জ্বলদর্চি

দূরদেশের লোক গল্প—চীন দেশ/চিন্ময় দাশ


দূরদেশের লোক গল্প—চীন দেশ

চিন্ময় দাশ

একটা ছেলেই চালাকি করেনি

রাজামশাইর মনে সুখ নাই। থাকবে কী করে? এত বড় একখানা রাজ্য আছে তার। রানি আছে ঘরে। আদরের দুলালি মেয়েও আছে একটি। কিন্তু ছেলে নাই রাজার। তাই সুখ নাই রাজার মনে।

একটাই দুশ্চিন্তা রাজামশাইর। মরার সময় এলে, কার হাতে দিয়ে যাবে রাজ্যের ভার। কে দেখবে প্রজাদের।
রাজার মন্ত্রী ভারি বুদ্ধিমান। সে বলল—কেন রাজামশাই, জামাইকেই তো রাজা করা যাবে।
রাজা বলল—সে তো হতেই পারে। কিন্তু মানুষ হিসাবে কেমন হবে সে, বুঝব কী করে? প্রজাদের সুখে রাখবে তো? 
মন্ত্রী গম্ভীর গলায় কেবল বলল- হুঁ-উ-উ।
রাজা বলল—রাখো তোমার লম্বা হুঁ। আমি চাই দেশের রাজা হবে সৎ। রাজা হবে নির্লোভ। চাতুরি থাকবে না মনে। এমন কেউ কি আর নাই দেশে? আছে নিশ্চয়। কিন্তু খুঁজে পাবো কী করে তাকে। কিছু একটা উপায় বের কর দেখি। তোমার তো বুদ্ধির শেকড়-বাকড় গজিয়ে গেছে খুলির ভেতর।
তখুনি কোন জবাব দিল না মন্ত্রী। একটু হাসল কেবল কথাটা শুনে।
আসলে হয়েছে কী, এই দুজনের বাবাও ছিল এই দেশের রাজা আর মন্ত্রী। ছোটবেলা থেকেই তাই দুজনের ভারি ভাবসাব। মনেই থাকে না যে তারা রাজা আর মন্ত্রী।
--ঠিক আছে তাহলে। শেকড়-বাকড়গুলো একটু নেড়েচেড়ে দেখি, কিছু উপায় হয় কি না। কাল দরবারেই জানাব আমি। 

পরের দিন। দরবারে এসেই রাজার কানের কাছে মুখ নিয়ে, ফিসফিস করে কী সব বলল মন্ত্রী। কী কথা হোল দুজনেই জানে। তবে রাজার মুখ ভারি উজ্বল।
দরবার শুরু হল। রাজা বলল— সবাই তোমরা জানো, এই রাজ্যের সিংহাসনের কোন উত্তরাধিকারী নাই। আমারও বয়স হয়ে যাচ্ছে। তাই এই সভায় একটা নির্বাচনের আয়োজন করা হবে। যে জিতবে, সেই পাবে এই সিংহাসন। তাকেই পরানো হবে এই রাজমুকুট।
এক সেপাইকে ডেকে মন্ত্রী বলল—নগর কোতওয়ালকে ডেকে নিয়ে আয়।
নগর কোতওয়াল এলে, তাকে বলা হোল-- সারা রাজ্যে ঢেঁড়া পিটিয়ে দাও। পাঁচ দিন বাদে রাজ্যের যত যুবক এসে হাজির হবে দরবারে। একটা করে বীজ দেওয়া হবে সকলকে। তা থেকে চারা তৈরি করে, ছ’মাস বাদে সবাই ফিরে আসবে, নিজের নিজের চারা নিয়ে। যার চারাটি সেরা হবে, সেই হবে দেশের আগামী রাজা। 
ঢ্যাঁড়াদারের গলায় রাজার ঘোষণা শুনল সারা দেশ। উত্তাল হয়ে এল দেশটা। হাজার হাজার যুবক দেশে। সবাই ভাবতে লাগল, আমিই গজাব সেরা চারাটি। আমিই হব দেশের পরবর্তী রাজা।

 যেসব লোক খেত-খামারের কাজে পটু, তার ভাবতে লাগল, তার ছেলেই হবে দেশের রাজা। সে এক উতরোল অবস্থা গোটা রাজ্যটার। 
দেখতে দেখতে কেটে গেলে পাঁচটা দিন। সূর্য না উঠতেই, রওণা দিয়েছে দূর এলাকার যুবকেরা। ভীড়ে ভীড়াক্কার হয়ে গেল রাজবাড়ির সামনে। 
অত লোক তো আর দরবারে ধরবে না। তাই, ম্যারাপ বাঁধা   হয়েছে সামনের মাঠে। যুবকের দল সেখানে জমায়েত হয়েছে। 
একটা মঞ্চের উপর, একেবারে মাঝখানে রাজার সিংহাসনটিকে রাখা হয়েছে। তবে, আজ রাজা তাতে বসেনি। সিংহাসনটি ফাঁকা। তার একদিকে বাসেছে রাজা, মন্ত্রী, আর কোতওয়াল। অন্য দিকে  রাজার পারিষদরা। সিংহাসনটিকে তাদের সকলের মাঝখানে এনে রখা হয়েছে।

 থিকথিক করছে ভীড়। শূণ্য সিংহাসনটি ঝলমল করছে সকলের চোখের সামনে। বুক ফেটে যাবার অবস্থা যুবকদের। কোন দিন এই সিংহাসন চোখেও দেখেনি তারা কেউ। আজ এই আসন হাতছানি দিয়ে ডাকছে সকলকে— এসো, যে পারো, জিতে নাও। 
আবার ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে দেওয়া হোল— এখনই একটা করে লিচুর বীজ দেওয়া হবে সকলকে। ঠিক ছ’মাস পরে এই ময়দানে ফিরে আসবে সবাই। যার চারাটি সেরা হবে, সে-ই বসবে এই সিংহাসনে। রাজামশাই নিজের হাতে মাথার মুকুট খুলে পরিয়ে দেবেন তাকে। 
ভয়ানক একটা কোলাহল উঠল এই ঘোষণায়। সবাই উল্লসিত। শূণ্য সিংহাসন আর রাজার মাথার মুকুট চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগল যুবকের দল। 

  সভা শেষ। এক বুক স্বপ্ন নিয়ে ঘরে ফিরে চলেছে যুবকেরা। হাতের মুঠোয় লিচুর বীজ নয়, যেন রাজার মুকুটটিই ধরা হয়ে আছে।
জুন নামের এক যুবক এসেছিল গ্রাম থেকে। নিজের গ্রামে ভালো চাষি হিসাবে নাম আছে তাদের বাপ-ছেলের। হাতে যেন সোনা ফলে তাদের। তাদের খেতে তরমুজ, মূলো, কড়াইসুঁটির ফলন দেখলে, চোখ জুড়িয়ে যায়। গোটা গ্রাম ভাগ পায় সেসবের। বিনি পয়সাতেই। সামান্য এক ফেন-ও খরচা করতে হয় না কাউকে।
ফসলের পরিচর্যা খুব ভালোই জানে জুন। কখন জল দিতে হয়, কতটা রোদ সইতে পারে কোন গাছ, খেতে নিড়ানি চালাতে হয় কখন—সবই তার নখদর্পনে। তাই, তার মনেও খুব আশা, সে নিশ্চয়ই সেরা হতে পারবে। 
ভারি যত্ন করে টবে বীজ পুঁতল জুন। মাটি, সার, জল-- সবই দিল পরিমাণ মত। তার পর অপেক্ষা করতে লাগল,  কখন দুটি সবুজ পাতা দেখা দেবে মটি ফুঁড়ে।
সেই গাঁয়েরই একটি ছেলে চে উন। তার চারা গজাল সবার আগে। তখন সে কী দেমাক আর হম্বি-তম্বি তার। যেন তখনই যুদ্ধ জিতে গিয়েছে সে। দেখতে দেখতে চারা গজাল ওয়াং, উ মিন ইত্যাদি গ্রামের অন্য ছেলেদেরও। 

 কিন্তু অবাক হওয়ার মত ব্যাপার। জুনের টবে সবুজের কোন চিহ্নই নাই।
মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড় ছেলেটার। এমনটা হওয়ার তো কথা নয়। অন্যদের টবে পরপর পাতা ছাড়ছে লিচুগাচ। কেবল জুনের টবে সবুজের চিহ্নটাও নাই।
অগত্যা একটা নতুন টব এলো। নতুন মাটি। নতুন করে সার। বীজটা তুলে, আবার পোঁতা হল দ্বিতীয় টবে। আবার প্রতীক্ষা। আবার মেহনত। রোদ, জল, আলো, বাতাস—সবেরই বিধি মতো ব্যবস্থা। 
কিন্তু ঐ পর্যন্তই। কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। চারা গজাচ্ছেই না। 

 এভাবে দু’মাস, তিন মাস কেটে গেল। কাজের কাজ কিছুই হয়নি। গ্রামের ছেলেরা এবার হাসাহাসি করতে লাগল জুনকে নিয়ে। করবে না কেন? তাদের সকলেরই গাছের কাণ্ড শক্ত হতে শুরু করেছে। 
দেখতে দেখতে চার মাস কেটে গেল যখন, আবার একটা নতুন টব এনে, নতুন করে বীজটা পোঁতা হোল। নতুন করে পরিচর্যা। কিন্তু পরের দু’মাসেও চারা গজালো না তার। 
ছ’মাস পেরিয়ে গেল যেদিন, রাজার ঢেঁড়া শোনা গেল আবার। নিজের নিজের গাছ নিয়ে হাজির হতে হবে রাজবাড়িতে। 

 শত শত গ্রাম আর গঞ্জ থেকে রাজবাড়ি মুখে গিয়েছে যেসব পথ, সবই সেদিন লোকে লোকারণ্য। নিজের নিজের সেরা পোষাক পরেছে সকলে। অনেকের সাথেই চলেছে তাদের বাবা-মায়েরাও। অনেকেই টবগুলোকে ঝকঝকে করেছে ঘষেমেজে। কেউ আবার চারাগুলোকে  চকচকে করেছে কাঁচা দুধে ধুয়ে। দেখলেই তারিফ করতে হয়। 

 মুখ কালো করে, বাবা-মাকে জিজ্ঞেস করল জুন—আমি কী করব? আমি তো চারাই গজাতে পারিনি।
বাবা তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল—তাতে হয়েছে কী। চেষ্টায় তো কোন খামতি ছিল না তোমার। ছ’মাস ধরে কত মেহনত করেছ, সবই দেখেছি আমরা। চেষ্টার বেশি মানুষ আর কী করতে পারে? এই টব নিয়েই দরবারে যাও তুমি। 
চারাগাছ সহ টব নিয়ে চলেছে উৎসাহী যুবকের দল। সকলের হাতেই একটা করে টব। সবুজ সতেজ চারা ঝলমল করছে তাতে।
জুন হাঁটছে সকলের পেছনে। মুখ নীচু। হাতে শূণ্য টব। চোখ তুলে তাকাতে পারছে না কারও দিকে।
সেদিন মঞ্চ সাজানো হয়েছে অনেক ঝলমলে করে। রাজা নির্বাচন হবে যে আজ! 
আজও মঞ্চের মাঝখানে সেই শূণ্য সিংহাসনটি। দু’পাশে দেশের রাজা, মন্ত্রী, পারিষদবর্গ সবাই। আজ কিন্তু রাজার একপাশে তাঁর রানি, অন্য পাশে রাজার দুলালী মেয়ে। সবাই দেখতে এসেছে, কে বিজয়ী হয়। কে বসবে সিংহাসনে। কে পরবে রাজার মুকুট।
এক দিকে সার বেঁধে দাঁড় করানো হয়েছে যুবকদের। সকলের হাতে নিজের নিজের চারাগাছ। অন্যদিকে তাদের বাবা-মায়েরা।

 জুন দাঁড়িয়েছে সবার পিছনে। হাতে শূণ্য টব। চোখ নীচু। মুখ কালো।
রাজা আর মন্ত্রী নেমে এল মঞ্চ থেকে। দু’জনে চলেছে গাছ দেখতে দেখতে। এক এক জনের গাছের বাড় এক এক রকম। দু’জনে যত এগোয়, ততই গম্ভীর হয় দুজনের মুখ। মাঝে মাঝেই মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে দু’জনে। গাছ দেখে আদৌ খুশি হয়নি দুজনে, বেশ বোঝা যাচ্ছে। 

 একেবারে শেষে জুনের সামনে এসে দাঁড়াল দুজনে। হাতে শূণ্য টবখানি। লজ্জায়, ভয়ে জুনের তখন প্রাণ বেরিয়ে যাওয়ার জোগাড়। 
রাজা আর মন্ত্রী— জুনের টব দেখে, থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছে তারা। দুজনে চোখ তুলে চেয়ে আছে পরস্পরের মুখে। অবাক করা ব্যাপার! হাসি ফুটে উঠেছে দুটি মুখেই।
রাজা বলল— এ কী? একটা শূন্য টব নিয়ে এসেছ আমার সামনে? 
ভয়ে থরথর করে কাঁপছে তখন ছেলেটা। কথা সরছে না মুখে। 

 রাজা গম্ভীর গলায় বলল— মাথা নামিয়ে রেখেছ কেন? মুখ তুলে জবাব দাও। কী বলবার আছে তোমার। 
কান্না ঠেলে উঠে আসছে বুক থেকে। গলার কাছে সেটাকে আটকে, মুখ ফুটল জুনের— আমার যথা সাধ্য চেষ্টা করেছি আমি। তিন বার টব বদল করেছি চারা গজাবার জন্য। কিন্তু কোন ফল হয়নি। অথচ, ভালো চাষি হিসাবে সুনাম আছে আমাদের বাবা-ছেলের। বাবার কাছ থেকেই কৃষিবিদ্যা শিখেছি আমি। সে মানুষটাও শিখেছে তার বাবার কাছ থেকে। কিন্তু এমন আজব ঘটনা কখনও ঘটতে দেখিনি আমরা। রাজবাড়ির দেওয়া বীজ থেকে চারা গজাতে ব্যর্থ হয়েছি আমি। যে কোনও শাস্তি দিন আমাকে। আমি প্রস্তুত হয়েই এসেছি। 

  রাজামশাইর গলা আরও গম্ভীর—তোমার বাবা ছিল না ঘরে? সে লোকটা কী করছিল? সে হাত লাগায়নি কেন? কোনও পরামর্শ দেয়নি কেন তোমাকে? 
--হাত লাগায়নি বটে, পরামর্শ বাবা দিয়েছে। এখন জুনের গলা কাঁপল না একটুও। স্পষ্ট করে বলল— বাবাই বলেছে, কাজটা তোমার। নিজের জ্ঞান আর বুদ্ধি দিয়ে, তোমাকেই করতে হবে কাজটা। রাজার দরবার থেকে সেই দায়িত্বটাই দেওয়া হয়েছে তোমাকে। 
রাজা চাইল মন্ত্রীর দিকে। দুজনের মুখেই একটা অর্থপূর্ণ হাসি। হাসি মুখেই দু’জনে ময়দান ছেড়ে মঞ্চে ফিরে গেল। 

 মন্ত্রীমশাই হুকুম করল— কোতওয়াল, দেউড়ির ফটক আটকে দাও। একজনও যেন পালাতে না পারে।
ঘড়ঘড় শব্দ করে ফটক বন্ধ হোল পেছনে। মাটি ফুঁড়ে উঠে এল একদল সেপাই। ছেলের দল আর বাবা-মায়েরা— দুটো ভাগের সামনেই দাঁড়িয়ে গেল সার বেঁধে। 
বুক ঢিপঢিপ করে উঠল সবার। এবার তাহলে মাথাটাই কেটে নেওয়া হবে জুনের। আহারে বেচারা! মুখে রা-টি নাই কারও। গাছের পাতাটি নড়লেও যেন শোনা যায়। 
রাজামশাই উঠে দাঁড়াল। গুরুগম্ভীর গলায় বলল--   একজন ছাড়া, আর সকলেই চারাগাছ নিয়েই এসেছে এখানে। কিন্তু বোঝা যাচ্ছে না, এসব গাছের বীজ তারা পেল কোথায়? কেননা, আমি যে বীজগুলো দিয়েছিলাম, সবই ছিল সেদ্ধ করা। যা থেকে কোনদিন চারা গজাবে না। জেনেবুঝেই দেওয়া হয়েছিল বীজগুলো। 
যদি বজ্রপাতও হোত এই জমায়েতে, এত চমকাত না কেউ। কেন না, রাজা আর মন্ত্রী দু’জন ছাড়া কেউ জানত না এ রহস্য। রাজবাড়ির লোকেরাও সবাই চমকে গিয়েছে। 

 আর নীচের জমায়েত? পাথর হয়ে গেছে সকলে। গলা শুকিয়ে কাঠ। প্রথমে বীজ না গজাতে, সকলেই বীজ বদলে নিয়েছিল। সকলের চাতুরীই ধরা পড়ে গেছে। 
ভয়র থরথর করে কাঁপছে সকলে। সকলের মাথা নীচু। 
হতভম্ব হয়ে গেছে জুন। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে মঞ্চের দিকে। তবে, কেবল তার মাথাটাই এখন সোজা।
রাজামশাই মন্ত্রীর দিকে চাইল ঘাড় ঘুরিয়ে। আবার হাসি দুজনের মুখে। হাসি মুখেই রাজা বলল— আজ আমি ভারি খুশি। আজ আমি ভারি নিশ্চিন্ত। আমার এই রাজ্যে অন্তত একজন হলেও যুবক আছে, যে রাজার ভয়েও মিথে  বলে না। লোভের ফাঁদে পা দেয় না সে। চাতুরীর আশ্রয় নেয় না কোন কিছুর লোভেই। একবার না পারলে, গুনে গুনে তিনবার চেষ্টা চালায় কাজে সফল হবার জন্য। হাল ছেড়ে দেয় না। আর, তার পরেও নিজের অসফলতার কথা স্বীকার করে নিতে লজ্জা করে না যে। আজকের প্রতিযোগিতাতে সে ছেলেটিই জয়ী। 

  মন্ত্রীমশাই নিজে গিয়ে সমাদর করে মঞ্চে নিয়ে এল জুনকে। রাজামশাই মাথার মুকুট খুলে, পরিয়ে দিল জুনের মাথায়। রাজা মন্ত্রী দুজন মিলে তাকে বসিয়ে দিল শূণ্য সিংহাসনে। 
এবার জমায়েতের বিচার পর্ব। রাজা মন্ত্রী পরামর্শ করে নিল ফিসফিস করে। মন্ত্রী বলল— বাকি যুবকেরা চাতুরী করেছে। তাদের প্রত্যেকের এক মাস কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হোল। যে বাবা-মায়েরা এসেছে এখানে, তাদের জন্য কারাবাস দু’মাসের। প্রত্যেকেই তারা নিজের নিজের ছেলেকে সাহায্য করেছে এই কুকর্মে।
সভা শেষ হতে যাচ্ছে। রানি তেড়েফুঁড়ে উঠে পড়ল—আরে দাঁড়াও, দাঁড়াও। এখুনি ছেড়ে দিলে চলবে কী করে এমন ছেলেকে। এই ছেলের হাতেই মেয়ের বিয়ে দেব আমি। কেবল মুকুট আর সিংহাসনটা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া যাবে না একে। 

 সেকথা শুনে, রাজা খুশি। দরবারের সবাই হইহই করে উঠল। মন্ত্রী হাসিমুখ করে রাজাকে বলল-- কী? আমি বলেছিলাম কি না! 
রাজকুমারি ছিটকে উঠে এল আসন ছেড়ে। সিংহাসনের কাছে এসে, জুনকে বলল— কীগো, তুমি খুশি তো? সবাই হেসে উঠল হো-হো করে।
কথা বলবে কী, জুনের মাথাতেই ঢুকছে না ব্যাপারটা। ঘাড়ের উপরে এখনও যে মাথাটা টিকে আছে, এই কত ভাগ্যেরর কথা! উলটে, একটা মুকুট উঠেছে সেই মাথায়। সাথে একটা গোটা রাজ্য। এখন আবার রাজকুমারির সাথে বিয়ে! 
ভোঁ-ভোঁ করে ঘুরছে জুনের মাথাখানা। মন্ত্রীমশাই মজা করে বলল— কীগো,ছেলে, আমাদের মেয়ের কথার জবাব দিলে না যে বড়। কিছু একটা তো বলো।
এবার নিজেকে সামলে নিয়ে, জুন বলল—একটা নয়। দুটো কথা বলব আমি। 
মন্ত্রী বলল— বলো। দুটো কেন গো। চাইলে, দু’শ কথাও বলতে পারো তুমি। 
রাজামশাই মনে মনে খুব খুশি এই ছেলের উপর। বলল—হ্যাঁ। যা বলবে, নির্ভয়ে বলো।
 জুন বলল— লোভ বড় কঠিন জিনিষ। মাথা খারাপ করে দেয় মানুষের। তার উপর, সেটা যদি হয় সিংহাসন আর রাজমুকুটের লোভ, তখন তো মাথা ঠিক রাখা বড্ড কঠিন। সেই লোভে এমন ভুল করে ফেলেছে সবাই। কিন্তু, মানুষকে সুযোগ দেওয়া দরকার। নিজেকে শুধরে নেওয়ার জন্য। 

 একটু থেমে বলল—রাজামশাই, আমার প্রথম কথা, জেলে পাঠিয়ে কী লাভ? সকলকে এক মাস রাজবাড়ির খেতে কাজ করতে পাঠানো হোক। তবে, সকলের খাবার-দাবার আর মজুরি দেওয়া হোক রাজবাড়ি থেকে। আর, তাদের বাবা-মাদের মাফ করে দেওয়া হোক এবারের মতো। 

 সাধু সাধু করে উঠল জমায়েতের সবাই। রাজা কিছু বলবার আগে, মন্ত্রীমশাই বলে উঠল— ঠিক আছে, তোমার কথাই রইল। তা বাপু, তোমার শেষ কথাটি কী? 
জুন বলল—শেষ কথাটা বিয়ের। বাড়িতে বাবা-মা আছে আমার। বিয়ের কথাটা তো বলবে অভিভাবিকরা। আমি নয়। একটি কথাও বলতে পারি না আমি। 
আনন্দে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরল রাজামশাই। 
মন্ত্রী ইঙ্গিত করতে, সাজানো গোছানো একটা ঘোড়ার গাড়ি বেরিয়ে গেল দেউড়ি পার হয়ে। 

 রাজার মুখে হাসি। এখন আর মনে কোন ভাবনা নাই রাজামশাইর।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments