জ্বলদর্চি

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা -৮১

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা -৮১

সম্পাদকীয়,
প্রচন্ড গরমে গোটা দক্ষিণবঙ্গের মানুষ হাঁসফাঁস করছে। পশুপাখির বুক তৃষ্ণায় ফাটছে। এমন সময় কলকাতার রাস্তায় জমা জলে একটা পায়রা পাখনা ঝাপ্টে জলকেলি করছে। এই ছবিটা তোমাদের জন্য পাঠিয়েছে মৃণাল আঙ্কেল। দেখেও শান্তি। দুঃসহ গরমে পাখিদের অবস্থা সঙ্গীন। ছোট্টবন্ধুরা তোমরা প্রত্যেকে নিজেদের বাড়ির উঠানে বা বারান্দায় ওদের জন্য জল আর মুড়ি বিস্কুট রেখো কিন্তু। দেখবে কখন যে শালিখ বা কাক তোমার বন্ধু হয়ে যাবে, জানতেই পারবে না। তবে সব পাখিরাই যে মুড়ি বিস্কুট খেতে ভালোলাগে তা কিন্তু নয়। পাখিদের রাণী ফ্লেমিংগোরা আবার শ্যাওলা খেতে খুব ভালোবাসে। কিভাবে জানলাম? কেন আমাদের বাসবদত্তা আন্টির চলো যাই আছে না? গরমে হাঁসফাঁস করলেও মাঝে মাঝে কালবৈশাখী হলে কিছুটা স্বস্তি পাওয়া যায়। গ্রামের মেয়েরা তখন আম কুড়োতে যায় আমবাগানে। সেই গল্প বলেছে ব্রততী আন্টি। সন্দীপন আঙ্কেল একটা ছড়া লিখেছেন। এদিকে জয়াবতী আর পুণ্যি তো ঘোড়ায় চড়া শিখে গেছে। কি মজার ব্যাপার না! হ্যাঁ, তারপর যা বলছিলাম, প্রচন্ড গরমে প্রাণীদের মতো গাছেদেরও অবস্থা সঙ্গীন। সেই গাছেদের নিয়ে গল্প লিখেছে ছোট্ট বন্ধু অপ্রতীম আর ছবি এঁকেছে শ্রীপর্ণা। ভাবতো গাছেরা না থাকলে কী হত? আরে গাছেদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে বলেই না এত গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা। এসো প্রাণীদের ভালো রাখতে, নিজেরা ভালো থাকতে আরো গাছ লাগাই, সবুজ বাগান বানাই,, আর অপ্রতীমের মতো তার নাম রাখি 'ফুল ফুটবেই'।  ---- মৌসুমী ঘোষ।



ধারাবাহিক উপন্যাস
জয়াবতীর জয়যাত্রা
তৃষ্ণা বসাক
ত্রয়োদশ পর্ব
 
দেশ দেখা
 
১৭
 
এরপর কয়েকদিন ঘোড়াচোর নিয়েই চলল কূটকাচালি। এই ফাঁকে জয়াবতী ঘোড়ায় চড়া শিখে নিল, ঘোড়াটা তার ভারি ভক্ত হয়ে পড়েছে। এমনকি পুণ্যিও একদিন চড়ে বসল ঘোড়ায়। দেখে তো জয়াবতী তাজ্জব। যাক, ভীতুর ডিম বলবে না কেউ পুণ্যিকে।
একদিন দুজনে ঠিক করল ঘোড়ায় চড়ে একটু বেড়িয়ে চেড়িয়ে দেখে আসবে চারদিক। দেশের মানুষের চিকিচ্ছে করবে যারা, তাদের তো দেশ দেখতেই হবে। কেমন পরিবেশে থাকে মানুষজন তা না দেখলে বুঝি চিকিচ্ছে করা যাবে ঠিকঠাক? বলা বাহুল্য জয়াবতীর মাথাতেই এল এই বুদ্ধি, সে পুণ্যির মাথায় বেশ ভালভাবেই কথাটা ঢুকিয়ে দিতে পারল।  তবে বিনা অনুমতিতেই  যেতে হবে। সেনমশাই জানতে পারলে মোটেই যেতে দেবেন না, উল্টে ঘোড়াটাই হয়তো বেচে দেবেন।  আর যেতে হবে পুরুষের পোশাকে।  গাঁয়ের লোক যদি দেকে মেয়েমানুষ ঘোড়ায় চড়ছে তো নির্ঘাত অক্কা যাবে।

যেমন ভাবা তেমন কাজ। দুপুরে এ বাড়ির সবাই ঘুমোয়, এমনকি কবরেজ মশাইও। সেই সুযোগে বেরোতে হবে।
‘কিন্তু যদি ফিরতে দেরি হয়? তাহলে তো ধরা পড়ে যাব। তখন সেনমশাই ঠিক বাড়ি পাটিয়ে দেবেন। সেকানে তো সেই একঘেয়ে জীবন, তার ওপর’
পুন্যি যে কথাটা বলতে গিয়েও আটকে যায়, সেটা হল বাড়ি ফিরে একাদশী করতে হবে আবার। এখানে সেনমশাই ঠাকমা খুড়িমা আর অবশ্যই জয়াবতী- এদের সবার বকুনি খেয়ে খেয়ে তার একাদশী করা বন্ধ হয়েছে। কিছুতেই সে শুনছে না দেখে সেনমশাই তাকে শাস্ত্র থেকে অনেক শোলক পড়ে শুনিয়েছেন, একটা শোলক শুনে পুণ্যি তো পুণ্যি, জয়াবতীর অবদি পিলে চমকে গেছে। বলে কিনা বিধবাদের আবার বে দেওয়া যায়।


জয়াবতী অবশ্য ঘাবড়ানোর মেয়ে নয়, সে এমন ভাব দেখাল যে এসব সে সবই জানত, আবার সে উল্টে বলল ‘তোকে তো বলেইছিলুম পুণ্যি, তুই ভাব, বে যকন দেওয়া যায়, মাছ খেতেই বা দোষ কি? ‘
না, পুণ্যিকে এখনো মাছ খেতে রাজি করানো যায়নি, তবে সে একাদশী আর করে না। তবে ওইদিন সে খিড়কিপুকুরঘাটে গিয়ে ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে খানিকটা কেঁদে আসে, এটা লক্ষ্য করেছে জয়াবতী। এমনিতে সে কাউকে রেয়াত করে কথা বলে না, কিন্তু এ ব্যাপার নিয়ে পুণ্যিকে কিছু বলে না সে। এমন ভাব করে থাকে যেন কিছুই জানে না সে। কিন্তু গা জ্বলে যায় ভেতরে ভেতরে। যত আদিখ্যেতা। কদিন দেকেচিস সেই সোয়ামীকে তার ঠিক নেই, তার জন্যে কেঁদে মরছিস, আর জয়াবতী যে পরশু রাতে পেটে ব্যথায় শুষছিল, তখন তো দিব্যি ভোঁস ভোঁস করে ঘুমুলি। নাহ, বেধবাদের বে দেওয়া যায় কিনা খবরটা সত্যি সত্যি যাচাই করে দেখতে হচ্ছে।
যদি দেওয়া যায়, তবে পেত্থম বিয়েটাই যেন পুণ্যির হয়, হে ভগবান! দেকি ও কত তকন খিড়কিপুকুরঘাটে গিয়ে কাঁদতে পারে।

 আজ যেন হেঁসেলের পাট চুকুতে বড় দেরি করছে খুড়িমা। এতক্ষণ তো এঁটো হাতে কত গল্প ফাঁদল, কোন দূর গাঁয়ে নাকি কে সতী হয়েচে, সেইসব। মানুষকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারে মানুষে! জয়াবতী দেখল পুণ্যির মুখ সাদা হয়ে গেছে ভয়ে। নাহ, এ দেকচি এখনো নিজেকে বেধবা ছাড়া কিচু ভাবতে পারে না। আরে, তুই কি মার পেট থেকেই বেধবা হয়ে জন্মেছিস নাকি? আগে তো তুই মানুষ, তারপর মেয়েমানুষ, তারপর নয় কপালের ফেরে বেধবা। নাহ কপালের ফেরে কেন ? যদি এই বয়সে বিয়ে না দিত ওর বাপ মা, তবে কি ও বেধবা হত? জয়াবতী ভেবে দেখল বিয়ে হলেই বেধবা হবার প্রশ্ন আসে। সুতরাং ও পাপ গোড়ায় ছেঁটে ফেললেই হল। এত সাত তাড়াতাড়ি বিয়ে দেওয়া কেনই রে বাপু। খেলার বয়সই তো ফুরোয়নি।
পুণ্যি খুব ভালো পান সাজে। সুন্দর খিলি পাকিয়ে লবঙ্গ দিয়ে মুড়ে রেকাবি করে সবাইকে দিয়ে আসে। সেনমশাইকে যখন দিয়ে এল, তখন তিনি একটা পুথি খুলে বসেছেন। এ তো ভালো জ্বালা। এ সময় তো সেনমশাইও একটু ঘুমোন। সে ভয়ে ভয়ে শুধোয় ‘আজ ঘুমুবেন না সেনমশাই?’
সেনমশাই মুখে পানের খিলি পুরতে পুরতে বলেন ‘এই একটা রোগের হদিশ পাচ্ছি না রে মা, তাই একটু দেখছিলাম। না পেলে কাল একবার গুরুমশাইয়ের কাছে দৌড়তে হবে’
বাব্বা! এঁরও আবার গুরুমশাই আছে? শেখার কি শেষ নেই পৃথিবীতে? একটু পরে পুণ্যি উঁকি মেরে দেখল পুথি পাশে রেখে সেনমশাই নাক ডেকে ঘুমুচ্ছেন।
অমনি তারা তাড়াহুড়ো করে তৈরি হয়ে নিল। পুণ্যির দুটো নরুনপেড়ে থান ধুতির মতো মালকোচা বেঁধে পরল, ওপরে পিরান, মাথায় একটা করে গামছা পাগড়ির মতো, আর একটা গামছায় মুখ ঢেকে ওরা যখন ঘোড়ায় চড়ে বসল, তখন চেনে কার সাধ্যি!
কিন্তু শুরুতেই বিপদ। সেই প্যাকাটি কোত্থেকে এসে বলল ‘আমাকেও নিয়ে যেতে হবে, নইলে বাবাকে বলে দেব’
জয়াবতী রেগে বলতে যাচ্ছিল ‘বলগে যা, বলগে যা। আমি যেন সেনমশাইয়ের ভয়ে ইঁদুরের গর্তে লুকুচ্ছি।‘
কিন্তু পেছন থেকে  পুণ্যির রামচিমটি খেয়ে সে নিজেকে সামলে নিল। সে বুঝতে পারল প্যাকাটিকে না নিলে সমূহ বিপদ। সে গম্ভীর গলায় বলল ‘নিতে পারি একটা শর্তে। রক্ত দিয়ে লিকে শপত করতে হবে ধরা পড়লেও বলবি না কোথায় গেছিলি।’
পুণ্যি অমনি ঝামরে উঠে বলল ‘যত  উতপ্টাং কতা তোর গঙ্গাজল! রক্ত দিতে লেকা! এ কি রঘু ডাকাতের দল খুলিচিস নাকি?’ তারপর সে প্যাকাটিকে বলল ‘ছুটে গিয়ে একটা মস্ত গামছায় মুখ মাতা ঢেকে আয়। গাঁয়ের লোক যেন চিনতে না পারে’
প্যাকাটির চোখে ফুটে উঠল অবিশ্বাস। সে ভাবছিল গামছা আনতে গেলেই এরা তাকে ফেলে পালাবে। পুণ্যি তাকে আশ্বস্ত করে বলল ‘আমরা কোতাও যাব না তোকে ছাড়া’।
( ক্রমশ)

শেষ? শুরু?
সন্দীপন রায়

ফুরিয়ে গেলে একটি বছর 
নতুন বছর আসে।
শুরু, শেষের এই ধারাপাত
চক্র ভালোবাসে।

শেষেরও নাকি রয়েছে শেষ? 
সব শুরুরই শুরু? 
সব গুরুরই আছেন যেমন 
একজন কোনো গুরু।

কী জানি, সব অদ্ভুতুরে 
ভাবনা মেশে এসে। 
মাথার ঘিলু কড়মড়িয়ে 
চিবায় সর্বনেশে।

হাঁস নাকি না ডিম্ব আগে, 
তর্কে বহুদুর।
আদম, ইভের আগেও 
ছিল মানব মনের সুর?

মরণ শেষে জীবন আছে? 
নাকি সবই শেষ? 
এবার থামি, হচ্ছি পাগল। 
দিব্যি আছি বেশ।



বৃষ্টিধোওয়া রামধনু
ব্রততী সেন দাস

জানলায় ঠক ঠক শব্দ,"লছমি, এই লছমি?''শুনে লছমি ধড়মড় করে ঘুম থেকে উঠে বসল।চোখ কচলে জানালাটা একটু ফাঁক  করে দেখল, রানি।''রানি তুই কি করছিস? দাঁড়া দরজা খুলছি।''দরজা খুলে দিল লছমি।বাইরে গনগনে রোদ,লু বইছে।রানি ভিতরে ঢুকে বলল,''এই লছমি,আম মাখা খাবি?''
''কোথায়?''
''চল না,কালকের ঝড়ে বাগানে অনেক কচি আম পড়ে আছে দেখলাম।…চল''
দুজনে বাগানে গিয়ে আমগাছটির কাছে গিয়ে দেখল কচি কচি অজস্র আম ছড়িয়ে আছে।এই গাছটা সবচেয়ে পুরনো আর এই গাছের আম খুব সুস্বাদু।সবাই বলে এই বাংলোর হাতায় এমন অনেক গাছ আছে যাদের বয়স একশো, দেড়শো বছর। এক বৃটিশ সাহেব  বহু যুগ আগে এই বাংলোটা বানিয়েছিলেন ।আর নানা জায়গা ঘুরে সেরা জাতের গাছের চারা যোগাড় করে নিজের হাতে লাগিয়েছিলেন তিনি।
দুজনে মিলে বেশ কয়েকটা কাঁচা আম নিয়ে একটা নীচু ডালে পা ঝুলিয়ে বসল।লছমি ঘর থেকে বিট নুন, শুকনো লঙ্কার গুঁড়ো আর ওর ম্যাজিক ঝিনুকটা নিয়ে এসেছে।এই ঝিনুকটা লছমির সম্পত্তি রাখার টিনের বাক্সটায় রাখে।আড়াই ইঞ্চির লম্বা ঝিনুকটার মাঝখানে একটা মস্ত ফুটো আর ধারালো।ওটা দিয়ে লছমি সুন্দর করা আমগুলির খোসা ছাড়িয়ে ফেলল।রানি চেষ্টা করেও পারল না।অথচ লছমি আমগুলো ছাড়িয়ে কুচি কুচি করে কেটে ফেলল।তারপর একটু বিটনুন আর লঙ্কার গুঁড়ো মাখিয়ে দারুণ আমমাখা বানিয়ে সারা দুপুর ধরে দুজনে মিলে টক টক শব্দ করে খেতে লাগল।

রানির বাবা মস্ত এক অফিসার।মাও তাই।রানি আগে মার সাথে অন্য জায়গায় থাকত।বাবার বদলির চাকরি,বাবা বদলি  হয়ে এখানে একা ছিলেন।এক বছর হল মাও বদলি নিয়ে এখানে এসেছেন।রানি এখানে এসে নতুন স্কুলে ভর্তি হয়েছে।বাড়িতে ওরা পাঁচজনে থাকে-ঠাম্মি,বাবা,মা,ও আর সরমাপিসি।সরমাপিসি বাবার চাইতেও বড় আর রানির জন্মেরও বহুদিন আগে থেকে এ পরিবারের সাথে আছে। রান্নাবান্না,ঘরদোর দেখাশোনা সব সরমাপিসির ডিপার্টমেন্ট।রানির স্কুল অনেক দূরে,স্কুল বাসে করে যাতায়াত করতে হয়।সকাল সাতটায় যায় আর দুপুর তিনটেয় আসে।বাড়িতে তখন শুধু ঠাম্মি আর সরমাপিসি থাকে।লছমি আউট হাউসের সার্ভেন্টস কোয়ার্টারে থাকে।ওর বাবা শিউচরণচাচা বাবার ড্রাইভার।লছমির মা নেই,মা বেঁচে থাকতে ও গ্রামেই থাকত।কিন্তু মা মারা যেতে ওর বাবা ওকে নিজের কাছে নিয়ে আসে।লছমি রানির থেকে একটু ছোট।গ্রামে থাকতে ও স্কুলে পড়ত।ক্লাস ফোর অবধি পড়েছে।এখানে ও বাড়ি থাকে,অতটুকু মেয়ে সারাদিন কত কাজ করে!ও সব পারে,উনুন ধরানো,রুটি করা সবজি কাটা,কাপড় কাচা ,ঘর মোছা,মশলা বাটা সব, সব।রানি যেতে আসতে গেটের কাছ থেকে ওকে দেখে আর ভাবে ইসস! যদি ও এসব করতে পারত!ও শুধু আলুর খোসা ছাড়াতে পারে।ডিমের খোসা ঠিক মত ছাড়াতে গেলে ডিম ভেঙ্গে ফেলে।রান্নাঘরের কোন কিছুতে হাত দিলেই সরমাপিসি খুব বকাবকি করে,শুধু শুধু।ঠাম্মিও চান না কিচেনে গিয়ে রানি গ্যাস জ্বালাক ।অথচ লছমিকে কেউ বকে না,ও সারাদিন যা ইচ্ছে তাই করে।দুপুরবেলা শিউচরণ চাচা বাড়িতে যখন খেতে আসে তখন গরম গরম রুটি বানিয়ে বাবাকে খেতে দেয়।মেয়ে আর বাবা পাশাপাশি বসে গল্প করতে করতে  কি সুন্দর রুটি, সবজি আর আচার খায়।রানির খুব ইচ্ছে একদিন ও নিজের হাতে খাবার বানিয়ে ঠাম্মি, মা আর বাবাকে খাওয়াবে।মা বলেন,''নিশ্চয়ই খাওয়াবে সোনা, আর একটু বড় হও।''আর কত বড় হবে ও,এখন ও ক্লাস সিক্সে  পড়ে।লছমি তো ওর চাইতে ছোট, কই ওর বাবা তো ওকে এসব বলে না!সরমাপিসি ত রানিকে লছমির সাথে মেলামেশা করতে দেখলেই রেগে যায়,ওকে বাড়ির কাছে দেখলে খুব বকে।কেন কে জানে।লছমিও ভয়ে বাড়িতে আসে না।তবে দুপুরবেলা স্কুল থেকে যখন ফেরে রানি তখন ঠাম্মি আর সরমাপিসি ঘুমোয়।একটু ফ্রেশ হয়ে রানি চুপিচুপি লছমিদের কোয়ার্টারের কাছে চলে আসে।লছমিকে ডেকে নেয়, তারপর কি আনন্দ দুজনের!
আগে রানিরা একটা মস্ত বড় আপার্টমেন্টে থাকত,বড় শহরে।সেখানে সিমেন্টে বাঁধানো খেলার জায়গা,স্যুইমিং পুল আর টেনিস কোর্ট।ওখানে রানির অনেক বন্ধু ছিল কিন্তু বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে ওর তাদের সাথে খেলতে ভাল লাগত না।সেই একঘেয়ে টেনিস খেলা বা সাইকেল চালানো।ও তখন বাড়িতে বসে ড্রয়িং করত বা টিভিতে কার্টুন চ্যানেল দেখত।আর এখানে ও কত স্বাধীন! বাংলোর হাতার মস্ত বড় বাগানটায় রানি আর লছমি ঘুরে বেড়ায় আর কত গল্প করে…রানির নতুন স্কুলের গল্প,বন্ধুদের কথা, লছমির গাঁয়ের এর কথা, মায়ের কথা,দুলারি গাই এর কথা।লছমি বলে ওর খুব স্কুলে ভর্তি হতে ইচ্ছে করে,'পড়ালিখা' করতে ইচ্ছে করে।
একদিন দুজনে ঘুরে ঘুরে গল্প করছে হঠাৎ দেখে কামিনী ঝোপের আড়ালে কি একটা ঝট পট করছে।লছমি দেখতে যাচ্ছিল। রানি ওর ফ্রক টেনে ধরল,'' না যাস না, লছমি… মনে হয় সাপ!" লছমির খুব সাহস,বলল,'' দাঁড়া না ,দেখি।''গিয়ে দেখে একটা চড়াইপাখি,তার ডানাটা ভিষণভাবে জখম হয়েছে।উড়তে পারছিল না বেচারি,রানি আর লছমি ওকে যত্ন করে তুলে নিয়ে গ্যারেজের পেছনে একটা ঝুড়ি চাপা দিয়ে রাখল।আহারে!পাখিটা শুধু জুলজুল করে তাকিয়ে থাকত।খেলনা বাটিতে করে জল আর দানা দেওয়া হল।আর লছমি চুন আর হলুদ মিশিয়ে  পাখিটার ডানাদুটিতে নিয়ম করে লাগাতে লাগাতে দিব্যি একদিন সেরে উঠল চড়ুইটা।রানি ওকে পুষবে ভেবেছিল কিন্তু লছমি ওকে বোঝাল যে,ঘরে তো রানির মা পুষতে দেবেন না।কোন প্রাণীকে বন্দী করায় তাঁর ঘোর আপত্তি।আর এখানে ইঁদুর, ভোঁদর, সাপের উৎপাতে একদিন এমনিই মরে যাবে পাখিটা তারচেয়ে ওকে ছেড়ে দেওয়াই ভাল।যেদিন চড়াইটাকে ছেড়ে দিল সেদিন পাখিটিরও বোধ হয় বন্ধুদের ছেড়ে যেতে মন চাইছিল না ।তাই ও ছাড়া পাবার পরও রানি লছমির চারদিকে এদিক ওদিক দু চার বার উড়ে উড়ে বসল। তারপর ফুড়ুৎ করে কোথায় যে উড়ে পালাল কে জানে! 

  লজ্জাবতী লতা, মিমোসা পুদিকা যার বৈজ্ঞানিক নাম, আঙুলের ছোঁওয়া দিলে সে গাছের পাতা মুড়ে যায়, রানি সায়েন্স বইতে পড়েছিল কিন্তু তাকে চিনতে শেখাল লছমি। ওদের বাগানের পেছনে মস্ত বড়ো ঝাড় আছে।রানি আগে কখনও দেখেনি।হাত দিলেই গাছের পাতা মুড়ে যায় আর সেটা ওদের খুব প্রিয় একটা খেলা।লছমি আরও অনেক কিছু জানে...টুনটুনি পাখি কেমন দেখতে হয়।বাবুইপাখির বাসার ভেতর কি থাকে,লঙ্কাজবা ফুল থেকে চুষে কী করে মধু খেতে হয় রানি ওর কাছ থেকে শিখেছে।আর রানির কাছ থেকে লছমি শিখেছে কীভাবে ছবি আঁকতে,ছবি রঙ করতে হয়!রানি খুব ভাল ছবি আঁকে,সবাই ওর ছবি আঁকার তারিফ করে আর ওর কাছে আছে ছবি আঁকার অজস্র উপকরণ।দেশ বিদেশের রং পেন্সিল, প্যাস্টেল, ক্রেয়ন,জলরং তুলি দিয়ে ওর ছবি আঁকার ডেস্ক ভরা।ও এত ভাল ছবি আঁকে বলে বড়মামা,ছোটপিসি বিদেশে থেকে প্রতি বছর ওর জন্মদিনে প্রচুর ছবি আঁকার সরঞ্জাম আর রং পাঠান।রানির আঁকা ছবি দেখে দেখে লছমিও আঁকতে চেষ্টা ককিনক্করে।কিন্তু ওর  সব আঁকাতে মার ছবি,কোথাও মা রান্না করছে,কোথাও জল তুলছে,চুল বাঁধছে,দুলারিকে ঘাস পাতা খাওয়াচ্ছে।একটা মস্ত ছবি এঁকেছে লছমি যেখানে মার কোলে মাথা রেখে শুয়ে সে  ঘুমোচ্ছে। নিজের সম্পদ থেকে রানি অনেক রং,ছবি আঁকার সরঞ্জাম লছমিকে দেয়।অনেক ছবির বইও ও দিয়েছে।শিউচরণ কাকা কত মানা করে কিন্তু রানি শোনে না।
শুধু সরমাপিসি গজগজ করে আর ঠাম্মির কাছে লছমির নামে নালিশ করে।ঠাম্মিও সারাদিন রোদের মধ্যে রানির টো টো করে ঘুরে বেড়ান পছন্দ করেন না।
* * * * * * * * * * * * *
সেদিন সকাল থেকে কি বৃষ্টি! আকাশ ভাঙা বৃষ্টি বোধহয় একেই বলে।বাড়িতে রানিরা এখন শুধু তিনজন।বাবা ট্যুরে গেছেন আর মাকে দাদাই এর হঠাৎ অসুস্থতার খবর পেয়ে রায়পুরে যেতে হয়েছে।বুকে ব্যথা হওয়াতে দাদাইকে হঠাৎ করে নার্সিং হোমে ভর্তি করতে হয়েছে।আর এদিকে গতরাত থেকে প্রবল বৃষ্টি হয়ে চলেছে।

 সকালে উঠে রানি দেখে বাড়িতে কোন সাড়া শব্দ নেই।সরমা পিসি উঠে তো এতক্ষণে হাঁকডাক শুরু করে দেয়।আজ কী হল? ঠাম্মির ঘরে উঁকি দিয়ে দেখল ঠাম্মি জেগে কিন্তু বাতের ব্যথায় উঠতে পারছেন না।কিন্তু সরমাপিসি কই?পিসির ঘরে গিয়ে দেখে পিসির ধূম জ্বর,জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে।পিসি অচেতন হয়ে পড়ে আছে।রানি এখন কী করে?ঠাম্মিকে ধরে ধরে নিয়ে গিয়ে মুখ ধুইয়ে দিল।থার্মোমিটারে সরমাপিসির জ্বর মেপে নিল তারপর বাড়ির ডাক্তার সুনন্দ ব্যানার্জিকে ফোনে একটা কল দিয়ে দিল।এরপর তিন গ্লাসে দুধ গরম করে তাতে কোকো পাউডার গুলে ঠাম্মি আর সরমাপিসিকে দিয়ে নিজে ঢক ঢক করে এক চুমুকে শেষ করে ফেলল।কিন্তু দুপুরে কী খাওয়া হবে।এদিকে বৃষ্টি থামার তো কোন লক্ষণ নেই।মার ফিরতে ফিরতে যে রাত হবে!রানি ফ্রিজ খুলে দেখে নিল কী আছে।ডিম ,দুধ আছে কিন্তু সেগুলো তো কাঁচা খাওয়া যাবে না? কী করা যায় ভেবে ভেবে একটা উপায় বার করল!
 ''রানি রানি,মাই বেবি!ওয়েক আপ ডার্লিং।আমি এসে গেছি সোনা!''মার কণ্ঠস্বর কানে যেতে ঘুমটা ভেঙে গেল।সোফায় শুয়ে হ্যারি পটার পড়তে পড়তে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল রানির নিজেরই খেয়াল নেই।চোখ কচলে দেখে স্মিতমুখে মা সামনে দাঁড়িয়ে।রানি মাকে দেখে বলল,''মা, তুমি চলে এলে! এখন কটা বাজে?"    
''দেড়টা…''
'' মাত্র!  তুমি এত তাড়াতাড়ি চলে এলে কী করে?দাদাই কেমন আছে?''
''দাদাই সুস্থ হয়ে বাড়ি চলে এসেছে…তাই আমি আর দেরি করিনি সোনা।ওঠো…চলো কিছু খাই।দেখি কী আছে,কী বানাতে হবে।সরমাদির জ্বর এখন একটু কম।আমি এসে ওষুধ  দিয়েছি।চলো,ঠাম্মিরও খিদে পেয়ে গেছে।"

খাওয়ার ঘরে গিয়ে মা পরম আশ্চর্য!
ডাইনিং টেবলে ক্যাসারোল আর ঢাকা দেওয়া কাচের বোওল রয়েছে ।তার মধ্যে রুটি,আলুভাজা আর ডালসেদ্ধ এবং এক শিশি লেবুর আচার।মা ঢাকনা খুলে হতবাক।বিস্ময়ে,আনন্দে চিৎকার করে উঠলেন,
''এসব কে বানিয়েছে!''রানি লাজুক হেসে বলল,''আমি…তোমার তো এ বেলায় আসার কথাই ছিল না।তাহলে ঠাম্মি কী খাবে,সরমাপিসি?সেই সব ভেবে আমি নিজেই বানিয়েছি মা।''
''তুই!  কবে এগুলো বানাতে শিখলি!কে শেখালো তোকে?''
রানি আস্তে করে বলল,''লছমি্‌…ও যখন খানা বানাত তখন আমি কাছে বসে মন দিয়ে দেখতাম।রুটি বেলতেও ও শিখিয়েছে…জানি না কেমন হয়েছে।আর ওই লেবুর আচারটা লছমি দিয়েছে।ওর চাচী বানিয়ে দেশ থেকে পাঠিয়েছে'' মা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বুকে টেনে নিলেন,বললেন “বাঃ কবে আমার মেয়ে এমন এমন বড় হয়ে গেল?”  হেসে ঠাম্মিকে বললেন,''মা দেখেছেন আপনার নাতনিটি কেমন মানুষ হয়ে উঠেছে?।রিয়েলি আই'ম প্রাউড অফ মাই বেবি।''
ঠাম্মিও গর্বিত ও প্রসন্ন মুখে রানিকে কাছে টেনে নিলেন।একা গ্যাস জ্বালিয়েছে শুনে হয়ত মা বকবেন এই ভয়ে ছিল রানি,কিন্ত মা  ঠাম্মির এত প্রশংসা শুনে ও বেজায় খুশি আর লজ্জায় কোলে মুখ লুকোল। 

খাওয়া হয়ে গেলে রানি বলল,''মাম্মাম,একটা কথা বলব?"
"বল সোনা,"
''জানো ,লছমি কিন্তু খুব ইনটেলিজেন্ট,আর ওর খুব ইচ্ছে পড়াশোনা করার।শিউচরণ চাচাকে বলে ওকে স্কুলে ভর্তি করে দাও না,দেবে?”
''আচ্ছা,বেশ ,'' মা বললেন,''আমি শিউচরণের সাথে কথা বলব।''শুনে রানির মন খুশিতে ভরে গেল।মাকে জড়িয়ে ধরে খুব আদর করে দিল।আর এদিকে সকালের মেঘ কেটে গিয়ে বাইরে তখন ঝকঝকে রোদ উঠেছে।


ফুল ফুটবেই

অপ্রতিম চ্যাটার্জী 
পঞ্চম শ্রেণী, সাউথ পয়েন্ট স্কুল, কলকাতা

কুঁড়েমিতে যদি নোবেল প্রাইজ থাকত, তাহলে সেটা যে ঝাড়গ্রামের মনোহর কুমার দাসই পেত, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সারাদিন স্নানের সময় ছাড়া সে বিছানা ছাড়তই না। বাড়িতে লোক বলতে সে আর তার বছর পঞ্চাশেকের কাজের লোক, হরি। তাই তাকে বিছানা ছাড়তে বলার কেউই নেই। মনোহর নিজে সারাদিন কিচ্ছু করত না আর হরিকে খুব খাটাত। তার কুঁড়েমি এতটাই ছিল যে সে সকালে মুখ ধুতেও বিছানা ছাড়ত না। হরি ব্রাশ, পেস্ট, জলের বোতল আর একটা বাটি নিয়ে আসত। এইসব নিয়ে খাতে শুয়ে শুয়েই মনোহর মুখ ধোয়ার কাজ সারত। অথচ, বাড়িতে বাথরুম, বেসিন সবই আছে !

এহেন এক সকালবেলা মনোহর খাটে আধশোয়া হয়ে আনন্দবাজার এ চোখ বোলাচ্ছে, আর হরি গিয়েছে বাজারে। বাড়ির চাবি নিয়েই গেছে সে। বেল বাজালে মনোহর তো আর উঠে গিয়ে দরজা খুলতে পারবে না। একটু বাদেই হরি এল। আজকে সে বাজারের সঙ্গে আরও অন্য জিনিস ও এনেছে। একটা গোলাপ গাছের চারা আর একটু মাটি। মনোহর এগুলো দেখে বেশ খুশি হল। ছোটবেলা থেকেই গাছ জিনিসটা তার দারুণ লাগে। তার বাবা তাকে হাতে ধরে গাছ লাগানো শিখিয়েছিলেন। ছোটবেলায় শেখা সেই বিদ্যেটাকে আরেকবার ঝালিয়ে নেওয়ার সুযোগ পেয়ে অতি কুঁড়ে মনোহরেরও  মনে একটা আনন্দময় অনুভূতি হল।

দুপুরবেলা খেয়ে দেয়ে মনোহর এমনিতে একটা দিবানিদ্রা নেয়, কিন্তু আজ সে তা না করে চুপিচুপি বারান্দায় গেল। সেখানে রাখা ফাঁকা টবটায় সে মাটি দিল। তারপর বাবার শেখানো পদ্ধতিতে অত্যন্ত যত্ন সহকারে মনোহর চারাটা সেখানে পুঁতল। এরপর আরও প্রায় এক ঘণ্টা ধরে সে জল দিয়ে, মাটি খুঁচিয়ে… যত্ন করল গাছটার। তারপর দেখল মাটি থেকে অল্প মাথা উঁচু করে টবে বসে আছে ছোট্ট একটা গাছ। মনোহর প্রতিজ্ঞা করল যে সে এই গাছে ফুল ফোটাবেই।

এইভাবে বেশ কিছুদিন কেটে গেল। মনোহর রোজ দুপুরবেলা গাছের যত্ন করে। এর সপ্তাহ খানেক পর একদিন সকালে মনোহর ঘুম থেকে উঠতেই হরি ছুটে এসে বলল “দাদাবাবু, দাদাবাবু, দেখে যান। আপনার গাছে ফুল ফুটেছে।“  “সত্যি !” মনোহরের যেন বিশ্বাস হল না। সে দৌড়ে বারান্দায় গিয়ে দেখল, হরির কথা বিন্দুমাত্র মিথ্যে নয়। তার গাছে সত্যিই সোভা পাচ্ছে বড় বড় টকটকে লাল রঙের দুটো গোলাপ। এই ঘটনা কুঁড়ে মনোহরের মনে এক নতুন উদ্যম জাগালো।

১ বছর পরে

“কটা লাগবে ?” “দুটো।“ “কী গাছের চারা ?” “গোলাপ।“ “হুম। নিয়ে যান। ওটা আমাদের নার্সারির স্পেশাল। তাই না হরি ?” “হ্যাঁ দাদাবাবু !!” পাশ থেকে উত্তর দেয় হরি। গত বছর গোলাপ গাছে ফুল ফোটার পর তার দাদাবাবুর পরিবর্তন দেখে সে অবাক হয়ে গেছে। অনেক অনেক গাছের চারা কিনে এনে এই ফুল গাছের নার্সারি খুলেছেন তিনি এবং তা থেকে এখন তার বেশ ভাল আয় হচ্ছে। আর তাকে বাপের পয়সায় চালাতে হচ্ছে না। আর হ্যাঁ, নার্সারির নামটাও কিন্তু বাবু ভাল দিয়েছে । ‘ফুল ফুটবেই।‘



স্মরণীয়
(সত্যজিৎ রায়)
কলমে - পীযূষ প্রতিহার

১৯২১ সালের ২মে কলকাতার বিখ্যাত রায় পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন বিখ্যাত চিত্র পরিচালক, সাহিত্যিক এবং শিল্পী সত্যজিৎ রায়। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই মানুষটি বেড়ে উঠেছিলেন মুক্তমনা পারিবারিক পরিবেশ ও সংস্কৃতিতে। তাঁর পিতা ছিলেন বিখ্যাত শিশু সাহিত্যিক সুকুমার রায় ও মাতা সুপ্রভা রায়। তাঁর ঠাকুরদা ছিলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। মাত্র আট বছর বয়সে তিনি বালিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সত্যজিৎ রায় পড়াশোনা করেছেন প্রেসিডেন্সী  কলেজে প্রথমে বিজ্ঞান নিয়ে ও দুবছর পর অর্থনীতি নিয়ে বি এ পাশ করেন। পরবর্তীতে শান্তিনিকেতন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে ভর্তি হন মায়ের উৎসাহে। চারুকলার প্রতি আবাল্য দুর্বল সত্যজিৎ বিশ্বভারতীতে নন্দলাল বসু ও বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের সংস্পর্শে আরও সমৃদ্ধ হয়ে ওঠেন। ১৯৪৩ সালে বিশ্বভারতীর পড়াশোনা ছেড়ে চলে আসেন কলকাতায় ও কাজ নেন ব্রিটিশ বিজ্ঞাপন সংস্থা ডি জে কিমারে। ঐ বছরের শেষের দিকে তিনি 'সিগনেট প্রেস' নামের প্রকাশনা সংস্থায় মূলত বিভিন্ন বই এর প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণের কাজ করতে শুরু করেন। এখানে কাজ করার সময় বহু বিখ্যাত বই এর প্রচ্ছদ ও ভিতরের অলঙ্করণ করেছেন তিনি। এই সময়েই বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'আম আঁটির ভেঁপু' বইটির অলঙ্করণ করতে গিয়ে গভীরভাবে প্রভাবিত হন তিনি। এই কাজ তাঁর মনে এতটাই দাগ কাটে যে পরবর্তী সময়ে তিনি 'পথের পাঁচালী'কে বেছে নেন চলচ্চিত্রের বিষয় হিসেবে। 

     ১৯৪৭ সালে কয়েকজনকে নিয়ে কলকাতা ফিল্ম সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন সত্যজিৎ রায়। ১৯৪৯ সালে জঁ রনোয়ার তাঁর বিখ্যাত ছবি দ্য রিভার এর শ্যুটিং করতে কলকাতা এলে সত্যজিৎ রায় তাঁকে সহায়তা করেন। রনোয়ারের সঙ্গে 'পথের পাঁচালী' নিয়ে তাঁর পরিকল্পনার কথা জানালে রনোয়ার তাঁকে উৎসাহিত করেন। পরে ১৯৫০ সালে ডি জে কিমার কোম্পানির কাজে লন্ডনে থাকাকালীন বহু আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র দেখার সুযোগ পান। এই সময়ে দেখা ইতালীয় ছবি 'লাদ্রি দি বিসিক্লেত্তে'(Ladri di Biciclette) বা 'বাইসাইকেল চোর' দেখে এতটাই অনুপ্রাণিত হন যে চলচ্চিত্র পরিচালনার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। 
    পরিচালক হিসেবে তিনি ৩৭টি পূর্ণ দৈর্ঘ্যের কাহিনীচিত্র ছাড়াও তথ্যচিত্র ও স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি তৈরি করেছিলেন। তাঁর নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র 'পথের পাঁচালী'(১৯৫৫) মোট এগারোটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেছিল। এছাড়াও তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র গুলি হল- অপরাজিত, পরশ পাথর, জলসাঘর, অপুর সংসার, দেবী, কাঞ্চনজঙ্ঘা, চারুলতা, মহানগর, তিনকন্যা, অভিযান, কাপুরুষ ও মহাপুরুষ, অরণ্যের দিনরাত্রি, প্রতিদ্বন্দ্বী, সীমাবদ্ধ, জন অরণ্য, নায়ক, শতরঞ্জ কে খিলাড়ি, ঘরে বাইরে, গণশত্রু, শাখা প্রশাখা, আগন্তুক। তথ্যচিত্র করেছেন - রবীন্দ্রনাথ টেগোর, টু, সিকিম, দ্য ইনার আই, বালা, পিকু এবং সুকুমার রায়। তাঁর ছেলে সন্দীপ রায় একবার অভিযোগ করেছিলেন তুমি শুধু বড়দের জন্যই ছবি বানাও, ছোটদের জন্য ভাবো না! তিনি তখন সৃষ্টি করেন তাঁর সবচেয়ে বেশি বাণিজ্যসফল ছবি গুপী গাইন বাঘা বাইন। এরপর একে একে সোনার কেল্লা, জয় বাবা ফেলুনাথ, হীরক রাজার দেশে 'র মতো শিশু কিশোরদের উপযোগী চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। চলচ্চিত্রের প্রয়োজনে নিজের পছন্দমতো সংলাপ, আবহ সঙ্গীত এমনকি গীতরচনাও করেছেন তিনি। তাঁর সমস্ত চলচ্চিত্রের বিজ্ঞাপন তিনি নিজেই আঁকতেন।

     বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই মানুষটি বাংলা সাহিত্যের জগতেও অদ্বিতীয়। ছোটদের কথা ভেবেই সৃষ্টি করা 'প্রফেসর শঙ্কু' ও শার্লক হোমসের আদলে তৈরি গোয়েন্দা প্রদোষ মিত্র বা 'ফেলুদা' আজও অবিস্মরণীয়। ফেলুদাকে নিয়ে লেখা গল্পের সংখ্যা ৩৫টি। ছোটদের কথা ভেবেই তিনি তাঁর ঠাকুরদা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর চালু করা 'সন্দেশ' পত্রিকাটি কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় ও পিসি লীলা মজুমদার এর সঙ্গে মিলে পুনরায় চালু করেন ১৯৬১ সালে। তিনি এই পত্রিকার জন্য ছবি আঁকতেন, কবিতা, ছড়া, প্রবন্ধ ও গল্প লিখতে ভালোবাসতেন। ছোটদের জন্য তাঁর কয়েকটি বিখ্যাত বই হল- 'তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম', 'একের পিঠে দুই', 'একডজন গল্প', 'তারিণী খুড়োর কীর্তিকলাপ' ইত্যাদি। এছাড়াও 'ফটিকচাঁদ' ও 'সুজন হরবোলা' র গল্পগুলো নিয়ে পরবর্তী সময়ে তিনি চলচ্চিত্র করেছেন। 'যখন ছোটো ছিলাম' নামে তাঁর একটি স্মৃতিচারণ মূলক লেখা এবং 'Our Films Their Films' নামে একটি চলচ্চিত্র সমালোচনা মূলক সংকলন তিনি লিখেছেন। 'বিষয় চলচ্চিত্র'(১৯৮২) তাঁর চলচ্চিত্র নিয়ে লেখা একটি প্রবন্ধের সংকলন। 'মোল্লা নাসিরুদ্দিনের গল্প' নামে একটি গল্পের সংকলনও তিনি প্রকাশ করেছিলেন। বেশ কিছু ইংরেজি ভাষার গল্প তিনি অনুবাদ করে প্রকাশ করেছিলেন 'ব্রাজিলের কালো বাঘ' নামের বইটিতে। তাঁর আঁকা বই গুলির প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ বাংলা সাহিত্যের সম্পদ।

    চলচ্চিত্র পরিচালনায় দেশীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। এরমধ্যে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক ডি লিট, ১৯৮৭ তে ফ্রান্সের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান লেজিয়ঁ দ্য নর, ১৯৯২ তে মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে পাওয়া সারাজীবনের কাজের জন্য একাডেমী সম্মানসূচক পুরস্কার বা অস্কার, ১৯৮৫ তে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার, ঐ ১৯৯২ তেই ভারতের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান ভারতরত্ন এবং মৃত্যুর পর পাওয়া আকিরা কুরোসাওয়া পুরস্কার উল্লেখযোগ্য।

     ২৩ এপ্রিল ১৯৯২ এই মহান স্রষ্টার হৃদযন্ত্রের জটিলতা জনিত অসুস্থতার কারণে জীবনাবসান হয়।


ধারাবাহিক ভ্রমণ
চলো যাই
(পাখিদের কাছে)
বাসবদত্তা কদম

শেষ পর্ব 

অবশেষে এলো শেষ পর্ব! কতদিন ধরে যে পাখি নিয়ে পড়াশোনা করতে হচ্ছে তোমাদের! কোনো মানে হয়! 
-হ্যাঁ। ভালো লাগে, কিন্তু শুধু পাখি আর পাখি!
-জানি তো। এত সব খটমট নাম, তাদের অভ্যাস, বাড়িঘর, খাওয়া দাওয়া সেই কবে থেকেই শুনে চলেছ তোমরা, তাই আজ পাখিদের রাজ্যের রাণী ফ্লেমিংগোর কথা বলে আমার এই ‘পাখি কথা’ শেষ করবো।
-ফ্লেমিংগো রাণী!
-হ্যাঁ গো রাণীই বলে অনেকে তাকে পক্ষী কুলের। এত সুন্দর রঙ। তেমনি সুন্দর দুলকি চালে তার চলার ধরন। দেখলে মনে হবেই, কোত্থেকে এলেন এই সুন্দরী! 
-আর কদিন বাদেই এখানে খুব গরম পড়ে যাবে আর ওরা উড়ে যাবে। তাই ওদের উড়ে যাবার আগে ফ্লেমিংগো পাখির সঙ্গে একটু পরিচয় করে নাও। কথা দিচ্ছি আর বিরক্ত করবো না না না।
-কি বললে, রাগ করেছি কি না! আরে না না রাগ করবো কেন! আমিও তো তোমাদের মতন ছোট ছিলাম সেই অনেক, অ-নে-ক বছর আগে, তাই তোমাদের মনের কথা এখনও একটু একটু বুঝতে পারি।
দূরে নীল জল, আর জলের মধ্যে সারি দিয়ে নেমে এসেছে সব লাল, লাল আগুনের শিখা। আগুনের শিখারা তখন সন্ধান চালাচ্ছে খাবারের। 
বিস্মিত আমরা কয়েকজন রাস্তা পেরিয়ে এসেও দেখছি, সে সব ফ্লেমিংগোদের ভ্রুক্ষেপ পর্যন্ত নেই। অবশ্য থাকবার কথাও নয়। ওরা যদি সংখ্যায় হয় হাজার। আমরা মোটে পাঁচ। 
কেরালা এবং তামিলনাড়ুতে শুনেছিলাম প্রচুর ফ্লেমিংগো আসে। কিন্তু সেটা এ-ত। 
আমরা পাঁচজন যদি দুদিকে হাত ছড়িয়ে ছড়িয়ে দাঁড়াই তাহলে যতটা লম্বা হবে, আরো পাঁচ, আরো পাঁচ কী জানি বাবা এরকম কত পাঁচজন হাত ছড়িয়ে দাঁড়ালে তবে ওদের একটা মাপ পাওয়া যেতে পারে।
সামনের খাড়াই বালিয়াড়ি, নেমে গেছে কাদা মাখানো পাড়ে।
বাবা বলল, -নাম, নাম! জামা অনেক হবে, কিন্তু এমন ফ্লেমিংগো দর্শন আর জীবনে হবে কি না তা তোরাও জানিস না। আমিও জানি না।
-যেমনি বলা, হেঁচড়ে ছেঁচড়ে নেমে পড়লাম আমরা। কিন্তু যতই হাঁটি ফ্লেমিংগোরা দেখি ঠিক ততটাই দূরে আছে। 
-কি মুশকিল! ফটো কি তোলা হবে না ওদের? দেখা দেবেনা একটুও কাছে এসে?
-না! বৃথা চেষ্টা। জল অবধি পৌঁছে গেলাম। কিন্তু তারা তখনো বহু বহু দূর। 
-আসলে এরা এত বেশি সুন্দর! তাই বোধহয় এত দেমাক। এর আগের পাখিগুলো খুব কাছে না হলেও, ক্যামেরা পোজ দিয়েছিল, প্রায় সবাই। 
অগত্যা! দূর থেকেই!
তবে একটা মজার ব্যাপার কি জানো? ফ্লেমিংগোরা সাধারণত খুব গভীর জলে খাবারের সন্ধানে যায় না। নাই এরা জলের বড় বড় মাছ ধরে খায়। 
-মাছ ধরে না তো জলে খায় কি?
-মাছ খায় না একেবারেই তা নয়। তবে ছোট ছোট মাছ, চিংড়ি এগুলো খায় তবে মূলতঃ এরা বেশ অগভীর জলাভূমিতে, এদের ছোট অথচ শক্ত এবং তীক্ষ্ণ ঠোঁটের সাহায্যে খুঁজে বেড়ায় শৈবাল। ঐ জলের শ্যাওলা আর কি।
-শ্যাওলা খায়!
-হ্যাঁ। শ্যাওলা খেতেই এরা সব থেকে বেশি পছন্দ করে। আর বৈজ্ঞানিকরা মনে করেন, এই শ্যাওলার গুণেই ওদের অমন সুন্দর রঙ।
তবে ছোট ফ্লেমিংগোরা একটু ফ্যাকাসে সাদা রঙের হয়। সেটা যে কোনো ফ্লেমিংগো। তবে একটু বড় হলেই রঙ লাগতে শুরু করে ওদের গায়ে। থুড়ি পালকে।
এই পাখি দেখা যায় আমেরিকা, আফ্রিকা মহাদেশ, এশিয়ার এক বৃহত্তম অংশ—যার মধ্যে আছে আমাদের দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ পশ্চিমের রাজ্যগুলি। গুজরাট, কেরালা এবং তামিলনাড়ুতে বেশ কিছু ফ্লেমিংগো দেখা যায়। 
গোলাপী ফ্লেমিংগো, লাল ফ্লেমিংগো, চিলিয়ান ফ্লেমিংগো, ক্যারিবিয়ান ফ্লেমিংগো, এরকম বেশ কয়েকটি প্রজাতির ফ্লেমিংগো সাধারণত দেখতে পাওয়া যায়।
ফ্লেমিংগো সেই কর্ডাটা পর্বেরই, পক্ষী শ্রেণীর ফোনিকোপটারিডি(Phoenicopteridae) পরিবারের সদস্য।     
এরা বাসা তৈরি করে কাদা দিয়ে। আর সে বাসা জলাভূমির আশেপাশেই বানায় এরা।
বেশ ভালো উড়তে পারে এরা, তা ধরো না কেন ঘন্টায় ৩৫-৪০ মাইল গতিতে। মাইল আর কিলোমিটারের অঙ্কটা তোমরাই করে নিও কেমন। আমি আবার ফ্লেমিংগো দেখি।
এই পাখিগুলি, মাঝারি আকৃতির হয়। ওজন ৪-৫কেজি। পা বেশ শক্ত এবং বলিষ্ঠ, জলে বহুঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকার উপযোগী। ঠোঁট ছোট কিন্তু খুব শক্ত ও বলিষ্ট। জলের ছোট ছোট পোকা, শামুক, শ্যাওলা ধরার উপুযুক্ত।
এ পাখির আয়ুষ্কাল বেশ বেশি, ৩০, ৪০ শোনা গেছে কোনো কোনো ফ্লেমিংগো ৫০ বছরেরও বেশি বেঁচে থাকে।
আজকের মত ফুরালো আমার পাখি কথা। গুনে ফেল দেখি কত রকমের পাখি দেখলে এই দশ সপ্তাহে। মনে মনে নামগুলো একবার বলে ফেলো দেখি।
সবাই ভালো থেকো। আবার দেখা হবেই আমার গল্পের ঝোলা নিয়ে।


পাঠপ্রতিক্রিয়া
(জ্বলদর্চি ছোটোবেলা ৮০ পড়ে গল্পকার ফাল্গুনী পান্ডা যা লিখল)

সম্পাদকীয় থেকেই আকর্ষণীয় এবারের সংখ্যা | ছোট্ট বন্ধুদের সাথে আমিও জানতে পারবো অনেক কিছু সেই আশা নিয়ে পড়তে শুরু করলাম | 
প্রথমেই জয়াবতীর জয়যাত্রা ধারাবাহিক উপন্যাস সুলেখিকা তৃষ্ণা বসাকের লেখা পড়ে জগোপিসির বানানো আমসত্ত্ব ও বড়ি খেতে খুব ইচ্ছে হল। প্রকৃতি পরিবেশ উপন্যাসে যা বিবৃত আছে তা এক কথায় অতুলনীয় | 

চাঁদের মায়াবী রাত গৌতম বাড়ই এর লেখা ছড়াতে সত্যিই মায়াবী চাঁদের রাতের বর্ণনা পেলাম মন ভরে গেল | 

হীরের নাকছাবি শ্রীকান্ত অধিকারীর লেখা গল্পে হিরে আকাশ থেকে বৃষ্টির মতো পড়ে গল্পে আগুনের ফুলকির সংযোজন করেছে | 

ধারাবাহিক ভ্রমণ চলো যাই (পাখিদের কাছে ) লেখিকা বাসব দত্তা কদমের লেখনীতে পেলিকান পাখিদের সম্পর্কে অনেক অজানা কথা বলেছেন। জানতে পারলাম | 
আমার দুঃখ মিষ্টি মেয়ে ছোট্ট সুহেনারর কলমে একটা সুন্দর মেসেজ আছে বড়ো মানবিক আবেদন সুহেনার যা উপেক্ষা করতে আমি অন্তত পারবো না এবার ময়ূরীর সাথে দেখা হলে সরি বলতেই হবে | 
স্মরণীয় নারায়ণ সান্যাল পীযুষ প্রতিহারের কলমে বহু অজানা কথা জানতে পারলাম | বড়ো ভালো লাগল | 
ধন্যবাদ সকল লেখক লেখিকা সম্পাদক ও চিত্র শিল্পী দের | 
সব শেষে বলি জ্বলদর্চি পত্রিকা যেন পরবর্তী সংখ্যায় আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে | এই পত্রিকার শ্রীবৃদ্ধি কামনা করি |

আরও পড়ুন 
জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments