জ্বলদর্চি

জবক্ষার /শ্রীজিৎ জানা

জবক্ষার 

শ্রীজিৎ জানা



 সহদেব অত সহজে ছেড়ে দেবার পাত্র নয়। গলা হাঁকিয়ে এক ঝাঁক লোকের সামনে বলে উঠে
--টাকা কী কেউ নিজের ট্যাঁক থিকে দিচ্ছে।  ই তো সরকারের টাকা। নেতাদের কী বাপের টাকা, যে অদের ঝাঁজ শুনব?
 কথাটা সবাই  শোনামাত্র পাথুরে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে পড়ে কিছুক্ষণ! সহদেব এসব বলে কী!  মহাদেব তার খুড়তুতো ভাই মানে কাকার ব্যাটা হলে কী হবে! সে তো সরকারের দলের লোক। বিশাল ক্ষমতা তার।দিনকে রাত করতে পারে চোখের পলকে। রুলিং পার্টির বুথ প্রেসিডেন্ট বলে কথা!গ্রামে তার মুখের উপরে কথা দ্যায় এমন ছাতির জোর আছে নাকি কারো? হুট কথায় সে পুলিশের ভয় দেখিয়ে বেড়ায়। বলে,
--দেখবি?হুচুট খেয়ে পড়ে যাব কী একভ্যান পুলিশ ছুটে চলে এসবে ঘরকে।

সেই হোমরাচোমরা নেতাকে একশ দিনের কাজ চলাকালীন লোকজনের মাঝেই সহদেব যারপরনাই বলতে থাকে। এমন হঠাৎ করেই চেঁচামেচি শুরু হয় যে প্রথমটায় কেউ ধরতেই পারেনি। ভেবেছে তাদের ঘরোয়া বিবাদ।কিন্তু পরে বুঝতে পারে গণ্ডগোলের কারণ এই একশ দিনের কাজকে নিয়েই।
সহদেব আগে নীল পার্টিরই প্রথম সারির নেতা ছিল।এক্কেবারে অঞ্চল কমিটির সদস্য। কিন্তু ওই যেরকম হয় সাদাকে সাদা বলতেই কোপ পড়ল সহদেবের ঘাড়ে। দশখানা আই সি ডি এস সেন্টারের বিল্ডিং  তৈরীর জন্য টাকা এসেছে অঞ্চলে। টেন্ডার দেবার জন্য যাকে প্যাঁচ-পয়চার করে ঠিক করা হয়েছে, বিগত দিন থেকে তার কাজকর্ম এক্কেবারে ভালো নয়। এলাকায় তার কাজ সমন্ধে প্রচুর অভিযোগ। পিঠ বাঁচাতে পার্টি কর্মীদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে সটকে পড়ে সে। এলাকার মানুষের বিক্ষোভের মুখে পড়তে হয় লোকাল কর্মীকে। বদনাম শুনতে হয় হাজার।সহদেব এসব মেনে নিতে পারে না। অঞ্চল সভাপতি সতীশ প্রধানের কাছের লোক ওই হাবু কনট্রাকটর। সেন্টারের নতুন বিল্ডিংয়ের বরাত পাইয়ে দেওয়ার মূল পান্ডা ওই সতীশ প্রধান। সহদেব সেইকথা ভালোমত করে জানে। এই কবছরে কাটমানির দৌলতে বিষয়আশয় কম বাড়েনি সতীশ প্রধানের ! পার্টির নিয়মশৃঙ্খলার কথা,কর্মীদের সৎ থাকার কথা মুখে আউড়ালেও আগাপাছতলা যে নিজে ডুবে আছে দুর্নীতির পাঁকে সেকথা সবাই জানে। উপরমহলের মন যুগিয়ে চলে বলেই রক্ষে। নীচু তলার কর্মীরাও সহজে মুখ খুলতে চায় না।

কিন্তু সহদেব সেই শুরুর দিন থেকে পার্টিটা করে আসছে। মার খেয়েছে বহুবার।মিথ্যা কেসের আসামী হয়ে ঘরছাড়া হোয়েছে কতদিন। চোখের সামনে তাই পার্টিকে কেউ বদনাম করলে সহদেব মেনে নিতে পারে না। টেন্ডার কমিটির মিটিংয়ে স্পষ্ট জানিয়ে দ্যায় সে,
---হাবুকে কোন কাজের বরাত দেয়া হবেনি।অর কাজের মান ভালো নয়।
সতীশ প্রধান তৎক্ষণাৎ ঝনকে উঠে,
---সে কী করে হবে। সবার মধ্যে হাবুর দরপত্রই তো কম বাজেটের। নিয়ম মাফিক উই ত দাবীদার।
---সব কাজ কী নিয়ম মেনে হচ্ছে?
---কুন কাজটা হয়নি তাহলে তুই বল?
---দেখ অত বিতর্কে যেতে চাইনি। অকে কাজ দেয়া মানে এলাকায় দলের ভাবমুত্তি খারাব হবে। লোকাল নেতাকে হাজার কথা শুনতে হবে। সেজন্য অন্যকে দেয়া হোক।
----তোর একার কথায় তো হবে নি। বাকিরা কী বলে দেখা যাক
প্রত্যাশিতভাবে বাকিরা চুপ থেকে বোঝাতে চায় তারা ডাঁইয়ে নয়,বাঁয়েও নয়,শুধুমাত্র নিজের কোলে ঝোলটুকু পেলেই খুশী। অগত্যা সতীশ প্রধান সময় নষ্ট না করে ঘোষণা করে,
----তাহলে সর্বসম্মতিতে হাবুকেই কাজের বরাত দেয়া হচ্ছে
---তাহলে আমার কথার কুনু দাম নাই। তুমি যা করবে সেটাই ঠিক।
---তার মানে?
---মানে ইটা বুঝায় হাবুর জন্য তোমার এত দরদ কেন?
---কী বোলতে চাউ তুই। নিয়মের বাইরে তুই আলফাল বোকবি আর তোর কথা শুনে লুব?
---বেশি নিয়ম মোকে বুঝাতে এসো নি। আমি সবই বুঝি। কুনু দুনম্বরী কারবারে সহদেব বাগ্দীকে পাবেনি। কমিটি থিকে আমি আজই ইস্তফা দিলম।

বলেই ঝটিতে বেরিয়ে যায় সহদেব। কিন্তু সহদেব নিজে থেকে বেরিয়ে যেতে চাইলেও পার্টির বিষ নজর থেকে তার এত সহজে ছাড় নেই। বিশেষ করে সতীশ প্রধান চন্দ্রবোড়া সাপের মতো রাগে ফুলতে থাকে ভিতরে ভিতরে। দলের কাছে সহদেবকে ছোট করতে জিলিপির প্যাঁচ আঁটে সারাক্ষণ। উটকোআটকা বদনাম রটাতে থাকে। উপর নেতৃত্বরাও সতীশ প্রধানের তালে তাল ঠুকছে দেখে সহদেব দল বদলায়।

এখন সে হলুদ পার্টির নেতা। তার পেছনেও ঢের লোক আছে।তবে প্রকাশ্যে অনেকেই বেরোতে সাহস পায় না। তার উপরে হরেক প্রকল্প,হরেক ভাতা থেকে বাদ পড়ে যাওয়ারও ভয় আছে বুকে। আড়ালে শুধু সহদেবকে ভরসা দ্যায়,
---ভাবিসিনি সহদেবদো তোদের ছাপেই বুতাম টিক টিপবো।
কেউ তো আবার আরো একঘাট উঠে বলে,
---সহদেবদো অরা ত ভোটের আগে ভোটার পিছু পাঁচশ দিবে বোলছে তরা কত দিবি?
সহদেব তাদের আশ্বস্ত করে,
---আমি আছি যখন তোদের কুনু চিন্তা নাই
সেই আশাতেই সহদেবকে গোপনে অনেকেই ধরে রেখেছে। সহদেব এসবই জানে। কখন কে কোন দিকে পাল্টি খাবে বোঝা মুশকিল! তবু সবার উপর বিশ্বাস রেখে চলাই নেতার কাজ। এই শিক্ষাই পেয়েছে সে পার্টির ক্লাসে।
আর যে শিক্ষা প্রথম থেকেই সহদেবের রক্তে টগবগ করে তা হল অন্যায়কে পশ্রয় না দেওয়া। তার জন্য সে সবরকম ঝুঁকি নিতে রাজি। পাড়ার অনেকেই তাকে বলে,
---তোর যা ফাটা মুখ সহদেব! কুন দিন না কুনদিন বাড্ডান খেয়ে যাবি অদের হাতে।
বউ তার রাগ উগরে দ্যায়,
---বেশি তমার এঁড়ামি ভাল নয়। আরো ত লোগ আছে কই তাদের ত মাথাবেথা নাই? তমারই যত জ্বালা?
সহদেব কারো কথাকেই খুব একটা পাত্তা দ্যায় না। তার সাফ কথা,
---অই পঁদে মুখ দিয়ে চলা মোর ধাতে নাই। যা বোলবো সামনে দাঁড়িয়ে বোলবো তাতে গদ্দান যায় যাবে।
আজকেও তাই সহদেব লোকজনের মাঝে দাঁড়িয়ে মহাদেবের কাছে কৈফিয়ত চায়,
---তরা কেন পরেশকে কাজ করতে দিবিনি বল?
মহাদেব মেজাজি গলায় বলে,
---তুই কে যে তোকে জবাব দিতে হবে?
---আমি একজন গ্রামের ভোটার। আমারো জানার হক আছে।
---তুই যে দলের ভোটার সেই দলের লোককে চোখরাঙাবি যা। এখিনে এসব চলবেনি।তাবাদে যার কথা বোলছু সে ত কিছু বলেনি! তোর এত দরদ ক্যানে?
সহদেব কিছু একটা বলতে যাবে কি অম্নি পাশ থেকে পরেশ রিনরিনে গলায় বলে উঠে,
---সহদেবদো ত ঠিক বোলছে জবক্ষারের লিস্টি থেকে ক্যানে মোর নাম কাটা হয়েছে বোলতে হবে?মোর জমকার্ডে নাম থাকতেও ক্যানে মোকে কাজ করতে দিবিনি?
সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল রতন। রতন দোলই। পার্টির একনিষ্ঠ কর্মী সে। শক্তপোক্ত শরীর হলে কি হবে যেহেতু পার্টি ন্যাওটা সেহেতু পুরস্কার স্বরূপ তাকে বিশেষ পদ দেওয়া হয়েছে। রতন হোলো একশ দিনের কাজের জলম্যান। সবাই ঘর থেকে বোতলে জল আনে। রতন কুটোটিও নাড়ে না। তবে মুখে তার বোম ফাটে। সেই মুহুর্তে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় ফাটালো,
---বেশি কেরতানি দেখাবিনি । খুব তো হলুদ পাটির পতাকা লিয়ে চেঁচাউ। তোর সেই বাপগুলাকে বলনা অকে কাজ দিতে
---বাপ তুলে কথা বলবি নি রতন! ন্যাজ নেড়ে নেড়ে ঘুরে আর কদ্দিন চালাবি?
এতক্ষণ চুপ ছিল জবওয়ার্কের মাস্টার সেভেন ক্লাস পড়া পঞ্চানন। পরনে লুঙ্গি আর হাফশার্ট। হাতে বিয়েতে যৌতুক পাওয়া ঘড়ি। চোখে ময়লা রঙচটা ফ্রেমের চশমা। মাস্টার রোলের কাগজখানা ব্যাগে ঢুকিয়ে দু'পা এগিয়ে তেড়ে আসে। তর্জনী ছুরির মতো উঁচিয়ে সহদেবের মুখের কাছে এনে গম্ভীর করে বলে,
---বিশিঙ্খলা পাকাতে এসছো এখিনি। হাটাও শালা মীরজাফর। আগে মোদের পার্টির খেয়ে এখন ওই পার্টির দালালি মারাচ্ছ।দেখবে কী কোরবো?
এবার পরেশও স্থির থাকতে পারে না।বলে,
--কী করবি তুই? মারবি?
---দরকার হলে তাই কোরবো। জবক্ষারের কাজ আমরা যাকে পারবো দুবো তোর কী?

 কথা কাটাকাটি যখন তুঙ্গে, তখনি হঠাৎ রতন ছুটে এসে পরেশের টুঁটি চেপে ধরে। সহদেব তাদের ছাড়াতে গেলে পঞ্চানন অন্য একজনের হাত থেকে কোদাল ছাড়িয়ে তার পেছনে কোপ মারে। লুটিযে পড়ে সহদেব। তাকে ওভাবে রক্তাক্ত দেখে কয়েজন মাহাদেবকে ফেলে দমাদ্দম কিল চড় লাথি মারতে শুরু করে। একটা হুলুস্থুল কান্ড বেঁধে যায়। পাড়া থেকে মেয়ে বুড়োরা ঝাঁক বেধে ছুটে আসতে থাকে। এরই মাঝে একদিকে নীল পার্টির স্লোগান তো অন্যদিকে হলুদ পার্টির স্লোগান। ভিড়ের মাঝে তখন অচেতন সহদেব। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে মহাদেব,রতন, পরেশ। পঞ্চানন চোখের পলকে বেপাত্তা। তবে কেউ জানেনা কখন সহদেবের ছেলে সব ঘটনা তার ফেসবুকে লাইভ করেছে।গাঁয়েও এখন মোবাইলের রমরমা। হাঁড়িকুড়ির ঠোকাঠুকির শব্দও নিমিষে চোখে চোখে চালান হয়ে যায়। তাই হোয়েছে এবারেও। শেষমেষ সবাইকে যে যার পার্টির সম্পদ ভেবে হাসপাতালে নিয়ে যায়।

বিকেলের লোকাল নিউজ চ্যানেলে সবাই দেখে সহদেবের এক হাতে স্যালাইন,অন্যটায় রক্ত। নাকে অক্সিজেন নল। কোমরে ব্যান্ডেজ। পাশের বেডে মহাদেব। হাত ভেঙেছে তার। রতন, পরেশেও গুরুতর জখম। সাংবাদিকের মুখোমুখি রুলিং পার্টির অঞ্চল-নেতা বলছেন,
--ঘটনাটা শুনেছি। ওখিনে জমকার্ডের কাজ লিয়ে বিরোধীরা একটা বিশিঙ্খলা বাঁধিছে। অর সঙ্গে আমাদের দলের কুনু যোগ নাই। আইন আইনের পথে চলবে। উন্নয়নকে যারা বাধা দিবে তাদের কুনু ছাড়া হবে নি।
---কিন্তু আপনাদের দলের মহাদেব বাগ্দী, রতন ও পঞ্চানন তো সরাসরি ঘটনায় জড়িত। ভিডিওতে তো সেটাই দেখাচ্ছে।
---যাদের নাম বোলছেন,অরা আমাদের পার্টির কেউ না। জমকার্ডের কাজে গ্রামের অনেকেই থাকে। ওরা বিরোধী দলের লোক। পার্টিকে বদনাম কত্তে ইসব নাটক কচ্ছে।

খবরটা বিদ্যুৎ বেগে ছড়িয়ে পড়ে জেলা,রাজ্য,দেশ,
বিদেশ সর্বত্র। হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকা মহাদেবে আর রতনের কাছেও। সন্ধ্যা পর্যন্ত দু'দলেরও কেউই তাদের কাছে ঘেঁষে না।  রাত জেগে বসে থাকে কারো বউ,কারো বাবা,কারো মা। ঘুম আসেনা তাদের কারো চোখে। রাগে গরগর করতে থাকে রতন। 
---শালা নিমখারাম। একবার ভাল হতে দে।তারপর..
মহাদেব তার ভাঙা ডান হাতটা বাম হাত দিয়ে আলতো করে চাগিয়ে বলে,
--যার জন্ন করি চুরি সেই বলে চোর। ছাড়ব ভেবেছু!
পরেশও তাদের সুরে গলা মেলায়,
---শালা গুয়ের কুনু পিঠ ভালো নয়। সবগুলান বেইমান বাচ্চা
শুধু মহাদেব কিছু বলতে পারে না। কাত হোয়ে শুয়ে শুনতে থাকে সবার কথা। অনেকটা রক্ত ক্ষরণ হযেছে তার। যন্ত্রণা নাশক কোন ওষুধেই সহদেবের যন্ত্রণার উপশম নেই।কেবল অবিরত নোনা জল গড়িয়ে পড়ছে তার দু'চোখ বেয়ে।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments