জ্বলদর্চি

গওহরজান - এক বিস্মৃত অধ্যায়-৭ /দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

গওহরজান - এক বিস্মৃত অধ্যায় 
পর্ব -৭                               

দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী    

বিভিন্ন শিল্পী ও উস্তাদদের কাছে বহুমুখী প্রশিক্ষণ গওহরকে দীর্ঘদিন যাবত ভারতবর্ষের সংগীত মঞ্চে একাধিপত্য বজায় রাখতে সাহায্য করেছিল। লক্ষ্মৌয়ের এক বিখ্যাত লেখক আব্দুল হালিম শারার ১৮৯৬ সালে কলকাতাতে একটি অনুষ্ঠানে গওহরের সঙ্গীত ও নৃত্য দেখে মোহিত হয়ে স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে উল্লেখ করেছিলেন "লক্ষ্মৌয়ের নর্তকীদের চেয়ে আরো নিখুত ভাবে নৃত্যের মাধ্যমে কেউ এমন অভিব্যক্তি দেখাতে পারেন এটা তাঁর কল্পনাতেও ছিল না। সেই অনুষ্ঠানে পুরো তিন ঘন্টা ধরে গওহরের 'বাতানা' বিষয়ে নৃত্যানুষ্ঠান উপস্থিত প্রত্যেক নৃত্য শিল্পী ও সঙ্গীত বোদ্ধাদের মুগ্ধ করেছিল"। গওহরজানের অনুষ্ঠানের খ্যাতি কলকাতার সীমারেখা অতিক্রম করে ভারতবর্ষের উত্তর দক্ষিণ ও পশ্চিম প্রান্তেও ছড়িয়ে পড়েছিল। কলকাতার এক অনুষ্ঠানে মহীশূরের সঙ্গীত রসিক মহারাজা চামরাজেন্দ্র ওয়াদেইয়ার গওহরজানের সঙ্গীত প্রতিভা দেখে তাঁকে মহীশূর রাজদরবারে অনুষ্ঠানের জন্য আমন্ত্রণ জানান। গওহরজান মহারাজের আমন্ত্রণ রক্ষার্থে মহীশূর রাজদরবারে তার সংগীত ও নৃত্যের ঝলক দেখিয়ে সেখানকার দর্শকদের মুগ্ধ করেছিলেন। রাজদরবারে তাঁকে বিশেষ রাজকীয় সম্মান ও পুরস্কার দিয়ে পুনরায় অনুষ্ঠান করার আমন্ত্রণ দেওয়া হয়েছিল। মহীশূর শহরের জন্মদিন পালনের উৎসব 'বর্ধন্তি' এবং দশেরা অনুষ্ঠানের সময় তিনি যেয়ে দর্শকদের আনন্দ দান করতেন। বিভিন্ন সময়ে মহীশূরে যেয়ে এই শহর ও দর্শকদের প্রেমের বন্ধনে এমনিই আবদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন যে ভাগ্যের পরিহাসে গওহরের শেষ জীবন সেখানেই কেটে ছিল। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। 
                                                                

প্রেম ও ভালবাসার ক্ষেত্রে প্রথম জীবন থেকে বঞ্চিত হয়ে গওহরের বুভুক্ষ হৃদয় তারপরেও ঘাত-প্রতিঘাত শূন্য ছিল না। বিভিন্ন সময়ে তার সাথে অনেকের প্রেম হয়েছিল কিন্তু তাদের কোনোটিই চিরস্থায়ী হয়নি। ভালবাসার কাঙ্গাল গওহর জীবনে কোন একজনকে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিলেন কিন্তু প্রত্যেকেই একটা সময়ে তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। তার মত মেয়েরা বিত্তবান পুরুষদের কাছে দামি খেলনা মাত্র। মূল্যবান উপহার দিয়ে দুর্বল মুহূর্তে জীবন যৌবন লুঠ করে আইনি স্বীকৃতি দিতে দ্বিধাগ্রস্ত হতেন এই সব পুরুষেরা। সমাজে তাদের প্রতিপত্তি ও অর্থের জন্য সেই সমস্ত পুরুষদের এই সমস্ত অবৈধ সম্পর্ক নিয়ে কেউ মুখ খুলতেন না।একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন গুজরাটি ও মারাঠি নাটকের সুদর্শন নায়ক অমৃত কেশব নায়েক। এর পরে গওহরের জীবনের সেই ঘটনাগুলি ক্রমান্বয়ে ব্যক্ত করছি।    

যে সময়ে গওহর তার প্রতিভা ও দক্ষতায় পুনরায় শান দিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করেছিলেন এবং আরো অসংখ্য শিল্পীদের থেকে জ্ঞান আহরণ করে নিজস্ব গায়কিরীতি এবং ব্যতিক্রমী পরিচিতি গড়ে তোলার চেষ্টা করছিলেন জীবনের সেই সময়ে বহরমপুরের ধনী জমিদার নিমাই সেনের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন। প্রেমের সূত্রপাত হয়েছিল মুর্শিদাবাদের হাজারদুয়ারীতে একটা অনুষ্ঠান করার সময়ে, সুদর্শন নিমাই সেনকে দেখে গওহর তার প্রেমে পড়েন। নিমাই সেনও সংগীতের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন। সেখানেই অনুষ্ঠানের শেষে নিমাইয়ের প্রস্তাব মত গওহর নিমাইয়ের দেশের বাড়ি বহরমপুরে একটি অনুষ্ঠান করতে যান এবং সেখানে কিছু অসাধারন মুহুর্ত কাটিয়েছিলেন। সোনা ও হাতির দাঁতের অত্যন্ত দামী দামী উপহারের থেকেও নিমাইয়ের সান্নিধ্য গওহর বেশি করে উপভোগ করেছিলেন। প্রেমিকাকে খুশী করার জন্য গওহরকে নিয়ে কলকাতায় আসার পরে জমিদার নিমাই সেন গওহরকে একটি কালো ঘোড়া কিনে দিয়েছিলেন যে ঘোড়াটি ছিল তাদের প্রেমের মত উদ্দাম। বহরমপুরে থাকাকালীন গওহরের একদিন খুব মাথার যন্ত্রণা হয়। শোনা যায় তার সম্পত্তির বহির্প্রকাশ ও গওহরের প্রতি প্রেমের নিদর্শন স্বরূপ নিমাই টাকার বান্ডিল আগুনে পুড়িয়ে গওহরের জন্য চা তৈরি করে দিয়েছিলেন। নিমাইয়ের কাছ থেকে গভীর ভালোবাসা পেয়ে গওহর তার জীবনে 'নথ উতরাই' অনুষ্ঠানে যে হীরের নাকছাবি পেয়েছিলেন সেইটি প্রেমের প্রতিদান হিসেবে নিমাইকে দিয়ে তার 'নথ উতরনি' বা কৌমার্য বিসর্জন দিয়েছিলেন।            

বহু বছর পরে নিমাই সেন যখন বহরমপুরে মৃত্যুশয্যায় সেই সংবাদ শুনে গওহর হৃদয়ের গভীরে ভালোবাসার টান অনুভব করে কলকাতা থেকে সোজা বহরমপুরে যান কিন্তু তিনি পৌঁছানোর পূর্বেই নিমাই সেন মারা যান। মারা যাবার পূর্বে সেই হীরের নাকছাবিটি নিমাই তার এক পরিচারিকাকে দিয়ে বলেছিলেন যে গওহর যদি কোনদিন ফিরে আসেন তাহলে তাকে নাকছাবিটি ফেরত দেওয়ার জন্য। গওহরের যেমন নিমাইয়ের প্রতি আকর্ষণ ছিল তেমনি নিমাইও গওহরকে কোনদিন ভুলতে পারেননি। পারিবারিক শিষ্টাচার ও সামাজিকতার ভয়ে গওহরকে স্ত্রীর মর্যাদা দিতে পারেননি কিন্তু তিনি নিশ্চিন্ত ছিলেন একদিন তাঁর কাছে গওহর ফিরে আসবেন। পরিচারিকা গওহরকে নাকছাবিটি ফেরত দিতে গওহর আকুলভাবে নিমাইয়ের শোকে কেঁদেছিলেন এবং সেই শোক ভুলতে তাঁর কয়েক মাস সময় লেগেছিল।       

পূর্বেই উল্লেখ করেছি গওহর ছিল ভালোবাসার কাঙাল। শৈশবেব সে পিতার আদর পায়নি। তার ১৩ বছর বয়সে পালক পিতা খুরশিদের মৃত্যু তাকে খুব মানসিক যন্ত্রণা দিয়েছিল। এরপরে যখন সে অর্থ, সম্মান পেতে শুরু করেছিল তখন তার হৃদয় এমন একজন মানুষকে খোঁজার চেষ্টা করেছিল যার কাছে সে আত্মসমর্পণ করতে পারে। কিন্তু এখানেও সে প্রতারিত হলো। নিমাই যদিও তাকে রানীর মত রেখেছিলেন কিন্তু সমাজ সংস্কারের ভয়ে তাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিতে পারেননি। যার ফলে গওহর সেখান থেকেও বেরিয়ে এসেছিলেন, কিন্তু মন প্রাণ তাকে সমর্পন করেছিলেন সেই জন্য তিনি নিমাইয়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে তাকে শেষ দেখা দেখতে গিয়েছিলেন।                           

ইতিমধ্যে তাঁর বয়স ২৭ বৎসর অতিক্রম করেছে। এই সময়ে এদেশে গ্রামোফোন কোম্পানির আগমনের সূত্র ধরেই গওহরের সাঙ্গীতিক প্রতিভা তার সৌন্দর্য ও ব্যক্তিত্বের সাথে সামঞ্জস্য রেখে চারিদিকে সৌরভ ছড়িয়ে ছিল। ভারতবর্ষের ভিতরে ও বাইরে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে তাঁর সাঙ্গীতিক প্রতিভা ছড়িয়ে পড়েছিল। গ্রামোফোন কোম্পানির রেকর্ডিংয়ে তাঁর পারিশ্রমিক ছিল সর্বোচ্চ, তখনকার দিনে ৩০০০ টাকা। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁর গাওয়া গানের রেকর্ডগুলি বাজারে আসা মাত্র নিমেষে সব বিক্রি হয়ে যেত। ১৯৪০ সাল পর্যন্ত তাঁর গাওয়া বিভিন্ন ভাষায় গানের সবোর্চ্চ রেকর্ড তাঁকে 'সেলিব্রিটি' পর্যায়ে উন্নীত করেছিল যা হয়তো তিনি নিজেও আশা করেননি।      
                                                               ক্রমশঃ…….

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments