জ্বলদর্চি

অম্বুবাচী /ভাস্করব্রত পতি

পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব - ২৬

অম্বুবাচী

ভাস্করব্রত পতি

"কিসের বার কিসের তিথি।
আষাঢ়ের সাত তারিখ অম্বুবাচী।।"---

যাহা অম্বু বা বারিবর্ষণের সূচনা করে তাহাই 'অম্বুবাচী'। 'অম্বু' অর্থে জল। আর 'বাচী' অর্থে প্রার্থনা। অর্থাৎ জলের জন্য প্রার্থনা। আসলে এই সময় আমন ধানের জন্য জলের প্রয়োজন। যে জল ফসলের বন্ধ্যাত্ব দূর করে অঙ্কুরোদগমে সাহায্য করবে। সমগ্র মানবজাতির জন্য গর্ভিনী হতে হয় পৃথিবীকে।

অম্বুবাচীর অর্থ ঋতুমতী (জলবর্ষণে বীজধারণযোগ্যা) ভূমি বা রজস্বলা পৃথিবী। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, "মৃগশিরার শেষার্দ্ধ, আর্দ্রার পাদচতুষ্টয় এবং পুনর্বসুর পাদত্রয় মিথুনরাশির অন্তর্গত। সূর্য্য, মৃগশিরা ভোগ করিয়া আর্দ্রার প্রথমপাদভোগার্থ গমন করিলে, পৃথিবী ঋতুমতী হয় (রবৌ রৌদ্রাদ্যপাদস্থে ভূমেঃ সংজায়তে রজঃ )"। তিনি আরও উল্লেখ করেছেন, "আষাঢ়ের কৃষ্ণপক্ষে সূৰ্য্য যখন আর্দ্রার প্রথমপাদ ভোগ করে সেই সময়, অর্থাৎ বিংশতিদণ্ডাধিক দিবসত্রয়।" 

জ্যোতিশাস্ত্রমতে আষাঢ় মাসে মৃগশিরা নক্ষত্রের তিনটি পাদ শেষ হলে চতুর্থ পাদে আর্দ্রা নক্ষত্রের প্রথম পাদের মধ্যে পৃথিবী তথা ধরিত্রী মা ঋতুমতী হয়। ঠিক সেই সময়েই 'অম্বুবাচী' পালিত হয়। আসলে বৈশাখ মাস হল শিশু কাল। আর আষাঢ় মাস হল যৌবনকাল। ঋতুমতী মহিলা যেমন তিনদিনের রজঃস্বলা অবস্থা থেকে মুক্তির পর গর্ভধারণের উপযুক্ত হয়ে ওঠে ঠিক তেমনি বর্ষার শুরুতে যৌবনমদমত্ত ধরিত্রী এই তিনদিনের রজঃস্বলা অবস্থা থেকে মুক্তির পর ফসল ফলানোর জন্য উপযুক্ত হয়ে ওঠে। 
অম্বুবাচী স্ত্রী [ অম্বু + √বাচি+অ (অণ্) - ক+স্ত্রী ঈ (ঙীপ্ )

ঋতুচক্র চলাকালীন যেমন মহিলাদের সঙ্গে সহবাস করা যায়না, ঠিক তেমনি বছরের এই তিনদিন কৃষিজমিতেও কৃষকরা কোনো ধরনের কৃষিকাজ যেমন হলকর্ষন, মাটি খোঁড়া, বীজ বপন, চারা রোপণ করেনা। অম্বুবাচীতে কোনো কৃষিযন্ত্র যেমন লাঙল, কোদাল, মই, পাসনি, খুরপি, ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলার, কাস্তে ইত্যাদিকে জমিতে কাজে লাগানো হয় না। এককথায় এগুলিকে মাটিতে স্পর্ষ করানোর নিদান নেই। গ্রামবাংলায় নির্দেশ রয়েছে, "সারা বছর করবি চাষ // অমাবতীকে তুলে রাখ" (অম্বুবাচী > অমাবতী / অম্বাবতী)। অম্বুবাচীতে মনসাপূজা করার রীতির সন্ধান মেলে। তন্ত্রবিভূতির 'মনসাপুরাণ' এ পাই -- "জ্যৈষ্ঠ মাসে দশহরা অম্বুবাচী দিনে। / মনসা পঞ্চমী লোকে করিবে পূজনে"।

অম্বুবাচীকে হুগলী ও হাওড়া জেলায় বলে 'আমাতী' বা 'আমাবতী' বা 'আমাবচী'। উত্তর দিনাজপুর জেলায় পালিত অম্বুবাচি উৎসবকে বলে 'আমাইত'। মাহালীদের কাছে 'অম্ববতী'। কুড়মালী ভাষায় বলে 'আঁমাবতী'। উত্তর ২৪ পরগণাতেও পরিচিত 'আমাবতী' নামে। মেদিনীপুর জেলায় 'অম্বুবাচী'ই উচ্চারিত হয়। কোথাও কোথাও 'আমাতী'ও বলে। তবে পশ্চিম মেদিনীপুর, পুরুলিয়া ও ঝাড়গ্রামের কোথাও কোথাও বলা হয় 'আঁবাবতী'। বাঁকুড়ার মানুষজনের কাছে তা 'আম্বাবতী' বা 'অম্বাবতী'। এখানে অবশ্য একসময় 'আমাচী' নামও জনপ্রিয় ছিল। তবে ওড়িশাতে এই উৎসবকে বলে ‘রজঃসংক্রান্তী’। ৭ ই আষাঢ়ের পরিবর্তে জৈষ্ঠ্যের শেষ দু-দিন ও পয়লা আষাঢ় —এই তিনদিন ধরে এখানে পালিত হয় ‘রজঃসংক্রান্তি।

অম্বুবাচির মূল নিয়ম "ত্যাগ, প্ৰদ, প্রবৃত্তি, নিবৃত্তি"। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় উল্লেখ করেছেন, "এই সময়ে কাম্য ও নৈমিত্তিক কৰ্ম্ম, স্বাধ্যায়, দেবপিতৃতর্পণ, হলবাহন ও বীজবপন নিষিদ্ধ। ষতি ব্রতী বিধবা ও দ্বিজ এই সময়ে পাক করিয়া ভক্ষণ করিবেন না।" অম্বুবাচী উপলক্ষে অনেক গেরস্থের বাড়িতে পিঠা পায়েস তৈরি হয়। ব্রতীনীরা ভাত খাননা। নানা ধরনের ফল যেমন আম, কাঁঠাল, কলা, সাবু, পেয়ারা খেয়ে থাকেন। অম্বুবাচীর আগের দিন রান্না করা খাবার ঠাণ্ডা করে এই সময় তিনদিন ধরে খান বিধবারা। আসলে এই সময় কোনো গরম খাবার খাওয়া নিষিদ্ধ। যেসব বিধবা অম্বুবাচী পালন করেন তাঁরা মৃত্যুর পর স্বর্গবাসী হন। আর অম্বুবাচী পালন না করলে নরকবাসী হতে হয়। তিনতাউড়ি বেগুনবাড়ির ফলহারিনী কালীর কাছে এইদিনে বিশেষ পূজা দিতে যান ভক্তরা। পুরুলিয়ায় রইহন দিনে যে ম্যুট বের করে সে এইদিনে উপোসী থাকে। উত্তর দিনাজপুরে এই সময় ছোট ছোট কিশোর কিশোরীরা জনচলাচলের রাস্তার পাশে খড়, ডালপালা, কলাগাছের খোল, বাঁশ দিয়ে অদ্ভুত ধরনের ঘর বানিয়ে আমাইত ঠাকুরের নামে পূজা করে। পথচলতি লোকজনের কাছে ঐ ঠাকুরের সেবায় যৎসামান্য দক্ষিণা চায়। যে যাঁর মতো সাহায্য করে। দিনের শেষে সংগৃহীত দক্ষিণায় আমাইত ঠাকুরের প্রসাদ তৈরি হয়। উপস্থিত সবাই তা খাওয়ার পর ঐ ঘরটি ভেঙে দিয়ে যে যাঁর বাড়ি চলে যায়। উত্তর ২৪ পরগনায় এদিন দুধ খাওয়া হয়। ধারণা যে এইদিন দুধ খেলে সাপের ভয় কাটবে।

অম্বুবাচীতে সবচেয়ে বড় উৎসব বা মেলা হয় আসামের কামাখ্যা মন্দিরে। তবে অন্যান্য শক্তি পূজার স্থানগুলিতেও অম্বুবাচী উপলক্ষে মেলার আয়োজন করা হয়। আসামে এ সময় একটি মাটির সরায় জল নিয়ে তাতে শষ্যবীজ রাখা হয়। তিনদিন পরে অঙ্কুরোদগম হলে তা জলে ভাসিয়ে দেওয়ার রীতি। এখানে এই তিনদিন কামাখ্যা মন্দিরের দেবীদর্শন বন্ধ থাকে। সেইসাথে যাবতীয় মাঙ্গলিক কাজ বন্ধ থাকে। চতুর্থ দিন দেবীর স্নান ও পূজা শেষ হলে দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় মন্দিরের গর্ভগৃহ। তখন থেকে সব কাজ করা যায়। অসংখ্য ভক্ত এখানে হাজির হন এসময়। অম্বুবাচির তিনদিন শেষ হলে কামাখ্যা মন্দিরের পাণ্ডারা রক্তবস্ত্র তুলে দেন ভক্তদের কাছে। লোকবিশ্বাস যে এই বস্ত্র আসলে দেবী মায়ের রক্তস্রাবের রক্ত। তাই এই বস্ত্র খুব পয়া। তবে এটি নিয়ে শ্মশানে যাওয়া কিংবা মৃতদেহ ছোঁয়া নিষিদ্ধ। পুরুষরা ডানহাতে এবং মহিলারা বামহাতে এই রক্তবস্ত্র 
ব্যবহার করে। এটি দেহের সঙ্গে থাকলে নাকি অভীষ্ট ফল লাভ হয়। 
"কামাখ্যাবস্ত্রমাদায় জপ পূজাং সমাচরেৎ।
পূর্ণকামং লভেদ্দেবী সত্যং সত্যং ন সংশয়।।"

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 

Post a Comment

0 Comments