জ্বলদর্চি

গওহরজান - এক বিস্মৃত অধ্যায় /পর্ব - ১৩ /দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

গওহরজান - এক বিস্মৃত অধ্যায় 

পর্ব - ১৩                                

দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী    

১৯১১ সালের এগারোই জুন সম্রাট পঞ্চম জর্জ ইংল্যান্ডের রাজা হওয়ার পরেই স্থির করলেন ব্রিটিশ উপনিবেশ গুলি সফর করবেন এবং সফরের অঙ্গ হিসেবে ব্রিটিশের বৃহত্তম উপনিবেশ অবিভক্ত ভারতবর্ষে আসবেন। সেই উপলক্ষে ১২ই ডিসেম্বর দিল্লিতে একটি বিশেষ রাজকীয় দরবারের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। অবশ্য পঞ্চম জর্জ ইতিপূর্বে ১৯০৫ সালে ভারত বর্ষ সফর করেছিলেন 'প্রিন্স অব ওয়েলস' হিসেবে। ১৮৭৫ সালে দিল্লিতে মহারানী ভিক্টোরিয়ার রাজ্যাভিষেকের স্মরণে এক রাজকীয় দরবার হয়েছিল। ১৯১১ সালে গভর্নরের অফিস থেকে গওহরজানকে এই রাজকীয় দরবারে সঙ্গীত পরিবেশনার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। দিল্লি দরবারের ঐতিহাসিক মঞ্চে ৮০০০০ হাজার দর্শকের উপস্থিতিতে গওহরজান ও এলাহাবাদের জানকী বাঈয়ের যুগ্ম সঙ্গীত "ইয়ে জলসা তাজপোশি, মুবারক হো, মুবারক হো" অর্থাৎ রাজাকে শুভ অভিষেকের জন্য অভিবাদন - সম্রাট পঞ্চম জর্জ, রানী মেরী ও রাজ পরিবারের সদস্যসহ ৮০ হাজার দর্শকের অকুণ্ঠ প্রশংসা পেয়েছিল। সেই অনুষ্ঠানে সম্রাট খুশি হয়ে দুজন গায়িকাকেই একশোটি করে সোনার গিনি উপহার দিয়েছিলেন। সবচেয়ে বড় কথা যে অনুষ্ঠানে ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লীতে স্থানান্তরিত করার ঘোষণা করা হয়েছিল সেই অনুষ্ঠানে কলকাতার কলা, শিল্প ও সঙ্গীতকে সম্মানিত করা হয়েছিল গওহরজানকে সম্মানিত করে। 

ব্রিটিশ সরকারের প্রতিনিধি তাঁকে দেশের সেরা গায়িকার সম্মান দিলেও দেশের নীতিবাগীশ সমাজের ব্যাক্তিত্বেরা তাঁর এই সম্মানের বিরোধিতা করে বলেছিলেন একজন বাঈজীকে সেরা সেলিব্রিটির মর্যাদা দেওয়ায় দেশের নৈতিক অধঃপতন ত্বরান্বিত হবে। কিন্তু নীতিবাগীশ সমাজের ব্যাক্তিত্বেরা যতই বিরোধিতা করুন না কেন এই সময়ের কয়েক মাস পূর্বে এলাহাবাদে যুক্তরাজ্য গুলি একটি তিন মাসের দীর্ঘ প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলেন যেখানে শিল্প ও কলা, কৃষিজাত দ্রব্য, শিল্পের উপকরণ এবং বিনোদন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা ছিল। এই অনুষ্ঠানে গওহরজানকে সেরা শিল্পী হিসেবে নির্বাচিত করে সোনার মেডেল দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। বিভিন্ন সংবাদপত্র এই খবরে ব্যাপক সমালোচনা করে বলেছিলেন একজন বাঈজীকে এই সম্মান প্রদান করলে সমাজের নৈতিক অধঃপতন ত্বরান্বিত করা হবে। কিন্তু সমস্ত সমালোচনাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে পূর্ব নির্ধারিত দিনে গওহরজানের অনুষ্ঠানে যে পরিমান দর্শক এসেছিলেন তা এককথায় অভূতপূর্ব। উচ্চমূল্যের টিকিট তিন চার গুণ বেশি অর্থ দিয়ে কিনে অগণিত শ্রোতা অনুষ্ঠানে প্রবেশ করেছিলেন। বহুলোক টিকিটের অভাবে অনুষ্ঠান দেখতে পাননি এবং অনুষ্ঠানে ভীড় নিয়ন্ত্রণের ও শান্তি রক্ষার জন্য পুলিশ ডাকতে হয়েছিল। উদ্যোক্তারা আশাতীতভাবে এক দিনে যে পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন তাতে সমগ্র প্রদর্শনী শেষ করেও তারা প্রভূত লাভ করেছিলেন। সমালোচনা সত্বেও গওহরের জনপ্রিয়তা যে প্রশ্নাতীত ছিল সেই অনুষ্ঠানে তা প্রমানিত হয়েছিল। 

গওহরের জনপ্রিয়তা এরপরে দক্ষিণ ভারতে ছড়িয়ে পড়েছিল। মাদ্রাজের ভিক্টোরিয়া পাবলিক হলে গওহরের অনুষ্ঠানে কর্ণাটকী সংগীতের বহু দিকপাল উপস্থিত ছিলেন। কর্ণাটকী সংগীতের পথপ্রদর্শক বলে যাঁকে বলা হয় সেই আরিয়াকুড়ি রামানুজ আয়েঙ্গার গওহরজানের কাছে শ্রীকৃষ্ণের ভজন গুলি যেমন 'রাধে কৃষ্ণ বোল মুখসে'এবং 'কৃষ্ণ মুরারি বিনত করত' শেখার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন।   

গওহরজান শেষ জীবনে মহীশূরে যাবার আগে রামপুরে যেয়ে যে অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়েছিলেন লর্ড আরউইনেসর অনুষ্ঠানে সে কথা পূর্বে উল্লেখ করেছি। কিন্তু রামপুরের নবাব হামিদ আলির সাথে তার পরিচয় যে কিরকম অপ্রত্যাশিতভাবে ঘটেছিল সে কথা এখানে উল্লেখ করছি।                                          

একদিন গওহরজান কয়েকজন বন্ধুর সাথে কলকাতার একটি বিখ্যাত সুগন্ধি দ্রব্যের দোকানে যখন সুগন্ধি দ্রব্য কিনছিলেন সেই সময় দেখলেন একজন সুদর্শন ও অভিজাত  যুবক রাস্তা দিয়ে হেটে যাচ্ছেন। সুপুরুষ ব্যক্তিকে দেখার লোভ সামলাতে পারেননি গওহর, অপরদিকে যুবকটিও গওহরের অসামান্য রূপ দেখে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখছিলেন। সেইদিন সন্ধ্যায় একজন পত্রবাহকের মারফত একটি চিঠি পেয়ে গওহরজান জানতে পারলেন রামপুরের নবাব হামিদ আলি বর্তমানে কলকাতাতে আছেন এবং তিনি গ ওহরজানের সাথে দেখা করতে চান একটি ঠিকানায় যেখানে নবাব বর্তমানে আছেন। রামপুরের নবাবের নাম শুনে গওহর খুব উৎফুল্লিত হয়ে উঠলেন কারন রামপুর রাজ্য তখন ভারতবর্ষের একটি উল্লেখযোগ্য সংগীতের পীঠস্থান।  রামপুর রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নবাব হামিদ আলির ঊর্ধ্বতন ষষ্ঠতন পুরুষ ফয়জুল্লাহ খান। এই বংশের পঞ্চম নবাব ইউসুফ আলি খানের রাজত্বকালে রামপুর হিন্দুস্তানী সংগীতচর্চার একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। সিপাহী বিদ্রোহের পরবর্তী সময়ে দিল্লি ও আউধের অনেক শিল্পী রামপুরে চলে আসেন এবং বিভিন্ন শিল্পীর গায়কীর সংমিশ্রণে এখানে একটি নূতন ঘরানার সৃষ্টি হয় যা 'রামপুর সহস ওয়ান' নামে পরিচিতি লাভ করে। রামপুরের বিখ্যাত বীণা বাদকেরা ধ্রুপদী শৈলীতে বাজিয়ে এই ঘরানাকে জনপ্রিয় করে তোলেন। নবাব হামিদ আলি খানের রাজত্বকালকে রামপুরের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজত্বকাল বলা হয়ে থাকে সংগীতের উৎকর্ষতার দিক দিয়ে। তাঁর সময়ে সঙ্গীত, সাহিত্য এবং স্থাপত্যবিদ্যা এখানে উৎকর্ষ লাভ করে। বিভিন্ন উস্তাদ যেমন ভাইয়া গণপতরাও, ইনায়েদ হুসেন খান, ওয়াজির খান প্রভৃতিরা ছাড়াও বহু শিল্পী রামপুর রাজ্যের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। পণ্ডিত বিষ্ণুনারায়ণ ভাতখন্ডের লেখা 'ক্রমিক পুস্তক মালিকা' এবং 'হিন্দুস্তানি সংগীত পদ্ধতি' বইগুলিতে রামপুরের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ আছে। এই দুটি বই লেখার সময় পন্ডিত ভাতখন্ডে নবাব হামিদ আলির নিমন্ত্রনে বেশ কিছুদিন রামপুরে থেকে নবাবের রাজসভার উস্তাদদের কাছ থেকে বহু তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন।                   

সেই সন্ধ্যায় গওহরজান যখন রামপুরের নবাবের নিমন্ত্রনে নৈশভোজে গেলেন সেখানে নবাব গওহরজানের সংগীতের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ দেখিয়ে তাঁকে রামপুরে যাবার প্রস্তাব দেন। নবাবের সঙ্গীত প্রীতির সংবাদ গওহর পূর্বের থেকে জানতেন এবং তিনি সানন্দে নবাবের প্রস্তাবে সম্মতি জানান। এরপর থেকে গওহরজান বহুবার রামপুরে গিয়েছিলেন এবং তাঁর জন্য বিশেষ ব্যবস্থাতে নবাবের রাজপরিবারের মহিলা সদস্যদের সাথে একত্রে জেনানা মহলে থাকার ব্যবস্থা করতেন নবাব। প্রতিবারই তিনি রামপুরে উষ্ণ অভ্যর্থনা পেতেন। ১৯১২ সালে নবাবের প্রয়াত বেগমের স্মৃতিতে গওহর একটি বিরাট মেহফিলের আয়োজন করেছিলেন যে অনুষ্ঠানে তিনি ছাড়াও বেনারসের রাজেশ্বরী বাঈ, আগ্রার জোহরা বাঈয়ের মতো শিল্পীরা আমন্ত্রিত হয়ে যে অনুষ্ঠান পরিবেশন করেছিলেন তা সকলের অকুণ্ঠ প্রশংসা আদায় করেছিল। গওহরের প্রতি নবাবের শ্রদ্ধা ও ভালবাসার নিদর্শন স্বরূপ নবাব তাঁকে বলেছিলেন রামপুর রাজদরবার গওহরের জন্য সর্বদাই উন্মুক্ত থাকবে এবং রামপুরকে তিনি যেন নিজের বাড়ী মনে করে আসেন। রামপুরে থাকাকালীন উস্তাদ নাজির খানের কাছে গওহর প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। নিজের গায়ন শৈলীতে রামপুর ঘরানার বৈশিষ্ট্যের সংমিশ্রণ করে গওহর নিজের সংগীত শিক্ষাকে আরো প্রসারিত ও বর্ণময় করে তুলেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে রামপুরের নবাবের সাথে একটি অন্য ঘটনায় মনোমালিন্য হয়েছিল এবং যার জন্য তিনি রামপুর চিরদিনের মতো ত্যাগ করেছিলেন। সেই ঘটনা পূর্বে উল্লেখ করেছি।
                                                              ক্রমশঃ…….

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments