ রয়েছে। 'বৈষ্ণবাচার্য দর্পণ' এ পাই "গৌরাঙ্গের শাখা তমলুকেতে বসতি"!

প্রাবন্ধিক ড. শ্যামল বেরা কবি হিসেবে বাসুদেব ঘোষকে নিয়ে গভীরভাবে আলোচনা এবং গবেষণা না হওয়ার দুঃখ প্রকাশ করেছেন তাঁর লেখনীতে। তিনি বিনীত প্রস্তাব দিয়েছেন, "সত্যিই তো, যাঁকে আমরা আখ্যা দিয়েছি জেলার ‘আদিকবি' হিসেবে, তাঁর প্রকৃত জন্মস্থান কোথায় সে সম্পর্কে প্রকৃত তথ্য মেলেনি এখনও। তাছাড়া তমলুকের শ্রীপাট নিয়েও কেউ কেউ ছড়িয়েছেন বিভ্রান্তি।" 

  কাটোয়াতে গিয়ে কেশব ভারতীর কাছে ১৫১০ এর ২৫ জানুয়ারি সন্ন্যাস গ্রহণ করেন নিমাই পণ্ডিত। এরপরের দিনই চৈতন্যদেব প্রায় তিন দিন ধরে রাঢ় অঞ্চল ঘুরে বেড়ান। সঙ্গে ছিলেন তিনজন নিত্যানন্দ, মুকুন্দ এবং চন্দ্রশেখর আচার্য (চৈতন্যদেবের মেসো)। ‘রাঢ় দেশে তিন দিন করিলা ভ্রমণ'। মুরারি গুপ্তের কাব্যানুসারে চৈতন্যদেব শান্তিপুরে ফিরে যাত্রা করেন নীলাচলে। এই শান্তিপুরে অদ্বৈতাচার্যের বাড়িতে থাকার সময় শ্রীচৈতন্যের সাথে সাক্ষাত হয় শচীদেবীর। তখন সেই সাক্ষাতের সময় উপস্থিত ছিলেন নবদ্বীপের শ্রীবাস, শ্রীরাম, বিদ্যানিধি, গদাধর, গঙ্গাদাস, বক্রেশ্বর মুরারি, শুক্লাম্বর, বুদ্ধিমন্ত খানের পুত্র, শ্রীধর, বিজয়, বাসুদেব, দামোদর, মুকুন্দ, সঞ্জয়। সবাই মিলে সেদিন নৃত্যগীত করেছিলেন। 

  মহাপ্রভুর অন্যতম ভক্ত কবি বাসুদেব ঘোষ কখন তমলুকে এসেছিলেন? ইন্দুভূষণ অধিকারী মন্তব্য করেছেন— ‘মহাপ্রভুর সঙ্গে এসে এখানেই থেকে গিয়েছিলেন বাসুদেব ঘোষ, তিনিই এখানকার আদিকবি'। ড. সুস্নাত জানা লিখেছেন— ‘বিখ্যাত বৈষ্ণব পদকর্তা বাসুদেব ঘোষ, ১৪৫৫ শকাব্দে চৈতন্যদেব দেহান্তরিত হলে তমলুকে মহাপ্রভুর বাল মূর্তির প্রতিষ্ঠা করে এখানেই বসবাস শুরু করেন।' মালিবুড়োর ‘প্রসঙ্গ মেদিনীপুর’ গ্রন্থেও লেখা হয়েছে '১৪৫৫ শকাব্দে শ্রীচৈতন্যদেবের অন্তর্ধান হলে তিনি শোকাকুল চিত্তে তমলুকে এসে বসবাস করেন এবং বালশ্রীচৈতন্যের মূর্তি স্থাপন করে সেবা পূজায় আত্মনিয়োগ করেন। তমলুকে বাসুদেব ঘোষ প্রতিষ্ঠিত মহাপ্রভুর মন্দির আজও বর্তমান।' 

সলিল মিত্র প্রণীত 'মেদিনীপুরের গৌরব কাহিনি' বইতে বাসুদের ঘোষ সম্পর্কে লেখা হয়েছে বাসুদেব ঘোষ বৈষ্ণব যুগের এক উজ্জ্বল রত্ন বিশেষ। তাঁর পূর্বপুরুষের ভিটে ছিল কুমারহাটে। জীবনের কিছু সময় তাঁর নবদ্বীপে কেটেছে। কিন্তু শ্রীচৈতন্যের সন্ন্যাস গ্রহণের পর তিনি মেদিনীপুরের তমলুকে এসে বসবাস শুরু করেন। বাসুদেব সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছেন এই তমলুকেই।' তরুণদেব ভট্টাচার্য ‘মেদিনীপুর’ গ্রন্থে লিখেছেন - 'চৈতন্যদের সন্ন্যাস নেবার পর বাসুদেব তমলুকে এসে বসবাস করতে থাকেন'। গোপীনন্দন গোস্বামী 'তমলুকে শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য' গ্রন্থে বলেছেন— ‘মহাপ্রভুর অন্তর্ধানের পর বাসুদেব ঘুরতে ঘুরতে এখানে (তমলুকে) মহাপ্রভুর মূর্তি স্থাপন করেন, এটাই জনশ্রুতি।” কিন্তু ‘শ্রীল বাসু ঘোষের শ্রীপাঠ' অনুসারে বলা যায়, শ্রীমন মহাপ্রভুর নির্দেশে শ্রী জগন্নাথ ক্ষেত্র পুরী থেকে শ্রীল বাসুদেব ঘোষ ফিরে আসেন নিত্যানন্দ প্রভু, রামদাস ও ভাই মাধব ঘোষের সঙ্গে।
"প্রভুর আজ্ঞায় নিত্যানন্দ গৌড়ে চলিলা / তাঁর সঙ্গে তিনজন প্রভু আজ্ঞায় আইলা / রামদাস, মাধব আর বাসুদেব ঘোষ / প্রভু সঙ্গে রহে গোবিন্দ পাইয়া সন্তোষ।"

 আবার অন্যত্র পাই ‘শ্রীমান মহাপ্রভু নদীয়া ছাড়িয়া যাইবার পর নদীয়াবাসী ভক্তগনের মনে প্রিয় হারানোর বেদনা জমাট হয়েছিল। বিষণ্ণ পরিবেশে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে শ্রীল বাসুদেব ঘোষ নদীয়াতে আর থাকিতে পারিলেন না। শ্রীল বাসুদেব ঘোষ নবদ্বীপ হইতে দূরে তমলুকে ভজনকুঠী স্থাপন বসতি করিয়াছিলেন। ইহা তমলুকবাসীরও সৌভাগ্য'। ড. শ্যামল বেরার দাবি, তমলুকে কবি বাসুদেব ঘোষ এসেছিলেন শ্রীচৈতন্যের সন্ন্যাসগ্রহণের পর। ১৪৫৫ শকাব্দে অন্তর্ধানের পরে নয়। অর্থাৎ ‘মালীবুড়ো’ যুধিষ্ঠির জানা এবং অধ্যাপক ড. সুস্নাত জানার দেওয়া বাসুদেব ঘোষের তমলুকে আগমন সংক্রান্ত অভিমত মেনে নেওয়া যায় না। সাল তারিখ বিচার করে আমার ধারণা, কবি বাসুদেব ঘোষ কোনও মতেই তমলুকে আসেননি ১৫১৫ খ্রিস্টাব্দের মে মাসের আগে। এ সময় শেষ বারের মতো মহাপ্রভু নীলাচলে যান। আর যখন তিনি আর নীলাচল থেকে ফিরবেন না নদীয়াতে, তখনই দুঃখ ভারাক্রান্ত বাসুদেব ঘোষ ফিরে আসেন নদীয়া থেকে। অনেকের মতে শ্রীচৈতন্যদেবের অদর্শনে তাঁরই পদরেণু ধন্য তমলুকে বসেই গৌরাঙ্গলীলা রচনায় উদ্বুদ্ধ হতে চেয়েছিলেন কবি বাসুদেব ঘোষ। তবে নিশ্চিতভাবে এই বিষয়টি তমলুকের বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে একটি অন্যতম মহাজাগতিক ঘটনা। আমার মনে হয় সে সময় তমলুক এতদঞ্চলের অন্যতম জনপদ ছিল। তাই তমলুককেই বেছে নিয়েছিলেন কবি বাসুদেব ঘোষ। তিনি সম্ভবত যেতে চেয়েছিলেন পুরী। কিন্তু যেতে পারেননি। রয়ে গিয়েছিলেন তমলুকেই। 

 এখানেই তিনি রচনা করেন ‘গৌরাঙ্গ চরিত’, ‘নিমাই সন্ন্যাস' নামে দুটি গ্রন্থ। ভক্তি ভাবের পাঠক রসে ডোবানো এবং জারিত এই গ্রন্থে দুটি বৈষ্ণব সাহিত্যের অন্যতম আকর গ্রন্থ। এ দু’টি ছাড়াও কবি লিখেছেন ‘বাসুদেব ঘোষের কড়চা।’ ১৩২৫ সালে ‘সুবর্ণবণিক সমাচার’-এর প্রথম বর্ষের শ্রাবণ সংখ্যায় ‘একখানি প্রাচীন পুঁথি’ নামে রচনায় সতীশচন্দ্ৰ রায় লিখেছিলেন, ‘বাসুদেবের কাব্য -- ভক্তের রচনা। সুবর্ণবণিকগণ কেন নিত্যানন্দের  মন্ত্রশিষ্য হইয়াছিলেন, এ সকল কথা উক্ত গ্রন্থ পাঠে বিশদরূপে জানিতে পারা যায়। 

  এভাবেই বাসুদেব ঘোষ চালিয়ে যান তাঁর সাহিত্য চর্চা। কিন্তু শ্রীধাম পুরীতে শ্রীমন মহাপ্রভুর অন্তর্ধান সংবাদে বিমর্ষ হয়ে পড়েন কবি বাসুদেব ঘোষ। পরমাত্মীয়ের বিরহ ব্যথায় কবির হৃদয় মোচড় দিয়ে ওঠে। দুঃখ ভারাক্রান্ত কবি এই বিরহ ব্যাথা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য মাটির গভীরে প্রবেশ করে প্রাণ ত্যাগ করার সংকল্প নেন। 'বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্য সংগ্রহ কোষ’-এ শ্রী কিশোরী দাস বাবাজি লিখেছিলেন 'শ্রীমন মহাপ্রভু টোটা গোপীনাথে অন্তর্ধান করিলে গৌর বিরহে শ্রী বাসুদেব ঘোষ সঙ্গীক পট্ট বাঁধিয়া প্ৰাণ ত্যাগ সংকল্প করিলেন।' শ্রী শ্রী শ্যামানন্দ প্রকাশ'তে বলা হয়েছে - 'নিশ্চয় ত্যাজিব প্রাণ সাক্ষাৎ অদর্শনে /  মাটি খোঁড় নিজ দেহ দিব বিসর্জনে।” 

  মালীবুড়ো উল্লেখ করেছেন ‘কিংবদন্তি বলে মহাপ্রভু পুরীতে অন্তর্ধান করলে বাসুদেব ঘোষ আর তাঁর পত্নী শোকে আকুল হয়ে ছুটে চলেন পুরীর উদ্দেশ্যে।' জয়দীপ পণ্ডা লিখেছেন— ‘প্রসঙ্গত বাসুদেব ও তাঁর স্ত্রী মাধবী দাস নিঃসন্তান ছিলেন। স্বপ্নাদেশ পেয়ে ওনারা দু’জনে আর অগ্রসর না হয়ে প্রভুর নির্দেশ মতো শ্রীচৈতন্যদেবের বালকমূর্তি নির্মাণ করে মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। কথিত রয়েছে সেই মূর্তি আজও মন্দিরে পূজিত হয়ে চলেছে।'

  কবি বাসুদেব ঘোষ মহাপ্রভুর মহাপ্রয়াণে বিরহ ব্যাথা থেকে নিষ্কৃতির লক্ষ্যে মাটির গভীরে প্রবেশ করে প্রাণ বিসর্জনের সংকল্প করেছেন। অর্থাৎ তিনি সস্ত্রীক পুরী ছুটে যাননি। যে কোনও একজন ভক্তের পক্ষে তাঁর আরাধ্য দেবতার বিরহে নিজের প্রাণত্যাগ করার সংকল্পই প্রকৃত ভক্তের লক্ষণ। কবি বাসুদেব ঘোষ ছিলেন শ্রীমন মহাপ্রভুর অত্যন্ত নিকটস্থানীয় ভক্ত। তিনি এখানেই প্রাণত্যাগ করার সংকল্পই গ্রহণ করেছিলেন।

  সেই মোতাবেক ভগ্ন হৃদয়ে ভক্ত রচনা করেন মাটির সমাধিক্ষেত্র। তারপর বিরহব্যথায় কাতর সঙ্গীক কবি বাসুদেব ঘোষ চোখে পট্টি বেঁধে প্রবেশ করেন ওই সমাধি ক্ষেত্রে। ব্যথিত চিত্তে ভক্তগণ সে সময় হরিনাম সংকীর্তন করতে করতে মাটি চাপা দেওয়ার কালে দেখতে পেলেন যে বাসুদেব ঘোষ সমাধিমগ্ন হয়েছেন। ফলে সমাধি ভগ্ন না হওয়া পর্যন্ত মাটি চাপা দেওয়ার কাজ বন্ধ রাখা হল। গভীর রাতে বাসুদেব ঘোষের চোখের পট্টি আপনা আপনিই খসে পড়ল। 'শ্রী শ্রী শ্যামানন্দ প্রকাশ' গ্রন্থে বলা আছে, "এরপর বালক নিমাই বেশে শ্রী মহাপ্রভু শ্রী বাসুদেব ঘোষকে দর্শন দিলেন। আর মহাপ্রভুর অঙ্গ স্পর্শে শ্রী বাসুদেব ঘোষ মোহিত হলেন।'' 

 কথিত আছে, সম্পূর্ণ জীবন্ত অবস্থায় বাসুদেব ঘোষকে সমাধিক্ষেত্রে মাটি চাপা দেওয়ার যে ঘটনা ঘটেছিল তারই পরিপ্রেক্ষিতে এই স্থানের নামকরণ হয় 'নরপোতা'। অর্থাৎ ‘নর’ বা ‘মানুষ’ কে পোঁতা বা প্রোথিত করা হয়েছিল যেখানে। তাই আজও তমলুককে বলা হয় ‘নরপোতা” --
‘অদ্যাপিহ নরপোতা সর্বলোকে গায়। / অভয় বরদ দিয়া মহাপ্রভু রয়। / তবে রাত্রে বালরূপ হইয়া আইলা। / পট্ট খুলি দেখ মোরে বলি আজ্ঞা কৈলা। / ঘোষ কহে কহো তুমি তোমা নাম কোন / তবে কহে প্রভু মোর শ্রী নিমাই নাম। / শুনি ঘোষ বলে যদি নিমাই হইবে। / নিশ্চয় মানিব আগে পট খুলি যাবে। / তবে প্রভু ইচ্ছাতে পট খুলি গেলা। / শুইয়া আছেন নিমাই গোড়েতে দেখিলা।'
অবশেষে গৌরাঙ্গলীলার রচনা করতে করতে এখানেই একদিন জীবনাবসান ঘটে। তখন কবি বাসুদেব ঘোষের মৃতদেহ সমাধি দেওয়া হয় এখানে। যেখানে এখন সিদ্ধ বকুল গাছ রয়েছে। 

 কবি বাসুদেব ঘোষ লিখিত পদাবলীর সংখ্যা মোট ২২১ টি। অন্যদের মতে এই পদাবলী সংখ্যাগত দিক থেকে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। প্রবন্ধকার ড. শ্যামল বেরা উল্লেখ করেছেন মালবিকা চাকি তাঁর বাসু ঘোষের পদাবলীতে মোট ২১৮ টি পদ সংকলনের কথা বলেছেন। আবার মালিবুড়ো উল্লেখ করেছেন 'পদকল্পতরুতে তাঁর রচিত একশতটি পদ স্থান লাভ করেছে'। ইন্দুভূষণ অধিকারী বাসুদেব ঘোষ রচিত মোট ১৫৯ টি পদের সন্ধানের খবর দিয়েছেন। শ্রী কিশোরী দাস বাবাজি বাসুদেব ঘোষের ২২১ টি পদাবলীর কথা উল্লেখ করেছেন। 

 কবি বাসুদেব ঘোষের লেখা পদগুলি যেভাবে বিন্যস্ত করা হয়েছে তা এরকম --
(১) শ্রী গৌরাঙ্গ লীলা বিষয়ক – ক) শ্রী নিত্যানন্দ মহিমা, মোট পাঁচটি পদ (১–৫)। খ) শ্রী গৌরাঙ্গ মহিমা, মোট ৬৪টি পদ (৬–৭০)।
২) নবদ্বীপ লীলা বিষয়ক — ক) শ্রী গৌরাঙ্গের আবির্ভাব ও বাল্যলীলা, মোট ১৩টি পদ (৭১–৮৩)।
৩) শ্রীবাস গৃহে অভিষেকাদি নবদ্বীপ লীলা, মোট ৬টি পদ (৮৪–৮৯)
৪) শয়ন লীলা, মোট ৪টি পদ (৯০–৯৩)
৫) ব্রজভাবে শ্রী গৌরাঙ্গের নদীয়া লীলা, মোট ৩৮টি পদ (৯৪–১৩১)।
৬) শ্রী গৌরাঙ্গের সন্ন্যাস ও শান্তিপুরে আগমন, মোট ৪৪টি পদ (১৩২–১৭৫)।
৭) বিষ্ণুপ্রিয়ার দ্বাদশ মাসিক বিরহ, মোট ৪২টি পদ (১৭৬–২১৭)।
এই হল মোট ২১৭টি পদ। এর সাথে যুক্ত হয়েছে কবি বাসুদেব ঘোষ প্রণীত আরও চারটি পদ ‘পরিশিষ্ট’ হিসেবে। সব মিলিয়ে মোট ২২১টি পদ।

আজও গ্রাম বাংলার কীর্তনিয়ারা কবি বাসুদেব ঘোষের পদাবলী গান করেন। কিন্তু গীত রচনায় হয়তো তখনকার গ্রাম বাংলার চরিত্র, সামাজিক, অর্থনৈতিক অবস্থার পরিচয় মেলেনা। কিন্তু বৈষ্ণব ধর্মের নানা দিক প্রস্ফুটিত এখানে। ভক্তিভাবে মজে থাকা মানুষ কীভাবে, কেমনভাবে আরাধ্যকে প্রতিভাত করে তা তাঁর রচনায় সুস্পষ্ট। কবি বাসুদেব ঘোষের পদাবলীতে ভাষা অত্যন্ত সহজ সরল এবং সহজবোধ্য। সে সময়কার ভাষায় প্রভাব প্রকট হলেও যেহেতু তিনি মেদিনীপুরে বসেই লিখেছিলেন, তাই তাঁর পদাবলীতে মেদিনীপুরের ভাষার প্রভাব থাকতে পারে। বিশেষ করে এই জেলায় ভাষার ক্ষেত্রে ওড়িয়া প্রভাব আছেই। তাই কবি বাসুদেব ঘোষের পদাবলী ভাষাতাত্ত্বিকদেরও আলোচনার বিষয়।

  এই কবি বাসুদেব ঘোষের লেখা একটি পদ খেতুরির বিখ্যাত বৈষ্ণব সম্মেলনে গেয়ে শুভারম্ভ হয়েছিল। কবির পদটি গেয়েছিলেন নরোত্তম ঠাকুর, খোল বাজান দেবীদাস, করতাল বাজান গোকুল এবং গৌরাঙ্গ প্রমুখ কীর্তনীয়াগণ। তাঁরা সেদিন গেয়েছিলেন— ‘সখী হে ওই দেখ গোরা কলেবর। / কত চন্দ্র জিনি মুখ সুন্দর অধর। / কবির কর জিনি বাহু সুবলনি। / যজ্ঞন জিনিয়া গোরা নয়ন নাচনি। / চন্দন তিলক শোভে সুচারু কপালে। / আজানুলম্বিত বাহু বনমালা গলে। / কুম্বকন্ঠ পীন পরিসর হিয়া মাঝে। / চন্দনে শোভিত কত রত্নহার সাজে। / রামরম্ভা জিনি ঊরু অরুণ বসন।/ নখমনি তিনি পূর্ণ ইন্দু দরশন। / বাসু ঘোষ বলে গোরা কোথা না আছিল। / যুবতী বধিতে রূপ বিধি সিরজিল।'

  প্রভু শ্যামানন্দ যখন প্রেম প্রচারে তমলুকে গেলেন তখন তিনি দেখেন যে শ্রী গৌরাঙ্গদেব এক সন্ন্যাসীর অত্যাচারে মির্জাপুরে এক ব্রাহ্মণের বাড়িতে রয়েছেন। প্রভু শ্যামানন্দ তমলুকের রাজাকে কৃপা সঞ্চার করে ওই সন্ন্যাসীকে ওই এলাকা থেকে তাড়িয়ে মির্জাপুর থেকে শ্রীমন মহাপ্রভুর মূর্তি এনে তমলুকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট হন। ভক্তগণের ক্রমাগত নামগানের মাধ্যমে শ্রী শ্যামানন্দ প্রভু ও শ্রী রসিকানন্দ প্রভু রাজার লোকজনের সঙ্গে মির্জাপুর থেকে মহাপ্রভুর বিগ্রহ নিয়ে আসেন তমলুকে। তমলুকের রাজা এরপর সেবার জন্য দ্বিগুণ বিত্ত দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন। সেই থেকে শ্রীমন মহাপ্রভুর মূর্তি বাসুদেব ঘোষের শ্রীপাট তমলুকের হরিরবাজার বা নরপোতাতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

2 Comments

  1. খুব ভালো লেখা। অনেক অজানা তথ্য জানা গেল ভাস্করব্রতের লেখায় ।

    ReplyDelete
  2. অপ্রতিম।
    🙏🏻🙏🏻🙏🏻🙏🏻

    ReplyDelete