জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা--২৭/প্রীতম সেনগুপ্ত

পর্ব ২৭

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

প্রীতম সেনগুপ্ত

 তুরীয়ানন্দজী সম্পর্কে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের দশম সঙ্ঘগুরু স্বামী বীরেশ্বরানন্দজী বলেছেন নানা কথা। সেগুলি এইরকম--“হরি মহারাজ -- স্বামী তুরীয়ানন্দজী সম্পর্কে যেটুকু আমার মনে আছে তাই এখানে বলছি। ওঁর সঙ্গে ছিলাম ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি থেকে ১৯২১-এর ৩রা মার্চ।...ঠাকুর হরি মহারাজ সম্বন্ধে বলতেন ‘গীতোক্ত সন্ন্যাসী’। 

বাস্তবিক আমরা যখন তাঁকে দেখেছি, তাঁর চালচলন কথাবার্তা -- এসব দেখেশুনে মনে পড়ত গীতায় শ্রীকৃষ্ণ-কথিত স্থিতপ্রজ্ঞের লক্ষণগুলি। তিনিও নিঃসন্দেহে একজন স্থিতপ্রজ্ঞ পুরুষ। তাঁর সম্বন্ধে কয়েকটি কথা বলছি। তিনি কত বড় ত্যাগী পুরুষ ছিলেন--তাতে তা বোঝা যাবে। একদিন তিনি গঙ্গাতীরে বসেছিলেন। রাত গভীর হয়েছে লক্ষ্য করে একবার ভাবলেন, আশ্রমে ফিরে যাই। সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো এ কি কথা? আমি সন্ন্যাসী, আমার থাকার কথা গাছতলায়, আমি আবার আশ্রমে যাব -- এ আবার কিরকম কথা? ঠিক করলেন, তিনি আর আশ্রমে ফিরে যাবেন না। এই ভাব নিয়ে অনেকদিন বাইরে ছিলেন, কোন আশ্রয়ে না থেকে গাছতলায় পড়ে থাকতেন। এরকম একদিন গাছতলায় শুয়েছিলেন, হঠাৎ কে যেন তাঁকে একটা ধাক্কা দিয়ে বললে, সরে যাও। তিনিও তখুনি উঠে সরে গেলেন। আর গাছতলায় যেখানটায় তিনি শুয়েছিলেন সেখানে গাছের মোটা একটা ডাল হুড়মুড় করে ভেঙে পড়লো। তিনি বুঝতে পারলেন যে, ভগবানই তাঁকে সতর্ক করে  দিলেন। নতুবা ঐ ডালে চাপা পড়ে তিনি মারা যেতেন। 


 ...একদিন তিনি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন, পিছনে চলেছিলেন আমাদের সাধুরা। রাস্তার পাশে একটি সুন্দর দোতলা বাড়ি তৈরি হচ্ছিল। সেটি দেখে একজন সাধু মন্তব্য করেন, বাঃ, বেশ চমৎকার বাড়ি তো! হরি মহারাজ চট করে ঘুরে সাধুটিকে বললেন, বাড়ি ভালো, তোমার কি তাতে? হরি মহারাজের বলার উদ্দেশ্য, সাধুটির মনে হয়ত সুন্দর ভাল বাড়িতে থাকার সুপ্ত বাসনা ছিল। এই কারণে তিনি বুঝিয়ে দিলেন যে, এরকম একটা aspiration (আকাঙ্ক্ষা) থাকাটাও ঠিক নয়। এইভাবে তিনি সবসময়ে আমাদের ভুলত্রুটি দেখিয়ে দিতেন।
 ...স্বামীজী দ্বিতীয়বার বিদেশে যাওয়ার পূর্বে হরি মহারাজকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চান। হরি মহারাজ কিন্তু পুণ্যভূমি ভারতবর্ষ ছেড়ে বাইরে যেতে নারাজ ছিলেন। শেষ পর্যন্ত স্বামীজী তাঁকে জড়িয়ে ধরে বলেন, দেখ হরিভাই, ঠাকুরের কাজ করতে করতে আমার শরীর ভেঙে পড়েছে। তোমরা আমাকে একটু সাহায্য করবে না? এভাবে appeal (অনুনয়) করে বলাতে হরি মহারাজ রাজী হয়ে গেলেন। তিনি স্বামীজীর সঙ্গে আমেরিকায় গেলেন। স্বামীজী তাঁকে বলেছিলেন, তোমাকে এখানে কোন বক্তৃতা করতে হবে না। তুমি শুধু আদর্শ সন্ন্যাসীর জীবন কি, তা দেখিয়ে দেবে। তাহলেই হবে। স্বামীজী একবার আমেরিকানদের বলেছিলেন, তোমরা আমার মধ্যে fighting সন্ন্যাসী অর্থাৎ ক্ষত্রিয় সন্ন্যাসীকে দেখেছ। এবার তোমরা দেখবে ব্রাহ্মণ সন্ন্যাসীকে, তাহলেই ভারতবর্ষে সন্ন্যাসীর আদর্শ তোমরা ঠিক ঠিক বুঝতে পারবে।  স্বামী তুরীয়ানন্দ সে রকম আদর্শ সন্ন্যাসীর জীবনযাপন করেছিলেন। তিনি ‘শান্তি আশ্রমে’ থাকতেন। কোন ভারতীয় আশ্রমে সন্ন্যাসী যেমন থাকেন তিনিও তেমন থাকতেন। একদিন তিনি আশ্রমবাসীদের ক্লাসে বলেছিলেন, seriously অর্থাৎ ঠিক ঠিক যদি তোমরা ভগবানকে ডাক, তাহলে তিন দিনের মধ্যেই ভগবৎ দর্শন হতে পারে। এই কথা শুনে আশ্রমবাসী একটি অল্পবয়সী মেয়ে তিন দিন আর তার ঘর থেকে বেরুল না। সবসময় সে ভগবানের চিন্তা করতে থাকল। তিন দিন পরে সে এসে হরি মহারাজকে বললে, Well Swami, what you said is true. (আপনি যা বলেছিলেন, সে কথা ঠিক)। অর্থাৎ তিনদিন ভগবানকে ডেকে ভগবানের দর্শন না হোক একটা কিছু নিশ্চিত অনুভব করেছিল।”(স্বামী তুরীয়ানন্দের স্মৃতিকথা, সংকলক ও সম্পাদক- স্বামী চেতনানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়) 

 শ্রীরামকৃষ্ণের দেহত্যাগের কিছুদিন পরেই হরিনাথ প্রবল বৈরাগ্যের বশে একটিমাত্র বস্ত্র পরিধান করে ও উত্তরীয় হিসেবে একখানি লেপের ওয়াড় কাঁধে ফেলে গৃহ পরিত্যাগ করেন এবং শিলং পর্যন্ত ঘুরে আসেন। এরপর চব্বিশ বছর বয়সে ১৮৮৭ সালে বরানগর মঠে যোগদান করে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। সন্ন্যাস নাম হয় স্বামী তুরীয়ানন্দ। সন্ন্যাস গ্রহণান্তে পরিব্রাজক ও সাধকরূপে তীর্থাদিতে গমন করেন। ১৮৮৯ সালে স্বামী সারদানন্দ প্রমুখের সঙ্গে হৃষীকেশে তপস্যা করেন এবং পরের বছর গঙ্গোত্রী দর্শন করেন। গঙ্গোত্রী থেকে প্রত্যাবর্তন করে মুশুরী পাহাড়ের তলদেশে রাজপুরে উপস্থিত হয়ে তপস্যামগ্ন হন। ১৮৮৯ সালের শেষদিকে স্বামী বিবেকানন্দের সাহচর্যে কিছুদিন অতিবাহিত করার পর দিল্লি থেকে স্বামী ব্রহ্মানন্দজীর সঙ্গে জ্বালামুখী ও অন্যান্য তীর্থ দর্শনে গমন করলেন। ১৮৯৩-এর প্রথম দিকে বোম্বে ফিরে এলেন, সঙ্গে ছিলেন স্বামী ব্রহ্মানন্দজী। এখানে এসে আমেরিকাগামী স্বামী বিবেকানন্দের দেখা পেলেন। এর অল্প কয়দিন পরে ব্রহ্মানন্দজী ও তুরীয়ানন্দজী বৃন্দাবনে যান এবং দীর্ঘকাল সেখানে তপস্যায় কাটান। বৃন্দাবনে থাকাকালীন হরি মহারাজ শ্রীরাধার দর্শনেচ্ছায় মাঝে মাঝে নিধুবনে যেতেন। একদিন তমালবৃক্ষের শাখায় আলুলায়িত বেণী দেখে প্রথমে সেটি তাঁর ময়ূরপুচ্ছ বলে ভ্রম হয়। কিন্তু ভ্রমভঙ্গ হতে বিলম্ব হয় নি। সত্য উদ্ভাসনে যুগপৎ চমকিত ও উল্লসিত হন! হরি মহারাজের পরিব্রাজক জীবনে অদ্ভুত চমকপ্রদ সব ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। একবার পথ চলতে চলতে তাঁর মনে গ্লানি এল। তিনি ভাবতে থাকলেন, জগতে সকলেই কিছু-না-কিছু কর্তব্য সম্পাদনে প্রয়াসী, শুধুমাত্র তিনিই ভবঘুরের মতো এক ব্যর্থ জীবনযাপন করছেন। 

তারপর কেশীঘাটে শায়িত অবস্থায় ধ্যানমগ্ন হয়ে তাঁর অনুভূতি হল -- তিনি সুবিশাল ভূমিতলে শায়িত এবং তাঁর দেহ আকাশ-পাতাল জুড়ে প্রসারিত। এক অদ্ভুত নির্জনতার মধ্য থেকে শুনতে পেলেন অশরীরী বাণী -- “দেখ, তুমি কত মহান! কেন তুমি ভাব তোমার জীবন ব্যর্থ? ওঠ, জাগ, পরম সত্য লাভ কর -- সে সত্যের কণামাত্র বিশ্বকে মুক্ত করতে পারে। এই জীবনই হল মহত্তম জীবন।” তাঁর মনের সমস্ত গ্লানি চিরতরে বিদূরিত হল।

 সৌরাষ্ট্রের গিরনার পাহাড়ে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় চিকিৎসকের কাছে যেতে স্বাভাবিকভাবেই প্রয়াসী হলেন। কিন্তু তৎক্ষণাৎ তাঁর স্মৃতিতে উদ্ভাসিত হল এই শ্লোকটি -- ঔষধং জাহ্নবীতোয়ং বৈদ্যো নারায়ণো হরিঃ। আর বৈদ্য বা চিকিৎসকের কাছে যাওয়া হল না। গঙ্গাজল পানের মাধ্যমে রোগ নিবারণের আশাকে সজীব করে কুঠিয়ায় ফিরে এলেন। আরেকটি ঘটনা ঘটে উত্তরকাশীতে। গঙ্গাস্নান করতে যাওয়ার পথে দেখলেন একটি বাঘ মৃতদেহ ভক্ষণে ব্যস্ত। স্বভাবতই তাঁর চলার গতি রুদ্ধ হল। পরক্ষণেই জ্ঞানস্বরূপ জাগ্রত হয়ে তাঁকে জানান দিল -- “বাঘ মৃতদেহ খাচ্ছে তো খাক, এতে আমি ভীত হব কেন?” (শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তমালিকা--স্বামী গম্ভীরানন্দ, প্রথম ভাগ, উদ্বোধন কার্যালয়)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments