জ্বলদর্চি

পদ্মপাতায় শিমুল-২৮ /সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়

পদ্মপাতায় শিমুল-২৮

সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়

এ আমি অন্য আমি। নিজেই নিজেকে বদলে ফেললাম। না-পিছন ফিরে আর তাকাই নি। এই পরিবর্তন কিন্তু প্রতিশোধের চেয়েও মূল্যবান, সেটা আমার ক্ষেত্রে চূড়ান্তভাবে কাজ করেছে। রবি ঠাকুরের শেষের কবিতায় পড়েছিলাম, “শেষের পরেও একটা নতুন শুরু থাকে...যে আবারও একটা নতুন শেষের গল্প লেখে।”

এই শেষ আর শুরুর খেলা চলতেই থাকে...কখনও ধিকি ধিকি , কখনও বাঁধনহীন। উল্কার মতো তারা ভেসে ভেসে বেড়ায়। আমরা তো নিমিত্ত মাত্র। এতদিনে বুঝেছি, আজকের আধুনিক এবং দ্রুততর গতির জীবনে সম্পর্কের বিচ্ছেদ কোনও নতুন ব্যাপার নয়। ব্রেক আপ এখন প্রতি ঘন্টা, মিনিটে, সেকেন্ডে হয়েই চলেছে।

এইবার ভর্তি হলাম লুইজিয়ানা স্টেট ইউনিভারসিটিতে(LSU)। মাস্টার্স করতে হবে মাইক্রোবায়োলজিতে। টোএফিল (TOEFL) আর জি. আর. ই(GRE) দেওয়াই ছিল। এই দুটোই লাগে এখানে কলেজে ভর্তি হতে গেলে। কলকাতায় থাকতেই এই দুটো পরীক্ষা দিয়ে নিয়েছিলাম। নম্বর ও ভালো ছিল, কাজেই ভর্তি হতে অসুবিধা হল না একটুও। দাদা বৌদির কাছে থাকি আর সাথে থাকে আমার মাতৃসমা দিদিয়া, আদরের কচিকাঁচা ভাইপো-ভাইঝিরা। নো চিন্তা-নো ভাবনা তখন।

টুক করে লুইজিয়ানা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে মেজর মাইক্রোবায়োলজি আর মাইনর এনাল্যাটিকাল কেমিস্ট্রি নিয়ে মাস্টার্স করে ফেলি। রেজাল্ট বেশ ভালোই হল।

পুরো স্কলারশীপ নিয়ে পড়লাম-কারুর কাছে হাত পাতি নি। এই একটা ব্যাপারে আমার খুব গর্ব হল। 'বিটা বিটা বিটা বায়োলজিক্যাল সরোরিটি সোসাইটি' থেকে পেয়ে গেলাম অনার (Honor) সার্টিফিকেট। পুরোপুরি Chancellor List আর Dean List-এ থাকার দরুন পেলাম Outstanding and achievement Award.

আমার গুরুদেবের কথা এক বর্ণ-ও মিথ্যা হয় নি। “বিয়ে ছাড়া আর যাতেই হাত দেবে সব ভালোভাবে সার্থক হবে।”

মনে আছে বলেছিলাম তোমাকে জীবনে অনেক পুরস্কার পেয়েছি। কাজেই পুরস্কারের লোভ আমার নেই-যা ভালো লাগে তাই মন দিয়ে করার চেষ্টা করি।

ভালো ভালো জায়গায় এ্যপ্লাই করলাম-যেমন কোকোকোলা কম্পানী, এক্সন-কিন্তু শিফট ডিউটির জন্য সরে এলাম দাদাদের পরামর্শে।

জব পেয়ে গেলাম লুইজিয়ানা স্টেটে। আমার ড্রিম জব।

ড্রিম জব কেন? যদি প্রশ্ন করো, তাহলে বলি ... এই কাজে কোনো টেনশন থাকার কথা নয়। কিন্তু তখন লুইজিয়ানা স্টেটে জব ফ্রিজ হওয়ার কারণে এক বছর আমাকে অপেক্ষা করতে বলল।


এর মধ্যে আমি ব্যটনরুজ জেনারেল হাসপাতালে মাইক্রোবায়োলজিস্ট হিসেবে পার্ট টাইম কাজ পেলাম। এরই ফাঁকে আমি ফিলোবটেমি নিয়ে একটা মেডিক্যাল কোর্স সেরে ফেললাম আমার বড় ভাইঝির পরামর্শে। শুধু জীবনে যাতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারি তাই মনকে ভালোভাবে গামছা দিয়ে বাঁধতে শুরু করলাম। তাই আমার জীবনের “শেষ-শুরুর” খেলা থেকে সবাইকে বলি-”জীবনে কি হল-আর কি হল না”... না ভেবে সামনে কি ভাবে এগিয়ে যাওয়া যায়, তার জন্য নিজেকেই এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। যোগ-এর সাথে বন্ধু করতে হবে। জয় আসবেই। আসতে বাধ্য। জীবনে কখনও কাউকে তোষামোদ করতে হয় নি-এটা আমার চরিত্রের একটা বড় অংশ।

কত কিছু করার আছে এই দুনিয়ায়। যেটা করব স্থির করেছি-সেটা না করে ছাড়ি না। আমি কিন্তু এত কেরিয়ার মাইন্ডেড ছিলাম না। শুধু শুধু জীবনটাকে জলের স্রোতের মধ্যে ফেলে দিয়ে ভেসে যাচ্ছিলাম।

বিয়ে হবে, ঘর সংসার করব চুটিয়ে... এই ছিল আমার স্বপ্ন... ছোটবেলা থেকে। কিন্তু বিধাতা আমার অদৃষ্টে লিখে রেখেছিলেন অন্য কিছু। সেখানে আমার হাত ছিল না। সেখানে কারুর -ই হাত থাকে না।

-- কত পড়েছো? কুডোস তোমাকে শিমুল। যত শুনছি অবাক হওয়া ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছি না। আমি আগেই বলেছি তুমি যখন সেই ঝড়কে অতিক্রম করেছো সেই অল্প বয়সে তখন তোমার মধ্যে অনেক কিছু জন্ম নিয়েছিল।

--তা ঠিক, সব সাবজেক্ট-ই প্রায় ছুঁয়ে দেখেছি। সে যে কি আনন্দ -তা বোঝানো আমার সাধ্যের অতীত।

আমার আনাচে কানাচে প্রেম কিন্তু নাছোড়বান্দা তখন , তবে এক তরফা। হাসি আসে কখন বলোতো? এখানে আমেরিকান, ইটালিয়ান ছেলেরাও পেছনে পড়েছিল। সবাই ভাববে, এ আবার হয় নাকি? কিছু তো বাড়িয়ে বলছি হয়ত। কিন্তু না, বাড়িয়ে বলে লাভ কী আমার, তাই না? কিন্তু হয়েছে আমার ক্ষেত্রে। আগে এলে হয়ত এদেশের ছেলেই আমার জীবনপাত্র ভরাতো আমার ছোট ভাই-এর মতন। বলেই মুখটা কাঁচুমাচু করল শিমুল। কিন্তু আমি তো তখন একেবারে বেপরোয়া। পড়ছি, নিজের পায়ে দাঁড়াব। আর হারব না জীবনে। আর কেউ ঠকাতে পারবে না।

-- তাই নাকি?

--হ্যাঁ মশাই একটুও বাড়িয়ে বলছি না। আর বাড়িয়ে বলবই বা কেন বলো? বাড়ির সবার কাছে শুনো। সব সময় হাসি আর হৈ চৈ করে বাড়ি মাতিয়ে রাখতাম। বাড়ির ছোট ছোট ভাইপো-ভাইঝি, ভাগনেগুলোর কাছে বাবা মায়ের চেয়েও বড় হল ওদের পিপি, ফুলমাসি।

ছোটবেলা থেকেই বাইরের লোকেদের সাথে আমি খুব একটা মিশতাম না মানে মিশতে ভালোবাসতাম না। নিজের পড়াশুনা আর ছোটদের নিয়েই কেটে যেত বছর এর পর বছর। ছোটদের সাথে থাকা মানেই একটা অন্য জগতে ঘোরাফেরা করা।

আর ছিল সেলাই, ঘর সাজানো, রান্না, বাগান। এই নিয়েই ছিল আমার নিজস্ব জগত। বাংলা, ইংলিশে লিখতাম টুকটাক। পাঠাতাম এখানকার কিছু কিছু পূজা বার্ষিকীতে। ইংরাজি কবিতা লেখার দরুণ বোলোজি ডট কম গুগুলস থেকে বেশ কয়েকবার ডলার পুরষ্কার পেয়েছি। অবশ্য সেগুলো খরচা করতাম না-কোনো ভালো কাজে সেগুলো ব্যবহার করতাম।

আর ছিল আমার কয়েন কালেকশন। মাঝে মাঝে রাত্রে স্বপ্ন দেখতাম কারা যেন আমার কয়েন কালেকশন-এর খাতা নিয়ে যাচ্ছে। অত রাতে আমাকে লাইট জ্বেলে কিছু খুঁজতে দেখে দিদিয়া আমার ঘরে এসে জিজ্ঞেস করত- “এত রাতে আলো জ্বেলে কি খুঁজছিস?”
তখন আমার ঘোরটা কেটে যেত-লজ্জায় পড়ে যেতাম। “কিছু না”, বলে শুয়ে পড়তাম। “পাগলি” বলে দিদিয়া হেসে দরজা বন্ধ করে চলে যেত।

এর মধ্যে বিয়ের সম্বন্ধ যে আসত না একেবারেই, তা বলব না। তারপর কেটে যায় দিন, মাস, বছর। আবার ব্যস্ততা পড়াশুনা আর নানারকম ভল্যান্টিয়ার কাজে। এদেশে ভল্যান্টিয়ার কাজ যে এত গুরুত্বপূর্ণ তা ইন্টারভিউ দিতে দিতে বুঝতে পারলাম।

ওহ! বলা হয় নি। প্রথম নিউ ইয়র্কে এসেই সিন্ডিকেট ব্যাঙ্কে এ্যপ্লাই ক্রেছিলাম সেজদার কথায়। ছোদ্দিভাই আর জামাইবাবু তখন নিউ ইয়র্কে। অঙ্ক আর বেসিক ইংলিশ এ একশো টা প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। আমার কাছে অঙ্ক খুব সোজা লাগল। বড় বড় যোগ-বিয়োগ, গুণ ভাগ। সময়ের আগেই করে ফেললাম। কাজেই আমাকেই প্রথম ডাকল। আমি অবাক। আমাকে ডাকতে এলেন যিনি তার পিছু পিছু যাচ্ছি। এইবার যখন মৌখিক জিজ্ঞেস করছেন আমার মাথা একেবারে ফাঁকা মাঠ। কিছুই বুঝতে পারছি না ওনাদের কথা।

“হোয়াটস ইয়োর নেম?” সেটাও না। বোঝো তাহলে পুরুষমানুষ দেখলেই আমি কিভাবে নার্ভাস হয়ে যেতাম এবং এখনও হয়ে যাই মাঝে মাঝে। এখন হাসি আসে খুব এসব ভেবে। তবে রামকৃষ্ণ নাম যে কত উপকার... আমার গুরুদেব তা শিখিয়েছিলেন।

এইবার লুইজিয়ানা এনভাইরনমেন্টাল কোয়ালিটিতে কাজে ঢুকলাম। পরিচয় কার্ডে লেখা রইল-এনভাইরনমেন্টাল সাইন্টিস্ট, এয়ার পারমিট ডিভিশন। সে যে কি আনন্দ তা আমার সাধ্য নেই ভাষায় প্রকাশ করা। বেশ কিছু আমেরিকান বন্ধু-বান্ধবী হল-তারা যেচে আমার সাথে আলাপ করল। রোজ আমার কিউবিকল-এ একটা কাঁচের পাত্রে সদ্য ফোটা বেলফুল রাখতাম। আর এই জন্যই যারা আমার কিউবিকল -এর পাশ দিয়ে যেত -একবারও অন্তত ঢুকে গন্ধ শুঁকে যেত। আসতে আসতে আমার কিউবিকল ফেমাস হয়ে গেল।

কারণ, কাজের ক্ষেত্রেও আমার খুব নাম তখন। ২০০১ এর ৯/১১, বরোদায় ভূমিকম্প, ক্যাট্রিনায় সাহায্যের কিছু ভল্যান্টিয়ারের খুব প্রয়োজন। অফিসে কিছু জনের সাথে আমিও আমার নাম লেখালাম।

আমাকে সিলেক্ট করেছিল Air Permit থেকে কারণ আমার কাজের লোড খুব কম ছিল। -একদিন আমাদের ডিপার্টমেন্টের এডমিনিস্ট্রেটর হঠাৎ আমার কিউবিকল এ এসে জানান যে, মানি কালেকশন এ আমাদের ডিপার্টমেন্ট সেকেন্ড-এ আছে। ব্যাস! নিজের জমানো পিডী ব্যাঙ্ক থেকে কিছু ডলার দিয়ে দিলাম। উঠে এল আমাদের ডিপার্টমেন্ট প্রথমে। সেই জন্য সবাই বলত চাইল্ডিস আমাকে। জানি না কেন-হারতে চাইতাম না আর জীবনে।

“আমেরিকান রেড ক্রশ, ইউনাইটেড ওয়ে” -গ্রুপে ভল্যান্টরী যোগ দিলাম। এই নিঃস্বার্থভাবে মানুষের সেবা করলে মনে যে কি আনন্দ হত তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।
-তাহলে এত লিখলে কবে?-পলাশ প্রশ্ন করল।

-কাজ সারতে আমার বেশি সময় লাগত না--তারপর অফিসের এদিক ওদিক না ঘুরে বসে বসে ইউনিভার্সিটিতে চেনা জানা, বাড়িতে যারা আসত তাদের কথাবার্তা, আর তার সাথে আমেরিকানদের সাথে মেলামেশা করে যা জানতে পারলাম লিখে রাখতে শুরু করলাম। এক নেশা পেয়ে বসল।

আমেরিকানদের শুধু কেন? অন্য কোনো দেশের মানুষের সাথে না মিশলে কিন্তু খালি বই পড়ে বা মন থেকে লেখা যায় না। আমি ওদের সাথে মিশে একেবারে ওদের মনের কাছাকাছি এসে গেলাম। সবাই নিজেদের সুখ-দুঃখের গল্প করত আমার কাছে এসে। কি যে ভালো লাগছিল-এত মানুষের ভালোবাসা পেয়ে গেলাম প্রথম কাজের জায়গায়। একটা নতুন সূর্য উদয় হল আমার জীবনে। বেস্ট পারমিট রাইটার অ্যাওয়ার্ড পেলাম মাত্র দু বছর কাজ করে। পলাশের মুখে মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ল।

আমার গুরুদেবের আশির্বাদে এগিয়ে চললাম। গুরুর কথা কখনও মিথ্যে হয় না-আমি বিশ্বাস করি। এই যুদ্ধের প্রস্তুতির শেষ দেখতে দেখতে আমি ক্রমশ বড় হয়ে উঠি। সত্যিকারের বড়।

(চলবে)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

2 Comments

  1. খুব আগ্রহ নিয়ে পড়ছি,ভাল লাগল । অপেক্ষায় থাকব পরের পর্বের ।

    ReplyDelete
  2. Khub valo laglo ...

    ReplyDelete