জ্বলদর্চি

পদ্মপাতায় শিমুল-২০/সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়

পদ্মপাতায় শিমুল-২০

সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়

জব্বলপুর, মধ্যপ্রদেশ

বিধাতা কিন্তু ভাল লেখেন নি তো আমার কপালে। যে মা একেবারে চোখের আড়াল করতেন না, সেই মা মাত্র তিপ্পান্ন বছর বয়সে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন চিরদিনের মতন। তাঁর নয় বছরের কোলের আদরের মেয়েকে আর বড় হতে দেখলেন না। মনমরা হয়ে থাকতাম। যদিও দাদা দিদিরা তাদের অপত্য স্নেহে কোলে টেনে নিয়েছিল। কিন্তু আমার মা -কে মাঝে মাঝে মনে পড়ে। বিশেষ করে জন্মদিনের দিন। আসতে আসতে বাবাকেও হারালাম মাত্র সতেরো বছর বয়সে। সুস্থ চেহারার বাবা হার্ট এ্যটাকে হঠাত আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন।

 নিজেকে 'অপয়া' ভাবতে শুরু করলাম। কেন? সবার কত বয়স্কা মা বাবারা বেঁচে আছেন-আর আমাদের মা বাবা কেন চলে গেলেন অসময়ে। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম আর কোনদিন জন্মদিন পালন করব না। পরে ভাইপো ভাইঝিদের আবদারে, কান্নাভরা প্রশ্নে “কেন পিপির(ছোটপিসি”)র জন্মদিন হবে না যখন সবার জন্মদিন হয়।" রাজী হতেই হল। কারোর চোখের জল দেখতে পারি না আজও। না কারোর সাথে বাদ-প্রতিবাদ করতে জানতাম? সবাইকে নিজের মতো করে ভালোবাসতাম।

 বেশ আহ্লাদী হয়েই তো বেড়ে উঠছিলাম। নাচগান, পড়াশুনার সঙ্গে গল্পের বই পড়া। কথায় কথায় অভিমান করে বসে থাকতাম। আর অভিমান ভাঙ্গানোর জন্য সদা সর্বদা কেউ না কেউ তৈরি থাকত, দাদা দিদিদের মধ্যে।

 কিন্তু আজ তো আমার কথা কেউ ভাবে না। এমনি হয় বোধহয়। তখন বুঝিনি ভালো করে। জীবনটা যে একটা নাট্যশালা ভালভাবেই বুঝে গেলাম। দেখি হাসি-কান্নার, রাগ-অভিমানের পালা। এক-একটা পর্ব ওঠা-নামা করছে। তাই আমি হাসির বই ছাড়া সিনেমা দেখি না-টিভি দেখি না।

 কিন্তু এক ছন্দে জীবন তো কারোর কাটে না। একটানা সুখই বা কে কবে পেয়েছে? শিমুলের গলার স্বরে একটু দুঃখ... একটু হতাশা মেশানো।

 --পলাশ বেশ লম্বা হাই তুলে একটা জোর দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নাঃ চলো আজ আর না। আজ ওঠা যাক। বিকেল শুরু হতে চলেছে। তুমি গাছে জল দাও আমি চটজলদি তোমার আর আমার জন্য কফি করে আনি।
 
 জল দিয়ে আবার গার্ডেন চেয়ারে বসলাম দুজনে। আর শুরু হল স্মৃতির ট্রেণ... প্রথমে মন্থর গতিতে পরে একটু জোরে... তারপর আরো জোরে...

 এই ঘটনায় স্বাভাবিক ভাবেই সবচেয়ে ক্ষতি হয়েছিল আমার আর ছোট ভাই বাবুর। আমরা হয়ে গেলাম বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অপু আর দুর্গা। সন্ধ্যের পর মা’র কোলে মুখ গুঁজে চুপটি করে শুয়ে থাকা বন্ধ হয়ে গেল। কথায় কথায় যে অভিমানে ঠোঁট ফুলিয়ে দৌড়ে এসে মায়ের আঁচলে চোখ ঘষতাম, তাও বন্ধ। একধাক্কায় একেবারে আরো শান্ত হয়ে গেছিলাম। আয়নায় দেখতাম... আমার চোখে সব সময় কেমন একটা ভয়মাখানো উদাসীন দৃষ্টি। সাজগোজ, হৈ-হুল্লোড় কোনও কিছুতেই আজও আমার কোনো আগ্রহ নেই। ভাবতাম সব সময় “বিধাতা এত পাষাণ কেন? আমার সব কিছুতেই এত বাঁধন কেন?”

 --সরি! কথার মাঝখানে আবার বলছি। জব্বলপুরে তো বিখ্যাত জলপ্রপাত-নর্মদা ফলস? সেই সম্বন্ধে একটু বলবে? পলাশ ইচ্ছে করে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল। আমি তো কিছুই দেখি নি।

 --শুধু জলপ্রপাত নয়। ব্যালেন্স রক, চৌষট্টী যোগীনি, নর্মদা নদী, কানহা কিসলি জঙ্গল এসবের জন্যও বিখ্যাত জব্বলপুর।

--ব্যালেন্স রক-টা আবার কি? পলাশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।

 --বিজ্ঞানসম্মতভাবে একটা বিশাল পাথর একটা মাত্র পয়েন্ট-এ লেগে আছে আর একটা পাথরের পয়েন্টের উপর। মানুষের জীবনও এই ব্যালেন্সেই থাকে আজীবন। দুটো পাথরকে আলাদা করার জন্য ব্রিটিশরা অনেক চেষ্টা করেছিল। কিন্তু নাঃ! তারা পারে নি। মানুষের জীবনকে নিয়েও ছিনিমিনি খেলে অদৃশ্য কোনো শক্তি। কিন্তু ব্যালেন্সেই থাকে জীবন। তাই না?

  চৌষট্টী যোগীনি মন্দির -টা দেখলে খারাপ লাগত খুব। সেখানে চৌষট্টী-টা নারী মূর্তি ভাঙ্গার পর যখন তার পরের মূর্তি ভাঙ্গতে শুরু করে, তখন নাকি বোলতার কামড়ে সেই কারিগরেরা মারা যায়। খুব জাগ্রত মন্দির বলে শোনা যায়।

আর কানহা কিসলি জঙ্গল তো চম্বলের দস্যু দের জন্য বিখ্যাত। জানোই সেটা।

  আগেই বলেছি আমার প্রতি দিদিয়ার একটু বেশি দুর্বলতা ছিল। অনেকটা বাৎসল্যও বলা যায়। দিদিয়া অনেকটা করুণ ভৈরবীর মতো। নারীর যতরকম রূপ আছে, সব মিলিমিশে বাইরে এসে এমন দেখায়, যার তুলনা দিদিয়া নিজেই। আর অন্য ভাই বোনের সাথে তুলনা চলে না। চুপচাপ থাকে ছোট্ট বোন, দিদিয়া মানতে পারত না।

 দিদিয়া ভাবত “এই একরত্তি মেয়ে সব থেকে বঞ্চিত হল। আমরা মা’র কাছে কত বায়না করেছি, কতদিন মায়ের ভালবাসা পেয়েছি। শিমুলের কপালটাই খারাপ, শুধু ওই এসব থেকে বঞ্চিত হল। মা ও দেখে যেতে পারলেন না সাধের ছোট মেয়েটার বড় হওয়া।”

 দিদিয়া তখন আঠাশ বছরের মেয়ে। পড়াশুনোয় খুব ভাল ছিল। তাছাড়া, সেলাই, গান, রান্না সবটাতেই সে সেরা। আর ছিল একটা কঠিন ব্যক্তিত্ব।

দিদিয়ার জন্যেও ভাল ভাল সম্বন্ধ আসছে। বাবাকে পরিষ্কার জানিয়ে দিল, সে বিয়ে করবে না। ওর জন্যে বিয়ের চেষ্টা না করতে।

-কেন?- জানতে চাইলে দিদিয়া জানাল, “তাহলে এই ছোটছোট ভাইবোনদের কে দেখবে, বাবা? ভাইদের বৌরা যে নিজের সন্তানের মত এদের দেখবে তার নিশ্চয়তা কোথায়? ওদের মানুষ করতে হবে, নয়ত মায়ের আত্মা খুব কষ্ট পাবে।”

  মেজমেয়ের কথা শুনে বাবা একটু চুপই হয়ে গিয়েছিলেন। তখন দিদিয়াই স্বান্ত্বনা দেওয়ার মত করে বলেছিল, “আমার কথা চিন্তা কোরো না বাবা। আমি তো কলেজে পড়াচ্ছি। নিজের ভালমন্দ বোঝবার যথেষ্ট বয়স হয়েছে আমার। ঠিক সময়ে বিয়ে হলে শিমুল আর বাবুর মত ছেলে মেয়ে তো হত, তাই না?”

 বাবা আর জোর করেন নি। তাছাড়া বাবা জানতেন, ছোটবেলা থেকে তাঁর মেজ মেয়ে কেমন জেদি। যা করবে স্থির করে, তাই করেই ছাড়ে। ওই বয়সেই দুটো বিষয়ে এম.এ. পাশ করে জব্বলপুর ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনার কাজে ঢুকে গিয়েছে।

তবে বাবা নিজেকে বোধ হয় তার জন্যে ক্ষমা করতে পারেন নি। দিদিয়ার দিকে তাকিয়ে বাবা দীর্ঘশ্বাস আর চোখের জল ফেলতেন।

  দিদিয়া নিজের হাতে শিমুল আর বাবুর ভার নেওয়ায় বাবা যেমন নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন, ততটাই কষ্ট পেয়েছিলেন... মেজ মেয়ে বিয়ে না করার জন্য। দিদিয়া সেসবে আমল না দিয়ে মায়ের স্নেহে মানুষ করতে লেগেছিল আমাদের।

তার সবচেয়ে বেশি পক্ষপাত বা দুর্বলতা ছিল আমার প্রতি। তবে দিদিয়ার আশঙ্কা সত্যি হয় নি। বাকি দাদারা বা বৌদিরাও তটস্থ থাকত তখন ছোট বোনকে নিয়ে। কারণ দিদিয়া যেখানে বাড়ির কর্তৃ। তার কথার নড়নচড়ন হবার সাধ্য কারুর নেই। কোনও দিক দিয়ে আমি আর ভাই যেন কষ্ট না পাই, অন্তত মা আর বাবার অভাব যেন কোনমতেই বুঝতে না পারি, সেদিকে সতর্ক থাকত সব সময়।

  খুব রোগা ছিলাম। কেউ রোগা বললে, দিদিয়া আর সেজদার খারাপ লাগত। বলত বাইরের লোক ভাবে, “মা বাবা মরা ভাই -বোন দুটোকে ঠিকমত খেতে দেয় না।” তাই দিদিয়া জোর করে খাওয়াত। আজ মনে হলে হাসি আসে খুব।

  তবে অতিরিক্ত ঘেরাটোপের মধ্যে রাখাতে পরবর্তী জীবনে আমার চূড়ান্ত ক্ষতি হয়েছিল। এদিকে সকলের আদরে, আহ্লাদে আমার মধ্যে বেড়ে উঠেছিল একটা অদ্ভুত ছেলেমানুষি আর সরলতা। জগতের নোংরা বা জটিল ক্যালকুলেশন সহজ সরল মাথায় ঢোকে না আজও। এটা কিন্তু একটুও বাড়িয়ে বলছি না। যেই দেখত... সেই বলত, “মেয়েটা কি বড় হবে না? এক রকমই আছে।” নাঃ আমি আজও বড় হই নি...যা কিছু প্রত্যক্ষ, স্পষ্ট তারই সঙ্গে কাটছে আমার যাবতীয় বেলা।

এইভাবেই জব্বলপুরে আমার তরুণী জীবন নর্মদার নৌকোয় উঠে তির তির করে বয়ে চলল ...

  জব্বলপুরের খামারিয়ায় পাহাড়ের ঢালের নিচে আমাদের বাড়ি ছিল। পাহাড়ের কোল বেয়ে নর্মদা নদীর একটা সরু শাখা বয়ে যেত। ঘন বর্ষায় তুমুল আকার ধারণ করত সেই নদী।

২৫৩ ইস্টল্যান্ড-এন টাইপ ছিল বাড়ির ঠিকানা। গান এন্ড এম্বুলেশন ফ্যাক্টরীর সারি সারি এক ধাঁচের সব কোয়ার্টার। কাঠের গেট দিয়ে ঢুকে লাল কাঁকড় বিছানো পথ দিয়ে বারান্দায় পৌঁছতে হত। পাশাপাশি একহারা সব লম্বা বাংলো। সামনে সিমেন্টের টানা বারান্দা। বাড়ির পিছন দিক বৃষ্টির জল যাবার জন্য নালা কাটা। ওপরে একটা চ্যাপ্টা পাথর ফেলা থাকত। তার ওপর দিয়ে পেছনের বাড়ি যাওয়া যেত। খুব পরিষ্কার ছিমছাম ছিল খামারিয়া। শীতকালে এত ঠান্ডা পড়ত-সবাই বলত কাশ্মীর।

  ঢোকবার গেটের দু পাশে তারের বেড়ায় বোগেনভেলিয়া ফুল ঝুলত আর ঝুলত ক্রিসেনথিমাম। তাদের তলায় লম্বাটে সবুজ সিমেন্টের বাক্সে রজনীগন্ধা আর বেলি ফুল ফুটত। বারান্দায় থাকত সারি সারি টবে ক্রোটন এর গাছ। আমি আবার ক্রোটন গাছের মাথায় কাঁচা ডিমের খোসা দিয়ে সাজাতাম। মা-এর হাতে লাগানো ডালিম গাছ ছিল বাগানের এক পাশে।

  আমাদের শোবার ঘরের জানলার পেছনে পেয়ারা গাছ ছিল। বাড়ির উঠোনে ছিল আমগাছ...একটা আঁটি থেকে বিশাল গাছটা ফলের ভারে নুয়ে থাকত। আর?

দুপুরবেলা সেই কাঁচা আম নিয়ে সোজা পপ্পিদের বাড়ি। নুন, লাল লংকা, একটু সড়ষে বাটা আর সড়ষের তেল। ~আহা! আজও খুঁজে বেড়াই সেই দিনগুলো।

ফ্যাক্ট্ররী থেকে মালী আসত বাগান পরিচর্যার জন্য। লোকে এমন বাড়ি স্বপ্নে দেখে। আর আমি এমনি বাড়িতেই বড় হয়েছি জব্বলপুরে।

দেখেছি- মুরগি, বাছুর খেতে বিশাল বড় বড় অজগর সাপ আসত । আমরা খেলছি হঠাত হিস হিস করে প্রায় দুই -তিন ফুট অজগর এসে খপ করে ধরে ফেলল মুরগি। সবাই পালিয়ে এলাম ঘরের ভেতর। আমরা দেখছি সামনে থেকেই নিয়ে যাচ্ছে মুখে করে সেই মুরগি। কী ভয়ঙ্কর তা না দেখলে বিশ্বাস হবে না।

  অবশ্য এখন আর সেই খামারিয়া নেই। সব কোয়ার্টার ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে।

জব্বলপুরেই বায়োলজি তে অনার্স নিয়ে ভর্তি হলাম। মাইগ্রেশন ফর্ম আসতে দেরী হল। কলেজ থেকে জানাল যতক্ষণ না মাইগ্রেশন সার্টিফিকেট এসে পৌঁচোচ্ছে ততক্ষণ ভর্তি করা হবে না । বললাম না...জীবনটা একটা যুদ্ধ আমার।

  তারপর মাইগ্রেশন সার্টিফিকেট আসতে দেরী হলেও ভাল রেজাল্ট এর জন্য জব্বলপুরের নামকরা মেয়েদের কলেজ...  গভর্নমেন্ট এম এইচ কলেজ-এ ভর্তি হলাম। সাথে চলল সেতার শেখা। আমার কিন্তু ছোটবেলা থেকে গিটার শেখার খুব শখ ছিল।

--গীটার তো বাজাও। কোথায় শিখলে তাহলে?

--তাহলে শোনো সেই মজার গল্প। আমার এক পার্শী বান্ধবী ডরোথির দাদা গীটার শেখাত। আমার সেজদা বাবাকে বলাতে বাবা জোর গলায় বলে উঠেছিলেন, “ নাঃ নাআআ! একদম না! কোন অল্প বয়সী ছেলে এসে ওকে গীটার শেখাক-তা আমি চাই না। কোন বয়স্ক ভদ্রলোক কে দেখো খুঁজে পাও কিনা।”

  তারপর সেজদা ফ্যাক্ট্ররী তে অনেককে জানাতে মধ্যপ্রদেশের একজন বয়স্ক রেডিও আর্টিস্ট কে পেয়েছিল। কিন্তু গীটার না। আমি তাঁর কাছেই শিখেছিলাম সেতার। আমাকে উনি যখন রেডিও তে বাজাবার জন্য ব্যবস্থা করেছিলেন। তখন-ই এসে গেল আমার জীবনের আরেকটি অধ্যায়।

(চলবে)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments