জ্বলদর্চি

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম-৫১/সন্দীপ কাঞ্জিলাল

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম 
পর্ব-৫১
সন্দীপ কাঞ্জিলাল

ভারতবর্ষ ও ধর্ম

উপযুক্ত ব্যাক্তিগণ সদা সত্ত্বগুণাশ্রয়ী। এর বাইরের ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য নিরূপণে উপদেবতাদের নাম ব্যবহার করা হয়েছে। এই ব্যাক্তিগণ হলেন: 

১। অসুরসত্ত্ব শ্রেণীর ব্যক্তি শারীরিক শক্তিমত্ত, ক্রোধপরায়ণ অহংকারপ্রমত্ত, ঔদরিক এবং অর্থলোলুপ;
২। রাক্ষসসত্ত্ব শ্রেণীর ব্যক্তি প্রতিহিংসাপরায়ণ, আগ্রাসী মনোভাবাপন্ন নিষ্ঠুর আমিষ-ভোজনবিলাসী, পরিশ্রমী হলেও নিদ্রালস জীবনে যত্নবান;
৩। পৈশাচিকসত্ত্ব শ্রেণীর ব্যক্তি অলস, অপরিচ্ছন্ন স্বভাব-ভীরু ও ইন্দ্রিয়পরায়ণ। 
৪। সর্পসত্ত্বাধিকারী ব্যক্তি ভয়ংকর ক্রোধী, বিশেষ অবস্থায় কাপুরুষ, কুমন্ত্রণাদানে উৎসাহী, কুঅভ্যাসের দাস ও অত্যন্ত ইন্দ্রিয়পরায়ণ; 
৫। প্রৈত্যসত্ত্ব শ্রেণীর ব্যাক্তি খাদ্যরসিক, দুর্মুখ, কর্কশ ঈর্ষাপরায়ণ অসহিষ্ণু অবিবেকী লোভী আলস্যপরায়ণ;
৬। শকুনসত্ত্ব শ্রেণীর ব্যক্তি ভোজনবিলাসী ইন্দ্রিয়পরায়ণ অস্থিরচিত্ত নির্মম স্বভাব এবং অমিতব্যয়ী; 
এছাড়াও পশুদের উপমা সহকারে অন্যশ্রেণির ব্যক্তিরা হলেন: 
১। পাশবসত্ত্ব শ্রেণীভূক্ত ব্যাক্তিদের নোংরা পোশাক-পরিচ্ছদ, অমানবিক, সর্বদা ইন্দ্রিয়সম্ভোগে লিপ্ত, নিদ্রাতুর নিরুৎসাহী, নেতিবাচক মানসিকতায় পূর্ণ; 
২। মৎস্যসত্ত্ব শ্রেণীর ব্যক্তিগণ ভীরু বোকা উদরপরায়ণ অস্থিরমতি সহজেই ক্রোধাক্রান্ত ইন্দ্রিয়পরায়ণ এবং ভ্রমণবিলাসী; 
৩। বানস্পত্যসত্ত্ব শ্রেণীর ব্যক্তিগণ নিরামিষাশী, অকর্মণ্য সর্বদা খাই খাই স্বভাব এবং বিচারবুদ্ধি যুক্ত কাজে অসম্ভব নির্লিপ্ত। 

  মানুষের স্বভাবগত আচরণগত বিষয়গুলির নিরিখে মানুষকে বিচার করার উপযুক্ত নিদর্শনগুলি থেকে এই সত্য প্রতীয়মান- মানুষ স্বাতন্ত্র্যে  কখনও উজ্জল, কখনও অনুজ্জ্বল। গুণগত বিচারে সে কখনও সদগুণ কখনো বদগুণের অধিকারী। আবার বিশিষ্টভাবে এই মানুষই সর্বগুণান্বিত সবদিকে শ্রেষ্ঠতায় ঐশ্বর্যময়। যে কোন দেশেই নানা গুণসম্পন্ন মানুষ রয়েছে। ভারতীয় মানুষের আবির্ভাবের পেছনে রয়েছে বহুজাতি ও ধর্মের মানুষের আত্মীকরণের ইতিহাস। বহু বিবর্তনের মধ্য দিয়ে এই ভারতীয় মানুষের আবির্ভাব ঘটেছিল বৈদিক যুগের শেষের দিকে। পরম্পরার দিক দিয়ে দেখলে ভারতীয় ধর্মের দুটি প্রধান উপাদান- একটি বৈদিক বা নিগম উপাদান; অপরটি তান্ত্রিক-পৌরাণিক বা আগম উপাদান। এই দুই উপাদানের মধ্যে আদান-প্রদান দ্বারাই ভারতীয় মানুষের জন্ম হয়েছে; সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নানা জাতির সংমিশ্রণের নানা বৈশিষ্ট্য ও অন্যান্য মানবিক অমানবিক উপাদানও। 

  বৈদিক পরম্পরা বলতে প্রাক আর্য ঐতিহ্যকে বোঝায়। ভারতীয় মানুষের ইতিহাস হল পরিগ্রহণের ইতিহাস; বর্জনের বেদনায়, সংঘাতের সংক্রমণে আহত হবার ইতিহাস নয়। পন্ডিত মাধবাচার্য বহু শতাব্দ আগে তাঁর রচিত 'সর্বদর্শন সংগ্রহ' গ্রন্থে, বহু দর্শনের পরিগ্রহণে যে ভারতীয় মানসের বুনিয়াদ গড়ে উঠেছে, এবং তারই ফলশ্রুতিতে ভারতীয় মানুষের আবির্ভাব তা ব্যক্ত করেছেন। হিন্দুত্ব তাই এককভাবে একটি ধর্মমতের উৎস নয়, বরং বহুধর্মের নির্যাস। ভারতীয় মানুষের মনুষ্যত্ব বিকাশের বহু ধর্ম জাতি সম্প্রদায়ের মানবধর্মের অন্তর্লীন সম্পদগুলি সংযুক্ত হয়েছে। ফলে ভারতীয় সভ্যতার বৈচিত্র্যময় ইতিহাসে ভালো-মন্দ দুয়েরই প্রকাশ ঘটেছে। ইসলাম, খ্রিষ্টান বৌদ্ধ জৈন তাও শিখ সিন্টো জরথুস্ত্র ইহুদি প্রভৃতি সব ধর্মের মানুষের অবদান রয়েছে ভারতীয় মানুষের আবির্ভাবে। জাতিক্ষেত্রে আর্য দ্রাবিড় নিষাদ কিরাত কোল মুন্ডা মোগল পাঠান শক হুন জাতি অনুলোম প্রতিলোম বিবাহ সম্পর্কের গভীরে প্রকাশ প্রবেশ করে ভারতীয় মানুষের মানস উপাদান গঠনে যে বৈচিত্র্য দান করেছে, ভারতীয় মানুষের আবির্ভাবে তার স্থায়ী প্রকাশ ঘটেছে। 

 শিক্ষাবিদ ও দার্শনিক Cramb বিষয়টি যে ভাবে বিচার করেছেন তা হল: "India is not only the Italy of Asia;it is not only the land of romance, of art and beauty. It is in religion earth's central shrine. India is religion." ভারতবর্ষ আবহমানকাল ধরে সত্যকে খুঁজেছে। ভৌগোলিক বিস্তারের দিক দিয়ে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারীকা, গান্ধার থেকে কামরূপ- এই সত্যানুসন্ধান অব্যাহত থেকেছে। স্বধর্ম রক্ষার ক্ষেত্রে কোনো জাতি তার নিজস্বতা রক্ষার ক্ষেত্রে কোথাও কখনোই বাধাপ্রাপ্ত হয়নি। সারা ভারতবর্ষ জুড়ে সব ধর্মের উপাসনাস্থল থেকে উদ্দীপিত যে প্রার্থনা সেখানে স্বধর্মের উচ্চারণ অনুরণিত হয়েছে। এই প্রার্থনার ঐকতান ভারতীয় মানুষের উত্থান ত্বরান্বিত করেছে।

  এটাও ঐতিহাসিক সত্য যে, পৌত্তলিকতা বিরোধী ইসলাম ধর্ম ভারতীয় ধর্ম-মানসে চূড়ান্ত আঘাত হেনেছে, অপরদিকে ধর্মান্ধ কুসংস্কারাবদ্ধ হিন্দুদের জাতপাত পরিকীর্ণ আচারসর্বস্ব উৎপীড়নের বিধ্বস্ত লোকজীবন ইসলাম ধর্মের উদার আহ্বানে সাড়া দিয়ে ধর্মান্তর গ্রহণ করে আত্মরক্ষা করেছে।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments