জ্বলদর্চি

গওহরজান - এক বিস্মৃত অধ্যায় - ১০/দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

গওহরজান - এক বিস্মৃত অধ্যায় 
পর্ব - ১০                                

দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী    

এরপরে শুরু হলো আব্বাস ও তার বাবা গোলাম মেহেদী হোসেনের আসল খেলা। প্রথমে তাদের পুরো পরিবার ও আত্মীয়স্বজনদের সেখানে নিয়ে এলেন এবং পরবর্তীকালে নিচের তলার ভাড়াটিয়াদের সমস্ত ভাড়া আদায় করতে লাগলেন। শুধু তাই নয় এত লোকের আগমনে গওহরের জীবনের শান্ত পরিবেশ নষ্ট হতে থাকলো এবং তার প্রত্যেকদিনের রেওয়াজে ব্যাঘাত ঘটতে লাগল। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে গওহর অতিষ্ঠ হয়ে নিজেই বাধ্য হলেন সেখান থেকে চলে যেতে। বেণ্টিক স্ট্রীটের বাড়িটি বিক্রি করে ফ্রি স্কুল স্ট্রীটে একটি বাড়ি কিনে সেখানে বাস করতে শুরু করলেন। 'মুটা ম্যারেজ' করে গওহর চেয়েছিলেন এমন একজন মানুষকে যে তার বৈষয়িক সম্পত্তির দেখভাল করবে, বিভিন্ন আইনী ঝামেলা, রেকর্ডিং ও অনুষ্ঠানের ব্যবস্থার সম্পূর্ণ দায়ভার নেবে যাতে গওহর নিজে পরিপূর্ণভাবে সঙ্গীতে মনোনিবেশ করতে পারেন। আব্বাস সেই দায়িত্ব ভালোভাবে পালন করছিল কিন্তু গোলমাল শুরু হল আব্বাসের বাবাকে নিয়ে। আব্বাস তার বাবার কথায় প্রভাবিত হয়ে বিভিন্নভাবে অশান্তি করতে শুরু করলো। এছাড়াও গওহরের ম্যানেজার হওয়ার সুবাদে কলকাতার উঠতি কমবয়সী বাঈজীদের সাথে প্রেমের খেলা শুরু করল। এই সমস্ত ঘটনা গওহরের কানে যেতে গওহর আব্বাসকে সতর্ক করে দিলেও কোনো কাজ হচ্ছিল না।      
                                                           .    
১৯১৩ সালে আব্বাসের সাথে গওহরের 'মুটা ম্যারেজে'র মাধ্যমে যে বৈবাহিক চুক্তি হয়েছিল আব্বাসের ক্রমাগত দুরভিসন্ধিমূলক আচরণে অতিষ্ঠ হয়ে ১৯১৬ সালে আব্বাসের সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা করে সেই সম্পর্ক থেকে মুক্তি পেতে চাইলেন। ইতিমধ্যে চিৎপুরের বাড়ির নিচের তলার ভাড়াটিয়াদের কাছ থেকে ভাড়ার টাকা আব্বাস গওহরের ব্যাংক একাউন্টে জমা করা বন্ধ করে দিয়েছিল। উপরন্তু গওহরের নিজের নামের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে গওহরের অজান্তে ' পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি'র সুবাদে ক্রমাগত টাকা তুলে নিয়েছিল। মামলা হলে কি হবে বিভিন্ন সময়ে গওহরের লেখা আব্বাসকে চিঠিগুলি আদালতে তার বিপক্ষে গিয়েছিল। ১৯১৮ সালে বিচারক রায় দানকালে গওহরের স্বপক্ষে মামলাটি খারিজ করে দেন এবং তার সাথে আব্বাসের ' মুটা ম্যারেজ' বাতিল করে দিয়ে গওহরকে মুক্তি দিয়েছিলেন। গওহরের বিবাহিত জীবন এই ভাবে শেষ হয়ে গেল। কিন্তু গওহর যখন মামলা থেকে অব্যাহতি পেলেন তখন দেখলেন আব্বাসকে অর্থনৈতিক লেনদেন করার অধিকার দেওয়ার ফলে তার সঞ্চিত অর্থ সব শেষ করে দিয়েছে। মানসিকভাবে অবসন্ন এবং অর্থনৈতিকভাবে নিঃস্ব হয়ে গেছলেন।  

ফল স্বরূপ চিৎপুর রোডের বাড়িটি পূর্বেই বিক্রি করে দিয়েছিলেন আব্বাসের সাথে মামলার খরচ সামলানোর জন্য। পরবর্তীকালে তাঁর বিলাসবহুল খরচের জন্য এবং বিভিন্ন মামলায় জড়িয়ে পড়ার জন্য ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের বাড়ি এবং নাখোদা মসজিদ সংলগ্ন 'গওহর বিল্ডিং'ও বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। অবস্থা এমনই দাঁড়ালো একসময়ের বিলাসবহুল বাড়ি ছেড়ে ওয়েলেসলি স্ট্রিটে মৌলানা আজাদ কলেজের সন্নিকটে একটি বাড়ির ছ' তলায় দুটি ছোট ঘর নিয়ে থাকতে বাধ্য হলেন এবং সংগীতের প্রশিক্ষণ দিয়ে কিছু অর্থ উপার্জন করতে লাগলেন। তিনি নিজেকে নিয়ে চিন্তা করলেন কিভাবে এই অবস্থা থেকে মুক্ত হবেন, কারণ সঙ্গীতই তার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।  প্রেম, প্রণয়, মুটা ম্যারেজ থেকে মুক্ত হয়ে গওহর এতদিনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন কিন্তু জীবনের সোনালী সময় তিনি তখন অতিক্রম করে এসেছেন। এই সময় একাকীত্বকে গওহর মেনে নিতে পারছিলেন না যার ফলে পেশাদারী প্রতিদ্বন্দিতা থাকা সত্ত্বেও তাঁর বন্ধু আগ্রাওয়ালি মলকা জানের সাথে একত্রে থাকতে শুরু করলেন।                       

 কৈশোরে ছগন রাই, যৌবনে নিমাই সেন, পরিপূর্ণতার সময়ে অমৃত কেশব নায়েক ও আব্বাসের সাথে বিগত জীবনের আনন্দদায়ক দিনগুলি পেরিয়ে জীবনের ঝরা বসন্তে এসে এখন তিনি স্থির করলেন সংগীতের প্রশিক্ষণ দেবেন। তাঁর আর্থিক অবস্থার কথা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হতে দেখা গেল বহু সম্ভ্রান্ত মানুষ তাঁকে অর্থ সাহায্য করতে এগিয়ে আসছেন। গ্রামোফোন কোম্পানীও তাঁকে অল্প কিছু সাম্মানিক দিয়েছিলেন, কারণ গওহরের গানের রেকর্ডই তাদের এদেশে ব্যবসার দৃঢ় ভিত্তি স্থাপনের সুযোগ করে দিয়েছিল। কিন্তু গওহরের আত্মসম্মানবোধ এতই প্রবল ছিল যে কারো করুনার প্রার্থী হতে মানসিক দিক দিয়ে তার আপত্তি ছিল। কেউ যদি তাঁকে তার শিল্পের বিনিময়ে অর্থ দিতেন তাহলে তিনি সাদরে গ্রহণ করতেন কিন্তু তাদের অর্থে বিনা পরিশ্রমে তাঁর গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যাপারটা মেনে নিতে পারতেন না। এই সময় তিনি স্থির করলেন শান্তির খোঁজে কলকাতা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাবেন।    

  এক ধনী সঙ্গীতপ্রেমী তাঁকে দার্জিলিংয়ে থাকার জন্য অনুরোধ করে তাঁকে একটি বাংলোতে থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। সেখানের শান্ত নিরিবিলি পরিবেশে যাতে সঙ্গীতের সাধনা করতে পারেন। গওহর তাঁর প্রস্তাবে রাজী হয়ে ১৯২৪ সালে কলকাতা ছেড়ে দার্জিলিংয়ে চলে যেয়ে নিজের সঙ্গীত চর্চাকে পরিশীলিত করার সাথে সাথে স্থানীয় ছাত্র-ছাত্রীদের প্রশিক্ষণ দিতেন। পূর্বেই বলেছি গওহরের জীবনে যখনই সুখ-শান্তি এসেছে বিধাতা অলক্ষ্যে থেকে তাতে বাধা দিয়েছেন। বিধাতার অভিশাপ গওহরের জীবনের প্রতি অধ্যায়ে এসেছে। দার্জিলিঙে থাকাকালীন তাঁর এই প্রশিক্ষণ দেওয়াকে কেন্দ্র করে স্থানীয় অধিবাসীরা তাঁর থাকার ব্যাপারে আপত্তি করেন, কারণ যখন তারা জানতে পারেন যে তিনি একজন পেশাদারী বাঈজী। প্রতিবেশীরা ভেবেছিলেন এই বাঈজীর সংস্পর্শে এসে তাদের ছেলেমেয়েদের চরিত্র খারাপ হয়ে যাবে। যে প্রতিবেশীরা আগে তাঁর সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছিল তারাই তাঁর সম্বন্ধে কুৎসা রটনা করতে লাগল। যে শান্তির আশায় গওহর দার্জিলিঙে গিয়েছিলেন সেই শান্তির পরিবর্তে তিনি বদনাম পেলেন। অবশেষে একদিন দার্জিলিং ত্যাগ করে কিছুদিন দ্বারভাঙ্গাতে থাকার পরে রামপুরের নবাব হামিদ আলির প্রাসাদে গিয়ে উঠলেন। সেখানে নবাবের জেনানা মহলে তাঁর থাকার ব্যবস্থা হল। নবাবের সাত বৎসরের কন্যা নন্নির তাঁকে এত ভাল লেগেছিল যে তাঁকে 'গওহর আম্মা' বলে ডাকতে শুরু করলো। এরপরে সেখানে এমন একটি ঘটনা ঘটল যাতে নবাবের সাথে গওহরের সুসম্পর্কে ফাটল ধরল।      

  ১৯২৭ সালে ভারতের ভাইসরয় লর্ড আরউইন রামপুরে নবাবের অতিথি হয়েছিলেন। গওহরজানের কথা তিনি কলকাতায় শুনেছিলেন। তাঁর ইচ্ছাতে রামপুরের নবাব এক সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করলেন যেখানে ভাইসরয় গওহরজানের গান শুনবেন। যথাসময়ে অনুষ্ঠান শুরুর পূর্বে গওহর তাঁর সোনালী দিনের জমকালো পোশাক পরে লাস্যময়ী সাজসজ্জা করে দুজন ছাত্রীকে নিয়ে মঞ্চে এসে উপস্থিত হলেন। ছাত্রী দুজন তানপুরা সহযোগে তাঁকে কণ্ঠসংগীতে সহযোগিতা করবেন। ব্রিটিশ সরকার, বিভিন্ন মহারাজা ও নবাব দরবারে তিনি এ যাবৎকাল যতগুলি পদক পেয়েছিলেন সেগুলি তার পোশাকের উপরে আটকে অনুষ্ঠান শুরু করলেন। সে দিনের অনুষ্ঠানে তিনি বয়স বা মানসিক পরিস্থিতিকে উপেক্ষা করে অসাধারণ এক সংগীত অনুষ্ঠান পরিবেশন করেছিলেন লর্ড আরউইন উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে মঞ্চে উঠে গওহরের পদক গুলি দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করে (মুসলিম আদব-কায়দা উপেক্ষা করে) তাঁর পদকগুলি ছোঁয়ার জন্যে তাঁর বুকের উপরে হাত রেখে দেখেছিলেন। এই ঘটনায় গওহর নিজে খুব অস্বস্তিতে পড়ে গেলেন যেটি তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে ঘটেছিল। গওহরের বুকে হাত ছোঁয়াতে দেখে রামপুরের নবাব ক্ষোভ প্রকাশ করলেন কিন্তু যেহেতু তিনি বৃটিশের কাছ থেকে অনুদান পান সেজন্য ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ করলেন না। কিন্তু তিনি ভুল ধারণা করলেন যে গওহরের মৌন সম্মতিতেই যেন ভাইসরয় তাঁর পদকগুলি স্পর্শ করার অছিলায় গওহরের বক্ষদেশ স্পর্শ করেছেন। অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পরে তিনি গওহরকে ভৎর্সনা করে বললেন সে যেন ইচ্ছাকৃতভাবে সাহেবকে তার বক্ষ দেশ স্পর্শ করতে দিয়েছিল। এই কথা শুনে গওহরের চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে এলো কারণ ভুল ভেবে নবাব তাকে ভৎর্সনা করলেন। এই ঘটনার পরে নবাবের কাছ থেকে তিনি ক্রমাগত দুর্ব্যবহার পেতে শুরু করলেন এবং নিজের সম্মান বোধ চিন্তা করে ১৯২৮ সালে তিনি নবাবের সাথে আপোস করতে না পেরে রামপুর পরিত্যাগ করে বম্বে চলে গেলেন।   
             
ক্রমশঃ…….

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments