জ্বলদর্চি

যেতে যেতে পথে-১৮/রোশেনারা খান

যেতে যেতে পথে
রোশেনারা খান
পর্ব  ১৮

১৯৭৫ সালে খান সাহেব ডব্লিউ বি সি এস পরীক্ষায় বসলেন। এই বছরই আমার শ্বশুরমশাই মাত্র ৫২ বছর বয়সে মারা গেলেন। শাশুড়িমার বয়স তখন ৪৫/৪৬ হবে। আমার ছোট ননদদের বয়স ৭ বছর। ১৯৭৫ সালের ২৬ নভেম্বর আমাদের প্রথম সন্তান সাহিনের(বাবলি)জন্ম হল। আমার বয়স তখন ১৮ বছর। মেয়ের জন্ম মেদিনীপুর রেডক্রসে। এই সময় আমি কয়েকদিন মামাবাড়িতে ছিলাম। আমার মামাতোভাই শ্বশুরবাড়িতে এই খবর দিতে গেলে আমার খুড়শাশুড়ি শুনে অবজ্ঞাভরে  বলেছিলেন, ঝ্যাঁটামারি বাবা, বেটিছেলে হয়েছে? কথাটা শুনে খুব খারাপ লেগেছিল। কারণ আমাদের দুজনের কারো ছেলে চাই, এরকম কোন বাসনা ছিল না। সুস্থ সন্তান চে্যেছিলাম। 
      মাঝের একটা সময় পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার গড়বেতা ও কেশপুর থানা রাজনৈতিক হানাহানির কারনে উত্তপ্ত এলাকা হিসেবে পরিচিত হলেও ১৯৭৪/৭৫ সালে গড়বেতা এরকম ছিল না। তবে কেশপুরের মুসলিম অধ্যুষিত  গ্রামগুলি গ্রাম্য বিবাদের কারণে প্রায় উত্তপ্ত থাকত। গ্রামের বেশকিছু মানুষ মামলাবাজ ও পার্টিবাজ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। প্রতিবেশীকে জব্দ করার জন্য  কেউ কেউ নিজেই নিজের বাড়িতে আগুন দিয়ে আদালতের শরণাপন্ন হতেন। এই  সমস্ত কারণে গ্রামে পুলিশের আসাযাওয়া লেগেই থাকত। আমি এসবে অভ্যস্থ ছিলাম না।উনিও খুব ভয়ে ভয়ে থাকতেন। একবার যদি পুলিশের খাতায় নাম উঠে যায়, তাহলে আর সরকারি অফিসার হওয়া হবেনা। শ্বশুরমশায়ের মৃত্যুর পর পরিবারের সমস্ত দায়িত্ব এসে পড়ল ওনার ওপর। তবে পারিবারিক আয়ের প্রধান উৎস ছিল কৃষিজমি, এসব দেখাশোনা করত মেজদেওর। ইতিমধ্যে মেজ ননদ ও মেজ দেওরের বিয়ে হয়েছে।  মেজ দেওরের জন্য আমিই পিড়াকাটা মেয়ে দেখতে গেছলাম। বনেদি পরিবার(আমার বড়মাসির শ্বশুরবাড়ি), মেয়েও সুন্দরী, কিন্তু বোধবুদ্ধি বেশ কম। তবে দুষ্টু বুদ্ধিতে পাকা। 

      কিছুদিনের মধ্যে ওনার পুলিশ ভেরিফিকেশন, মেডিকেল টেস্ট হয়ে গেল।  এখন শুধু নিয়োগপত্র হাতে আসার অপেক্ষা। এর মধ্যে একদিন উনি স্কুল থেকে মনখারাপ করে বাড়ি ফিরে, বেবি, চাকরিটা আর আমার হল না। এই বলে স্কুল থেকে নিয়ে আসা আনন্দবাজার খুলে ছোট্ট একটি খবর দেখালেন। সেখানে  লেখা আছে আপাতত কেন্দ্রিয় সরকারের সমস্ত বদলি ও নিয়োগ স্থগিত থাকবে। কিছু করার নেই। আমি সান্ত্বনা দিয়ে বললাম। তাতে কী হয়েছে? বাতিল তো হয়ে যায় নি? দেরি হবে, এই যা। এরই কয়েকদিন পরে(১৯৭৭) বহু প্রতীক্ষিত  নিয়োগপত্র  এল। উনি তখন স্কুলে, আমিই সই করে নিলাম। পিওন মিষ্টি খাওয়ার টাকা চাইলেন, দিলামও। পড়ে দেখলাম নিয়োগস্থল পশ্চিম দিনাজপুরের সদর শহর বালুরঘাট। মুক্তির আনন্দ আর বিচ্ছেদের ব্যথা চোখে জল এনে দিল।

      স্কুল থেকে ‘উইদাউট পে’ একবছরের ছুটি নিয়ে ০৭/০৭/ ১৯৭৭ এ বালুরঘাট রওনা দিলেন। আমিও ওইদিন থেকে বিছানা নিলাম। তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা খুব খারাপ ছিল। মেদিনীপুর থেকে হাওড়া, হাওড়া থেকে মালদা, মালদা থেকে বাসে বালুরঘাট পৌঁছাতে দুদিন লাগল। ওখান থেকে ওনার পৌঁছানোর খবর পেলাম ১০ দিন পর। এদিকে আমিও টের পেলাম দ্বিতীয় বার মা হতে চলেছি। ওখানে ওনার কিছুতেই মন বসছিল না। দ্বিতীয় চিঠিতে উনি কাতরভাবে জানালেন, বাড়ি ছেড়ে, আমাদের ছেড়ে ওনার মোটেও ভাল লাগছে না। এই চাকরি ছেড়ে উনি স্কুলেই ফিরতে চান। আরও লিখেছেন, আপাতত আমাদের মেদিনীপুরে বাড়ি ভাড়া করে রাখবেন। তারপর মেদিনীপুরে যে জমি কেনা আছে সেখানে বাড়ি করবেন। আমি যেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ির সবার সঙ্গে আলোচনা করে জানাই। এদিকে ওনার বাইরে চাকরি করতে যাওয়াটা বাড়ির কেউই মেনে নিতে পারছেন না। এর জন্য আমাকেই দায়ি করছেন। এই অবস্থায় ওঁদের সঙ্গে আলোচনা করা বৃথা। আবার ওনাকে ফিরে আসতে না করলেও কষ্ট পাবেন। ওইটুকু বয়সে নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে লিখলাম, তুমি বাড়ি এসো, সবাই মিলে বসে আলোচনা করা যাবে। সেই সময় আমার সেজকাকা সমবায় দফতরের জেলা স্তরীয় অফিসার ছিলেন। কাকার সঙ্গে উনি নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। কাকাও ওনাকে সান্ত্বনা দিয়ে লিখলেন, তুমি বাসাভাড়া নিয়ে বেবিকে নিয়ে যাও, ধিরে ধিরে সব ঠিক হয়ে যাবে। চাকরি জীবনের প্রথম দিকে আমাকেও অনেক কষ্ট  সহ্য করতে হয়েছে।
                    কিছুদিন পর উনি বাড়ি এলে বললাম, তুমি সেজকাকার সঙ্গে দেখা করে এসো। কাকা যদি চাকরি ছেড়ে দিতে বলেন, ছেড়ে দিও। আমি কিছু বলব না।  উনি সেজ কাকার সঙ্গে দেখা করতে গেলে কাকা চাকরি ছাড়ার প্রসঙ্গে না গিয়ে প্রথমেই জিজ্ঞেস করেন, তুমি বেবিকে কবে নিয়ে যাচ্ছ? বাড়ি দেখেছো?  কাকার সঙ্গে দেখা করে ফিরে এলে  জিজ্ঞেস করলাম, কাকা কী বললেন?- কাকা চাকরি ছাড়ার প্রসঙ্গেই যাননি, আমার কাছে জানতে চাইলেন কবে তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি। আমি তখন বললাম, তুমি আগে স্কুলে ‘রেজিগলেশন লেটার’ জমা দিয়ে এসো। না হলে আবার তোমার চাকরি ছাড়ার ভুত ঘাড়ে চড়ে বসতে পারে। উনি বালুরঘাট  ফিরে যাওয়ার আগে স্কুলে রেজিগলেশন দিয়ে গেলেন। ওখানে সরকারি আবাসনের জন্য আবেদনপত্র জমা দিয়ে আয়ুব নামে এক লেবার ইন্সপেক্টরের সঙ্গে আত্রেয়ী নদীর পাড়ে হোটেলে একটি রুম ভাড়া নিয়ে  থাকলেন। 
      সেপ্টেম্বর মাসে হঠাৎ আমার ব্লিডইং শুরু হল। শাশুড়িমা কেশপুরের একজন হাতুড়ে ডাক্তারকে ডাকার কথা বললে, আমি রাজি না হয়ে বললাম,  আমাকে মেদিনীপুর পাঠানোর ব্যবস্থা করুন। অখানে আমার মামা মেসো আছেন, তাঁরাই ডাক্তার দেখানোর ব্যবস্থা করবেন। সেদিন বৃহস্পতি বার, ধান বিক্রি করা যাবেনা, তাই সামান্য কিছু টাকা হাতে দিয়ে আমার এক দেওর মেদিনীপুর পৌঁছে দিয়ে যায়। মামাবাড়ির কাছেই ছোট মাসির বাড়ি। মেসো সব শুনে বললেন, সুভাষনগরে একজন বিলেত ফেরৎ ডাক্তার এসেছেন। ড.পরামানিক, ওঁকে দেখানোই ভাল। মেজমাসিকে সঙ্গে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলাম। উনি পেটের  ওপর হাত রেখে বললেন, বাচ্চা বেঁচে আছে, তবে ৫০/৫০ চান্স। ওষুধ দিলেন এবং বেডরেস্টে থাকতে বললেন।
        আমি অসুস্থতার দিনই ওনাকে চিঠিতে সব জানিয়ে ছিলাম।তখন তো টাকা পাঠানো এত সহজ ছিলনা।‘মানি অর্ডার’ করতে হত। উনি ওখান থেকে  আমার মামাতো ভাইকে চিঠিতে লিখে পাঠালেন, উনি টাকা পাঠিয়েছেন, হয়ত পৌঁছাতে দেরি হবে। টাকার জন্য আমার চিকিৎসায় কোনও ত্রুটি যেন না হয়। একমাস পরে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরি। উনি বলেছিলেন, ডেলিভারির পর , ‘কাম সুন, ওয়াইফ সিক’ এই কথা লিখে যেন ওনাকে টেলিগ্রাম করা হয়। তা না হলে মার্চমাসে ছুটি পাওয়া যাবেনা। তবে তার আগে যেন চিঠি লিখে টেলিগ্রামের কথা জানানো হয়।
      এবারেও মামার বাড়িতে গিয়ে উঠলাম। দেরিতে ডেট ছিল। কিন্তু মামাবাড়ি আসার দুদিন পরেই আমাকে রেডক্রসে ভর্তি করতে হল। ১৯৭৮ এর ১৪ ফেব্রুয়ারি সকাল ১১ টা ৪৫ মিনিটে আমাদের একমাত্র ছেলে বকুলের জন্ম  হল। সবার স্বামীরা আসছেন দেখা করতে। আমার খুব মনখারাপ লাগছি। আমি কেবিনে ছিলাম। কেবিনে ৭ দিন রাখে। আমি আগেই চলে এলাম।নর্মাল ডিলিভারি হয়েছে, তাই অসুবিধা হয়নি। মামাবাড়িতে ফিরেই মামাতো ভাইকে দিয়ে ওনাকে টেলিগ্রাম করালাম। কিন্তু আমরা ভাল আছি, একথা জানিয়ে কোনো চিঠি পাঠানো  হয়নি। তবে পুত্র সন্তান জন্মানোর খবর জানিয়ে সেইদিনই চিঠি পাঠানো হয়েছিল। উনি তো টেলিগ্রাম পেয়ে সত্যি আমি অসুস্থ ভেবে তখুনি রওনা দেন এবং মেদিনীপুর স্টেশন থেকে সোজা রেডক্রসে হাজির। আমার খোঁজ নিতে ওনারা জানান, মা ও বেবি দুজনেই সুস্থ আছে। দুদিন আগেই ছুটি নিয়ে চলে গেছে। ওই সময়  বাবলিকে দেখার জন্য মা এসে মামাবাড়িতে ছিলেন।আমার কোনও অসুবিধা হচ্ছিল না। খান সাহেব রেডক্রস থেকে মামাবাড়ি এসে আমরা সুস্থ আছি যেনে  সেইদিনিই আমাদের নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। কিছুদিন থেকে আবার বালুরঘাট ফিরে গেলেন। আমাদের ছেলে বকুলের তিনমাস বয়সে ভাইবোন দুজনেরই অনুষ্ঠান করে ‘আকিকা’(নামকরনের অনুষ্ঠান) হল। বাবলির নাম হল ‘সাহিন পারভিন’ আর  বকুলের শাহিদ পারভেজ। নাম দুটি ওনার বন্ধু আয়ুবের দেওয়া।  উনি সেবার ১০ মাসের জন্য কল্যাণী ট্রেনিং এ এলেন। কল্যাণী থেকে প্রতি সপ্তাহে বাড়ি আসতে পারতেন। ট্রেনিং শেষ হলেই আমাদের বালুরঘাট নিয়ে যাবেন, এমনটাই কথা হল।

                                        (ক্রমশ)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments