জ্বলদর্চি

কাউকে কোন কথা বলা যায় না /তড়িৎ ভট্টাচার্য

কাউকে কোন কথা বলা যায় না 

তড়িৎ ভট্টাচার্য 

কাউকে কিছু বলা যায় না। এই কথাটা একদিক থেকে ঠিকই কারণ মানুষের ধৈর্য্য এখন বড় কম। কিছু বললেই উত্তেজিত হয়ে ওঠে তারপর কথা কাটাকাটি এবং পরিশেষে উত্তপ্ত পরিবেশে প্রায় হাতাহাতির কাছাকাছি। এ তো হামেশাই ঘটছে। সর্বত্র খেলাধূলা থেকে রাজনীতি এবং প্রাত্যহিক জীবনের প্রায় সর্বত্র। এমনকি বাড়ির লোকও এর সঙ্গে যুক্ত। তারাও এর থেকে বাদ নয়। এখনকার সামাজিক চালচিত্রের এই ছবি সব জায়গায়। আমার লেখার বিষয় কিন্তু এটা নিয়ে নয়, এ নিয়ে কি লিখবো একেবারে একঘেয়েমী হয়ে যাবে। বরঞ্চ একটু অন্য কথা বলা যাক।

সকালবেলায় বাজার যাচ্ছি। ছুটির দিন সাপ্তাহিক বাজার এর দুটো দিক আছে (১) বাজার করা (২) অনেকের সঙ্গে দেখা হওয়া। বেশ খানিকটা সময় এরজন্য ব্যয় হয় আর বাজার নিয়ে বাড়িতে ফেরার পর স্ত্রীর কলকন্ঠের গঞ্জনা । তবুও ওটা একটা আকর্ষণ। গত রবিবার বাজার যাচ্ছি যখন, তখন মনটা ভাল ছিল না নানান কারণে। মনের এই ভার খানিকটা কমে যদি কাউকে একটু বলা যায়। যাই হোক একটু অন্যমনস্কও ছিলাম। ঠিক এমন সময় একটা সম্বোধন চলে এলো- -আরে কি ব্যাপার আজ যে বড় তাড়াতাড়ি বাজার যাচ্ছেন। তাকিয়ে দেখি আমারই পাড়ার একজন প্রায় আমারই বয়সী হাসিমুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। মনে মনে ভাবলাম ভালই এই একজন কাছের মানুষকে পাওয়া গেল যাকে আমার মনের কথা বা আমার দুঃখ কিছু জানিয়ে মনটা হালকা করা যাবে। আমি সাগ্রহে বললাম - ঐ আছি আর কি খুব ভাল নয় ৷ নানান রকম সমস্যা। আমি ভাবলাম উনি বোধহয় আমার কাছ থেকে জানতে চাইবেন কি এমন ঘটলো যার জন্য মন ভালো নেই। তার বদলে উনি আমার কথাটা লুফে নিয়ে বলতে শুরু করলেন ঠিক বলেছেন নানান রকম সমস্যা – এই দেখুন না বাজারে আসার মুখে স্ত্রীর সঙ্গে এক প্রস্থ কথা কাটাকাটি হয়ে গেল। আজ মাসের তৃতীয় রবিবার এমনিতে হাত খালি আর আজই উনি ওনার বোন, ভগ্নিপোতকে নেমন্তন্ন করেছেন আর হুকুম হয়েছে দু'রকম মাছ এবং মাংস আনতে হবে। আমি বলতে আমার ওপর প্রচন্ড ক্ষুব্ধ । পরিষ্কার বলে দিল আমার বোন আসবে বলে? মাসের শেষে কি তোমার বাড়ির লোক আসে না? আমার অবস্থা বুঝুন কাকে আমি আমার দুঃখের কথা বলবো। যাকে বলবো বলে ভাবলাম তিনিই শুরু করলেন সাতকাহন। আমি একটু এগিয়ে যাবার চেষ্টা করতেই তিনি থামালেন। বললেন শুনে যান মশাই শুনে যান। এমনিতেই গতকাল অফিসে একটা গন্ডগোল হয়েছে। কাজে একটা ভুলের জন্য বস আমায় বললেন যে, এইভাবে কাজে ভুল! না পারলে কাজ ছেড়ে দিন। অনেক লোক কাজের জন্য অপেক্ষা করে আছে। বুঝুন এই বয়সে এই ধরণের ধাক্কা, ভালো লাগে? এই যে আপনি বলছিলেন না ভাল নেই। তা হলে আমার অবস্থা ভাবুন। বলতে বলতে তিনি আমার সঙ্গেই এগুতে লাগলেন। আর আমার অবস্থা তখন ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি। আমার কথা আর কি বলবো, আমার মাথা তখন আরও ভারী হয়ে উঠেছে। সেদিন বাজার ঠিক মতো করতে পারলাম না আর ফিরতেও বেশ দেরী হয়ে গেল।
  সেদিন এক বন্ধুকে Phone করলাম। দু-একটা কথাবার্ত্তার পর বললাম, জানতো কয়েকদিন হলো আমার বড়দা মারা গিয়েছেন। বড়দাকে আমার বন্ধু বেশ তাঁর কে ভালই চিনতো এমন কি আলাপও ছিল। বললো, ও তাই নাকি, তারপর কি হয়েছিল, কতো বয়েসে মারা গেলেন সে সব কিছু জিজ্ঞাসা না করে শুরু করলো কে মারা গিয়েছে তার কথা, বেশকিছু দিন তার বৃদ্ধ শ্বশুরমশাই মারা গিয়েছেন। তার স্ত্রীর মনটা খুব খারাপ। অনেক চেষ্টা করা হয়েছিল কিন্তু কিছু করা গেল না। এ ছাড়া আর এক মামাতো ভাই অকালে এবং তার শালার স্ত্রীও মারা গিয়েছেন, তার ক্যানসার হয়েছিল ইত্যাদি। আমি চুপচাপ শুনছিলাম। আমার তো বলার নয় শোনার কথা। এইটাই এখন পদ্ধতি - দাদা হারিয়ে গেলেন। তারপর এক সময় বললো, আজ বড় তাড়া আছে তোমার সঙ্গে পরে কথা বলবো বলে ফোনটা ছেড়ে দিল। আমিই তাকে ফোন করেছিলাম।

এর পর একদিন আর একজন আমার পরিচিত মানুষের কাছ থেকে ফোন পেলাম যে আমায় জিজ্ঞাসা করলো আমার স্ত্রী কেমন আছে। আমার স্ত্রী COPD রোগে ভুগছেন। তার শরীর একদম ভালো নয়। লড়াই করে যাচ্ছে। তার কথা বলতে সবে শুরু করেছি তখন সে আরম্ভ করলো তার স্ত্রী আর মেয়ের কথা। স্ত্রী খুব অসুস্হ হয়েছিল। খুব দৌড়ঝাঁপ হয়েছে তাকে নিয়ে এখন একটু ভালো আছে। আর মেয়ের কানের একটা Problem নিয়ে কি কান্ড। ভাবতে পারবে না মেয়েটা কি কষ্ট পেয়েছে। মেয়ে বেশ বড় এবং তার বিয়ের চেষ্টা চলছে। এই সব বলতে বলতে সে কিন্তু আমার স্ত্রীর কথা একেবারেই ভুলে গেল। এমন কি আমি কেমন আছি সেটাও জিজ্ঞাসা করতে ভুলে গেল। কেন Phone করেছিলো ঠিক বুঝতে পারলাম না। কথা বলবো কাদের সঙ্গে। নিজের কথা বলাই যায় না শুধু শুনে যেতে হবে।

কিছু দিন আগে আমার ছোট ভাই মারা গেলো। আমার চেয়ে বয়েসে অনেক ছোটো। একেবারে কাউকে কিছু করতে দিল না। মিনিট দশেকের মধ্যে হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে মৃত্যু হলো। বিহ্বল বাড়ির লোক। এক ছেলে আর স্ত্রী। এ ছাড়া এক নাতী আছে। আমার মনও খুব খারাপ। ওকে চিনতো খুব ভালোভাবে এমন একজনকে ফোন করে খবরটা দিলাম। প্রথমেই সে বিস্ময় প্রকাশ করলো ঠিকই কিন্তু তারপরই তার দুইভাই কি ভাবে এমনি Heart attack এ মারা গিয়েছে সে কথা বলতে শুরু করলো। যদিও বিষয়টা পুরানো এবং আমার জানা। আবার পুনরায় সব শুনতে হলো। আমার ছোটভাই একেবারেই ঢাকা পড়ে গেল সেই পুরোন বেদনায়। আমি অসহায়, কেন Phone করতে গেলাম।

এই তো হলো অবস্থা। সাংসারিক জ্বালা যন্ত্রণা আমাদের আছেই। কার সঙ্গে Share করবো - একটু হালকা হবো উপায় নেই, কথা বললেই তার কথা শুনতে হবে কোন একটা ঘটনা নয় অনেক অনেক ঘটনা। শুনতে হবে, না হলে খারাপ হয়ে যাবো আমি। আমার ব্যথা আমার কষ্টটা, আমার যন্ত্রণা কে বুঝবে। আমার মতো যদি একজনকে পেতাম। কিন্তু এ সমাজ বড় নিষ্ঠুর কাউকে রেওয়াত করে না। তাই কাউকে পাওয়া যায় না। আর যদি বা মনে হলো পেলাম তা আমার মনে হওয়াই । বড়ো কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে আমাদের। আমরা সবাই একা। একদম একা, কথা বলারও লোক নেই। মনের কথা বলবো কি সই কইতে মানা, দরদী নইলে প্রাণ বাঁচে না। প্রাণ কি আমাদের সত্যি বেঁচে আছে?

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 

Post a Comment

0 Comments