জ্বলদর্চি

প্রকৃতির বিষ /নিশান চ্যাটার্জী

জীবনের গভীরে বিজ্ঞান- ৫

প্রকৃতির বিষ

নিশান চ্যাটার্জী

"বিজ্ঞান মানুষের জীবনে যেমন দিয়েছে বেগ কিন্তু কেড়ে নিয়েছে আবেগ"। এই কথাটির সাথে আমরা অনেকেই হয়তো পরিচিত। "বেগ" বলতে এখানে মূলত জীবনধারার গতিকে বোঝানো হয়েছে, হ্যাঁ একথা সত্য যে আজকের দিনে ইচ্ছে করলেই দুনিয়াটা হাতের মুঠোয়। আপনার  কৌতূহল হলে যেমন কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই মিটিয়ে ফেলা সম্ভব, তেমনি মহাবিশ্বের যেকোনো তথ্য আমাদের করায়ত্তে। এই "বেগ" টাই মানুষের জীবন থেকে কেড়ে নিয়েছে "আবেগ"। ইতিহাস সাক্ষী মানুষ বিজ্ঞানের সহায়তায় যতটুকু উন্নতি লাভ করেছে তার থেকে বিজ্ঞান কে কাজে লাগিয়ে ক্ষতি করেছে অনেক বেশি। এই ক্ষতির প্রধান শিকার হয়েছে কিন্তু সেই মানুষই, বিভিন্ন সময়ে। আর সেই ক্ষতির করার রসদ কিন্তু খুঁজে নিয়েছে বিজ্ঞান সচেতনতা থেকেই। বিজ্ঞানী সক্রেটিস কে বিষপান করানো হয়েছিল আমরা সকলেই জানি।

 এক্ষেত্রেও উদ্ভিদ বিজ্ঞানের জ্ঞান কে কাজে লাগানো হয়েছিল। হেমলক উদ্ভিদের পাতা, ফুল,শেকড় সবটাই অতন্ত্য বিষাক্ত কারন এই উদ্ভিদে  কনিডিন এবং কনিসিন নামক বিশেষ অ্যালকালয়েড থাকে যা এই বিষের কাজ করে। ইতিহাসের পাতায় এখনো জ্বলজ্বল করছে পূর্ব গ্রীসের কথা। সেখানে যুদ্ধ বন্দীদের এই বিষ পান করানো হতো। আমাদের চারপাশে এরকম বহু উদ্ভিদ বা উদ্ভিদজাত পদার্থ রয়েছে যেগুলো অতন্ত্য ক্ষতিকারক। আমরা অনেকেই উপকারী বা ভেষজ উদ্ভিদ সম্পর্কে পড়েছি কিন্তু তাদের মধ্যে অসংখ্য ক্ষতিকারক গুন রয়েছে। আমরা আজকের আলোচনায় সেই দিকেই আলোকপাত করার চেষ্টা করবো।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর "কৃষ্ণকলি" ফুলের সৌন্দর্য নিয়ে লিখেছেন যা আমরা সকলেই জানি। কিন্তু এই কৃষ্ণকলি ফুলের বীজে ট্রাইগোনেলিন নামক বিষ রয়েছে। 

বিভিন্ন উদ্ভিদের এই বিষের উৎস হলো তাদের দেহে ঘটে চলা বিপাকক্রিয়া।  খুবই সুন্দর দেখতে হয় কুচ ফলের বীজ। এতে উপস্থিত আব্রিন নামক বিষ এই সৌন্দর্যের পথকে কন্টকাবৃত করেছে। এক্ষেত্রে এর একটিমাত্র বীজই, একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের মৃত্যুর জন্য যথেষ্ট।
মাশরুম বা ব্যাঙের ছাতা অনেক মানুষের খুব প্রিয় খাবার। কিন্তু বেশ কিছু প্রজাতির মাশরুম রয়েছে আমাদের প্রকৃতিতে, যা বিষাক্ত। "আ্যমানিটা" নামক একটি বিশেষ প্রজাতির মাশরুম, যা অনেকটাই আমরা সচরাচর যে মাশরুম খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে থাকি(খড় ছাতু) তার মতোই দেখতে হয়। এই মাশরুমে উপস্থিত বিষাক্ত পদার্থ রান্না করার সময়ে যে তাপমাত্রা সেই তাপমাত্রাতেও অপরিবর্তিত থাকে। তাই রান্না করে খেলেও ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েই যায়। এর ফলে মানুষের প্রাথমিক ভাবে ডায়েরিয়া ও পরে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। এতে উপস্থিত বিষাক্ত পদার্থকে "আ্যমাটক্সিন"("Amatoxin") বলে। তাই এর অপর নাম "Death Cap"। জঙ্গলমহলের মানুষের কাছে "কাড়ান ছাতু" বা "দুর্গা ছাতু" অতন্ত্য জনপ্রিয়। সাধারণত বিষাক্ত ছাতু, তার মাথার টুপির মতো অংশটি দেখে চেনা যায়। যদি টুপির মতো অংশে বিশেষ কোনো রঙিন ছাপ থাকে তাহলে তা অবশ্যই বিষাক্ত। এছাড়াও কেটে ফেলার পর বিষাক্ত ছাতুর রঙের পরিবর্তন হয়। যা নির্বিষ ছাতুর ক্ষেত্রে হয় না।

 আমাদের দেশের অনেক স্থানেই "ল্যানটানা ক্যামেরা" নামের একপ্রকার আগাছা জন্মায়। একে স্থানীয় ভাষায় "ফুটুস" বলা হয়। গাছটিতে অসাধারণ রঙিন ফুল গুচ্ছাকারে উৎপন্ন হয়। দেখতে ভালো লাগে বলে অনেকসময় এই উদ্ভিদকে বেড়া দেওয়ার কাজে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এর ফল গুলি অতন্ত্য বিষাক্ত যাতে ল্যামটোডিন নামের টারপিনয়েড থাকে।

 এছাড়াও শিউলি, ধুতুরা ইত্যাদি উদ্ভিদের বিষাক্তগুণ আমরা প্রায় সবাই জানি। আপেল,ন্যাসপাতি এগুলো অতন্ত্য উপকারী ফল। কিন্তু এদের বীজে অতিবিষাক্ত সায়ানাইড জাতীয় বিষ অতি স্বল্প মাত্রায় জমা থাকে। তাই একটি দুটি বীজ ভুল করে খেলে কোনো ক্ষতি হয় না। কিন্তু একমুঠো আপেল বীজ খেলে মৃত্যু অবধারিত।
গরীব মানুষের কাছে খুব সহজলভ্য খেসারীর ডাল। এটি নিয়মিত খেলে কিন্তু পক্ষাঘাত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। কারণ এতে বিটা আ্যমিনো প্রোপিও নাইট্রাইল থাকে। যা মানুষের স্নায়ুতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্থ করতে পারে। পরিশেষে বলা যায় মানুষের মধ্যেও যেমন ভালো বা খারাপ গুণ দুটোই রয়েছে ঠিক তেমনি এই বিশালাকার জীবজগতেও তার প্রতিফলন রয়েছে। 

তাই খারাপ মানুষদের নির্বাচন করে যেমন তাদের থেকে দূরে থাকতে হয় তেমনি এই বিস্ময়কর জীবজগতের ক্ষতিকারক দিকগুলো চিহ্নিত করে তা থেকে সচেতন থাকাই মঙ্গল।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন।

Post a Comment

0 Comments