পদ্মপাতায় শিমুল-২৬
সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়
জয়-জয়ন্তী, কলকাতা!
ডিভোর্সের পর আমি আরও একটু চুপচাপ হয়ে গেলাম। কোথাও যেতে চাইতাম না। বাড়ি থেকে বেরোতে চাইতাম না। পড়াশুনো করে আর ঠাকুর পুজো করে দিন কাটাতাম। ফ্ল্যাটের সবাই নিজেদের মেয়েদের আমার উদাহরণ দিত। ভেতরের খবর দিদিয়া কাউকে বলে নি। বলেছে এইভাবে, “ওর বর আমেরিকায় আছে-গ্রীন কার্ড পেলেই নিয়ে যাবে। আমরাও তো সবাই যাব আমেরিকায়।” মেয়েগুলো এসে আমাকে আবার বলত সেসব কথা। এভাবেই দিন কাটে। বাইরের দুনিয়া সম্পর্কে একটা আতঙ্ক বাসা বাঁধে মনে। বাইরের কোনও পুরুষমানুষকেই সহ্য করতে পারতাম না। অচেনা পুরুষের সামনে কেমন অস্বাভাবিক আচরণ করে ফেলতাম।
--অস্বাভাবিক বলতে ?
--মানে কেউ কিছু প্রশ্ন করলে উত্তর দিতে পারতাম না। চুপচাপ থাকতাম। মাথা নিচু করে থাকতাম, যেন শুনতে পাই নি এভাব দেখাতাম।
যখনই কেউ আমাকে আবার বিয়ের কথা বলত তখনই অসুস্থ হয়ে পড়তাম। আরও কবছর পেরিয়ে যাবার পর বিয়ের কথা বললে করুণ চাউনিতে উত্তর দিতাম, "আমি যাতে না বাঁচি সেটাই কি চাস তোরা? মা বাবা থাকলে এই ঘা খাওয়া মেয়েকে আবার বিয়ে দিতেন?”
চাঁদের ওপরে ভাসতে থাকা হাল্কা মেঘের স্রোতটা এখন আর নেই। কাঁচের জানলা দিয়ে উজ্জ্বল হলুদ আলো এসে আট তলার ঘরের আলোগুলোকেও যেন ম্রিয়মাণ করে ফেলল।
মেঘ ছোঁয়া পাখি নীড়ে ফিরে এলো। কোথায় যেন নামলো এক ঝড়ের তান্ডব-
বৌদির বান্ধবী ডাঃ প্রমিলা কাথারানি ছিলেন গাইনোকোলজিস্ট। তাঁর সাথে আড়ালে আলোচনা করা হল। উনি আমার কাছ থেকে সব জানতে চাইলেন। লুকোতে বারণ করলেন। তিনিই বললেন যে, “সে ইম্পোর্টেড না হলে শুধু শুধু একটা মেয়ের জীবন নিয়ে এইভাবে খেলা করত না। এটা একধরণের রোগ। এই রোগে খুন করতেও পেছপা হয় না মানুষ। " শুনে পাগল হয়ে গেলাম আমি।
ঠাকুর বিশ্বাসী আমি রাত দিন ঠাকুরের সামনে বসে একটাই প্রশ্ন করতাম, “কেন? কেন আমাকে সব দিক থেকে বঞ্চিত করলে ঠাকুর? কেন আমাকে মিথ্যা বদনাম দিল? কেন আমি মিথ্যে অপবাদ নিয়ে ঘুরে বেড়াব? আমি কি কিছু অন্যায় করেছি ঠাকুর? তুমি তো অন্তর্যামী-চুপ করে থেকো না জবাব দাও ঠাকুর। ঘন ঘন ছুটে গেছি বেলুড় মঠে আমার গুরুদেবের কাছে। খালি ভাবতাম এই ডিভোর্স এক ভয়ানক ক্ষতি করে মানুষের-”
“এক ভালে মানুষ-কো অমানুষ বনাকে ছোড়া...”
উত্তর পেলাম যেন নিজের মনের থেকেই। হ্যাঁ, হ্যাঁ গাইনোকোলজিস্ট জানাতে পারবে এর সমাধান। বাবার বয়সী বড় জামাইবাবু-ছোট জামাইবাবু-বড় জামাইবাবুর ডাক্তার জামাই হিমান্তর মাথার পোকা নাড়িয়ে দিয়ে প্রশ্নের পর প্রশ্ন... বিজ্ঞানের উত্তরগুলো ওর থেকে পেয়ে গেলেও, আরও বড় প্রশ্নগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠল।
সমাজ? আচ্ছা সমাজ তো কোনও স্থবির বস্তু নয়। আমার সমাজ তো আমিই তৈরি করেছি...তৈরি করে চলেছি প্রতিদিন...প্রতিনিয়ত।
যে সমাজ সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে সে আমার বা আমার জীবনে এগিয়ে যাবার পথে বাধা হতেই পারে না। প্রত্যয় জন্মালো ধীরে ধীরে। বাইরের লোকের চেয়ে বেশী আঙুল উঁচু করবে বাড়ির আত্মীয় স্বজন। পরিবার?
আমার বামপন্থী প্রগতিশীল চিন্তার আত্মীয় স্বজন, যারা বিয়ে হবার পর শুধু ওঁত পেতে থাকত। কারণ বৌদিদের ভাই-এরা, ও দিদির দেওয়েরা বিয়ে করতে পারল না। মা-বাবা মরা মেয়ে দাদা-দিদিদের কাছে মানুষ। কি করে তারা আজকের এই দিনে এমন মেয়ে তৈরী করল। ভালো কে ভালো থাকতে দিতে কি কেউ চায়? তাও তাদের কেও সব বলে বোঝাল দাদারা, দিদিয়া-বৌদিরা।
সারাজীবন পচাগলা নিয়মগুলোকে বর্জন করে এগোতেই দেখেছি যাদের। তাদেরও নিলাম আমার দলে... একা তো কিছু বদলানো যায় না। সঙ্গের মানুষগুলোকেও যে নিজের মতো করে গড়েপিটে নিতে হয়। ডিভোর্স পর্যন্ত আশা করে নি সে। তাই সে কিছুতেই রাজী নয়। হার মেনে নেয়ার নাম জীবন না, বুঝলে মশাই। লড়াই করে বেঁচে থাকার নাম জীবন, এটাকেই ধ্রুব সত্য মেনে নিলাম। এইরকম অহরহ লড়াই আমরা মেয়েরা করেই যাচ্ছি। কেউ আড়ালে আর কেউ জনসমক্ষে।
সত্যি কথাটা বলে ফেললে কিন্তু আগে রসিকতা করছে এই মেয়েরাই। এরাই আড়ালে আবডালে টক, নুন, ঝাল এর নকশি কাঁথা বুনে চলে। ওরাই আঙুল তুলছে সেই প্রত্যাক্ষাত মেয়েটির দিকে। ওরা পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুক না কেন।
ডিভোর্স হয়ে গেল একতরফা। কারণ, হিমান্ত কোর্টে হাজিরা দিতে নারাজ। তাকে এসকর্ট করে নিয়ে আসা হয়েছিল। অফিসে ছুটি নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিল-কিন্তু পুলিশি সমনে তাকে কোর্টে হাজির হতেই হল। ভেবেছিল বড্ড বোকা মেয়ে, সবটাতেই 'হ্যাঁ' করে দেবে আর পেয়ে যাবে এক দিস্তা ডলার। কিন্তু হাইকোর্টের ডায়াসে উঠে সেই মেয়ে তখন আগুনের ফুলকি। তারিখ, সময়, দিন নির্ভুল বলে চলেছে। বাড়ির লোকের সাথে আইনজিবীরাও অবাক। এত সাহস পেল কোথা থেকে। তখন আমি “ না জানি বেদন, না জানি রোদন...”।
আমার প্রিয় কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র -এর কথায় বলতে ইচ্ছে হয় “মানুষের মরণ আমাকে বড় আঘাত করে না, করে মনুষ্যত্বের মরণ দেখলে।” একদম ঠিক। সেই নিদারুণ দিনগুলোর কথা আজও যাতায়াত করে রাতে ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন হয়ে। কারুর আত্মহত্যা শুনলেই মনে পড়ে আমার সেই দিনগুলো। কেন কেন আত্মহত্যা করে এরা? নিজের জীবন কি এতই ফেলনা?
কি ভাবে সেই দিনগুলো কাটিয়েছি ভেবে আজও শিউরে উঠি কোনও কোনও বিজন বেলায়। প্রায় একা লড়াই করে সে দিনগুলোকে কী ভাবে যে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়েছিলাম, ভেবে অবাকও হই। আমার ধারণা, যারা ছোট বেলায় আহ্লাদে মানুষ হয়, তারাই বেশী কষ্ট পায়।
অবাক হলেও, জীবনের নতুন অর্থ খুঁজে পাওয়ার জন্য ধন্যবাদ জানাই আমার প্রিয়তম ঈশ্বরকে। সেই শেষ।
দুজনে উলটো মুখে দুদিকে সরে গেলাম। ছাড়াছাড়ির আইনি ব্যবস্থা। পাকাও হয়ে গেল বিচ্ছেদ। তারপর থেকে আজ পর্য্যন্ত আর কোনো খবর রাখিনি। জানিও না সে কোথায়। জানার আর আগ্রহও নেই। তাহলে বোঝো আমাকেও জীবনে যা সহ্য করতে হয়েছে তা ফেলে দেবার মতন নয়...
বেশ কিছু টাকা খরচ করে ফেলল দাদারা। আর সেই কারণে তাড়াতাড়ি ডিভোর্সটাও হয়ে গেল। কে জানে তখন যদি জোর করে বাড়ির বড়রা আমাদের ডিভোর্স না করাতো...আর পাঁচটা অসহায় মেয়ের মত আমাকেও অকালে চলে যেতে হত একদিন। তাই তো বলে সবাই।
তারপর থেকেই আমাকে আর হারতে হয়নি কোনো কিছুর কাছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে করুণ করে হাসল শিমুল একটু।
--ছেড়ে দাও এবার। চলো একটু ফ্রেশ হাওয়া নিয়ে নাও। পৃথিবীতে দুই ধরণের মানুষ বাস করে, শিমুল। মানুষ আর অ-মানুষ। এই অ-মানুষগুলো ক্ষতি করছে সমাজের। দুঃখের কথা শুনতেও বেশি ভাল লাগে না। পলাশ এইবার উঠে পড়ল।
ওরা উঠে ফ্রেশ হয়ে রাতের ডিনার খেয়ে পেছনের ব্যালকনিতে গিয়ে বসল। ঘুরতে শুরু হল শিমুলের কথা বলার চাকা...
খালি ভাবতাম, আমায় দেখে সবাই কী ভাবছে? আত্মগ্লানিতে ভুগতে শুরু করলাম। কোথাও যেতে চাইতাম না। বাড়ি থেকে বেরোতে চাইতাম না। সেজদা কাজ করে কাশিপুরে তখন, সেখানকার লাইব্রেরী থেকে সব ঠাকুরের বই পড়ে শেষ করলাম। আমার ছোরদা, যাকে 'বটি' বলে ডাকতাম। সে তখন বার্নপুরে কাজ করে, সেখানকার লাইব্রেরীর ঠাকুরের -দেবতার সব বই পড়ে ফেললাম।
--আচ্ছা শিমুল ? ওকে বটি বলে ডাকতে কেন? পলাশ চালাকি করে কথা ঘুরিয়ে দিল।
--ওহ! হাসি মুখে বলে উঠল শিমুল। আসলে ওর নাম মন্টু। বড়রা মটি বলে ডাকত। আমি মটি বলতে পারতাম না ছোট্টবেলায়, তাই 'বটি' বলে ডাকতাম।
বড় মজার মনের মানুষ এই বটি। আমেরিকার ব্যাটন রুজে আসার পর যখন ওর সাথে কোথাও যেতাম, সবাই তো এক সাথে থাকতাম। ও আর দিদিয়া সামনের সিটে আর আমি, বটির বৌ নিনা আর দেড় বছরের ভাইপো পাপাই পেছনের সিটে। সাঁ সাঁ করে গাড়ি চলেছে আর বটি এক এক করে গাড়িগুলোর নাম বলে চলেছে। ডজ, লেক্সাস, ফোর্ড, হন্ডা, মার্সিডিজ। আর আমি অবাক হয়ে ভাবতাম, কি করে নাম বলে দিচ্ছে। কৌতূহল বশত একদিন জিজ্ঞেস করে ফেললাম, “ কি করে নামগুলো বলছিস রে?”
-- 'বলব নি। বলব নি, ঝাউগ্রাম থেকে আউচি বাব্বা!'...হা হা করে হেসে ফেলল পলাশ।
বোনের চোখে জল দেখলেই তার চোখেও জল এসে যেত। এভাবেই দিন কাটে। বাইরের দুনিয়া সম্পর্কে একটা আতঙ্ক বাসা বাঁধে মনে। বাইরের কোনও পুরুষ মানুষকে দেখলেই মনে হত 'এরা ভালো না। ওরা বড্ড চালাক।'
--শিমুল। আর নাঃ চলো। পরে আবার না হয় হবে...বেশি বললে মন গরম হবে। আবার শুনব না হয়। তোমার খুব ভাগ্য আর তোমার ঠাকুর, মা বাবার আশীর্বাদ এ তুমি রক্ষা পেয়ে গেছো।
উফ কি যে হত কে জানে? আমিও তোমাকে পেতাম না আমার করে। মানুষ সব হারায়, শুধু নিজেরই লোভে-ক্রোধে, হিংসায় আর সন্দেহের বশে। গলাটা বেশ ধরে গেল পলাশের।
সে তো বেশ কিছু বছর আগের কথা। পরে আবার বিয়ের কথা বললেই কাঁদতাম খুব। আসলে ওই বয়সে সরল বিশ্বাসে এমন আঘাত পেয়েছিলাম যে সেই দগদগে ঘা-টা মেলিগ্ন্যান্ট-এ পরিণত হয়েছিল। আজ ভাবি সত্যি পড়াশুনা করেছি ঠিক-কিন্তু অন্য ব্যপারে অপরিপক্ক ছিলাম।
অনেক ভাল ভাল সম্বন্ধও এসেছিল। 'তবুটুকুর' পাঁচিল ডিঙোতে কতবার যে হোঁচট খেয়েছি, তার ইয়ত্তা নেই। ধাক্কা মেরে মেরে, ধাক্কা মেরে মেরে, এক জীবন থেকে তাকে অন্য জীবনে প্রবেশ করানো যে কী কঠিন কাজ ছিল, তা একমাত্র যারা ভুক্তভোগী তারাই জানে। ওই তবুরই এক ক্ষীণ ভগ্নাংশ কি এখনও রয়ে গেছে আমার হৃদয়ে? আত্মগ্লানি হয়ে? অসন্তোষের রূপ ধরে যা ঠিকরে বেরোয় আজও মাঝে মধ্যে?
কিন্তু বাড়ির বড়রা আর আমার অমতে যান নি। তারা জানতেন গহন অরণ্যে বারবার একা যাওয়া ভালো না...তুমি তো জানো, ছোট ছোট ভাইপো ভাইঝিরা আমার প্রাণ। তাদের নিয়েই একটা নিজের সুখী জগতে বাস করতাম। বিয়ের কথা বলা হত না, তা বলব না। কথায় আছে না, 'মা-এর চেয়ে মাসীর দরদ।' ঠিক তেমনি হয়েছিল আমার অবস্থা। কিচ্ছু বলতাম না।
ন'দাদা জয়-জয়ন্তীর বাড়িতে জানালো আমাকে ব্যস্ত রাখার জন্য। তাই পড়ে নিলাম স্প্যানীশ(রামকৃষ্ণ মিশন ইন্সটিটিউট অফ কালচার) এ, সেলাই , রান্না, গীটার, ? হোমিওপ্যাথিক সিস্টার নিবেদিতা কলেজে- বাড়ি থেকেই। খালি পরীক্ষা দিতে যেতে হয়েছিল। সেকেন্ড ডিভিশনে পাশ করলাম। বাড়ির সবাই সাথে না থাকলে কি যে হত, কে জানে? আটলান্টিক সাগরের অন্তরীক্ষে নিজেকে আজ বন্ধনমুক্ত ও সরল সত্যবাদী মনে হয় অকস্মাৎ...
(চলবে)
0 Comments