জোয়ান অব আর্ক
মিলি ঘোষ
পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথম দিক। ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধে ফ্রান্স তখন নাজেহাল। ফ্রান্সের ষষ্ঠ চার্লসের পুত্র যুবরাজ ডফিনের, দেওয়ালে পিঠ ঠেকেছে। দক্ষিণ চিনন শহরে আশ্রয় নিয়েছেন অর্থবল, শক্তিবল হারিয়ে। ইংরেজের আক্রমণের ভয়ে কাঁটা হয়ে আছেন। এই কঠিন সময়ে ঝড়ের মতো সতেরো বছরের এক কিশোরী এসে দাঁড়ালেন যুবরাজ ডফিনের সামনে। দৃপ্ত ভঙ্গিতে বললেন, ইংরেজদের তাড়িয়ে ফ্রান্সকে তিনি মুক্ত করবেন। হ্যাঁ, এই কিশোরীই জোয়ান অব আর্ক।
কথিত আছে, জোয়ান ঈশ্বরের দূত। কিছু দৈববাণী শুনে সে যুবরাজের কাছে গিয়েছিল। যেহেতু বিষয়টি বিতর্কিত, তাই সেদিকে না গিয়ে মূল ঘটনায় ফিরি।
এতটুকু মেয়ে যুদ্ধে যাবে শুনে প্রচুর বাধা এসেছে, হেসে উড়িয়ে দিয়েছে অনেকে। শুধু পাশে ছিলেন জোয়ানের কাকা। কাকা আর এক ভাইয়ের সাথে তিনি সেনাপতি রবার্টের দুর্গে যান। প্রথমে রবার্ট গুরুত্ব না দিলেও জোয়ানের কথার দৃঢ়তায় এবং তাঁর অপূর্ব চেহারা দেখে জোয়ানকে বিশ্বাস করলেন। ছয়জন সৈন্য নিয়ে পুরুষের বেশে জোয়ান যাত্রা করলেন চিননের দিকে।
ডফিনের তখন বয়স কম। তাঁর পিতা ষষ্ঠ চার্লস মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন। স্বভাবতই সব দায়িত্ব তখন ডফিনের কাঁধে। এমতাবস্থায় জোয়ান এসে দাঁড়ান ডফিনের সামনে। অনেক সন্দেহ, অবিশ্বাস আর প্রশ্নের মুখোমুখি পড়তে হলো জোয়ানকে। ধীর অথচ দৃঢ় কণ্ঠে জোয়ান সব প্রশ্নের উত্তর দেন। জোয়ানের কথা শুনে একবার শেষ চেষ্টা করার আশায় বুক বাঁধলেন ডফিন। কারণ, এমনিতেও তিনি হেরেই বসেছিলেন।
কয়েকজন সেনাপতি, চার হাজার সৈন্য আর মধ্যিখানে হাতে সাদা পতাকা, কোমরে তলোয়ার নিয়ে কালো ঘোড়ায় চেপে জোয়ান। চারদিকে ছড়ানো ফ্রান্সের রাজবংশের প্রতীক আইরিশ ফুল। ১৪২৯ সালের ৩রা মে, তাঁরা এসে পৌঁছলেন অরলিয়েন্সে। কয়েকদিন বিশ্রামের পর যুদ্ধ শুরু হলো। একটার পর একটা শহর দখল করে এক বিশাল ইংরেজ বাহিনীর সামনে পড়লেন জোয়ান, এক প্রান্তরে এসে। একটানা নয় দিন যুদ্ধ করে জোয়ান জয়লাভ করলেন। সবাই জোয়ানকে ধন্য ধন্য করলেও তিনি নিজে কিন্তু বলছেন, এ জয় যুবরাজ ডফিনের।
চারপাশে অসংখ্য মৃতদেহ। আহতের আর্তনাদ। এ দৃশ্য সহ্য করতে পারলেন না জোয়ান। কান্নায় ভেঙে পড়লেন। নিজের শরীর থেকে রক্ত ঝরছে, তবু আহত ইংরেজ সৈন্যদের সেবায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। এদিকে যুবরাজের অভিষেকের সময় হয়েছে। জোয়ান তাঁর সেনাদের নিয়ে প্রাসাদে ফিরে গেলেন। ডফিন নিজে এসে জোয়ানকে অভিনন্দন জানালেন এবং রেইন শহরে প্রথাগতভাবে ডফিনের রাজপদে অভিষেক হলো। ডফিন হলেন সপ্তম চার্লস।
জোয়ান এবার তাঁর গ্রামে ফিরতে চাইলেন। সবুজে সবুজে ঘেরা তাঁর গ্রাম। সেখানে তাঁর বাবা, মা আছেন, ভাইয়েরা আছে। কিন্তু সপ্তম চার্লস রাজি হলেন না। রাজধানী প্যারিস এবং আরো কিছু অঞ্চল তখনও ইংরেজের দখলে। জোয়ানের আর সে শক্তি ছিল না, তবু চার্লসের আদেশ মানতেই হলো। কিন্তু এবারের যুদ্ধে ইংরেজ ও বার্গণ্ডির ডিউকের যৌথ বাহিনীর কাছে পরাজিত হলেন চার্লস। স্বভাবতই এই পরাজয়ের সব দায় পড়ল জোয়ানের ওপর। অনেক অপবাদ দেওয়া হলো তাঁকে। জোয়ান নির্বিকার ছিলেন।
এবার বার্গণ্ডির ডিউক রাতের অন্ধকারে আক্রমণ করলেন। জোয়ান চার্লসের কাছে সৈন্য চেয়েও পেলেন না। সভাসদরা জোয়ানের বিরুদ্ধে চার্লসের কান বিষিয়ে তুললেন। অল্প সংখ্যক সেনা নিয়ে শত্রুদের আটকাবার চেষ্টা করলেন জোয়ান। কিন্তু সে'রাতেই সব ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। জোয়ান ঘোড়া থেকে পড়ে গেলেন। চারদিকে সৈন্যরা তাঁকে ঘিরে ফেলল। জোয়ান বন্দী হলেন ডিউকের সেনাপতি লুক্সেমবার্গের হাতে।
ইংরেজরা আগেই ঘোষণা করেছিল, যে জোয়ানকে ধরিয়ে দিতে পারবে তাকে ১০০০০ স্বর্ণমুদ্রা দেওয়া হবে। ডিউক স্বর্ণমুদ্রার লোভে ইংরেজদের কাছে জোয়ানকে বিক্রি করলেন। জোয়ানের বয়স তখন মাত্র উনিশ। ইংরেজরা উল্লসিত। জোয়ানকে এমন শাস্তি দিতে হবে যা পৃথিবী মনে রাখবে।
বিচার সভা বসল। বিচারকমন্ডলীতে এলেন প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা, বিভিন্ন অঞ্চলের ধর্মযাজকরা। প্রধান বিচারপতি ছিলেন বোভের বিশপ। বহু অভিযোগের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল জোয়ান ব্যভিচারিণী। সংখ্যাটা শুনলে চমকে যাবেন। মোট ৭২ টা অভিযোগ ছিল জোয়ানের বিরুদ্ধে। হ্যাঁ, বাহাত্তরটা। একটা উনিশ বছরের মেয়ের বিরুদ্ধে। একা জোয়ান সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। কেউ তাঁর পাশে দাঁড়ায়নি। শোনা যায়, বিচারকের আসনে যারা ছিলেন, অর্থাৎ জোয়ানের বয়সের দ্বিগুণ বা তিন গুণ বয়সীরা, তাঁরা নাকি জোয়ানকে, জোয়ানের খ্যাতিকে ঈর্ষা করতেন। তাই এই প্রহসন।
শাস্তি ছিল সামান্যই। জোয়ানকে পুড়িয়ে মারার আদেশ এলো। রায় শুনে বিচলিত হয়েছিলেন জোয়ান। বাঁচার আর্তি জানিয়েছিলেন। সে আর্তি হৃদয় স্পর্শ করেনি তথাকথিত বিচারকদের। আর সপ্তম চার্লস? তাঁর ভূমিকা কী ছিল ? সে কথায় পরে আসছি।
৩০শে মে, ১৪৩১
প্রকাশ্য রাস্তায় একটি মঞ্চে খুঁটির সাথে বেঁধে ফেলা হলো জোয়ানকে। জহ্লাদ তাঁর গায় আগুন ধরিয়ে দিলেন। দাউ দাউ করে জ্বলে গেল জোয়ান। পৃথিবী সাক্ষী থাকল একটি চরমতম লজ্জাজনক ঘটনার।
জোয়ানের উনিশ বছরের জীবন তো শেষ হয়ে গেল। কিন্তু সপ্তম চার্লস তখন কী করছিলেন ? বিচারের সভায় যখন জোয়ান নাস্তানাবুদ হচ্ছেন, তখন স্বার্থপর, অকৃতজ্ঞ চার্লস, জোয়ানের হয়ে একটি বাক্যও খরচ করেননি। জোয়ানের এই মর্মান্তিক পরিণতি তাঁকে কতটা সুখী করেছিল ? না, তিনি ভাল ছিলেন না। ভয়ানক অনুতাপ তাঁকে গ্রাস করেছিল।
১৪৫৫ সালে জোয়ানের বিরুদ্ধে আনা সমস্ত অভিযোগের পুনর্বিচার হয় সপ্তম চার্লসের উদ্যোগেই। জোয়ানের লিখে রেখে যাওয়া জবানবন্দী ভাল করে বিবেচনা করে প্রমাণ হয় জোয়ান নির্দোষ ছিলেন। জোয়ানকে বীরাঙ্গনার মর্যাদা দেওয়া হয়। এই সাহসটা চার্লস কেন আগে দেখাননি ? তাঁর একটা বাক্যে সিদ্ধান্ত বদল হতে পারত। তিনি চার্লস। ইচ্ছা করলেই পারতেন তিনি জোয়ানের পাশে দাঁড়াতে। বাঁচাতে পারতেন জোয়ানকে। তবু তিনি তা করেননি।
আজ থেকে প্রায় ৬০০ বছর আগের কথা। আজকের দিনে(৩০মে) বীরাঙ্গনা জোয়ান অব আর্ক মৃত্যুকে বরণ করেছিলেন কয়েকজন ঈর্ষাপরায়ণ কাপুরুষের মনের ক্ষুধা মেটাতে। পৃথিবীর ইতিহাসে আজ একটি কলঙ্কময় দিন। তবু জোয়ান অমর হয়ে রইলেন আমাদের মতো বহু মানুষের হৃদয়ে। 🙏🙏🙏
তথ্য সংগ্রহ : বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জীবনীশতক
0 Comments