জ্বলদর্চি

দশহরা /ভাস্করব্রত পতি

পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব - ২৪

দশহরা

ভাস্করব্রত পতি

“সেজোবৌ একখানা মাজা পিতলের সরায় করিয়া চিনিবাসের নিকট হইতে মুড়কি, সন্দেশ, বাতাসা দশহরা পূজার জন্য লইলেন“। এ কাহিনী অপু দুর্গার স্রষ্টা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের "আমি আঁটির ভেঁপু"তে মিলবে। সেসময় সামান্য এই ক'টা মিস্টির জন্য চিনিবাস ময়রার শরণাপন্ন হওয়া অপু দুর্গার উল্লাস আজ পড়তে পড়তে শিহরিত হয়ে উঠতে হয়। তেমনি এই কাহিনীতেই মিলবে - "কাল দশহরা, লোকে আজ হইতেই মুড়কি সন্দেশ কিনিয়া রাখিবে”। যদিও এখন 'দশহরা' উৎসবের চরিত্রে এহেন চাহিদার দেখা মেলেনা। জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লা দশমী তিথিই 'দশহরা'। আজ এই দশহরা পশ্চিমবঙ্গের একটি অন্যতম লৌকিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। কিন্তু কৃত্রিমতা আর আধুনিকতার মিশেল পরতে পরতে। এই দিনটি আবার বটুকভৈরবের আবির্ভাব তিথি হিসেবে পরিগণিত হয়ে থাকে।

সংস্কৃত শব্দ দশহরার অর্থ দশ দিন। অর্থাৎ তিথির দশম দিনই দশহরা।
দশ + অহ > দশারহ > দশহরা > দশেরা (হিন্দি ভাষী এলাকায় কথিত)
‘অহ’ অর্থে দিন। মূলতঃ অসুরদলনী দেবী দুর্গার মহিষাসুর বধকে কেন্দ্র করেই দশহরা বা দশেরা পালিত হয়। আশ্বিন মাসে মহালয়া থেকে দশম দিনকেই বলে 'দশেরা'। এটিই বাঙালীদের সুপরিচিত 'বিজয়া দশমী'। এদিন রাবণপোড়া হয় অনেক যায়গায়। কেননা, এদিনেই লঙ্কায় লঙ্কাপতি রাবণ পরাজিত হন রামের কাছে। লঙ্কাজয় করে উদ্ধার করেন জনক দুহিতা সীতাকে। রাবণের অপর নাম দশানন। সেই দশাননের 'হার' বা 'হরা'ই হল "দশহরা"।

জৈষ্ঠ্যমাসের এই দশহারাতেও মিলবে বিজয়া দশমীর অনুষঙ্গ। কিভাবে? দুর্গা যখন মহিষাসুর বধ করেন তখন সেই খবর পেয়ে যায় শুম্ভ এবং নিশুম্ভ নামের দুই দৈত্য। তখন তাঁরা মহিষাসুর বধের প্রতিশোধ নিতে বিন্ধ্যাচলে হাজির হয়। সেখানে যুদ্ধ চলে দেবী দুর্গা তথা বিন্ধ্যাচলের অধিষ্ঠাত্রী দেবী বিন্ধ্যবাসিনীর সাথে। পুরাণ  মতে এই দেবী বিন্ধ্যবাসিনী আসলে দুর্গার অন্য এক রূপ। মহিষাসুর বধের পর দুর্গার মহাশক্তি থেকে বিন্ধ্যাচল পর্বতেই উদয় হন দেবী বিন্ধ্যবাসিনী।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্যনীয় বিষয় যে, অরণ্যষষ্ঠীতে তথা জামাইষষ্ঠীর দিনে পূজিত হন এই দেবী বিন্ধ্যবাসিনী। এরপর ঠিক দশমীর দিনেই দেবী বিন্ধ্যবাসিনী বধ করেন দুর্গাসুরকে। এ মত স্কন্দপুরাণের। স্বাভাবিকভাবে এই জৈষ্ঠ্য মাসের শুক্লা দশমীতে দশহরার গুরুত্বটাই অন্যরকম। 

আবার এই দিনেই শুরু হয় মনসা পূজা। মনসার স্নানযাত্রা আয়োজিত হয়। এরপর পুরো বর্ষাকাল জুড়ে চলে মনসা পূজা। যে পূজার প্রসাদ হিসেবে দেওয়া হয় খই, নাড়ু ইত্যাদি। মনসাপূজা উপলক্ষে মনসামঙ্গলের পালাগান হবেই। যেহেতু বর্ষাকাল আগতপ্রায়, তাই সাপের উৎপাত হয়ই। তাই সর্পদেবীর আরাধনা শুরু হয় দশহরাতেই। 

সাপের হাত থেকে বাঁচতে সর্পদেবীকেই আশ্রয় করেন ভক্তরা। বহু বাড়িতে এদিন পালিত হয় পঞ্চমী ব্রত। যা চলে শ্রাবণ সংক্রান্তি পর্যন্ত। লোকসমাজে বিশ্বাস যে, এই বিশেষ দিনে দশ ধরনের মেঘের সভা বসে। মেঘের তথা বজ্রপাতের ভয়ঙ্কর শব্দে সাপের ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। মেদিনীপুরের বহু গ্রামে দশহরার দিন সকালে মনসা তলায় বা তুলসীমঞ্চের সামনে গোবর নিকোনো উঠোনে মনসার ডাল বা সিজ গাছ পুঁতে পূজা করা হয় মনসা দেবীর। দুধ, কলা ও বাতাসা দিয়ে আরাধনা করা হয় এখানে। পূজোর পরে ঐ মনসা গাছ পুকুরে বিসর্জন দেওয়ার রীতি লক্ষ্য করা যায়। নানা 'মনসামঙ্গল' কাব্যেও আছে দশহরা এবং মনসা পূজার প্রসঙ্গ। বিপ্রদাসের 'মনসাবিজয়'তে পাই -- "নানা কুতূহলে, বঞ্চয়ে সকলে, জ্যৈষ্ঠ মাস পরবেশ। / দশমী দশহরা, তিথি যোগ তারা, শুভক্ষণ সবিশেষ"। আবার তন্ত্রবিভূতির 'মনসাপুরানে' পাই -- "জ্যৈষ্ঠ মাসে দশহরা অম্বুবাচী দিনে। / মনসা পঞ্চমী লোকে করিবে পূজনে"।

দশহরাতে গঙ্গাপূজাও হয়। আর এই দিনেই গঙ্গাস্নান করলে মেলে যাবতীয় পাপস্খলনের পুণ্য। এ বিশ্বাস লোকসমাজে প্রচলিত। তবে বাঙালিদের কাছে গঙ্গা অর্থে 'জল' বোঝায়। তাই এইদিনে পুণ্যের কামনায় মানুষজন ভোরে নদীতে স্নান করে ডুব দিয়ে। দশহরাতে গঙ্গাস্নানের তাৎপর্যের পেছনেও পৌরাণিক কাহিনীর খোঁজ মেলে। এই দিনেই ভগীরথ গঙ্গাকে মর্ত্যে আনয়ন করেছিলেন দেবাদিদেবের জটা থেকে। এই গঙ্গাই তাই হয়ে উঠেছে যাবতীয় নদী তথা জলাশয়ের প্রতিনিধি। তাই সেই জলে ডুব দিয়ে মেলে পাপ থেকে রেহাই। দশহরা তাই গঙ্গাপূজার সাথেও সম্পৃক্ত।

দশহরার দিনে গঙ্গায় স্নান করে গঙ্গাকে দশ ধরনের ফুল, দশ ধরনের ফল এবং দশখানা প্রদীপ জ্বালিয়ে পুজো করলে মানবজাতির দশ ধরনের পাপ থেকে মুক্তি লাভ হবে। স্কন্দপুরাণ সেকথাই বলে। করমচা, আম, কাঁঠাল, কচার ফল, জাম, খেজুর, কাঁঠাল, পেয়ারা, লেবু, কেলে খোঁড়া -- এই দশ ধরনের ফল দেওয়া হয় উপচারে। যদিও এখন এসব নিয়মের বদলে যেকোনও দশ ধরনের ফল পূজা দেওয়া হয়। তবে প্রতিটি ফল যেন রসালো হয়। এদিন ভাত রান্না করেননা অনেকেই। সম্পূর্ণ নিরামিষ ভোজন করতে হয়। 

দশহরা তিথিতে পূর্বের দশজন্মের যাবতীয় পাপের পাশাপাশি এ জন্মের দশ ধরনের পাপ স্খলন করে। কি কি সেই পাপ? মূলতঃ তিন প্রকৃতির পাপকাজ রয়েছে। পরচর্চা পরনিন্দা, মিথ্যা বলা, ভুলভাল বাক্য প্রয়োগ এবং কথায় অহংকার প্রকাশ হল চার ধরনের বাক্যগত পাপ। অন্যের ক্ষতিসাধন করার ভাবনা, পরের জিনিস নিজের করে নেওয়ার ভাবনা এবং মিথ্যার প্রতি ভালোবাসা হল তিন ধরনের মানসিক পাপ। পরকীয়া প্রেম, পরের সামগ্রী চুরি এবং অহেতুক প্রাণী হত্যা হল আরো তিন ধরনের দৈহিক পাপ।

দশহরা উৎসবে দু ধরনের রীতি চালু আছে। একটি নিরামিষ প্রসাদ এবং অন্যটি আমিষ প্রসাদ খাওয়া। কোথাও কোথাও ফলাহার হিসেবে চিঁড়ে, দই, আম, কাঁঠাল, চিনি, মুড়কি, কলা, দুধ বা ক্ষীর একসাথে মেখে খাওয়ার নিরামিষ রীতি পালিত হয়। আবার কোথাও গঙ্গাপুজোতে দেওয়া পাঁঠাবলির মাংস খাওয়ার রীতি অনুসৃত হয়। বর্ধমানের বৈঁচিগ্রামে প্রথমে গঙ্গাপুজোর সাথে সাথে গ্রামদেবী চণ্ডীর পুজো আয়োজিত হয়। দুই পূজোতেই বলি হয়। এখানে ঐ বলির মাংস খাওয়ার মাধ্যমেই দশহরা উৎসব পালিত হয়। স্বয়ং কথাসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘বাবু' তে এই গঙ্গাপুজায় পাঁঠাবলির মাংস খাবার রীতি উল্লেখ করেছেন তৎকালীন ‘বাবু কালচার’-এর রীতি হিসেবে। তবে বেশিরভাগ যায়গায় দশহরাতে নিরামিষ খাওয়ার চল দেখা যায়। আমিষ চলবেই না। মাংস বা ডিম মোটেও নয়। তবে মাছ খায় অনেকেই।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 

Post a Comment

0 Comments