জ্বলদর্চি

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম-পর্ব-(৫৬) /সন্দীপ কাঞ্জিলাল

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম-পর্ব-(৫৬)

সন্দীপ কাঞ্জিলাল

ধর্ম ও মুক্তচিন্তা 


রাষ্ট্রশক্তি ও ধর্মশাস্ত্রের যৌথ প্রয়াসে সমস্ত বেদবিরোধী স্বাধীন চিন্তাকেই যে সমূলে বিনষ্ট করা হয়েছিলো তার প্রমান মনুস্মৃতি-তেই আছে। প্রাচীন ভারতে আধুনিক কালের মত সর্বজনীন রাষ্ট্রীয় আইন চালু ছিলো না। ধর্মশাস্ত্রের ধর্মীয় সামাজিক বিধানগুলোই রাষ্ট্র দ্বারা  বলবৎ হতো। সেদিন থেকে ধর্মশাস্ত্র ছিল ব্যক্তিমানুষের উপরে, তথা নিপীড়িত শ্রেণীদের উপরে শাসক শ্রেণীর নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার। মনুস্মৃতি-তে বেদবিরোধী, চতুর্বর্ণ্য বিরোধী, অজ্ঞেয়বাদী এবং নাস্তিকতাবাদী সব ব্যাক্তি ও গোষ্ঠীকে সাধারণত 'পাষণ্ড' বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।

 ভট্ট মেধাতিথি, গোবিন্দরাজ, নারায়ণ সর্বজ্ঞ, রাঘবেন্দ্র সরস্বতী, কুল্লুক ভট্ট, নন্দনাচার্য প্রভৃতি মনুস্মৃতি-র টীকাকারেরা বলেছেন যে 'পাষণ্ড' শব্দের অর্থ চার্বাকবাদী, কাপালিক (তান্ত্রিক),বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মাবলম্বী সহ সমস্ত বেদবিরোধী, এবং সব রকমের নাস্তিক। মনুস্মৃতি বলছে যে রাজার কর্তব্য সমস্ত পাষণ্ডদের রাজ্য থেকে নির্বাসিত করা। স্নাতকদের পাষণ্ড অধ্যুষিত দেশে বাস নিষিদ্ধ। গৃহস্থদের প্রতি পাষণ্ডদের এবং পাষণ্ড সম্প্রদায়ের যোগদানকারী নারীদের জল দিতে নিষেধ করা হয়েছে। স্নাতকদের আদেশ করা হয়েছে যে তারা যেন কোন পাষণ্ডকে সম্বোধন না করে। সব মানুষের পক্ষেই পাষণ্ডদের গ্রন্থ সহ সমস্ত বেদবিরোধী গ্রন্থ পাঠ নিষেধ। 'অন্ধকারময়' সমস্ত বেদবিরোধী শাস্ত্র এবং 'ঘৃণ্য দর্শন' পাঠ নিষেধ। উপরোক্ত টিকাকারেরা মত দিয়েছেন যে ঘৃণ্য এবং অন্ধকারময় বলতে চার্বাকবাদী এবং অন্যান্য বেদবিরোধী দর্শন এবং গ্রন্থকেই বোঝানো হয়েছে। 

প্রাচীন গ্রিসে সাধারণ ভাবে মুক্তচিন্তার প্রাধান্য থাকলেও মাঝে মাঝে রাষ্ট্র কর্তৃক মুক্তচিন্তকদের ধ্বংস করবার চেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। নাস্তিক অ্যানাকসাগোরাস (৫০০-৪৮২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) বলেছিলেন যে সূর্য একটি বিরাট আগুনের গোলা, দেবতা নয়। তিনি আরও বলতেন যে বস্তুকণার সমাহার থেকেই মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে। এই অপরাধে তাকে এথেন্স থেকে বহিষ্কার করা হয়, এবং তার সমস্ত লেখা পুড়িয়ে ফেলা হয়। যে রাষ্ট্রীয় ধর্মে সূর্যপূজার প্রাধান্য স্বীকৃত ছিলো, তার মূলে আঘাত করা এই আক্রমণের কারণ। দেবতার অস্তিত্ব নেই, এবং মানবতাই শ্রেষ্ঠ আদর্শ, এই মতবাদ প্রচার করবার ফলে প্রোটাগোরাসকে (৪৮০-৪১০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) এথেন্স থেকে প্রাণভয়ে পলায়ন করতে হয়। সক্রেটিসকে (৪৬৯-৩৯৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) যেভাবে হত্যা করা হয়েছিলো, তার পেছনে ধর্ম সংক্রান্ত অভিযোগ থাকলেও রাজনৈতিক কারণই ছিল প্রধান। কারণ সক্রেটিস শাসক শ্রেণীর সদস্যদের অজ্ঞানতা, মূর্খতা, অকর্মণ্যতা এবং ভ্রষ্টাচার যুব সমাজের সামনে তুলে ধরবার চেষ্টা করেছিলেন, এবং তার কাছে শিক্ষাপ্রাপ্ত যুবকেরা অনেকে উচ্চপদে অধিষ্ঠিত অভিজাত শ্রেণীর অন্যান্য সদস্যদের অসুবিধা সৃষ্টি করেছিলো। কিন্তু তাকে বিষ খাইয়ে হত্যা করার সময় বিচারকেরা তার বিরুদ্ধে যুব সমাজকে বিভ্রান্ত করা ছাড়াও এই ধর্মীয় অভিযোগ এনেছিল যে তিনি নাকি পুরাতন দেবদেবীদের পরিবর্তে নূতন দেবদেবীর প্রবর্তন করেছিলেন, এমন কি তিনি নাস্তিক ছিলেন। সক্রেটিস অবশ্য সব অভিযোগই অস্বীকার করেছিলেন, এবং ধর্ম সংক্রান্ত দুটি অভিযোগের পরস্পর বিরোধিতার দিকেও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। কিন্তু বিচারকেরা তথাপি সব অভিযোগেই তাকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন। 

প্রাচীন রোম ও রোমক সাম্রাজ্যেও রাষ্ট্র মুক্ত চিন্তকদের দমন করবার কোন সাধারণ নীতি গ্রহণ করেন নি। কিন্তু একটি বড় ব্যতিক্রম ঘটেছিল ১৮৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। সে সময়ে রোমে ভারতীয় তান্ত্রিকদের মত এক সম্প্রদায়ের মানুষ ছিল যারা পঞ্চ মকার, স্বতঃস্ফুর্ত নৃত্যগীত এবং সহজিয়া যৌন সম্পর্কে বিশ্বাস করতো। প্রাচীন ভারতীয় তান্ত্রিকদের মতোই তারা মাঝে মাঝে বড়ো বড়ো সমাবেশ করে পানভোজন, নৃত্যগীত এবং সহজিয়া যৌন সম্ভোগের প্রবৃত্ত হতো। সে বছরে রোমের সেনেট এরকম সাত হাজার মানুষকে ধরে এনে বিচার করে, এবং তাদের মধ্যে অর্ধেককে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে হত্যা করে।

 সম্ভবত রাষ্ট্রীয় রোমক ধর্ম এবং রাষ্ট্রশক্তির পক্ষে, অর্থাৎ শাসক শ্রেণীর শ্রেণিস্বার্থের পক্ষে এদের ধর্মহীনতা বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। তাছাড়া ৩৯০ খ্রিস্টাব্দে বিশপ থিওফিলোস ধর্মীয় কারণে আলেকজান্দ্রিয়ার বিখ্যাত লাইব্রেরীর এক অংশ ধ্বংস করে। আবার ৪১৫ খ্রিস্টাব্দে আলেকজান্দ্রিয়ার বিখ্যাত গণিতজ্ঞা এবং নিওপ্লেটোনিক দার্শনিক হাইপেশিয়াকে প্রধান বিশপ সেন্ট সাইরিলের নেতৃত্বে এক দল পাদরি নির্মম ভাবে হত্যা করে।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন।

Post a Comment

0 Comments