জ্বলদর্চি

পুন্যিপুকুর/ভাস্করব্রত পতি

পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব - ১৮

পুন্যিপুকুর

ভাস্করব্রত পতি

একসময় এক গ্রামে এক ধর্মনিষ্ঠ ব্রাহ্মণ আর ব্রাহ্মণী বাস করতেন।  তাঁদের একটিই মেয়ে লীলাবতী। কোনো পুত্রসন্তান ছিলনা। মেয়েটি ছোটবেলা থেকেই তুলসী গাছ দেখলেই ভক্তি সহকারে প্রণাম করত ও তুলসীতলা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে গাছে জল দিত। যখন সে ১২ বছরে পড়ল, তখন একদিন রাত্রে স্বপ্ন দেখল যে তাঁর মাথার কাছে দাঁড়িয়ে এক ব্রাহ্মণ বলছেন, "তুলসী গাছের উপর তোমার এই শ্রদ্ধা দেখে আমি তোমার উপর খুব প্রসন্ন হয়েছি। কাল থেকে এই চৈত্র মাসের সংক্রান্তি থেকে বৈশাখের সংক্রান্তি পর্যন্ত প্রতিদিন এক ঘটি করে জল ঢালবে তুলসীগাছে। এটা করলে তোমার মনের সব বাসনা পূরণ হবে।" পরেরদিন সকালে লীলাবতী এ ঘটনা তাঁর বাবা মা'কে জানালে তাঁরাও সেটাই করতে বললেন।

  এরপর চৈত্র সংক্রান্তি থেকে বৈশাখের সংক্রান্তি পর্যন্ত লীলাবতী ছোট পুকুর কেটে তাতে তুলসীগাছ পুঁতে তিনবার মন্ত্র পড়ে জল ঢেলে ভক্তিশ্রদ্ধায় গলায় আঁচল দিয়ে প্রণাম করত। এইভাবে টানা চার বছর ধরে উপচার মানার পর শেষ বছরের বৈশাখ সংক্রান্তিতে যেইমাত্র জল ঢেলে প্রণাম করা শেষ হল, সেইমাত্র তাঁর সামনে এক দেবীমূর্তি উপস্থিত হল। তা দেখে লীলাবতী চমকে উঠে জিজ্ঞাসা করল —“তুমি কে মা"? তখন  লীলাবতীকে স্নেহের আলিঙ্গন করে বললেন, "আমিই সেই ব্রাম্ভণ। যে তোমায় আজ থেকে চার বছর আগে স্বপ্নে দেখা দিয়ে বলেছিলাম চৈত্র সংক্রান্তি থেকে বৈশাখের সংক্রান্তি পর্যন্ত তুলসীগাছে জল ঢালতে। এখন চার বছর পরে তোমার পুণ্যিপুকুর ব্রত উদযাপন সম্পন্ন হয়েছে। জগতের লোকজন জানতে পেরেছে তোমার আরাধনা। এখন তোমার বর চাওয়ার পালা।" তখন লীলাবতী বর হিসেবে চাইল যে, তাঁর বাবা মা যেন চিরকাল সুখে থাকেন। তা শুনে দেবী তাঁকে সাবিত্রীর মতো পতিব্রতা ও অতুল ঐশ্বর্যের অধিকারিণী হয়ে স্বামী সংসার সহ চিরকাল সুখে থাকার আশীর্বাদ করলেন।

  সেই আশীর্বাদের প্রতিফল হিসেবে পরবর্তীতে লীলাবতীর সঙ্গে এক বিখ্যাত জমিদারের একমাত্র ছেলে অজিতের খুব জাঁকজমক ভাবে বিয়ে হয়। শ্বশুরের সম্মান ও প্রতিপত্তি বাড়তে থাকে। এছাড়া লীলাবতীর বাবারও অনেক ছেলে হয়। সকলের সব কষ্ট লাঘব হওয়ায় ধীরে ধীরে লীলাবতীর এই পুন্যিপুকুর ব্রতের কাহিনী বাংলার রমণীকূলের কাছে পৌঁছানোর পর ক্রমশঃ তা লৌকিক উৎসবে পরিণত হয়।

  চৈত্র সংক্রান্তিতে শুরু করে সারা বৈশাখ মাস জুড়ে একক ভাবে পালন করতে হয় পুন্যিপুকুর ব্রত। চার বছরে এই ব্রত শেষ হয়। প্রতিদিন ভোরে উঠে যে কোনো স্থান পরিষ্কার করে পূর্বমুখে বসে মাটিতে খড়িকা বা আঙ্গুল দিয়ে চতুষ্কোণ একটি পুকুর অঙ্কন করে সেই পুকুরে তিনবার জল ঢেলে প্রণাম করে। এই ব্রতটি আসলে ঐন্দ্রজালিক উপায়ে বৃষ্টিপাত করিয়ে বসুমতীকে শস্যশ্যামলা করার আদিম কামনাপ্রসূত ব্রত। বৃষ্টির কামনায় এই ব্রত উদযাপন। ড. শীলা বসাক উল্লেখ করেছেন, এই ব্রতের মাধ্যমে প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে আত্মরক্ষা ও প্রাকৃতিক বৈপরিত্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য সাধনের চেষ্টা করা হয়েছে। বৈশাখের প্রচণ্ড দাবদাহে যাতে পুকুরের জল শুকিয়ে না যায়, অত্যধিক গরমে গাছপালা যাতে মরে না যায় এই আদিম কামনাই এই ব্রতের মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। 

  এই ব্রতে বলা হয়েছে যে, বাড়ির উঠোনের একপাশে একটা ছোট চৌকো গর্ত করে তার চারদিকে চারটি ঘাট করতে হয়। এক ঘাটে শাঁখ, আর এক ঘাটে একটি চন্দনকাঠ, অপর ঘাটে একটি সুপারি এবং আর একটি ঘাটে একটি সিঁদুর কৌটো রাখতে হবে। পুকুরের মাঝখানে একটি তুলসী গাছের সঙ্গে বেলগাছের ডাল বেলপাতা সহ পুঁতে দিতে হবে। এরপর পূর্বমুখী অথবা উত্তরমুখী বসে গাছে আর পুকুরে একঘটি করে জল ঢালতে ঢালতে মেয়েরা ছড়া বলবে পুন্যিপুকুরের।

  গাছে জল ঢালার সময় মহিলারা বলেন, ‘‘তুলসী তুলসী নারায়ণ / তুমি তুলসী বৃন্দাবন / তোমার মাথে ঢালি জল / অন্তিমকালে দিও স্থল"। আর কুমারী মহিলারা পুকুরে জল ঢালার সময় তাঁদের কামনায় থাকে যে তাঁরা যেন পুত্রবতী হয়, সতীত্ব যেন অক্ষুন্ন থাকে -- "পুণ্যিপুকুর পুষ্পমালা / কে পুজেরে সকালবেলা? / আমি সতী ভাগ্যবতী / সাত ভাইয়ের বোন লীলাবতী। / পুজি চন্দন দুর্বাফুলে / বাড়ুক লক্ষ্মী বাপের কুলে। / পুণ্যিপুকুরে ঢালি জল / বাপ ভাইয়ের হোক অশেষ"। আর সধবা মহিলারা বলেন - “পুণ্যিপুকুর পুষ্পমালা / কে পূজেরে দুপুর বেলা? / আমি সতী ভাগ্যবতী / সাত ভাইয়ের বোন লীলাবতী।। / জল ঢালি তুলসী মূলে / শ্বশুর কূল ভরুক ফলে ফুলে।। / পুণ্যিপুকুরে ঢালি জল / বাপ শ্বশুরের হোক মঙ্গল।” এরপর আবারও মন্ত্রোচ্চারণ করে তিনবার পুকুরে ফুল, চন্দন আর দুর্বা দিয়ে বলতে হয় - “এ পূজলে কী হয়? / নির্ধনীর ধন হয়। / সাবিত্রী সমান হয়। / স্বামীর আদরিণী হয়। / স্বামীর কোলে পুত্র দোলে। / মরণ হয় যেন একগলা গঙ্গাজলে।”

  এহেন লৌকিক উৎসব তথা ব্রতকথাটির মধ্যে সমাজ বিজ্ঞানের কথা রয়েছে। ধনী ও দরিদ্রের কাহিনী রয়েছে। অসহায় দারিদ্রতার কথা রয়েছে। ক্ষুধার্ত হয়েও নিপাট আতিথেয়তা লক্ষ্য করা গিয়েছে। একদিকে এই ব্রত পালনের ফলে দরিদ্রের ভাগ্য পরিবর্তন, অন্যদিকে অঢেল ধনসম্পত্তি অর্জিত হয়েছে। বাংলার লৌকিক মানুষের বিশ্বাস চাহিদা কামনা বাসনা এখানে প্রতিফলিত হয়েছে প্রতি মুহূর্তে। স্বাভাবিক ভাবেই একটা ব্রত স্থান পেয়েছে লৌকিক উৎসবের আঙিনায়। অদ্ভুতভাবে বিজ্ঞানও মিশে গিয়েছে বাংলার এই সংস্কৃতির সাথে। প্রকৃতির কঠিন রূপে মানুষ সবসময়ই পরাজিত সৈনিক। আর এই ব্রত উদযাপনের মাধ্যমে প্রকৃতির প্রলয়ঙ্কর অত্যাচার থেকে মুক্তির লক্ষ্যে পুকুর কেটে জল ভরা হয়। যাতে গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহেও পুকুর শুকনো না হয়ে যায়। পুন্যিপুকুর তাই নেহাতই কোনো ব্রত নয়, উপচার পালনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট এলাকার মানুষের কামনার চাহিদা পূরণে হয়ে উঠেছে এক অনালোচিত এবং অনালোকিত লৌকিক উৎসব।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments