জ্বলদর্চি

গওহরজান - এক বিস্মৃত অধ্যায় পর্ব - ১৪/দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

গওহরজান - এক বিস্মৃত অধ্যায় 
পর্ব - ১৪                                

দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী    

দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনে পরোক্ষভাবে গওহরজান নিজেকে জড়িয়ে ছিলেন। উনিশশো কুড়ি সালে কলকাতায় ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের 'স্বরাজ ফান্ড' নামে একটি তহবিলের জন্য অর্থ সংগ্রহ কালে গান্ধীজী গওহরজানের বিপুল জনপ্রিয়তার কথা ভেবে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন। গান্ধীজী গওহরকে অনুরোধ করেছিলেন অর্থ সাহায্যের জন্য এবং গওহর সানন্দে গান্ধীজিকে জানিয়েছিলেন তিনি দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অর্থ সাহায্যের জন্য প্রস্তুত। অর্থ সাহায্যের জন্য তিনি একটি সংগীতের অনুষ্ঠান করবেন এবং সেখানে প্রাপ্ত অর্থ সম্পূর্ণভাবে তিনি গান্ধীজীর তহবিলে দান করবেন, কিন্তু শর্ত একটাই যে অনুষ্ঠানে গান্ধীজিকে উপস্থিত থাকতে হবে। গওহরের পূর্ব শর্ত জানতে পেরে গান্ধীজী রাজি হয়ে জানালেন যে তিনি উপস্থিত থাকবেন। পরবর্তী সময়ে কিছু রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা থাকায় অনুষ্ঠানে গান্ধীজী নিজে উপস্থিত না থেকে তার প্রতিনিধি মৌলানা শওকত আলীকে তিনি পাঠিয়েছিলেন।

 সেই অনুষ্ঠানে দর্শকাসন কানায় কানায় পূর্ণ হয়েছিল এবং অনুষ্ঠান থেকে উদ্যোক্তারা ২৪ হাজার টাকা সংগ্রহ করেছিলেন। মৌলানা শওকত আলী যখন টাকা নিতে গেলেন, গওহর তখন তাঁকে অর্ধেক অর্থ অর্থাৎ বারো হাজার টাকা দিয়ে হেসে বলেছিলেন 'মৌলানা সাহেব, আপনার মহাত্মাকে বলুন সততা ও একনিষ্ঠতার কথা প্রচার করলেও তিনি নিজে কিন্তু সামান্য এক বাঈজীকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করে অনুষ্ঠানে উপস্থিত না থেকে আপনাকে পাঠিয়ে অর্ধেক প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছেন। পুরো অর্থ দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমিও অর্ধেক প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে প্রাপ্ত অর্থের অর্ধেক দিলাম'। গান্ধীজীর মতো ব্যক্তিত্বের কাছেও গওহর নিজের ব্যক্তিত্ব হারাননি। মৌলানা সেই অর্থ নিয়ে মৃদু হেসে চলে গিয়েছিলেন।              

গওহরজানের সম্বন্ধে লিখতে গেলে অবধারিতভাবে একটি রাজবাড়ির কথা উঠে আসে। সেই রাজবাড়িটি হলো পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদল রাজবাড়ী। এই রাজবাড়ীর সঙ্গে গওহরের পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সমীহের সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। বিভিন্ন সময়ে তিনি এখানে এসে অনুষ্ঠান করেছিলেন এবং যখনই আমন্ত্রণ পেতেন তিনি শত ব্যস্ততার মধ্যেও সেই অনুষ্ঠানে যোগ দিতেন, কখনোই প্রত্যাখ্যান করতেন না। প্রথম মহিষাদল রাজবাড়িতে এসেছিলেন মহারাজ কুমার দেব প্রসাদ গর্গের অন্নপ্রাশন অনুষ্ঠান উপলক্ষে। পরবর্তী সময়ে দেবপ্রসাদ হিন্দুস্তানী সংগীতের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন এবং নিজে উস্তাদ মুজাফফর খানের ছাত্র ছিলেন। এছাড়াও শিল্পী ও চিত্রকর ছিলেন। মহিষাদলের রাজাদের কলকাতাতেও বাসস্থান ছিল। পরবর্তীকালে দেবপ্রসাদ গর্গ যখন কলকাতায় যেতেন সেখানে গওহরের সাথে রাস্তাতে কোথাও দেখা হলে উভয় উভয়কে বিনম্র অভিবাদন জানাতেন। দেবপ্রসাদ গর্গ গওহরজানের পরিণত বয়সের একটি ছবি এঁকেছিলেন যেখানে দেখা যায় অবিন্যস্ত চুলের এক বয়স্কা মহিলা গোল চশমা পরে নিচের দিকে তাকিয়ে আছেন এবং ছবিটির নিচে গওহরজানের উর্দুতে স্বাক্ষর করা।

 ছবিটির নীচে সম্ভবতঃ দেবপ্রসাদ গর্গের নিজের হাতে ইংরেজিতে লেখা গওহরজানের নাম ও ছবিটির তারিখ দেওয়া ৩রা এপ্রিল, ১৯২৮। মনে করা হয় এই ছবিটি এঁকে রাজকুমার দেবপ্রসাদ গর্গ গওহরজানের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি জানিয়েছেন। মহিলাদলের রাজবাড়ি ও রাজকুমার দেবপ্রসাদ গর্গের প্রসঙ্গে উস্তাদ ফৈয়াজ খানের নাম এসে যায়। কলকাতায় ফৈয়াজ খানের যে কয়েকটি অনুষ্ঠান হয়েছিল তার প্রায় প্রতিটিই দেবপ্রসাদ গর্গের পৃষ্ঠপোষকতায় হয়েছিল। কিন্তু এই ফৈয়াজ খানের সঙ্গে গওহরজানের অম্লমধুর সম্পর্ক ছিল।                         

গওহরজান যখন সঙ্গীতের জগতে রাজহংসীর মত বিচরণ করেছিলেন সেই সময়ে উস্তাদ ফৈয়াজ খান পুরুষ শিল্পীদের মধ্যে সর্বোত্তম ছিলেন। কিন্তু তাঁর উন্নাসিকতা ছিল কলকাতায় কখনো অনুষ্ঠান করতেন না কারণ তিনি মনে করতেন কলকাতা যেহেতু বাঈজীদের অনুষ্ঠানের একটি ঈর্ষণীয় স্থান সেজন্য সেখানে তাঁর মত পুরুষ গায়কদের কোন স্থান নেই। কিন্তু মজার কথা এক বাঈজীর সাথেই ত্রিকোণ প্রেমে জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি এবং যার ফলে ত্রিকোণ প্রেমের অপর পুরুষ গায়কটির জীবন হতাশায় শেষ হয়ে গিয়েছিল। এই বাঈজীটি হলেন দিল্লির মলকাজান, যিনি অবশ্য ফৈয়াজ খানের থেকে বয়সে বড় ছিলেন। আবার মলকাজানকে অসম্ভব ভালোবাসতেন বেনারসের মউজুদ্দিন। কিন্তু ফৈয়াজ খানের প্রতি মলকাজানের অতিরিক্ত ঘনিষ্ঠতা দেখে মউজুদ্দিন হতাশায় অতিরিক্ত মদ্যপান করে তাঁর সঙ্গীত জীবনের অপূরণীয় ক্ষতি করেছিলেন।                           গওহরের সাথে ফৈয়াজ খানের তিক্ত সম্পর্কের সূত্রপাত হয়েছিল দিল্লির এক অনুষ্ঠানে। একবার দিল্লিতে এক সংগীত প্রতিযোগিতায় গওহরজান এবং মলকাজানের মধ্যে প্রতিদ্বন্দিতা হয়েছিল যদিও মলকাজান কিন্তু গওহরের অকৃত্রিম বন্ধু ছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে যখন মলকাজানের থেকে গওহরজানের গান সর্বাংশে দর্শকদের বাহবা পেয়েছিল তখন অযাচিতভাবে মলকাজানকে আড়াল করার জন্য উপস্থিত ফৈয়াজ খান এক অসাধারণ সঙ্গীত পরিবেশন করে গওহরজানের প্রতি দর্শকদের অভিনন্দনের মাত্রাকে নিজের প্রতি আকর্ষণ করেছিলেন। এর ফলে গওহরজান স্বভাবতঃই যথেষ্ট মণোক্ষুন্ন হয়েছিলেন কারণ প্রতিযোগিতা হয়েছিল মলকাজনের সাথে গওহরজানের। সেই মঞ্চে ফৈয়াজ খান অনধিকার প্রবেশ করে গওহরজানের সুনাম ক্ষুন্ন করেছিলেন।

 যাইহোক এই ঘটনার প্রায় দু'বছর পরে কলকাতার শ্যামলাল ক্ষেত্রীর বাড়িতে এক অনুষ্ঠানে ফৈয়াজ খান, মলকাজান, গওহরজান ছাড়াও আরো অনেক সঙ্গীত শিল্পী ও সঙ্গীতের পৃষ্ঠপোষকেরা এসেছিলেন। গওহরজান মনে মনে ভেবেছিলেন যে পূর্ব অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য এটাই সব থেকে উপযুক্ত মঞ্চ। গওহরজান যেন না চেনার ভান করে শ্যামলাল ক্ষেত্রীকে ফৈয়াজ খানের পরিচয় জিজ্ঞেস করেছিলেন। ফৈয়াজ খানের পরিচয় জানার পরে তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন গওহরের বাড়িতে যেয়ে গান গাওয়ার জন্য। এই কথা শুনে ফৈয়াজ খান ক্রুদ্ধ হয়ে বলেছিলেন বাঈজীদের মত তানপুরা সঙ্গে নিয়ে যেয়ে তিনি অনুষ্ঠান কোথাও করেন না। তাঁর কথা শোনার পরে গওহরজান এবং ফৈয়াজ খানের মধ্যে শালীনতা বজায় রেখে বাকবিতণ্ডা হয়েছিল এবং ফৈয়াজ খান ও তার প্রেমিকা মলকাজান অনুষ্ঠানস্থল থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। গওহরজান তাঁর সম্মান ও ব্যক্তিত্বে আঘাত পেলে কাউকে ছেড়ে কথা বলতেন না। এই জন্য তিনি জীবনে অনেক সময় মানসিক শান্তি হারিয়েছিলেন, কিন্তু এই ব্যাপারে তিনি ছিলেন অনমনীয়।  

গওহরজানের গানের গায়কী রীতি সম্পর্কে বিভিন্ন পণ্ডিত বিভিন্ন সমালোচনা করলেও গওহরের প্রতি শ্রেষ্ঠ শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিলেন পণ্ডিত বিষ্ণুনারায়ণ ভাতখন্ডে যিনি আধুনিক শাস্ত্রীয় সংগীতের একজন উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। আমার লেখা 'ভারতীয় সংগীতের ক্রমবিকাশে' তাঁর সম্বন্ধে উল্লেখ করেছি। কলকাতার এক অনুষ্ঠানে গওহরজানের গান শুনে তিনি মন্তব্য করেছিলেন 'সেই সময়কালে মহিলা ঠুমরী ও খেয়াল গায়িকাদের মধ্যে গওহরই সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন'। 
                                                              ক্রমশঃ…….

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments