জ্বলদর্চি

অশোক মহান্তীর কবিতা : জীবন ভাঙা পথে ঈশ্বরের গান--৯/দিলীপ মহান্তী

অশোক মহান্তীর কবিতা : জীবন ভাঙা পথে ঈশ্বরের গান


দিলীপ মহান্তী


।৯।
রাত্রির তারাভরা আকাশ এক এক জনের কাছে এক এক রকমের আলো নিয়ে আসে। কেউ জীবনের, কেউ বা মৃত্যুর রহস্য সন্ধানের দিশা পান। আর কেউ বাস্তব পৃথিবীর রূপ রসের সমুদ্রে ডুবে তলিয়ে যেতে যেতে জীবনের বা মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে পুনর্মূল্যায়ন করেন জগতের। সেই সঙ্গে খুঁজে নিতে চান নিজেকে, নিজের অস্তিত্বকে। অশোক মহান্তীর কবিতায় জগৎ ও জীবন সম্পর্কিত এই ধারণা আরও প্রগাঢ় এবং নিজেকে জানার অন্বেষণের, অধ্যয়নের বিরাম নেই।
       আমরা জানি বেদের একটি অন্যতম প্রধান ধারা হল: বিশ্বরহস্যকে জানার প্রবল আকুতি থেকে সৃষ্ট এক প্রবল জ্ঞানতৃষ্ণা। যা আরণ্যকের যুগে প্রধান অবলম্বন হয়েছিল এবং বিশুদ্ধ দার্শনিক জ্ঞানের অন্বেষণে সম্পূর্ণভাবে নিয়োজিত ছিল-  যার ফলস্বরূপ উপনিষদের সৃষ্টি। যে সমস্ত চিন্তাচেতনা সংহিতাতে বীজ আকারে ছিল তা উপনিষদে বিকশিত হয়ে বনস্পতির আকার ধারণ করল। বেদের সংহিতাতে দেখা যায় প্রকৃতিতে যখন কোনো শক্তির বা সৌন্দর্যের প্রকাশ ঘটেছে তখন তার মধ্যে দেবত্ব আরোপ করা হয়েছে। যাকে কখনো বলা হয়েছে পুরুষ। এই পুরুষ উপনিষদে রূপান্তরিত হয়েছেন ব্রহ্মে। সমস্ত জীবজগৎ অর্থাৎ সমস্ত মানুষ ও সমস্ত বস্তুজগতের মধ্যে যিনি প্রচ্ছন্নভাবে ব্যাপ্ত হয়ে আছেন। এজন্যই তিনি ব্রহ্ম। যিনি সবসময় বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হন, বৃদ্ধি পেতে পেতে নিজেকে বিশ্বে মিলিয়ে দিয়েছেন। কাজেই এই বিরাট বিশ্ব হল সৃষ্টি আর ব্রহ্ম হলেন স্রষ্টা। বিশ্বের মধ্যেই নিহিত আছে বিশ্বশক্তি। সেই শক্তিই বিশ্বের আশ্রয় এবং সেই শক্তিই বিশ্বের মধ্যে ছড়িয়ে আছে। সেই শক্তিই সবকিছুর অন্তরে অধিষ্ঠিত। ছান্দোগ্য উপনিষদে আছে- ‘সর্বং খল্বিদ্যং ব্রহ্ম তজ্জলানীতি।।‘-এই সব কিছুই ব্রহ্ম, ব্রহ্মেই সবকিছুর জন্ম, পুষ্টি এবং বিলয়। ব্রহ্ম নিয়ামক শক্তি হিসেবে বিশ্বে সমস্ত রকম কাজ করেন। বৃহদারণ্যকে আছে –‘ তাঁর প্রশাসনে সমগ্র বিশ্ব বিধৃত  এবং পরিচালিত। সূর্য চন্দ্র প্রভৃতি সমস্ত গ্রহ নক্ষত্র, নিমেষ -মুহূর্ত সবকিছুই তাঁর নিয়ন্ত্রণে। আবার তিনি সকল জীবের অন্তরে বর্তমান থেকে তাদের অজান্তে তাদের নিয়ন্ত্রণ করেন। সকল জীব তাঁর শরীর স্বরূপ এবং তিনি অন্তর্যামী। দেহ পরিবর্তিত হয়, কিন্তু তাঁর নিয়ামক শক্তি নিত্য এবং তিনি অমৃতস্বরূপ।'
       আবার উপনিষদে এও আছে বিশ্বসত্তা শিল্পরসিক। তাই তিনি শিল্পীর ভূমিকা গ্রহণ করে আনন্দ পান। সমগ্র বিশ্ব তাঁরই শিল্প। পুরাণের যুগে যাঁকে বলা হচ্ছে ঈশ্বর।
       এই সবুজ পৃথিবী তো ঈশ্বরের বাগান । পৃথিবীর বুকে খেলে বেড়ানো সবকিছুই ঈশ্বরের সৃষ্টি। এই সবকিছুর মধ্যে ঈশ্বরকে খুঁজে পাওয়া আসলে মহাজীবনকে খুঁজে পাওয়া।
      আর একটি যুক্তিগ্রাহ্য ব‍্যাখ‍্যা আছে যা বিবেকানন্দের : ‘মহাবিশ্বে ব্রহ্ম বা হিরণ্যগর্ভ বা মহাজাগতিক সমষ্টিমহৎ প্রথমে নামরূপে নিজেকে প্রকাশ করেন, তারপর এই বিশ্ব জগতের রূপ ধারণ করেন। এইসব ব্যক্ত ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎই রূপ যার অন্তরালে আছে অনন্ত অব্যক্ত স্ফোট। এই স্ফোট হচ্ছে সমগ্র জগৎপ্রকাশের কারণ শব্দব্রহ্ম। সমস্ত ভাব বা নামের নিত্য উপাদানস্বরূপ এই অনন্ত স্ফোটই হচ্ছে সেই শক্তি যার দ্বারা ঈশ্বর জগৎ সৃষ্টি করেন। শুধু তাই নয়, ঈশ্বর প্রথমে স্ফোটরূপে নিজেকে প্রকাশ করেন, তারপর ক্রমে বিবর্তিত হয়ে আরও স্থূল ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎরূপে প্রকাশিত হন।'  

     এই ঈশ্বরসন্ধানী কবি অশোক মহান্তী ঈশ্বর সম্বন্ধীয় যাবতীয় তত্ত্বকথা আত্মস্থ করেছেন এবং  মহাজাগতিক রহস‍্যকে উপলব্ধি করতে সর্বদা সচেষ্ট‌। তাঁর কন্ঠে  যে শব্দরূপ মন্ত্র উচ্চারিত হয় তা যেন উপনিষদের ঋষিদের মুখ নিঃসৃত বাণী। তা যেন মহাজগতের মহাজীবনের গান। সেইসঙ্গে ঈশ্বর যেভাবে প্রথমে শব্দের মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশিত করেন এবং জগৎ সৃষ্টি করেন সেইভাবে তিনিও তাঁর অন্তরের ঈশ্বর বা আত্মস্বরূপ উপলব্ধির ফলে শব্দব্রহ্মের মাধ্যমেই নিজেকে ছড়িয়েছেন কবিতার পংক্তির মধ্য দিয়ে সমগ্র বিশ্বে । এইভাবে সৃষ্টি হচ্ছে  আনন্দের। আর আনন্দও তো ব্রহ্ম। সেই আনন্দের আকর্ষণে জীবের জন্ম ও মৃত্যু। এর মধ্যেই বিশ্বের প্রাণ- প্রবাহের ছন্দ। সুর তাল লয়:

 ১. “অজস্র মৃত্যুর মধ্যে যে মৃত্যুহীন বেঁচে থাকা
      সেই অনন্ত আলোর ভেতর তুমি কে?
      আমি দেখতে চাই তোমাকে, ছুঁতে চাই, আর বিশ্বাস করতে চাই
      এমনি আলো বরাবর তুমি ছড়িয়ে দিয়েছো তোমার জন্য

     তোমার ডানার অন্ধকার ছড়িয়ে পড়েছে দিগন্তে
     অন্ধকার কেটে কেটে বের হচ্ছে দিনরাত্রির কবিতা
     শৃঙ্খলা আর সূর্যোদয়ের পাশাপাশি জীবন

     শৃঙ্খলা আর সূর্যোদয়ের পাশে যে জীবন আমাদের
     সেখানে ভ্রান্তি থাকতে নেই, মোহ থাকতে নেই, পরাজয় থাকতে নেই
     কেবল অনিবার্যের নিখিল চরাচর জুড়ে কঠিন আস্তরণ
     ভাঙতে ভাঙতে ভাঙতে ভাঙতেই এগিয়ে যাওয়া আমাদের।“
           (কুসুম : আলোক শিশির)

২. ‘কবিতার সব শব্দ মানুষ এ পৃথিবীর অন্ধকারে কুড়িয়ে পেয়েছে
     জীবনের সব প্রেম মানুষ এ পৃথিবীর অন্ধকারে কুড়িয়ে পেয়েছে
     যতকিছু উন্মাদনা, ভয়, প্রবণতা, মানুষ এ পৃথিবীর অন্ধকারে কুড়িয়ে পেয়েছে।
     আর এই সন্তানসম্ভব কাল, যুদ্ধক্ষয়, জল ও বাতাসবাহী রোগ
     মানুষ সমস্ত এই পৃথিবীর অন্ধকারে কুড়িয়ে পেয়েছে।

    মানুষ এ পৃথিবীর দীর্ঘ অমাবস্যা রাত্রি পূর্ণিমার আলো
    মানুষ এ পৃথিবীর যা-কিছু সুন্দর আর যত কিছু ভালো
    সবকেই ভালোবেসে মানুষ থেকেছে বরাবর
    মানুষ দেবতা হয়নি, মানুষই থেকেছে বরাবর
    মানুষের শুভবোধ তাকেই মানুষ করে ইতিহাস হয়ে আছে
    হাজার বছর পৃথিবীতে।‘
         ( শুভ :আলোক শিশির )

৩. ‘যেখানে আকাশ জলের সঙ্গে কথা বলে, আর হাওয়ায় দুলে ওঠে স্থির গাছ
     সেখানেই পাথরের বুকেই, আমার হৃৎপিন্ডের ধ্বনি শুনতে পাই।
     ত্বকে ধুলো লাগলে বুঝতে পারি এই পৃথিবী ধূলিময়
     যেমন ছাই দেখেই বুঝতে পারি এখানে আগুনে জ্বলে উঠেছিল বহুকাল আগে।

     শিল্পসৃষ্টির কোনো মন্ত্রই আমার জানা নেই।
     ব্যাকুলতা-ভিন্ন আর কোনো সার্থকতাও।

     শুধু জড়িয়ে ধরেছি নিজেকে, নিজেকেই রামি আর নিজেকেই চণ্ডীদাস ভাবতে শিখেছি
     এছাড়া আমার আর কোনো নন্দনতত্ত্বও নেই।
          ( তৃষ্ণা : মাটির মন )

৪. ‘দৃশ্যের আড়ালে শুধু বোধটুকু স্মৃতি হয়ে থাকে
     পরিমাণ নেই, কোনো প্রচ্ছন্নতা নেই, হিশেব নিকেশ নেই
     স্মৃতি শুধু, স্মৃতি আমরণ।

    আমরা স্মৃতির মধ্যে বেঁচে আছি, স্মৃতি আমাদের কাছে
    আজীবন নতুন শৈশব। গ্রহলোকে স্মৃতি নেই
    ওখানে মানুষ নেই বলে স্মৃতি নেই, ইতিহাসও নেই
    ধ্বংসর ভেতর দিয়ে হারাতে হারাতে শুধু ধুলো আর বালি
    শুধু সৃষ্টির আদিম গাঢ় অন্ধকার। নিমজ্জন।
    আর কিছু নেই।‘
        ( মনা ও মুহূর্ত : আলোক শিশির )



অশোক মহান্তীর কবিতা ধারাবাহিকভাবে, নিবিড়ভাবে পড়লে বোঝা যায় তিনি এক মহাজীবনের কথা মহাকালের কথা শোনাতে চাইছেন। এক অনন্ত জীবন ও জগতের দর্শন তাঁর শব্দ ব্রহ্মে জেগে উঠছে। আমাদের দুচোখে দেখা জীবনের পাশাপাশি আর এক না দেখা জীবন আছে; এই দুই জীবনের মাঝখানে সেতু রচনার কাজ করে গেছে তাঁর কবিতা। এক জীবন দেশ ও কালের আধারে সীমাবদ্ধ অন্য জগৎ গ্রহ নক্ষত্র মহাকাশে ব্যাপ্ত। দেশকালের সীমা ছাড়িয়ে অনন্ত জীবন প্রবাহে যাওয়ার চেষ্টা আছে তাঁর সারা জীবনের কাব্য সাধনায়।
      আমাদের আর একটু অনুসন্ধানী হতে হবে। দেখার চেষ্টা করবো এই দৃষ্টি ও জীবন ভাবনা তিনি কোথা থেকে পেলেন। এই অনন্ত জীবন ভাবনার অনেকটা তিনি পেয়েছেন পারিবারিক ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিচর্চার উত্তরাধিকার সূত্রে। তাঁর প্রপিতামহ চিরপ্রণম্য বনোয়ারী মহান্তী ছিলেন সাত্ত্বিক ব্রাহ্মণ ও জ্ঞানী পুরুষ। গৃহস্থ হয়েও যিনি ঋষি। বেদ উপনিষদ গীতা ভাগবত রামায়ণ মহাভারত ও পুরাণ বিশেষজ্ঞ। তাঁর জ্ঞান ও চেতনা এই পরিবারে বয়ে আসছে। সেই পারিবারিক ঐতিহ্য বজায় রেখে অশোক মহান্তী নিজেও পড়াশুনা করেছেন প্রচুর। যা তাঁকে জীবনের তাৎপর্য ও গভীরতা বুঝতে সাহায্য করেছে।
       দ্বিতীয়ত, আর একটি উৎসমুখ হল তাঁর জন্মস্থানের প্রকৃতি। লালমাটি, ঘন সবুজ জঙ্গল, ছোটো ছোটো পাহাড় নদী, খাল, দূরে ধান জমি, বাঁধ পুকুর, সারি সারি তাল ও  খেজুরগাছ ,আর কিছুটা ফাঁকা মাঠ দিয়ে ঘেরা গ্রাম। আর গ্রামের মধ্যে কয়েক শতাব্দী ধরে আম জাম কাঁঠাল চল্লা চাকলদা তেঁতুল কুসুম  বট অশ্বত্থ প্রভৃতি প্রাচীন বৃক্ষ বহু ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে । আর আছে অজস্র বাঁশঝাড়। যার ভেতরে সূর্যের আলো প্রবেশ করতে পারে না । সবকিছু নিয়ে এই গ্রাম সংবেদনশীল মানুষকে অন্য জগতে নিয়ে যেতে চায়।এই প্রকৃতি তাঁকে সৃষ্টি রহস্য পাঠে ধ্যানমগ্ন করেছে।
      তৃতীয় উৎসমুখ তাঁর জীবিকা। হোটেল রেঁস্তোরা ও মিষ্টিদোকান ব্যবসার সূত্রে তিনি সরাসরি বহু মানুষের সংস্পর্শে এসেছেন। প্রত্যেকটি মানুষকে তিনি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। এক একটি মানুষের হৃদয়ের খোঁজ পেতে তিনি যেন তপস্যা করেছেন। মানুষের মধ্যে ঈশ্বরকে খুঁজেছেন। এইসব মানুষ তাঁকে প্রভূত সমৃদ্ধ করেছে। আর রচনা করেছেন অমর কাব্য। যা চিরকাল বেঁচে থাকবে। মনে পড়ে অথর্ব বেদের একটি কথা – ‘দেবস্য পশ্য কাব্যম্। ন মমার ন জীর্ণতি।‘ যার অর্থ: দেবতাদের কাব্য দেখ, এর মৃত্যু নেই, কখনো জীর্ণ হয় না। আমাদের আলোচ্য কবিতাগুলিও অবিনশ্বর। এই সমস্ত শব্দ ও পংক্তি উঠে এসেছে তাঁর হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে। যা গভীরভাবে জগৎ ও জীবনকে জানার নির্যাস।মহাজীবনের কথা মহাকালের কথা মহাজগতের কথা বলতে চেয়েছেন বলেই তাঁর কাব্যের নামকরণের দিকে লক্ষ্য করা জরুরি: আবহ সকাল, অতিবর্তী জাগো, আলোক শিশির, দ্বিতীয় সঙ্কেত, মাটির মন, ঘাস রঙয়ের আকাশ প্রভৃতি। এই সৃষ্টি রহস্য এই দেশ কাল থেকে গ্রহ তারা সপ্তর্ষিমন্ডল নীহারিকা পুঞ্জ পর্যন্ত প্রসারিত। জাগতিক সৌন্দর্যের মধ্যে মহাজাগতিক সৌন্দর্যকে খুঁজে পাওয়াই তাঁর অন্বিষ্ট:

১.’ যে কবি আজ পুরস্কার পাচ্ছেন তাঁর প্রাপ্ত পুরস্কারেও তাই লেগে থাকে
    মাটির গন্ধ, জাতির জীবনমান, রাষ্ট্রের ক্ষুধা, হাহাকার আর নৈরাশ্য।
    
    এখান থেকে আরও একটু এগিয়ে যেতে পারলেই বিশ্ব

   মহাজাগতিক সময়, বিগ ব্যাং ও মহাকাশ
   এখান থেকে আরেকটু এগিয়ে যেতে পারলেই দর্শন ও প্রজ্ঞা।‘
     ( যুগান্তর : মাটির মন )

২. ‘উড়ে যাচ্ছে ডানা আর সহস্র আলোকবর্ষ পার হয়ে উড়ে যাচ্ছে রোদ
     কোটি কোটি নক্ষত্রেরা ভেসে যাচ্ছে হাওয়ায় হাওয়ায়

   আর্ত চিৎকারের মতো শব্দ শুনি
   শুনি চারদিকে নিখিল বিশ্বের মৃত্যু মাড়িয়ে মাড়িয়ে
   জীবন চলেছে ছুটে উর্ধ্বশ্বাস। জীবনের ক্লান্তি নেই কোনো।
   চারিদিকে মৃত্যুর মর্মরে বাজে জীবনের গম্ভীর আওয়াজ আমি নিত্য, সনাতন।

   অপরিমাণের মতো সেই মুখ।
   সেই চোখে বিস্ফারিত দ্যূতি।

  জীবন এমনি হয়তো। ক্লান্তি আর আগুনের পাশে
  ভুল আর ভুলের সীমানা বরাবর অন্তিম যাত্রায় মূর্ত।‘
       (ভুল: আলোক শিশির )

৩.’ আগুনের কাছে আজ কৃতজ্ঞতা-ছাড়া কিছু নেই।
    যেমন করুণা নেই মাটির কাছেও, তেমনি একে একে হারিয়েছি সব
    পেয়েছি অনেক বেশি।

   আজ সব জগৎ-সংসার এসে ঘরের ভেতরে খেলা করে।
   সারাদিন খেলা-শেষে রাতের তিমিরে, সে আমাকে হাঁটিয়েছে পথ।
   হাঁটতে হাঁটতে চলে গেছি, সেখানে সকাল নেই, আলো নেই, আর কোনো
    বিবর্তন নেই, শুধু স্থির, শুধু অনন্তমৌনের মতো স্থির এক মহাশূন্যজালে
    আমিও অনন্তবন্দী।‘
        ( আকাশ দর্পণ: মাটির মন)

৪. ‘যে যত বলুক আজ মানুষে মানুষে এই রূঢ় ব্যবধান কিছুতে যাবেনা ভোলা, তবু
     রুক্ষ প্রান্তরের পাশে দীর্ঘ মাঠময় অজস্র ধানের শব্দ অজস্র পাখির গানে গানে
     ভীষণ পুরোনো কোনো জীবনের কথা মনে পড়ে।
    এখানে সভ্যতা ছিলো কোনোদিন। ক্ষুধা ও ঐশ্বর্য পাশাপাশি
    পশু ও মানুষে পাশাপাশি, প্রেমে ও হিংসায় পাশাপাশি

    আর এই যে অধুনাবিশ্ব এর প্রতি স্পন্দনে আমার ক্লান্ত জীবনের শ্বাস
    ঝড়, ধুলোবালি, শ্রমজাত ফসলের ভয়। আকাশ যা নিরাপদ কল্পনার আশ্রয়
    সেখানে জমেছে কলের ধোঁয়া, কূটবিষ, সাম্রাজ্যবাদের নগ্নহাত
    পাখির বদলে আজ সেখানে প্রযুক্তি উড়ে যায়।

     বুঝেছি এ পৃথিবীতে আমার সন্তান তার এতকিছু প্রয়োজন ছিলো।
     বুঝেছি এ পৃথিবীর চারপাশে যে-অমোঘ রহস্যময়তা তার পেছনে
     ধাবিত হওয়া ছাড়া তার কোনো মুক্তি নেই।
     তবু ভয় হয় মেঘ সরাবার আগে তার হাত পুড়ে গেলে
     সে আরো নবীন কোনো বসন্তের দিকে যেতে যেতে অকস্মাৎ চোখে পড়বে
     বায়ুর ওজোনস্তর কবে তার হাড় খেয়ে গ্যাছে, বাকী রক্তমাংসটুকু
     ঝরে গ্যাছে পথের ধুলোয়।
     হয়তো-বা এসকলই আমার চোখের সামনে ঘটে যেতে পারে কোনো শতাব্দীর
     অন্তিমবেলায়, হয়তো-বা আজ নয়।

     অসহ্য স্মৃতির ভার  বুকে নিয়ে আমিও তো যাবো একদিন।
     একদিন বর্ণাঢ্য আলোর পাশে মৃত্যুর উৎসবে। সেদিনের সেই পৃথিবীর রঙ
     অনেক আগের কোনো চেনা পৃথিবীর রঙ থেকে আলাদা, সহজ, তবু
     মনে হবে সকল লোকের থেকে ভিন্নতর অস্তিত্বে আমার আজকে কবিতা নয়
      জীবনের ক্লান্তি ঝরে শুধু।
      সেদিন কী থাকে আর? মরাঘাস, হৃদয়ের প্রতিসরণের মতো
      এইটুকু বিস্তীর্ণ আকাশ-ছাড়া সেদিন কী থাকে আর?

       সংক্রান্ত তোমার বুকে ঢাকো মুখ।
       দূরে চাঁদ যেমন ঢেকেছে কলঙ্কের কালো দাগ
       সমুদ্র রেখেছে বিষ, হলাহল, আদিম কালের
       সহস্রবন্ধন থেকে প্রীতির অমৃতগর্ভে মুক্তি হোক আজ জীবনের, যৌনকামিতার
       আজ মুক্তি সফল, সুন্দর।
 
       তবু যদি খেদ থাকে, যদি থাকে আত্মার বিলাপ
       যদি মনে হয় এই স্বর্গচ্যুত খানিক বিশ্রাম ঠিক সত্য নয়
       আরো আলো, আরো প্রেম, আরো দিব্য চেতনার কাছে
       আমাকে উন্নিদ্র করো।
       সংক্রান্ত আমাকে তুমি ঠেলে ফেলে দাও সেই আলোক শিশিরে।‘
            (আলোক শিশির : আলোক শিশির)
             (ক্রমশ)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments