জ্বলদর্চি

কেজিএফ চ্যাপ্টার ২ – ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ উদযাপনের উৎসব /রাকেশ সিংহ দেব

কেজিএফ চ্যাপ্টার ২ – ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ উদযাপনের উৎসব
 
রাকেশ সিংহ দেব

অভিনয় – যশ, সঞ্জয় দত্ত, রবিনা ট্যান্ডন, সুনিধি শেট্টি, প্রকাশ রাজ, রাও রমেশ। 
পরিচালনা – প্রশান্ত নীল
মুক্তি – ১৪ এপ্রিল ২০২২

রেটিং – 5/5

উৎসবের সংজ্ঞা কি ? কাতারে কাতারে মানুষ যখন প্রাণখোলা আনন্দে সমবেত হয়ে জীবনকে উদযাপন করে সেটাই তো উৎসব। সেই অর্থে প্রেক্ষাগৃহের পর্দায় মনস্টার রকি ভাই এর প্রত্যাবর্তণ আসমুদ্র হিমালয়ে উদযাপনের বন্যা বইয়ে দিয়েছে। দর্শকদের দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে মুক্তি পেয়েছে তার দ্বিতীয় অধ্যায় ‘কে জি এফ চ্যাপ্টার-২’। মূলত যারা অ্যাকশন সিনেমা দেখতে ভালবাসেন, তাদের জন্যই তৈরি পরিচালক প্রশান্ত নীলের এ সিনেমা। অ্যাকশন ছবির ভক্ত দর্শকদের জন্যে এমন দেশি স্টাইলের পাওয়ার প্যাকড অ্যাকশন মুভি খুব কমই হয়েছে। শুধুমাত্র অ্যাকশনের জন্যই এ ছবি দেখা যায়। এবং অতি অবশ্যই, বাস্তবের যুক্তিগুলিকে দূরে সরিয়েই এই মুভি দেখা উচিত।  কন্নড় সিনেমার সুপারস্টার নবীন কুমার গৌড়া ওরফে যশ অভিনীত রকি চরিত্রের সঙ্গে ‘কেজিএফ চ্যাপ্টার ১’ ছবিতেই দর্শকদের পরিচয় হয়েছিল। ‘কেজিএফ চ্যাপ্টার ১ মুভিতেই KGF-এর উপর রাজত্ব বিস্তার করতে সফল হয়েছে রকি। এবার আরও বড় স্বপ্ন তাড়া করে বেড়াচ্ছে সে। 

  কেজিএফের ফ্ল্যাশব্যাক থেকেই কেজিএফ-টুয়ের কাহিনি শুরু হয়েছে। ছোটবেলায় মাকে কথা দিয়েছিল রকি, একদিন পৃথিবীর সব সোনা সে তার মাকে এনে দেবে। সেই প্রতিজ্ঞা রাখতেই রকি কেজিএফের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিয়ে আসে।  কেজিএফ-এর কাহিনি যিনি লিপিবদ্ধ করেছিলেন, সেই আনন্দ ইঙ্গালগির স্ট্রোক হওয়ার দরুন তিনি আই সি ইউ তে শয্যাশায়ী।  কাহিনিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব নিতে হল আনন্দের ছেলে বিজয়েন্দ্রকে। আনন্দের লাইব্রেরি তন্নতন্ন করে খুঁজে বের করা হল 'কেজিএফ-চ্যাপ্টার টু'র পাণ্ডুলিপি। শুরু হল নতুন পর্ব।


  গরুড়াকে মারার পর কেজিএফ ওরফে কোলার গোল্ড ফিল্ডের অধিকার নিয়ে ফেলেছে রকি। এতে বাকি পার্টনাররা মোটেও খুশি নয়। তাতে অবশ্য কিছু এসে যায় না রকির। সোনার খনির সাম্রাজ্যে তার আধিপত্য বাড়তেই থাকে। কে জি এফের মধ্যে আরও নতুন সোনার খনিরও সন্ধান পায় সে। রকি দ্রুত সেই সোনা বের করে ফেলতে চায়। এদিকে সোনার এই সাম্রাজ্যের পৈতৃক অধিকার ফিরে পেতেই আসে অধীরা (সঞ্জয় দত্ত) । এদিকে রকির সাম্রাজ্য ধ্বংস করতে মরিয়া দেশের প্রধানমন্ত্রী রমিকা সেনও (রবিনা ট্যান্ডন)। 

  বাকি কাহিনি চেনা ছন্দে এগোলেও প্রতি পদে টুইস্ট অ্যান্ড টার্ন অক্ষত রেখেছেন পরিচালক। যশের অভিনয়ে শক্তির আস্ফালন বেশ ভালভাবেই দেখা গিয়েছে। ‘খলনায়ক’ হিসেবে সঞ্জয় দত্ত বরাবরই নিজের সেরাটা দিয়ে থাকেন। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। রবিনা ট্যান্ডন নিজের চরিত্র চাহিদা মেনে অভিনয় করেছেন। এই মুভিতে দেখানো হয়েছে কে জি এফ চ্যাপ্টার-১ এ গরুড়াকে রকির সামনে বাধার পাহাড়ের মতো মনে হয়েছিল দর্শকদের। এই মুভিতে জানা যায় গরুড়া ছিল হিমশৈলের ছোট চূড়া মাত্র। এই ছবিতে রকির ইমোশনাল দিকেরও ঝলক পান দর্শকরা। রকির  চরিত্র নির্মাণে যে সূক্ষ্ণ বিষয়গুলিতে নজর রাখা হয়েছে, তার জেরেই আমজনতার বিপুল ভালবাসা কুড়িয়েছে ছবিটি। রকি অপরাধ জগতের মানুষ হয়েও মহিলাদের প্রতি সে শ্রদ্ধাশীল। মায়ের প্রতি তার অগাধ ভালবাসা। নিজের মদ্যপ বাবাকে তার অজান্তেই মায়ের সমাধির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দিয়ে সে বুকের ভার হাল্কা করার চেষ্টা করে। ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও সে রমিকা সেনের কোনও ক্ষতি করে না। বরং নিজের মৃত্যুবাণ নিজেই যেন তুলে দেয় তাঁর হাতে। চরিত্রের এই গুণগুলোই অন্ধকার জগতের রকিকে মনুষ্যত্বের আলোয় আলোকিত করে রাখে। এই ছবির অন্যতম সেরা শট সঞ্জয় দত্তের এন্ট্রি সিন। মুহূর্তের মধ্যে পর্দায় যেন ম্যাজিক হয়ে গেল। প্রধানমন্ত্রীর চরিত্রে ভালোই করেছেন রবিনা ট্যান্ডন । এই ছবির আরও এক প্রাপ্তি প্রকাশ রাজের ব্যারিটোনে ছবির ন্যারেশন। সিবিআই অফিসার রাঘবনের চরিত্রে দুরন্ত অভিনয় করেছেন রাও রমেশ। তবে বলতেই হয়, এই ছবি রকি ভাইয়ের ছবি। রকির চরিত্রের উচ্চতা, ব্যপ্তি এতটাই যে অন্যান্য চরিত্রগুলি তার চরিত্রের ছায়ায় কিছুটা হলেও ঢাকা পড়ে যায়। পরিচালক প্রশান্ত নীল অত্যন্ত যত্ন নিয়ে ছবিটির কাহিনি লিখেছেন। আর বলতেই হয়, সেট ডিজাইন থেকে ছবির কালারটোন, সবেতেই একটা নিজস্বতার ছাপ রেখেছে এই ছবি। রবি বাসরুর সঙ্গীত পরিচালনায় এই ছবির গান, থিম সং এবং আবহসঙ্গীত দুর্দান্ত। ভুবন গোডার সিনেম্যাটোগ্রাফিও অসাধারণ। কেজিএফ চ্যাপ্টার ওয়ানেও তিনিই সিনেম্যাটোগ্রাফির দায়িত্ব সামলেছিলেন। যশের মুখে অসাধারণ সব সংলাপ বসিয়েছেন এম চন্দ্রমৌলি। দুর্দান্ত সব পাওয়ারফুল সংলাপ এই মুভির প্রাণ। 

  গোটা ছবিতে একটা ভিন্ন সিনেম্যাটিক টোন ব্যবহার করেছেন সিনেম্যাটোগ্রাফার ভুবন গৌড়া। তাতে সুবিধাও রয়েছে। একটি দৃশ্যে যেভাবে ব্ল্যাক কাট ব্যবহার করে অ্যাকশনের দৃশ্য দেখানো হয়েছে, তা সত্যিই মুগ্ধ করে। কিছু জায়গায় জর্জ মিলারের ‘ম্যাড ম্যাক্স’ সিনেমার সিরিজের প্রভাবও দেখা গিয়েছে। লার্জার দ্যান লাইফ সিনেমা তৈরি করাতে দাক্ষিণাত্যের জুড়ি মেলা ভার। এই ভিন্ন মেজাজই ক্রমে বলিউডের বিপদ হয়ে উঠছে। প্যান ইন্ডিয়া সিনেমার যে নতুন ঢেউ সারা দেশ জুড়ে শুরু হয়েছে, তা অদূর ভবিষ্যতে আরও উঁচু হবে বলেই মনে হচ্ছে। গোটা ভারতীয় সিনেমার ক্ষেত্রে এক নতুন অধ্যায় শুরু হতেই পারে। ‘কেজিএফ চ্যাপ্টার ২’ সিনেমার রকির ভাষায় যদি বলতে হয়, তাহলে বলিউডের ‘গ্যাংস্টার’দের ছাপিয়ে যাচ্ছে দক্ষিণী সিনেমার ‘মনস্টার’রা। মুক্তির দুই সপ্তাহের মধ্যে হাজার কোটি টাকার ব্যবসা সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে। 'কেজিএফ চ্যাপ্টার টু' শেষ হওয়ার পর একটি অসামান্য মিড ক্রেডিট সিন রয়েছে যা দেখে হল থেকে একথাই ভাবতে ভাবতে বেরোতে হয় যে চ্যাপ্টার থ্রি’র জন্য আর কতদিন অপেক্ষা করতে হবে? কে জি এফ চ্যাপ্টার -৩ রিলিজের দিন আবার আসমুদ্র হিমালয় জুড়ে হবে উৎসবের আবাহন এবিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। 

রেটিং
5 – অসাধারণ
4 – বেশ ভালো
3 – ভালো
2 – দেখতে পারেন
1 – না দেখলেও চলবে

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments