জ্বলদর্চি

অশ্বত্থনারায়ণ /ভাস্করব্রত পতি

পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব -- ১৯

অশ্বত্থনারায়ণ

ভাস্করব্রত পতি

"চাকুন্দে সুন্দরী ছিল শ্যাম পণ্ডিতের ঝি, 
খেতে তার সাধ হলো পান্তা ভাতে ঘি। 
কর্তা বলে, গিন্নী ওগো একি তব আশা, 
অশ্বত্থপাতা ব্রতে তব মিটিবে পিপাসা। 
সাত বোন যায় সাত ঘোড়ায় চড়ে, 
সাত বউ যায় সাত দোলাতে মনের সাধ ভরে, 
কর্তা যান হাসি মুখে হাতির উপরে, 
গিন্নী যান রত্ন সিংহাসনে হর্ষ ভরে।।"

  নাম, যশ, অর্থ, পরিবার, পরিজন সব কিছুই যেন অশ্বত্থ গাছের মতো চিরজীবী, দীর্ঘায়ু এবং অক্ষয় অমর হয়ে ওঠে এই ভাবনায় কেবলমাত্র কুমারী মেয়েরাই পালন করে এক অনন্য লৌকিক উৎসব "অশ্বত্থনারায়ণ" বা "অশ্বত্থপাতা ব্রত"। এটি মূলতঃ একপ্রকার বৃক্ষ বন্দনা উৎসব। যা করলে সুসন্তান লাভ, ধনসম্পদের যোগান বৃদ্ধি, বৈধব্যযন্ত্রনা থেকে মুক্তি, স্বস্তি ও শান্তি আনয়ন, সুখ ঐশ্বর্য প্রাপ্তি হয়। পুণ্য অর্জনের পাশাপাশি তাঁদের আর্তি থাকে পৃথিবীর বুকে বর্ষিত হোক বৃষ্টির ধারা। বৈশাখের তীব্র দাবদাহের অবসান ঘটুক শীতল বারিধারার বর্ষনে। এতে একদিকে যেমন রুক্ষতার অবসান ঘটবে তেমনি পরিবেশ প্রকৃতিও প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাবে। বৃষ্টির আগমনে ধরিত্রী হয়ে উঠবে চাষের উপযুক্ত এবং চারিদিক হয়ে উঠবে শষ্য শ্যামলা। বৈশাখ মাস জুড়ে চলে এই গ্রামীন লোকাচারটির পরিস্ফুটন। পরপর চার বছর ধরে এটি পালন করলে ফললাভ হয় বলে বিশ্বাস। গ্রামীণ বাংলার এক লুপ্তপ্রায় মেয়েলী উৎসব এটি।

  অশ্বত্থনারায়ণ ব্রতের মূল উপকরণ হল ৫ টি অশ্বত্থ পাতা। এর মধ্যে ১ টি পাকা পাতা, ১ টি কাঁচা পাতা, ১ টি কচি পাতা, ১ টি শুকনো পাতা এবং ১ টি ঝুরঝুরে ছেঁড়া পাতা রাখতে হয়। এরকম পাঁচ ধরনের অশ্বত্থ পাতা মাথায় নিয়ে ব্রতিনী প্রতিদিন সকালে পুকুরে গিয়ে পাঁচবার ডুব দেয়। এরপর পুকুর থেকে ভেজা গায়ে উঠে এসে অশ্বখ গাছের গোড়ায় এক ঘটি জল ঢেলে প্রনাম করে আর এই ছড়া আওড়ায় -- 
"পাকা পাতাটি মাথায় দিলে / পাকা চুলে সিন্দুর পরে। / কাঁচা পাতাটি মাথায় দিলে / কাঞ্চন মূর্তি হয়। / কচি পাতাটি মাথায় দিলে / নব কুমার কোলে হয়। / শুকনো পাতাটি মাথায় দিলে / সুখ-ঐশ্বর্য বৃদ্ধি হয়। / ঝুরঝুরে পাতাটি মাথায় দিলে / হীরে মুক্তোর ঝুরি পায়। / উজাইতে পারিলে ইন্দ্রের শচী হয়। / না পারিলে ভগবানের দাসী হয়। / সুখ হয়, সম্পদ হয়, স্বস্তি হয়। /  সাত ভাইএর বোন হয়।"

  সুন্দর স্বামী পাওয়ার পাশাপাশি কপালের সিঁদুর যাতে চির ভাস্বর হয়ে থাকে তার কামনায় উপরোক্ত এই ছড়াটি অন্যত্র এভাবে উচ্চারিত হয় --
"অশ্বত্থ অশ্বত্থ নারায়ণ / তুমি বিষ্ণু মহেশ্বর। / তোমার শিরে ঢালি জল / থাকতে থাকতে পাই ফল। / অশ্বত্থপাতা, কুঞ্জলতা, শ্যাম পণ্ডিতের ঝি, সাকারা সুন্দরী / সাত বৌ যায় সাত দোলাতে, সাত বেটা যায় সাত ঘোড়াতে / কৰ্ত্তা যান গজহস্তীতে, গিন্নী যান রত্ন সিংহাসনে, / ঠাকুর ঠাকরুণ যান দোলনে। / কাঁচা পাতাটি মাথায় দিলে, কাঁচা সোনার বর্ণ হয়। / শুকনো পাতাটি মাথায় দিলে, সুখ-সমৃদ্ধি বৃদ্ধি পায়। / ঝুরঝুরে পাতাটি মাথায় দিলে, মণিমুক্তার ঝুরি পায়। / পাকা পাতাটি মাথায় দিলে, পাকা চুলে সিন্দুর পরে। / কচি পাতাটি মাথায় দিলে, কমলসম পুত্র কোলে পায়।"

কিন্তু কুমারীরা এই উৎসবে তথা ব্রত পালনে অশ্বত্থপাতা কেন বেছে নিয়েছে? তার পেছনে নিশ্চয়ই কোনো কারণ রয়েছে। বলা হয়ে থাকে যে, অশ্বত্থ বিষ্ণুরূপী ধর্মীয় বৃক্ষ। ধর্মীয় বা রিলিজিয়াস ব্যাপার এই গাছের সাথে জড়িত। তাই ল্যাটিন নামেও তার ছোঁয়া — Ficus religiosa। বহুকাল আগে থেকেই বিভিন্ন ধর্মের সংস্কৃতির সাথে জড়িয়ে আছে এই বৃক্ষের নাম। কথিত আছে অশ্বত্থ গাছের পূজা করলে শনিদেব প্রসন্ন হন। আসলে একসময় কথভ নামে এক অসুরকে হত্যা করে দেবতাদের বাঁচিয়ে ছিলেন শনিদেব। যাঁরা অশ্বত্থ গাছের পূজা করত তাঁদের এই কথভ ছাড়তোনা।

  অশ্বত্থ গাছের তলে শাক্যমুনি বােধিলাভ করেন। তাই এটি 'বোধিবৃক্ষ'। এই গাছ পরিচিত বোধিবৃক্ষ, বোধিদ্রুম, Bo Tree, Bo, Bawdir, Bodhi Tree, Holy Tree ইত্যাদি নামেও। সংস্কৃতে 'বোধি'র অর্থ 'জ্ঞান'। এটি সিংহলীতে বিবর্তিত হয়ে 'বো' হয়েছে। হিন্দিতে পিপল বা পিপুল (গীতায় শ্রীকৃষ্ণের কথা, "আমি গাছের মধ্যে পিপুল, ঋষিদের মধ্যে নারদ, গান্ধারদের মধ্যে চিত্ররথ এবং সিদ্ধপুরুষদের মধ্যে ঋষি কপিল।") বলে।

  ইতিহাস বলে, ২৮৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে শ্রীলঙ্কা এবং তারপরে ফিলিপিন্স ও সিঙ্গাপুর সহ অন্যান্য এশীয় দেশে এ বেড়ে উঠেছিল। শ্রীলঙ্কার অনুরাধাপুরে থাকা পিপুল গাছটি 'জয়া শ্রী মহাবোধী' ২২৫০ বছরেরও বেশি প্রাচীন। বলা হয়ে থাকে যে এটিই বিশ্বের প্রাচীনতম ধর্মীয় গুরুত্বসমৃদ্ধ বৃক্ষ। তবে সব অশ্বত্থ কিন্তু বোধিবৃক্ষ নয়। বুদ্ধদেব কেবলমাত্র যে অশ্বত্থ বৃক্ষের নিচে বোধিলাভ করেন কেবল সেই বৃক্ষের বংশধরদেরকেই বোধিবৃক্ষ বলে। অশ্বত্থ গাছ একটি অত্যন্ত পবিত্র গাছ বলে বিবেচিত। হিন্দুধর্ম অনুসারে যে ২৭ ধরনের গাছ ২৭ টি নক্ষত্রকে প্রতিনিধিত্ব করে তাদের মধ্যে পুষ্যা নক্ষত্রের প্রতিনিধিত্ব করে এই অশ্বত্থ‌। তাই এই গাছের তলায় ধ্যান করেন মুনিঋষিরা। আর এই গাছকে প্রদক্ষিণ করলে মেলে পুণ্যফল। তাই সেই বিশ্বাস থেকে অনেকেই সাতবার প্রদক্ষিণ করেন। অনেক স্থানে প্রতিদিন অশ্বত্থতলায় সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালানো হয়।

  অশ্বত্থের উৎপত্তি নিয়ে পুরাণে দুখানা কাহিনীর সন্ধান মেলে। একদিন যখন শিব ও পার্বতী নির্জনে নিভৃতে রসালাপে ব্যস্ত ছিলেন তখন দেবতাদের আদেশে সেখানে অগ্নি চলে আসে। এতে পার্বতী ভয়ানক কুপিত হয়ে সকল দেবতাদের অভিশাপ দিয়ে বৃক্ষযোনিতে রূপান্তরিত করে দেন। এরপরেই বিষ্ণু অশ্বত্থ বৃক্ষ হয়ে জন্মান। আরেকটি কাহিনী এরকম -- ব্রহ্মার বরে অত্যাচারী জলন্ধর ইন্দ্রকে স্বর্গচ্যুত করলে সকল দেবতা মহাদেবের শরণাপন্ন হন। তখন দেবাদিদেব মহাদেব জলন্ধরকে হত্যার উদ্যোগ নিলে জলন্ধরের স্ত্রী তথা কালনেমির কন্যা বৃন্দা স্বামীকে বাঁচাতে বিষ্ণুপূজা শুরু করেন। এদিকে বিষ্ণু জলন্ধরের রূপ ধরে বৃন্দার সামনে এলে বৃন্দা ভেবে নেয় যে তাঁর স্বামী জলন্ধর ফিরে এসেছে। তখন সে পূজা বন্ধ করে দেয়। আর তৎক্ষণাৎ জলন্ধরের মৃত্যু হয়। বিষ্ণুর এই ছলনায় ব্যাথিত হয়ে বিষ্ণুকে শাপ দেওয়ার জন্য উদ্যত হয় বৃন্দা। তখন বিষ্ণু তাঁকে সহমরণে যেতে বলেন। সেইসাথে বৃন্দাকে বরদান করেন এই বলে যে বৃন্দার চিতাভস্মের থেকে তুলসী, ধাত্রী, পলাশ ও অশ্বত্থ― এই চার বৃক্ষের জন্ম হবে পৃথিবীতে।

  যদিও ক্ষীরদ্রুম, গুহ্যপুষ্প, শ্রীমান, অচ্যুতবাস, চলপত্র, পবিত্রক, মাঙ্গল্য, ধর্মবৃক্ষ, চৈতদ্রুম, শুচিদ্রুম, বিপ্রসেব্য, শ্যামল, সত্য নামেও পরিচিত অশ্বথ গাছ। সংস্কৃতে একে বলে গজভক্ষ, পিপুল, ক্ষীরদ্রুম। গুজরাটিতে জেরি, সাঁওতালিতে হেসাক, তামিলে অর্শেমরম নামেও ডাকা হয়। 'মোরেসী' পরিবারভুক্ত অশ্বত্থের আদি বাসস্থান ভারত, চিন সহ নেপাল, মায়ানমার, শ্রীলঙ্কা, লাওস, আন্দামান, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড এবং বাংলাদেশ।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments